#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১০
সন্ধ্যার খানিক পরে রুমে বসে ফেসবুকিং করছিলাম। হঠাৎ তাজ ভাই রুমে এলেন। আমি ওনাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে ফোনে মগ্ন রইলাম। উনি বিছানায় এক পা তুলে আমার সামনে বসলেন। আমি ফোন থেকে চোখ তুলে ওনার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন করলেন,“কী করছিস?”
আমি বললাম,“নাচছি। কেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”
উনি আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“চল ওঠ।”
আমি প্রশ্ন করলাম,“কেন?”
“ছাদে যাব।”
“তো যান। আমি কী করব?”
“তুইও যাবি।”
“আমি কখন যাব বললাম?”
“তুই বলিসনি, আমি বলেছি। কারণ তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট।”
আমি বিরক্ত মুখে বললাম,“সবসময় এক কথা বলবেন না তো। আমি যাব না।”
“তোকে তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমি বলেছি তাই তুই যাবি।”
“বললাম না যাব না? আমার এখন ইচ্ছে করছে না। আপনার আরেকজন দরকার হলে আফরা আপুকে নিয়ে যান।”
কথাটা বলে নিজেই নিজেকে মনে মনে বকতে লাগলাম। কেন যে সবসময় এক লাইন বাড়িয়ে বলতে যাই আর বিপদে পড়ি। এখন যদি আবার চুড়ি চায়? আবার তো বলেছে সে বললেও যেন না খুলি। লোকটা আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। উনি আমার বাঁ হাতের কব্জি ধরে টেনে বিছানা থেকে নামাতেই আমি চোখ-মুখ কুঁচকে শব্দ করে উঠলাম,“আউচ।”
ওনার হাতের মুঠো থেকে আমি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। উনি ভ্রুকুটি করে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিঁলে যাওয়া অংশটুকু দেখে সেখানে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন,“ছিঁলে গেল কীভাবে?”
আমি ওনার হাতের ওপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে এনে রাগত কন্ঠে বললাম,“আপনি জেনে কী করবেন?”
উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম নিজে আমার হাতের এই অবস্থা করেছে ভেবেই হয়তো চলে গেছে। আমি আবার বিছানায় উঠে ফোন নিয়ে বসলাম। তখনই আবার তাজ ভাই রুমে এলেন। ওনার হাতে ফার্স্ট এইড বক্স। উনি আমার সামনে বসে আমার বাঁ হাতটা টেনে নিলেন। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,“ছাড়ুন, দরকার নেই এসবের।”
উনি আমার কথায় কানই দিলেন না। চুপচাপ হাতের ছিঁলে যাওয়া অংশটুকু স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলেন। কিছু সময়ের জন্য আমি নীরব দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাবা ছাড়া আমার এত যত্ন নেয়ার আর কেউ নেই। ওনার মুখে অনুশোচনা স্পষ্ট। হয়তো বেখেয়ালে আমার হাতের এই অবস্থা করায় ওনার এখন খারাপ লাগছে, কিন্তু মুখে প্রকাশ করছেন না। অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষ করে উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা আটকাতে আটকাতে প্রশ্ন করলেন,“একবারও অয়েন্টমেন্ট লাগাসনি?”
আমি ডানে বায়ে মাথা দোলালাম। উনি আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,“এত কেয়ারলেস কেন তুই? অকর্মা মেয়ে! আমি না লাগিয়ে দিলে তো নিজে আর লাগাতিও না।”
আমি থমথমে মুখে বললাম,“ডেভিল হাসবেন্ডদের মতো নিজে ব্যথা দিয়ে এখন দরদ দেখাতে এসেছে।”
উনি সুযোগ পেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,“তো তুই কি আমাকে হাসবেন্ড ভাবছিস না-কি?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম,“তা কখন বললাম?”
“বুঝি বুঝি, আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিস। এমন হ্যান্ডসাম একটা ছেলে চোখের সামনে থাকলে এমন হবারই কথা।”
“আপনাকে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না আমি। স্বপ্ন তো বাদই দিলাম। যেই না চেহারা।”
কথাটা বলে মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালাম। তারপর দুজনেই চুপচাপ। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেও বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন ওনার দিকে তাকাতেও অস্বস্তি লাগছে। তাই বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। উনি পেছন থেকে আমার ডান হাতটা ধরে আটকে দিলেন। আমি ওনার দিকে না তাকিয়েই বললাম,“হাত ধরলেন কেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। আমি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললাম,“ছাড়ুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
তবুও উনার উত্তর নেই। আমি এবার বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“কী হয়েছে আপনার? স্ট্যাচু হয়ে গেছেন?”
উনি বলে উঠলেন,“নেহালকে এখনও মনে পড়ে তোর?”
আমি একটু বেশিই অবাক হলাম। এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের কারণ খুঁজে পেলাম না। আমি অবাক হয়েই বললাম,“এখন এমন প্রশ্ন করার মানে কী?”
উনি আমার হাতটা ধরেই দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“চল, ছাদে যাব।”
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলেন না। ছাদের সিঁড়ি অবধি যেতেই সামনে পড়ল আফরা আপু। সে আমাদের দেখে প্রথমে খুশি হলেও পরে আমাদের হাতের দিকে তাকাতেই মুখটা কালো করে ফেলল। আমি আরও অস্বস্তিতে পড়লাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু শয়তানটা ছাড়ল না। আপু গোমড়া মুখে বলল,“ছাদে যাচ্ছিস?”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“হ্যাঁ আপু, তুমি যাবে?”
কথাটা আমি সুযোগ বুঝেই বললাম। আফরা আপু সাথে থাকলে শয়তানটা আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবে না। আপু তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“এভাবে হাত ধরে রেখেছেন, ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন না-কি ভাইয়া?”
তাজ ভাই বললেন,“ঘাড়ত্যাড়া হলে কী আর করব বল? ছাদে একা যেতে ইচ্ছে করছে না বলে ওকে ডাকলাম কিন্তু ও বেয়াদবের মতো না করে দিলো। সবাই তো আর তোর মতো ভদ্রতা জানে না। এ হচ্ছে উন্নতমানের ঘাড়ত্যাড়া।”
আফরা আপু মনে হচ্ছে একটু খুশি হয়েছে। তাজ ভাইয়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে তার মুখে হাসি ফুটেছে। আমি রাগত দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আফরা আপু গলে গিয়ে বলল,“ও যেতে চাইছিল না যেহেতু, তো আপনি আমাকে ডাকতেন।”
আমি বলে উঠলাম,“আপু, তাহলে তো ভালোই হয়েছে তুমি সামনে পড়েছো। তুমিই বরং তাজ ভাইয়ের সাথে ছাদে যাও, আমি যাব না। গরমে আমার মাথা ঘুরছে।”
আফরা আপু উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,“আচ্ছা, তুই যা।”
তাজ ভাই আমার হাত টেনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললেন,“ছাদে ফুরফুরে বাতাস আছে। ভালো লাগবে।”
ব্যাস, আমাকে জোর করে ছাদে নিয়ে গেলেন। ছাদে উঠে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আফরা আপুও আমাদের পেছন পেছন এসেছে। ছাদের একপাশে ফ্লোরে একটা পাটি বিছানো আছে। আমি গাল ফুলিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। তাজ ভাই আফরা আপুকে বললেন,“আফরা, এই মাথামোটাকে তো একটু ভদ্রতা শেখাতে পারিস। তোর ছোটো বোন তো। বড়োদের সম্মানটুকুও দিতে জানে না।”
আফরা আপু অবাক হয়ে বলল,“কী বলছেন ভাইয়া? ইলো তো সবাইকে কত সম্মান করে।”
“তাহলে আমার সাথে কী শত্রুতা?”
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,“নিজে সারাক্ষণ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে এখন আমার দোষ দিচ্ছেন? শয়তানের ফুপাতো ভাই।”
উনি বললেন,“একদম ঠিক বলেছিস। এতদিনে সত্যি কথাটা বুঝতে পেরেছিস। আমি তোর মতো আস্ত একটা শয়তানের ফুপাতো ভাই।”
আফরা আপু ফিক করে হেসে উঠল। আমি কটমট করে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আফরা আপু ওনার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে লাগল। প্রথমে একটু গম্ভীর গলায় বলল,“ভাইয়া, আপনি না-কি এ বছরই আবার সুইডেন ফিরে যাবেন?”
তাজ ভাই বললেন,“হ্যাঁ।”
“এসেছেন যখন দেশেই থেকে যান না।”
“দেশে থেকে কী করব? আমার ভাইয়া-ভাবি তো সুইডেন।”
“দেশে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করুন। তাহলে আর যেতে ইচ্ছে করবে না।”
কথাটা আফরা আপু খুব মিষ্টি কন্ঠে বলল। ইচ্ছে না থাকলেও আমি এবার তাজ ভাইয়ের কথা শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। অন্য দিকে তাকিয়েই কান খাড়া করে রাখলাম। তাজ ভাই মৃদু হেসে বললেন,“সুইডেনে এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে দেশে বিয়ে করব কেন?”
“দেশের কোনো মেয়েকে পছন্দ হয় না আপনার?”
আমি এবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনিও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন। ওনার হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না আমি। আফরা আপু হতাশ চাহনিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার জন্য আমার মায়া হলো। সে এই লোকটাকে আসলেই খুব পছন্দ করে। শয়তানটা বুঝেও না বুঝার ভান করছে। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“বিয়ে করলে আফরা আপুর মতো মেয়েকে করবেন বুঝলেন? আপুর মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন।”
আফরা আপু লাজুক হাসল। মনে মনে হয়তো খুশিতে আমাকে কয়েকটা চুমুও খেলো। তাজ ভাই একটু ভেবে বললেন,“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। দেখি আফরার মতো মেয়ে খুঁজে পাই কি না।”
আফরা আপু গদগদ কন্ঠে বলল,“একটু ভালোভাবে খুঁজলে আশেপাশেই পেয়ে যাবেন ভাইয়া।”
এবারও তাজ ভাই হাসলেন। উনি যে কোনোভাবেই আফরা আপুকে পাত্তা দিচ্ছেন না সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। আফরা আপু এসে আমার পাশে বসল। আমি তার সাথে গল্প করতে লাগলাম। তাজ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে তাতে ডুবে গেলেন। এশার আজান শুনে তাজ ভাই আমাদের ডেকে নিয়ে ছাদ থেকে চলে এলেন। উনি বাবার সাথে মসজিদে চলে গেলেন। আমিও আমার রুমে গিয়ে নামাজ পড়লাম। তারপর আফরা আপু আমার রুমে এসে বলল,“ইলো রে, প্লিজ তাজ ভাইকে একটু বুঝা না আমি ওনাকে কত পছন্দ করি।”
আমি বললাম,“বলেছিলাম তো আপু। উনি তো আমার কথা শুনছেনই না। আমার মনে হয় তোমারই বলা উচিত। হয়তোবা উনি চাইছেন তুমি নিজে ওনাকে প্রপোজ করো।”
আফরা আপু মন খারাপ করে বলল,“কিন্তু আমার তো সাহসই হয় না। ওনাকে দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। অন্য কোনো উপায় বের কর না।”
আমি একটু ভেবে বললাম,“এক কাজ করতে পারো। তুমি না ওনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করো। একবার না পারলে বারবার করবে। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।”
আফরা আপু লাফিয়ে উঠে বলল,“এটা ভালো বলেছিস। কী কী করব বল তো?”
“সেসব কাল থেকে ঠিক করব।”
“আচ্ছা। কাজ হলে তোকে আমি অবশ্যই ট্রিট দিবো দেখিস।”
আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। তবে মনে মনে ভাবলাম,“আপাতত এই তাজ নামক শয়তানটাকে আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে নাও তাতেই হবে।”
রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। আমি আর আফরা আপু সেদিকে দৌড় লাগালাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অলিকে নিয়ে রুমে চলে এলাম। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে নামাজ পড়ে আবার আম্মুর কবরস্থানের পাশে গেলাম। ইচ্ছে হলো একটু গ্রামের নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার। করলামও তাই। আশপাশটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। অনেকটা পথ চলে এসেছি। ভাবলাম এবার ফিরে যাওয়া যাক। সূর্য ভালোভাবেই উঠে গেছে। গ্রামের রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। কত লোক ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। আবার কেউ গরু নিয়ে মাঠে ছুটছে। আশেপাশের একটা মক্তব থেকে বাচ্চাদের কুরআন তেলাওয়াতের মধুর সুর ভেসে আসছে। গ্রামের সকালটার জবাব নেই। প্রশংসা করলেও বোধ হয় তা কম হয়ে যাবে। আমি উল্টো দিক ফিরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কয়েক পা এগোতেই একটা দৃশ্য দেখে আমি থেমে গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তার পাশের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে তাজ ভাই আর একটা লোক। লোকটাকে চিনতে আমার ভুল হলো না। কয়েকদিন আগে যেদিন মাঝরাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে তাজ ভাই বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন উনি এই লোকটার সাথেই চেঁচামেচি করেছিলেন। কিন্তু এই লোকটা এখানে কী করছে? আশ্চর্য! মনের ভেতর খটকা লাগল। গ্রামে আসার দিনই আমার মনে হয়েছিল উনি কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটাবেন। এখন আমি একদম নিশ্চিত যে কিছু একটা ঘটবে। লোকটার মাথায় কী চলছে আল্লাহ্ জানে। জিজ্ঞেস করলে তো জীবনেও বলবে না। মনে মনে আমার ভয়ও লাগছে। খারাপ কিছু যেন না হয়। আমার ভাবনার মাঝেই তাজ ভাই আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি চমকে ওনার দিকে তাকালাম। উনি দোকান থেকে বের হয়ে আমার কাছে এলেন। আমি নিজেকে নিজে বকতে লাগলাম। কী দরকার ছিল এখানে আহাম্মককের মতো দাঁড়িয়ে থাকার? উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,“এখানে কী করছিস তুই?”
আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম,“আমি হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসে পড়েছি। এখন বাড়ি ফিরছি।”
তারপর আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম,“ওই লোকটার ওপর না আপনি সেদিন রাতে চেঁচামেচি করলেন? উনি এখানে কী করছে?”
তাজ ভাই বললেন,“ও বেড়াতে এসেছে। আমি জানতাম না এই গ্রামে ওর আত্মীয় আছে। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।”
আমি বললাম,“ও। উনি কে? মানে সেদিন আপনার রাগ দেখে তো ভেবেছিলাম লোকটা হয়তো আপনার কোনো শত্রু হবে।”
উনি হেসে বললেন,“না। ও আমার এক ফ্রেন্ড।”
“তাহলে সেদিন ওমন ব্যবহার করলেন কেন?”
তাজ ভাই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন,“ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়েছে। তুই বাড়ি যা, আমি আসছি।”
উনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছেন না বুঝতে পেরে মাথা দুলিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। বাড়ি ফিরে ব্রেকফাস্ট করলাম। তারপর অলির সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলাম। বাবা আর মেজো কাকা বাইরে কোথায় যেন গিয়েছে। ছোটো কাকা গোডাউনে গেছে মাল ভর্তি ট্রাক এসেছে তা দেখতে। মেজো কাকি আর ছোটো কাকি নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আফরা আপু আর দাদুমনি বসে বসে আমার আর অলির দুষ্টুমি দেখছে আর হাসছে। তাজ ভাইয়ের ডাকে দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। তাকাতেই আরেকদফা অবাক হলাম। তাজ ভাইয়ের সাথে তারই বয়সী একটা ছেলে। পরনে কালো জিন্স আর লাল শার্ট। তাজ ভাইয়ের থেকে ছেলেটা কিছুটা কম ফর্সা। তবে চেহারার গঠন দেখলে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে। ছেলেটার হাতে লাগেজ। তাজ ভাই ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। তারপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্যে করে হাসিমুখে দাদিকে দেখিয়ে বললেন,“এই হচ্ছে আমার নানুমনি।”
ছেলেটা নিচু হয়ে দাদুমনিকে সালাম করে বলল,“কেমন আছেন নানু?”
দাদুমনি হেসে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ভাই?”
ছেলেটা উত্তর দিলো,“ভালো আছি।”
অলি আর আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারাও আমার মতোই অবাক হয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই আপু ইশারায় প্রশ্ন করল,“এ আবার কে?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইশারায় বুঝালাম আমিও চিনি না। তাজ ভাই মেজো কাকি আর ছোটো কাকিকে ডাকল। ডাক শুনে তারা দুজনেই এল। তাজ ভাই কাকিদের সাথে ছেলেটার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এতে বুঝতে পারলাম আমি, অলি আর আফরা আপু ছাড়া সবাই চেনে ছেলেটাকে। ছোটো কাকি ছুটলেন নাস্তা রেডি করতে। তাজ ভাই এবার আফরা আপুকে দেখিয়ে বললেন,“এ হচ্ছে আমার মেজো মামার মেয়ে আফরা।”
ছেলেটা হাসিমুখে আফরা আপুর সাথে কুশল বিনিময় করল। তারপর অলির সাথেও পরিচিত হলো। আমি ভাবছি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আর আমার দিকে তো ফিরেও তাকাচ্ছে না। অবশেষে তাজ ভাই আমাকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বললেন,“এনাকে কি চিনিয়ে দিতে হবে না-কি আন্দাজ করে বুঝতে পারছিস?”
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। এমনভাবে বলছে যেন ছেলেটা আমাকে আরও আগে থেকেই চেনে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,“ইলোরা, রাইট?”
আমি এবার বেশ অবাক হলাম। আসলেই তো ছেলেটা আমাকে চেনে। কিন্তু কীভাবে? আমি তো একে জীবনেও দেখিনি। তাজ ভাই বললেন,“রাইট। কিন্তু ও তোকে চেনে না তাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।”
ছেলেটা হাসল। আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি কোথায়? আমি সত্যিই ওনাকে চিনি না।”
তাজ ভাই ছেলেটাকে বললেন,“শ্রেয়ান, পরিচয়টা তুই দিবি না আমি দিবো।”
আমি এবার বড়োসড় ঝটকা খেলাম। চোখ গোল গোল করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একপ্রকার উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলাম,“আপনি শ্রেয়ান ভাইয়া?”
শ্রেয়ান ভাইয়া হাসিমুখে উপর নিচে মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ।”
“সত্যি?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“ভাইয়া আপনি জানেন? আপনাকে দেখার কত ইচ্ছে ছিল আমার। হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“তাহলে তো এমন সারপ্রাইজের জন্য তাজ একটা থ্যাংকস পাওনা তোমার থেকে।”
তাজ ভাই বললেন,“একদম ঠিক।”
আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলাম। তারপর আবার শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,“ভাইয়া, আপনার না আরও দুদিন পর চট্টগ্রাম থেকে ফেরার কথা ছিল?”
“হ্যাঁ। আসলে ওখানে যে কাজে গিয়েছিলাম তা হয়ে গেছে তাই গতকাল রাতেই ঢাকা ফিরেছি। তাজ বলল গ্রামে চলে আসতে তাই চলে এলাম। একদম ভোরবেলা রওনা দিয়েছিলাম। আমি কিন্তু জানতাম না যে তুমি আমাকে দেখলে এমন সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। তবে তাজ তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই আমার আসার কথাটা জানায়নি।”
আমি হেসে আফরা আপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে এখনও প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,“আপু, এ হচ্ছে তাজ ভাইয়ের স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড।”
এতক্ষণে আফরা আপু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে হাসল। মেজো কাকি শ্রেয়ান ভাইয়া আর তাজ ভাইকে বসতে বলল। তারা বসল। ছোটো কাকি ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। ওনারা দুজন খেতে শুরু করল। ইতোমধ্যেই আমি আর আফরা আপু শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছি। আমি ভাবতেও পারিনি উনি এতটা ফ্রি মাইন্ডেড। কী সুন্দর ফ্রেন্ডলি কথা বলেন সবার সাথে! এই এত সুন্দর একটা ছেলে কি না তাজ ভাইয়ের মতো এমন একটা বিপজ্জনক ছেলের বন্ধু! আমার তো বিশ্বাসই করতে ইচ্ছে করছে না।
চলবে………………..🍁
#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১১
কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে। এই প্রতিভাটা সবার মধ্যে থাকে না। খুব মিশুক মানুষরাই এটা খুব সহজে করতে পারে। শ্রেয়ান ভাইয়া এমনই একজন মানুষ। এসে হতে সে আমাদের সবার সাথে এত এত গল্প করেছে যে তার বায়োডাটাও মুখস্থ হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই তাকে একদম আপন করে নিয়েছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া বাইরে গেলেন। অলি যেতে চাইলেও তারা কেউ সাথে নিতে রাজি হলেন না। উল্টো অলিকে বুঝাল কাল ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। তারাও তো ঘুরতেই যাচ্ছে। অলিকে সাথে নিলে কী ক্ষতি হত? আফরা আপু, অলি আর আমি বাড়ির উঠানে পাটি বিছিয়ে পেয়ারা খাচ্ছি আর গল্প করছি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল সকালের কথা। তাজ ভাইয়ের ঐ বন্ধুও গ্রামে বেড়াতে এসেছে আবার এখন শ্রেয়ান ভাইয়াও। কেন জানি এই ব্যাপারটা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে। তবু ব্যাপরটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। আফরা আপু হঠাৎ বলল,“এই ইলো, শ্রেয়ান ভাইয়া দেখতে কেমন রে?”
আমি বললাম,“কেন? আমি কি ওনাকে একা দেখেছি না-কি? তুমিও তো দেখলে।”
“আরে তোর কাছে কেমন লাগে?”
“অবশ্যই ভালো লাগে। ওয়েট, এখন এটা বলো না যে শ্রেয়ান ভাইয়াকেও তোমার পছন্দ হয়েছে।”
আফরা আপু শব্দ করে হেসে বলল,“আরে না। আমার জন্য তো তাজ ভাইয়া আছেই। আমি ভাবছি শ্রেয়ান ভাইয়াকে তোর সাথে খুব মানাবে।”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“কী বলতে চাইছো?”
আফরা আপু হেসে বলল,“শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে প্রেম কর। ”
“পাগল হয়েছ? দরকার নেই আমার।”
“আরে ভেবে দেখ না। উনি কিন্তু তাজ ভাইয়ার থেকে কম যায় না।”
আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়ার অতীত সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না বলেই এসব বলছো।”
আফরা আপু প্রশ্ন করল,“কিসের অতীত?”
“পরে বলব। এখন বলো তাজ ভাইকে ইমপ্রেস করার ব্যাপারে কী ভাবলে?”
“তেমন কিছু না। আমার মাথায় কিছু আসছে না। তুই ঠিক কর না।”
আমি মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর আফরা আপুর সাথে এ বিষয়ে কিছু সময় আলোচনা করলাম। তখনই আমাদের পাশ দিয়ে বাবা হেঁটে যেতে যেতে বলল,“আফরাকে এবার ধরে বেঁধে আমাদের বাসায় নিয়ে যেও আম্মা। সারা দিন-রাত এমন আড্ডা দিতে পারবে।”
আফরা আপু হেসে বলল,“ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে না কাকা। আমি নিজেই যাব।”
আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। যে মেয়েকে জোর করেও আমাদের বাসায় নিতে পারলাম না সে কি না এখন নিজের ইচ্ছেয় যাবে! কারণটা অবশ্যই তাজ ভাই। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম,“বাবা, পেয়ারা খাবে?”
বাবা বাড়ি থেকে বের হতে হতেই উত্তর দিলো,“না আম্মা। তোমরা খাও।”
আফরা আপু আর আমি মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ঢুকলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া বাড়ি ফিরল এশার পরে। প্রতিবার গ্রামে এসে রাতের বেলায় গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে খুব ভালো লাগে আমার। সাথে বাবাও থাকে। আমি গিয়ে বাবাকে বললাম,“ও বাবা, চলো না ঘুরে আসি।”
বাবা সোফায় হেলান দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বলল,“এখন আমার শরীরটা ভালো লাগছে না আম্মা। কাল সকালে নিয়ে যাব।”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আমার তো এখন যেতে ইচ্ছে করছে।”
পাশ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,“চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,“সত্যি?”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বলল,“হ্যাঁ। যাও রেডি হয়ে এসো।”
বাবা বলল,“যাবে যাও, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
আমি ঘাড় কাত করে আফরা আপু আর অলিকে নিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। রেডি হয়ে এসে দেখলাম তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াও রেডি। আমি তাজ ভাইকে প্রশ্ন করলাম,“আপনিও যাবেন?”
তাজ ভাই বললেন,“আমার অত শখ নেই তোদের সাথে ঘুরঘুর করার। শ্রেয়ান বলেছে বলেই যাচ্ছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“হ্যাঁ, ওকে ছাড়া যাব না-কি?”
আমার ঘোরার যে বারোটা বাজতে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। এই শয়তানটা থাকতে আবার আমাকে শান্তি দিবে! বড়োদের বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তাজ ভাই গাড়ি নিতে চাইলেও আমি রাজি হলাম না। আমি বললাম রিকশা নিয়ে ঘুরব। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে কিছুদূর হেঁটে এসে আমরা দুইটা রিকশা নিলাম। আমি, আফরা আপু আর অলি একটা রিকশায় উঠলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া আরেকটায় উঠল। জোৎস্না রাত হওয়ায় আমি মুগ্ধ হয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। একটা বড়ো মাঠের পাশে এসে আমরা রিকশা থামালাম। কারণ সেখানে অনেক মানুষের ভিড় আর অনেক দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। আফরা আপু বলল,“আজ মনে হয় এখানে মেলা বসেছে।”
আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। সাধারণত আমি যখন গ্রামে আসি তখন মেলা হয় না। তাই একটু বেশিই খুশি হলাম। আমি ভেতরে যেতে চাইলাম। তাজ ভাই এবার আর আপত্তি করলেন না। আমরা সবাই মেলার ভেতরে গেলাম। মাঠের একপাশে সব খাবারের দোকান আরেকপাশে বিভিন্ন রকমের দোকান। গ্রামের মানুষজন একেকটা দোকানে ভিড় করে আছে। আমরা প্রথমে খাবারের দোকানের দিকে গেলাম। আমি আগেই বলে উঠলাম,“ফুসকা খাব।”
তাজ ভাই চোখ পাকিয়ে বললেন,“এসব বাজে খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার কোনো দরকার নেই।”
আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“আপনি তো আর খাবেন না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে তো খাব। আপনার কী?”
উনি আবার বললেন,“বললাম না দরকার নেই।”
আফরা আপু গোমড়া মুখে বলল,“এমন করছেন কেন ভাইয়া? কিছু হবে না। খাই না?”
তাজ ভাই একইভাবে বলল,“না, বাইরের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত না।”
আমি গাল ফুলিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে বললেন,“আরে তাজ, না করিস না তো। কিচ্ছু হবে না। কারণ ওদের তো এসব খাওয়ার অভ্যাস আছে।”
তাজ ভাই বলল,“হ্যাঁ, তুই তো ওদের সাপোর্ট করবিই। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুইও মেয়েদের মতো এসব পেটপুরে খাস।”
শ্রেয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,“দোস্ত, তুই জাস্ট একবার খেয়ে দেখ। তারপর তুইও আমার মতো হয়ে যাবি।”
আমি খুশি হয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, ওনাকে বাদ দিন। চলুন আমরা খাই।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বলল,“ওকে চলো।”
তাজ ভাই আর আমাদের বাঁধা দিতে পারলেন না। মনে মনে আমি প্রচন্ড খুশি হলাম। আমরা ফুসকার দোকানে গেলাম। একটা লোক কাঁচে ঘেরা ভ্যান গাড়িতে ফুসকা বিক্রি করছেন। গাড়ির পাশেই কয়েকটা প্লাস্টিকের টুল। সেখানে বসেই সবাই ফুসকা খায়। আমরা গিয়ে টুলে বসে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া চার প্লেট ফুসকা অর্ডার করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুসকা ওয়ালা আমাদের সবার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিলেন। আমরা খেতে শুরু করলাম। তাজ ভাই একটা টুলে বসে ফোন চাপছেন। আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, ফুসকাটা দারুণ না?”
শ্রেয়ান ভাইয়া ফুসকা মুখে পুরে হেসে উপর নিচে মাথা দোলালেন। আফরা আপু তাজ ভাইকে বলল,“ভাইয়া, একটা খেয়ে দেখুন না? অনেক মজা।”
তাজ ভাই আপুর কথায় পাত্তাই দিলেন না। ভাব দেখলে ইচ্ছে করে পঁচা পানিতে চুবিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে। অলি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“ও ভাইয়া, তুমি না বোকা। এত মজার খাবার কেউ না খায়!”
আমি বললাম,“অলি, সবার মুখে ভালো খাবার রোচে না, বুঝলি?”
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,“চুপচাপ খা। এগুলো ভালো খাবার? আসল ভালো খাবার তো খেতে ইচ্ছে করে না। এসব আজেবাজে খাবারই ভালো মনে হয়। বেয়াদব।”
আমি গাল ফুলিয়ে চুপচাপ ফুসকা শেষ করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের সবার বিল মিটিয়ে দিলেন। ফুসকার দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা মাঠের অন্যপাশে গেলাম। ঘুরে ঘুরে একেকটা দোকান দেখতে লাগলাম। আফরা আপু ইতোমধ্যে বিভিন্ন রকম কসমেটিকস কেনা শুরু করে দিয়েছে। সাথে অলিকেও কিনে দিচ্ছে। তাজ ভাই অলিকে কিছু খেলনা কিনে দিলো। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,“ইলোরা, তুমি তো কিছুই কিনলে না। বলো কী পছন্দ হয়, আমি কিনে দিচ্ছি।”
আমি হেসে বললাম,“না ভাইয়া, আমার কিছু লাগবে না। এমনিতেই আমি তেমন সাজগোজ করি না। কিছু কিনলে তা অযথা পড়ে থাকে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমার বারণ না শুনে আমাকে খুব সুন্দর এক মুঠো কাঁচের চুড়ি কিনে দিলেন। আমি আর নাও করতে পারলাম না। দোকানে চোখ বুলাতে বুলাতে এক জোড়া কানের দুল আমার চোখ কেড়ে নিল। দুল দুটো একটু বেশিই সুন্দর। আমি সেগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখলাম। দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন,“নিবেন না-কি আপা?”
আমি হেসে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,“না মামা।”
“নেন না। আপনারে খুব মানাইব।”
“লাগবে না মামা।”
আফরা আপু বলল,“নে না। তোকে খুব মানাবে। আমি অলরেডি দুই জোড়া কিনে ফেলেছি, নইলে আমিই নিতাম।”
আমি বললাম,“না আপু। বাসায় যা আছে তাই তো পড়ে থাকে। অযথা কিনে ফেলে রাখব কী করতে?”
আরও কিছুক্ষণ আশেপাশের দোকান ঘোরাঘুরি করার পর অলি হঠাৎ তাজ ভাইয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,“ভাইয়া, আমি নাগরদোলায় চড়ব।”
তাজ ভাই বললেন,“না অলি, এখন আমাদের বাসায় ফিরতে হবে। রাত এগারোটা বেজে গেছে।”
অলির মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা মেলা থেকে বেরিয়ে এলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে, আফরা আপুকে আর অলিকে হাওয়াই মিঠাই কিনে দিলেন। তাজ ভাইয়া দুইটা রিকশা দাঁড় করালেন। আমি একটা রিকশায় ওঠার সাথে সাথে তাজ ভাইও উঠে আমার পাশে বসে পড়লেন। আমি আর আফরা আপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তাজ ভাই এমন ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি। শ্রেয়ান ভাইয়া অন্য রিকশায় বসে বলল,“আফরা, তুমি অলিকে নিয়ে এটায় চলে এসো।”
আফরা আপু অলিকে নিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে অন্য রিকশায় উঠল। রিকশা চলতে শুরু করতেই আমি তাজ ভাইকে বললাম,“আপনি এটায় উঠলেন কেন?”
উনি বললেন,“আমার ইচ্ছে। তোর কোনো সমস্যা?”
“আপনি ঐ রিকশায় যান।”
“এখন রিকশা থামাব না।”
আমি কয়েকবার বলার পরও উনি একই কথা বললেন। আমি রিকশা ওয়ালাকে রিকশা থামানোর কথা বললেও উনি থামাতে দিলেন না। আমি গাল ফুলিয়ে রিকশার সিট আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম। সমস্যা হচ্ছে রিকশায় সচরাচর চড়া হয় না বলে আমি কখনও রিকশায় উঠলে পাশের জনের হাত ধরে রাখি। আমার শুধু মনে হয় এখনই বুঝি রিকশা থেকে পড়ে যাব। মনে মনে ভাবলাম এই লোকের সাথে গাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া যাবে না। হঠাৎ ডান হাতের বাহুতে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকালাম। দেখলাম তাজ ভাই আমাকে তার হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন। আমি হালকা নড়েচড়ে উঠতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“কী সমস্যা?”
আমি নিচু স্বরে বললাম,“হাত সরান।”
উনি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“তোর কী মনে হয়? আমি শখ করে তোকে ধরে রেখেছি? নিজেই তো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলি।”
আমি আমার বাঁ হাত দিয়ে ওনার হাত ঠেলে বললাম,“আমি ঠিক আছি। ছাড়ুন।”
উনি আমার বাঁ হাতের বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন,“একদম চুপ থাকবি। বকবক ছাড়া থাকতে পারিস না? বাঁচাল মেয়ে!”
আমি ওনার ওপর রাগ করতে পারলাম না। ওনার বুকের কাছে ঠেকে থাকায় আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। বারবার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। নেহালের পাশে বসেও আমি অনেকবার গল্প করেছি। কিন্তু তাতে যথেষ্ট দূরত্ব ছিল। এই প্রথম আমি কোনো ছেলের এতটা কাছে বসেছি। আমার কিছুটা অস্বস্তিও লাগছে। সারাটা রাস্তা আমি ওনার বুকের কাছে ঠেকে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। হঠাৎ করেই আমার মনে হচ্ছিল বাবা ছাড়াও আমাকে আগলে রাখার আরেকজন মানুষ আছে। বাড়ির সামনে রিকশা থামাতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে নেমে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে কারও অপেক্ষা না করেই গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। বাড়িতে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসতেই জেমি শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল। আমাকে দেখেই ও আমার কোলের মধ্যে বসে পড়ল। আমি কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। তারপর ওকে রেখে ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি অলি বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে। এতটুকু সময়ের মধ্যে ড্রেস চেঞ্জ করে এসে ঘুমায়েও পড়ল! আমি মৃদু হাসলাম। বিছানায় উঠে বসতেই প্রচুর পানি পিপাসা পেল। এখন পানি খেতে হলে বাইরে যেতে হবে। ধুর! বাইরে যেতে ইচ্ছেও করছে না এখন। তবু বিছানা থেকে নেমে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বাইরে গেলাম। ডায়নিং টেবিলের পাশে গিয়ে পানি খেলাম। বাড়ির সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সবার রুমের দরজা বন্ধ। আমি নিজের রুমে ফেরার সময় খেয়াল করলাম তাজ ভাইয়ের রুমের দরজা অর্ধেক খোলা। কৌতুহল বশত আমি এগিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে থেকেই ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখলাম তাজ ভাই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তার মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। শ্রেয়ান ভাইয়া চুপচাপ তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তখনই তাজ ভাইয়ের রাগত কন্ঠ কানে এল। উনি বললেন,“একটাকেও ছাড়ব না আমি। সামনে পেলে জানে মেরে ফেলব।”
আমার পিলে চমকে উঠল। এটা কী বললেন উনি! আমি চোখ বড়ো বড়ো করে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। শ্রেয়ান ভাইয়া পাশ থেকে তাজ ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,“মাথা গরম করিস না। শান্ত হ। এখন যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। কোনো ভুল করা চলবে না। আমি আছি তো। বি স্ট্রং।”
আমি দুহাতে মুখ চেপে ধরে দ্রুত সেখান থেকে সরে নিজের রুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম। এসব কী শুনে এলাম আমি! তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া কাউকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে! তাহলে কি আমার ধারণাই ঠিক? তাজ ভাই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামে এসেছেন। আর শ্রেয়ান ভাইয়াও ওনার সাথে আছেন! ওনারা কাদেরকে পেলে মেরে ফেলবেন? আমার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু আমি কেন? ওনাদের দেখলে কেই বা বলবে ওনাদের মাথায় এমন জঘন্য বুদ্ধি ঘুরছে? তাজ ভাই তো আট বছর ধরে গ্রামেই আসেননি। তাহলে গ্রামে তার কোন শত্রু থাকতে পারে? চিন্তায় আর ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। খারাপ আশঙ্কায় মাথাটাও ধরে গেল। বুকের মধ্যে এখনও ধুকপুক করছে। আমি দ্রুত বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম। বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। অনেকক্ষণ এভাবে থেকেও চোখে একফোঁটা ঘুম এল না। বারবার তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার বলা কথাগুলোই মনে পড়ছে। চেষ্টা করেও সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। আমি অসহ্য হয়ে গেলাম। তবুও জোর করে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। তার অনেকক্ষণ পর দুচোখে ঘুম নেমে এল। আপাতত আমি এই সাংঘাতিক চিন্তা থেকে রেহাই পেলাম।
চলবে…………………..🍁