অনান পর্ব-০৪

0
320

#অনান
#পর্ব-৪

“সারপ্রাইজ!”
সমস্বরে চিৎকার শুনে নীরার জান যাওয়ার উপক্রম। দরজার ওপাশে তার ছোট ভাইবোনের বিশাল দল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা মনখারাপ ভাব লুকিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো-
“তোরা কখন এলি? আর সবাই একসাথে এলিই বা কিভাবে?”
মৌমি সৌমি দু’পাশ থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো নীরাকে-
“ভাইয়ার প্রথম স্যালারি হয়েছে গো আপুনি। ভাইয়া আমাদের সবাইকে ট্রিট দেবে। সবাইকে ম্যানেজ করে আসতে অবশ্য একটু প্যারা হয়েছে। তবুও এবার বাবা মা সবাইকে দ্বিতীয়বার হানিমুনের সুযোগ দিয়ে আমরা দল বেঁধে ঢাকায়। হিহিহি, ভালো করেছি না আপু?”
দুইবোন পালাক্রমে বলে খিলখিল করে হাসলো।
“আসলি কিসে এতজন একসাথে?”
“মাইক্রো ঠিক করে দিয়েছিলো চাচ্চু। গান গাইতে গাইতে চলে এলাম। দারুণ মজা লেগেছে, কি বলিস রে তোরা?”
আরিশা বলে। বাকীরা সব হইহই করে গলা মেলায়। ড্রয়িং রুমের সোফা আর ফ্লোরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। মোর্শেদ কে খুঁজলো নীরা। কোথায় সে?
” আমরা তো তোমাকে না বলে চাইনিজ খেতে চেয়েছিলাম। সেটা বগুড়াতে খাওয়ালেও হতো। কিন্তু ভাইয়া তো একটু বেশি ভালো তাই একেবারে ঢাকায়। আপুনি, তুমি আবার রাগ করো নিতো তোমাকে না বলে এলাম বলে? ভাইয়া বললো তোমার এক্সাম শেষ। আমরা এলে তোমারও রিফ্রেশমেন্ট হবে।”
রাতুল বললো। নীরা মনে মনে বললো, খুব আমার রিফ্রেশমেন্টের চিন্তা করে। এইজন্যই নিজের কোনো কথা আমার সাথে শেয়ার করে না। ঢং করে আবার সব্বাইকে ডেকে খাওয়ানো হবে, হুহ।
“নাও, তোমার জন্য শরবত।”
মিতুল নীরার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিলো।
“তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? আমি তো ভেবেছি তুই মনেহয় আসিসনি।”
“আমি আর আয়াজ রান্নাঘরে ছিলাম সবার জন্য শরবত করলাম। এটা খাও দেখবে ক্লান্তি কাটবে, এনার্জি পাবে।”
“বাব্বাহ খুব সংসারি হয়েছিস দেখছি। শরবতটা চমৎকার হয়েছে।”
নীরা লেবুর শরবতটা খেয়ে নিলো একচুমুকে।
“তা তোদের ভাইয়া কোথায়?”
“আমাদেরকে ফ্লাটে পৌঁছে দিয়ে ভাইয়া আবার অফিসে গেছে। কি বা জরুরি কাজ আছে। তবে চলে আসবে তাড়াতাড়ি। আটটার ভেতর আমাদের সব্বাইকে তৈরি থাকতে বলেছে। ভাইয়া এসে নিয়ে যাবে আমাদের।”
মিতুল নীরাকে বলে।
“হুম, তাহলে তোরা সব এভাবে বসে আছিস কেন? গোসল টোসল কর, ফ্রেশ হ, দুপুরের খাবার খেতে হবে তো?”
“এখন আর কি খাবো,বেলা তো চারটে বেজে গেছে। তাহলে আর রাতে খেতে পারবো না। আমি বাপু কিছু খাবো না।”
রাতুল পেটে হাত বুলোয়।
“আমি খাবো, আমার খিদে লেগেছে। এখন না খেলে গ্যাস হবে পেটে। তখন এমনিতেই রাতে খেতে পারবো না। ”
আয়াজ বলে।
“আপু, তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ভাত চড়িয়েছি চুলায়। আম্মুরা অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে, আর কিছু রানতে হবে না। ”
“তাহলে আর কি আমরা সবাই খাবো। আধাঘন্টা টাইম দিলাম, সবাই ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আয় তোরা। কারো কোন কথা শুনবো না।”
নীরা উঠে নিজের রুমে গেলো। মনটা আজ বড্ড ক্লান্ত, একটা শাওয়ার নেওয়া খুব জরুরি। এদিকে মনের ভেতরটা খচখচ করছে। ও যখন দেখতে পেয়েছে তখন মোর্শেদের কি চোখে পড়েনি? কি জানি, হয়তোবা মোর্শেদ জানে। মোর্শেদকে নিয়ে কেন যেন ভালো কিছু ভাবতে পারে না নীরা, সবসময় মনের ভেতর সন্দেহ খেলা করে ওকে নিয়ে। শুধু বাবার কারনে মোর্শেদকে সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতোদিন? কতোদিন সহ্য হবে মোর্শেদকে?

★★★

নীরার আনমনা ভাব খুব ভালো করে বুঝলো মোর্শেদ। সারাটাখন সবার সাথে থেকেও যেন কারো সাথে নেই। কিছু একটা ভাবছে সবসময়। সবাইকে কাছে পেয়েও যেন ওর ভেতর এতোটুকু উচ্ছাস নেই। মোর্শেদ ইশারায় বারদুয়েক জিজ্ঞেস করেছে বদলে নীরা কেবল মাথা নেড়ে ইশারা করেছে কিছু হয়নি বলে। কয়েকবার খোঁচানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে। আজ নীরা কোনো উত্তরই দিচ্ছে না ওর কোনো কথার।

বাড়ি ফিরে লিফট যখন ওদের ফ্লোরে থামলো, নীরা নামতে যাচ্ছিলো মোর্শেদ পেছন থেকে চেপে ধরলো, মিতুলকে বললো-
“এই যে চাবি, তোরা যা আমি আর নীরা একটু ছাঁদে যাবো।”
“আমি যাবো না, খুব মাথা ধরেছে আমার।”
নীরা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
“জরুরি কথা আছে নীরা ছাদে চল। মিতুল তুই যা।”
মিতুল ঘাড় নেড়ে চলে গেলো। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই নীরা রাগী দৃষ্টিতে মোর্শেদকে দেখলো-
“সবসময় জোরাজোরি না করলে ভালো লাগে না তোর?”
“তোর ভালো লাগে? ”
“মানে?”
চিল্লিয়ে ওঠে নীরা।
“দেখ আমি শান্ত মত বললাম ছাদে চল কথা আছে। তুই কি রাজি হলি? তোর সাথে সব ব্যাপারে আমার জোরাজোরি করতে হয়। কেন করতে হয় আমি বুঝিনা। এবার দয়া করে নাম। দু’মিনিট নিভৃতে আমার সাথে কথা বললে তোর গায়ের চামরা খসে পড়বে না।”
নীরা চুপচাপ ছাদে উঠে এলো। ছাদটা বেশ সুন্দর, টিপটপ একেবারে। বসার কিছু বেদি তৈরি করা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কোনায় কোনায় কিছু ফুলের গাছ লাগানো আছে। নীরা মাঝের এক বেদিতে যেয়ে বসলো। কম পাওয়ারের একটা বাতি জ্বালালো ছিলো মোর্শেদ সেটা নিভিয়ে দিয়ে এলো-
“ভয় পাস না আজ পূর্নিমা, চাঁদের আলো আছে কাজেই অন্ধকার হবে না।”
মোর্শেদ নীরার পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ, একসময় মোর্শেদ নীরবতা ভাংলো-
“তোর কি হয়েছে নীরা, আজ তোকে খুব অন্যমনস্ক দেখছি। ওরা সবাই এলো তুই খুশি হসনি?”
“কিছু হয়নি এমনিতেই পরীক্ষা দিয়ে একটু ক্লান্ত।”
“প্লিজ মিছে কথা বলিস না তো। আমার কাছ থেকে কেন যে লুকোনোর চেষ্টা করিস বুঝে পাই না।”
মোর্শেদের গলায় হতাশা।
“তোকে বলছি না মানে তোকে বলতে চাই না। তো শুনতে চাইছিস কেন?”
“বারে, আমি তোর বর না? কোনো কারনে তোর মন খারাপ সে বিষয়ে আমি জানতে চাইবো না?”
“না চাইবি না। আমি তো বলেছি যে তোকে বর হিসেবে মানি না। ওয়েট ওয়েট, আমি না হয় তোকে বর মানি না কিন্তু তুই কি আমাকে বড় মানিস?”
মোর্শেদ অবাক হয়ে আকাশ থেকে পরে-
“মানে? কি বলছিস এসব? তোকে বউ মানি না কে বললো?”
“আচ্ছা! মানিস? তবে তোর স্যালারি হয়েছে, তুই সব্বাইকে খাওয়াবি এসব কথা ওদের থেকে আমার শুনতে হয় কেন? তুই নিজে থেকে তো কখনো আমায় বলিসনি?”
বিস্ময়ে মোর্শেদের মুখের হা বড় হয়-
“এইজন্যই তোর মন খারাপ? কিন্তু আমি তো তোর ভয়ে তোকে কিছু বলিনা। কিছু বলতে গেলেই তুই বিরক্ত হোস। আমি তোর বিরক্তির কারন হতে চাই না। ”
নীরা এবার যেন একটু লজ্জা পেলো। ধুস, কি বলতে কি বলে ফেললো। সো তো মোর্শেদকে স্বামী বলেই মানে না তাহলে ওর কোনো ব্যাপারে কিছু বলা না বলায় কি যায় আসে? ছি! মোর্শেদটা না জানি কি ভাবছে ওকে নিয়ে? নীরা নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করে-
“কিন্তু না চাইতেই তো সারাজীবনের বিরক্তির কারন হয়ে গেছিস। এখন এতো ভেবে কি লাভ?”
“এভাবে বলছিস কেন নীরা? সেই ছোটর থেকেই একসাথে হেঁসেখেলে বড় হলাম। তখন তো ঠিকই আমার সাথে খেলতিস? তারপর কি এমন হলো যে আমায় তুই সহ্য করতে পারিস না? আমি যে ছোটর থেকে তোকেই বউ ভেবে এসেছি? অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি পর্যন্ত?”
দুঃখী গলায় মোর্শেদ বলে। ওর কন্ঠের কম্পন টের পায় নীরা। মোর্শেদকে দেখলো, হালকা চাঁদের আলোয় মোর্শেদকে খুব আকর্ষনীয় লাগছিলো। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের ভাসা ভাসা চোখের মোর্শেদের হালকা খাড়া চুলগুলো হাওয়ায় দুলছিলো। দু’মিনিট এর জন্য নীরা ভুলে গেলো মোর্শেদকে ও একটুও পচ্ছন্দ করে না। বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকলো সে মোর্শেদের দিকে। বিদেশ থেকে আশার পর এই প্রথম নীরা ভালোভাবে মের্শেদকে দেখলো। তার মনেহলো, মোর্শেদ এই দুবছরে আরো স্মার্ট আর ড্যাশিং হয়েছে। মোর্শেদ কথা বলতে বলতে বার দুয়েক নীরার দিকে তাকালো। নীরাকে এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অবাকই হলো।
“শুনছিস আমি কি বললাম?”
“হু শুনবো না কেন? শোন মোর্শেদ, তোর যদি কারো দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয় তাকাবি, দরকার হলে প্রেম করবি কিন্তু আমার আশা ছেড়ে দে। আর আমার সাথে এতো ভালো ভাব ধরারও কোনো দরকার নেই। আমি জানি তুই কি? তোর মনটা কেমন? কাজেই যত চেষ্টাই করিস না কেন আমার চোখে তুই কোনোদিন মহাপুরুষ হতে পারবি না। ওকে?”
নীরা উঠে দাড়ালো।
“আমার মাথা ধরেছে আমি বাসায় গেলাম।”
মোর্শেদ নীরার হাত ধরে, দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো-
“কিন্তু আমার মন কেমন এটা তো বলে যা। কি করেছি আমি? এতো কেন রাগ আমার উপর তোর?”
“আমি কেন বলবো? তুই নিজেই ভাব, পেয়ে যাবি।”
নীরা ঝট করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে নীচে নামতে থাকে। চোখে দু’টো জলে টইটম্বুর। পেছনে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে মোর্শেদ। ওর কোন দোষে নীরা এমন করছে এটাই তো বুঝতে পারছে না?

চলবে—–
©Farhana_Yesmin।