অনান পর্ব-০৩

0
340

#অনান
#পর্ব-৩

“তোর এক্সাম কবে থেকে শুরু হবে?”
নীরা দোতালায় এসেছিল নিজের কিছু প্রয়োজনীয় বই খাতা গুছিয়ে নিতে। পেছন থেকে বাবার গলা শুনে থমকে গেলো। রাগে-ক্ষোভে বাবা মায়ের সাথে কথা বলে না নীরা। তবুও বাবার কথায় একটু অবাক হলো। পরীক্ষা আছে জেনেও জোর ধরে নিয়ে আসা বাবা যখন নিজেই পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করে তখন অবাক হতে হয় বৈকি।
“জেনে কি করবে?”
“আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছি আমরা। তোমরা তৈরি থেকো। সকাল দশটা নাগাত রওনা দেবো।”
“আমরা মানে?”
“বোকার মতো প্রশ্ন করো কেন? আমরা বলতে আমি তোমার মা, তোমার চাচীমা আর মোর্শেদ। বিয়ে হয়ে গেছে তোমার এখন কি তোমায় একা ছাড়বো? তোমাদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে আমরা ফিরে আসবো।”
হাসনাত সাহেব একনাগাড়ে কথাগুলো বলে চলে গেলেন। বাবা সরতেই মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নীরা। মায়ের মুখ হাসি হাসি।
“তুই খুশি হয়েছিস নীরা? বাবা কিন্তু এতটা খারাপ নয় যতটা তুই ভাবছিলি। তোর পড়ালেখা নিয়ে তার যথেষ্ট চিন্তা আছে।”
“এতো গরু মেরে জুতা দান করা হলো, মা? তোমাদের ইচ্ছে মতো সব করতে হচ্ছে। আমি তো একটা পাপেট, যেভাবে নাচাচ্ছ সেভাবে নাচছি।”
“নীরা! যত যাই করি তুই কখনো খুশি হোস না। দয়া করে চাচী মার সাথে কখনো এভাবে কথা বোলো না। তাহলে আমাদের যতটুকু সম্মান আছে সেটুকুও থাকবে না। একজন তো আমাদের কথা ভাবেনি তুমি অন্তত ভেবো। আর না পারলে আমাদের বলো গলায় ফাঁস নেবো না হয় দু’জন? বাবা মা হয়েছি তোমাদের কে তো মরতে বলতে পারি না?”
নীরার মা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। নীরা বোকার মতো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সব কথা কেন যে এক জায়গায় এসে আঁটকে কেন বুঝতে পারে না নীরা। কষ্টগুলো সব নতুন করে ডানা মেললো যেন। সংসার এমন একটা জায়গা যেখানে একজনার কর্মের ফল আরেকজনকে ভোগ করতে হয়।

চারতলায় এসে দেখে এলাহি কান্ড। চাচীমা হুলুস্থুল রান্না বান্না করছে। নীরাকে দেখে হইহই করে উঠলো-
“এই নীরা, দেখতো আর কি রান্না করা যায়? শুকনো কিছু বল যা অনেকদিন ভালো থাকবে।”
ডাইনিং টেবিলে তখন কয়েক পদের খাবারের বাটি সাজানো। পোয়া পিঠে, হাতে বানানো বিস্কুট, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, কুড়মুড়ে মিষ্টি নারকেল, দু’তিন পদের মাংস।
“এতোকিছু কেন চাচী? এতো কে খাবে?”
“এতো কোথায় দেখলি? তবুও তো ভাবী মানা করলো। আমি তো আরো অনেক কিছু করতে চাইছিলাম। এগুলো সব মোর্শেদের পচ্ছন্দের জিনিস। তুই তো মিষ্টি পচ্ছন্দ করিস না, ঝাল কিছু করবো তোর জন্য?”
“আর কষ্ট করো না চাচীমা। তুমি তো জানোই আমি অতো খেতে পচ্ছন্দ করি না।”
“এখন থেকে কিন্তু নিয়ম মেনে খাওয়া দাওয়া করবি। কেমন শুকিয়ে গেছিস দেখেছিস? আর তুই না খেলে তো আমার ছেলেটাও খাবে না। এবার কষ্ট করে একটু রান্নাটা শিখে ফেলিস। মোর্শেদের আবার বাইরের খাবার সহ্য হয় না।”
“এতো ভেবোনা চাচীমা ইউটিউব আছে না। ইউটিউব দেখে রান্না করে খাওয়াবো তোমার ছেলেকে।”
“আচ্ছা শোন, মোর্শেদের কাপড় গুলো একটু দেখে নিস তো। সব ইস্ত্রি করা আছে কিনা? আগামী পরশু ওর জয়েনিং। ঢাকায় যেয়ে সময় পাওয়া যাবে না তাই এখনই সব গুছিয়ে নে।”
“কিসের জয়েনিং? চাকরি পেয়েছে নাকি?”
কৌতুহলী হলো নীরা।
“হ্যা, তোকে বলেনি? মনেহয় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। যাক বাবা, আমি তাহলে আর কিছু না বলি। ওই জানাবে তোকে। তুই একটু দেখে নিস শোনা ওর কাপড় চোপড়। ছেলেটা বড্ড অগোছালো। ”
“ঠিক আছে আমি দেখছি।”
আরো কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো নীরা। মোর্শেদের চাকরি হয়েছে ঢাকায় অথচ ওকে কিছু বলেনি। না বলুক, আমার কি? নিজেকে সান্ত্বনা দিলো নীরা। বলতে এলেও শুনবে না আর। এতো আগ্রহ নেই। যেখানে খুশি চাকরি করুক মোর্শেদ তাতে নীরার কি যায় আসে। খুব ভাব হয়েছে শয়তানটার। সবাই যাক আগে তারপর তোকে বোঝাবো! নীরা মনে মনে ফন্দি আঁটে মোর্শেদকে শায়েস্তা করার। যদিও সেদিনের পর থেকে মোর্শেদ সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ঘরের ভেতর ওর সাথে কথা বলে না তেমন একটা। নীরাও ওকে ঘাটায় না। এমনিতে মোর্শেদের গায়ে পড়া স্বভাব ভালো লাগে না কিন্তু তবুও চাকরির কথাটা জেনে মনটা কেমন খচখচ করছে। এতো বড় খবর ওকে কেন দিলো না মোর্শেদ?

★★★

“ভাবী, ফ্ল্যাটটা ভারী সুন্দর, কি বলো?”
চাচীর উচ্ছাসে ভরা কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
“তা আর বলতে? চারপাশটা খোলামেলাও আছে। ঢাকার অন্যান্য জায়গার মতো গুমোট না। বারান্দা গুলো দেখো বেশ বড়।”
“হ্যা, ভাবী। ভালোই হলো আমরাও মাঝে মাঝে এসে থাকতে পারবো।”
“সেজন্যই তো এতোবড় ফ্ল্যাট নেওয়া। মোর্শেদের বুদ্ধিতেই তো কেনা হলো। অবশ্য ও না বললে তোমার ভাই কি রাজি হতো জীবনে?”
“তা যা বলেছো ভাবি। যেভাবেই কেনা হোক বেশ একটা কাজের কাজ হয়েছে, কি বলো? ছেলেমেয়েগুলো প্রায়ই ঢাকায় আসার বায়না করে। এখন নীরা আর মোর্শেদ থাকবে কেউ আসতে চাইলে আমাদের আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।”
“ঠিকই বলেছো। ওরা দু’জনেই বুঝদার আছে, ছোট ভাইবোনদের ঠিকই সামলে নিতে পারবো।”
“হ্যা, ভাবি।”
নীরা আড়ালে দাঁড়িয়ে মা আর চাচীমার কথা শুনছিলো। হঠাৎ মোর্শেদের ডাকে চমকে উঠলো-
“কি রে আড়ালে দাঁড়িয়ে কি শুনছিস? তুই তো দেখি বিরাট কুটনি?”
“আজেবাজে বকবি না একদম?”
নীরা আঙুল উঁচিয়ে শাসায়। মোর্শেদ নীরার সে আঙুল নিজের আঙুলের সাথে পেচিয়ে নিলো-
“বকলে কি করবি?”
“মোর্শেদ, ভালো হবে না বলে দিলাম!”
“মোর্শেদ ভালো হবে না বলে দিলাম। তুই এই হুমকি দেওয়া ছাড়া আর পারিস টা কি?”
মোর্শেদ ভ্যাংগালো নীরাকে।
“যাইহোক তোর সাথে এতো খাজুরে আলাপ করার শখ নেই আমার। চল বড় আব্বু ডেকেছে দু’জনকে।”
নীরা আর কথা না বাড়িয়ে মোর্শেদ পিছু পিছু হাঁটা দিলো।

“বসো, তোমরা। কাল ব্যস্ত থাকবো আর পরশু ভোরে উঠেই চলে যাবো তাই ভাবলাম আজই কথাগুলো বলে নেই।”
“জ্বী বড় আব্বু বলুন।”
“ঢাকায় তো অনেক আগেই ফ্ল্যাট কিনতে পারতাম কিন্তু কিনিনি। তোমাদের ছোট চাচা আবেদ অনেক আগে থেকে ঢাকায় এসে থাকতে চাইছিলো। মা কে তো জানোই, সে কিছুতেই রাজি হয়নি। যেনতেন ভাবে আমাদের চার ভাইকে মা একসাথে একজায়গায় রাখতে পেরেছে কিন্তু তোমাদের বেলায় কি হবে কে জানে। তোমরা দু’জনে যথেষ্ট বুঝদার আছো তাই আশাকরি এতোকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। মা বললো বলেই এই ফ্ল্যাট কেনা। আমাদের বাড়ি থেকে যেই আসুক এখানেই এসে থাকবে। নীরার পড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত তোমাদের ঢাকায় থাকতে মানা নেই। কিংবা আমি আর তোমার বাবা যতদিন বেঁচে আছি ততদিনও কোনো সমস্যা নেই। তবে একথাও মাথায় রেখো যে, আমাদের পড়ে পরিবারের হাল তোমাদেরই ধরতে হবে। কাজেই পরিবারের বাইরে আলাদা ভাবে নিজেদের নিয়ে কোনো চিন্তা করো না তোমরা। তোমরা বড়, বাকীরা তোমাদের দেখেই শিখবে। আশাকরি সেভাবেই চলাফেরা করবে। আর হ্যা, যাদের সাথে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখি নাই তাদের সাথে যেন তোমরা কোনো যোগাযোগ না করো। পরিবারের একতা আর মানসম্মানের ভাবনা যেন সবার আগে ভাবো তোমাদের দুজনার কাছ থেকে এটাই আশা করি।”
হাসনাত সাহেব থামতেই নীরা মাথা নাড়লো-
“মাথায় থাকবে বাবা।”
“থাকলেই ভালো। অন্তত তোমার কাছ থেকে যেন তোমার ছোট বোনরা ভালো কিছু শিখে।”
“বড় আব্বু, আপনি কিছু ভাববেন না আমরা ঠিক সামলে নেবো। আর যখনই সুযোগ হবে আমরা দু’জন বাড়ি চলে যাবো।”
হাসনাত সাহেব মাথা দুলিয়ে উঠে পড়লো। নীরার হঠাৎ বাবাকে দেখে মনে হলো যে বাবা অনেক বুড়িয়ে গেছে। কেমন নিস্প্রান দেখালো বাবাকে আজ।
“আব্বু, তোমার কি শরীর খারাপ?”
নীরা হঠাৎ করে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে। হাসনাত সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে ঘুরলেন। ক’দিন মেয়ের অভিমান মাখা মুখ দেখে ব্যাথিত ছিলেন আজ মেয়ের কনসার্ন দেখে মনটা খুশি হলো। যাক মেয়ে তবে তাকে নিয়ে ভাবে।
“নাতো, ঠিকই আছি। জার্নি করে এসেছি এইজন্য হয়তো ক্লান্ত লাগছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
নীরার মনটা তবুও খচখচ করছে। ওকে নিয়ে আবার বাবার মন খারাপ নয়তো? বিয়ে নিয়ে কি বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে নীরা? মোর্শেদের যায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতো ভাবতো না। কিন্তু মোর্শেদটাকে সহ্য হয় না কিছুতেই। দীর্ঘ খরার পরে বৃষ্টিটা বরাবরই আশির্বাদ মনেহয় অথচ সেদিনের ঝড়বৃষ্টি তাদের জীবনে ঝড় বয়ে এনেছিলো। কিভাবে ভুলে যাবে সেদিন? সেদিনের পর থেকে সে মনেপ্রাণে মোর্শেদকে ঘৃনা করে। মোর্শেদের কারনেই তো ওর বাবা মায়ের মনে বিশাল ক্ষত তৈরি হয়েছে। এই জীবনে কিছুতেই মাফ করবে না ওকে। স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! অতীত মনে করে মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে ওঠে নীরার।

চলবে—–
©Farhana_Yesmin।