অনুরাগের ছোঁয়া পর্ব-২১+২২

0
432

#অনুরাগের ছোঁয়া
#নবনীতা-নবনী(লেখনীতে)
#পর্ব-২১
||
সূর্যের আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার।চারপাশে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখলাম আমি বেলকনিতে আছি।কাল রাতে অনুরাগ যাওয়ার পর কান্না করতে করতে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে ছিলাম।বেলকনি থেকে উঠে রুমে যেতে নিলে হঠাৎ করে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।আমি মাথা ধরে রুমে থাকা সোফাটায় বসে পরলাম।গতকাল রাতে বেশী কান্না করার ফলে আজ মাথাটা এরকম লাগছে।সোফা থেকে উঠে কোন রকমে ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে টাওয়াল নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।আয়নার সামনে নিজের প্রতিছবি দেখে নিজেই আতকে উঠলাম।কারন আমার চোখ দুটো লাল হয়ে একদম ফোলে ফোলে গেছে।মাথার চুলগুলো পাগলের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।যেকোন লোক আমাকে এই অবস্হায় দেখলে পাগল ভাববে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোন রকম নিজেকে ঠিক করে নিলাম।আমি চাইনা বাবা- মা আমাকে এই অবস্হায় দেখে কষ্ট পাক।

অনুরাগের কথা আর ভাববো না বলে নিজেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করলাম।সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। আর আমি ভাববো না ভাববো না বলে আবার ও অনুরাগের চিন্তায় মঘ্ন।আমার কবুল বলার সাথেই সাথেই তার শেষ দিন তার বলা এই কথাটাই আমাকে বেশী করে ভাবাচ্ছে।মন খালি বলছে সে নিজের কোন ক্ষতি করে বসবে নাতো এই কথাটা ভাবলেই আমার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। তার কোন ক্ষতি হলে আমি নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারব না এমনকি আমি নিজেই মরে যাবো।
_____________________________________মেরুন রঙের শেরওয়ানি, মাথায় টুপি পরে আবির বর বেশে একদম নিজেকে তৈরী করে নিলো।ছোঁয়াকে নিজের করে পেতে চলেছে আজকে তো আবিরের খুশি হওয়ার দিন।কিন্তু আবীর কেন জানি খুশি হতে পারছে না।বারবার রিয়ার মুখটা আবিরের সামনে ভেসে উঠছে।চোখ বন্ধ করলেই রিয়ার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।এসব কথাই সে তার রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো। রিয়ার গলার আওয়াজে তার ভাবনার ছেদ ঘটে…
–স্যার ভেতরে আসব।

–হুম আসো।

রুমের ভিতর গিয়ে আবিরকে দেখে থমকে যায় রিয়া।বিয়ের পোশাকে আবিরকে কোন রাজপুত্রের থেকে কম লাগছে না।রিয়ার মনের ভেতরটা আবিরকে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠে। সে মনে মনে বিরবির করে বলে উঠে,খুব কি ক্ষতি হতো যদি আপনি আমার হতেন।কেনো আমার ভালোবাসাটা আপনি বুঝলেন না স্যার।আমি কি দেখতে অনেক অসুন্দর স্যার।আপনাকে বিয়ের সাজে দেখে আমার অন্তরটা যে একদম পুড়ে যাচ্ছে আবির স্যার।আবিরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এসব কথাই মনে মনে আওড়াচ্ছে রিয়া।

এদিকে আবির ও রিয়ার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।কালো রঙের জামদানী শাড়িতে রিয়াকে দেখতে একদম পরীর মতো লাগছে।কালো শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে জুয়েলারি, হাতে ব্যালবেটের কালো চুড়ি,ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিপ, চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া আর কপালে ছোট একটা কালো টিপ, মুখে মেকাপের ছিটেফোঁটা ও নেই তবু ও এইটুকুতেই তাকে যেন অসাধারণ সুন্দর লাগছে।আবির দৃষ্টি যেন রিয়ার মধ্যেই আবদ্ধ।

দুজনের ঘোর কাটে কিছু একটা পরার শব্দে।তাকিয়ে দেখে আবিরের পোষা বিড়ালটা টেবিলে থাকা ফুলদানিটা নিচে ফেলে দিছে।আবির নিজেকে সংযোত করে রিয়াকে বলে..

–কিছু বলবে তুমি।

রিয়ার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে যেন।কান্না গুলো তার ভেতরে যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বর রূপে দেখে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।সেও তো একদিন স্বপ্ন দেখত আবিরের বউ হয়ে সে তার পাশে থাকবে।কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।অনেক কষ্টে সে তার কান্না আটকিয়ে আবিরকে বলল..

–আসলে সবাই আপনার জন্য ওয়েট করছে।তাই আন্টি আমাকে আপনাকে ডাকতে পাঠাইছে।

–ওহ আচ্ছা,তুমি গিয়ে সবাইকে বলো আমি আসছি।

রিয়া যেন এই কথাটা শোনার অপেক্ষাই ছিলো।আবির বলা মাত্র সে হনহন করে আবিরের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

রিয়ার কষ্টটা আবির বুঝতে পারেছ।সে রিয়ার চোখে স্পষ্ট জল দেখতে পেয়েছে।সেই বা কী করবে,বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে যদি রিয়া তার মনের কথাগুলো আবিরকে বলত বা আবির রিয়ার লেখা ডায়েরিটা পেত তাহলে সে কিছু একটা করত।এখন সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না।তারও রিয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে।সে আর বেশী কিছু না ভেবে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

_______________________________আজ বিয়ে……. হুম রাতে।ঐ সন্ধ্যার পর আর কী!একে একে মেহমান বুঝি সব এসেছে।দুপুর বেলা পার্লার থেকে লোক এসেছে আমাকে সাজাতে,প্রায় ৫ টা বাজে আমার সাজ কম্পিলিট হলো।এসব সাজ টাজ আমার কাছে একদম অসহ্য লাগছে।

মেরুন রঙের ভারী পাথরের কাজের একটা লেহেঙ্গা আমাকে পরানো হয়েছে।সাথে ভারী ভারী গহনা।মাথার চুলগুলো রিং করে সামনে দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছে।সবাই বলছে আমাকে নাকি পুতুলের মতো লাগছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম,খারাপ লাগছে না আমাকে দেখতে।কিন্তু আমার মনের ভেতর একটুও শান্তি লাগছে না,অনুরাগকে একবার দেখার জন্য বেহায়া মনটা খালি ছটফট করছে।

আমাদের বাড়ির ছাদ অনেক বড় বিধায় বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের বাড়ির ছাদে করা হয়েছে।সাতটার দিকে আমাকে স্ট্রেজে এনে বসানো হলো।সবাই চলে এসেছে।অনগরাগের মা – বাবাও এসেছে।তারা অনেক সময় আমার সাথে কথা বলে গেলো।কিন্তু আমার মনটা অনুরাগকে খুঁজছে।চারদিকে চোখ বুলিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু নাহ তাকে কোথাও পেলাম না। তাকে না পেয়ে মনে আচমকাই ভয় ডুকে গেলো।তার এসব ভাবনার মাঝেই শোনা গেলো বর এসেছে।বর কথাটা শোনা মাত্রই তার বুকটা ধক করল উঠল।মনে মনে সে আওড়ালো, সে কী সত্যিই অন্যের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে এই কথাটা ভাবতেই তার চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরতে লাগল।



#চলবে?

#অনুরাগের ছোঁয়া
#নবনী-(লেখনীতে)
#পর্ব-২২
||
আবিরকে স্ট্রেজে এনে ছোঁয়ার পাশে বসানো হলো।ছোঁয়া একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখ নামিয়ে নিলো।আবিরের কাজিনরা এসে সবাই ছোঁয়ার সাথে ছবি তুলতে লাগল।ছোঁয়া মুখে মিথ্যা হাসি ঝু্লিয়ে সবার সাথে ছবি তুললো।এসব কিছু ছোঁয়ার যেন অসহ্য লাগছে। ছোঁয়া আবার চারদিকে চোখ ঘুড়িয়ে অনুরাগকে খুঁজতে লাগল।চারদিকে তাকে না পেয়ে তার মনে মনে ভয়ের দানা বাঁধল।

আবির বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে কিছুক্ষণ আগে সাইন করে দিছে।এবার আমার পালা!রেজিস্ট্রি পেপারে সিগনেচার করতে গিয়ে কলম কাঁপতে লাগল।পুরো পেপার দেখতে গিয়ে বরের পাশে আবির নামটি দেখে কেঁদে উঠলো মন।কাঁপা কাঁপা হাতে সিগনেচার করতে নিলে কেউ একজন ঝড়ের গতিতে এসে আমার হাত ধরে ফেলল।অশ্রু ভরা চোখে মানুষটির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম।অনুরাগের অগ্নিময় দৃষ্টি যেন আমাকে ভষ্ম করে দিচ্ছে।অনুষ্ঠানের সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।অনুরাগের বাবা তাকে ধমক দিয়ে বলল..

–কি হয়েছে অনুরাগ।তুই না আজকে আসবিনা বলেছিলি তাহলে এখন এসে ছোঁয়ার হাত ধরে আছিস কেন?

সে তার বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে আমাকে বলে উঠে,

–তুমি রেজিস্ট্রি পেপার সাইন করবে না।

তার কথা শোনে আমি এক ঝটকায় তার হাত আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলি,

–আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার। আপনি বলার কে আমি রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবো নাকি করবো না।একদম আপনি আমার ব্যাপারে নাক গলাবেন না বলে দিলাম।

–প্লিজ ছোঁয়া এরকম করো না,আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাবো।

আপনি যা ইচ্ছা তাই করুন। এটা বলে আমি রেজিস্ট্রি পেপার হাতে নিয়ে সিগনেচার করতেে নিলেই অনুরাগ চিৎকার করে বলে উঠে,

–তুমি যদি সিগনেচার করো তাহলে আমি নিজেকে এই মুহূর্তে শেষ করে ফেলবো বলে দিলাম। এটা বলে তিনি নিজের পকেট থেকে একটা একটা গান বের করে নিজের মাথায় ঠেকালো।

আকস্মিক এরকম ঘটনার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।সে এরকম কিছু করবে আমি এটা ভাবতেও পারিনি।হটাৎ করে তার বলা একটা কথা মনে পরে গেলো।ও বলেছিলো আমার কবুল বলার সাথে সাথে তার শেষ দিন এই কথাটা মনে পরতেই আমি আতকে উঠলাম।এদিকে অনুরাগের মা তো কান্না করতে করতে আমার কাছে এসে বলল,

–মারে তুই বিয়েটা করিস না।তুই বিয়ে করলে আমার ছেলেটাকে আমরা বাঁচাতে পারবো না।

তার এরকম কথায় আমার কী উওর দেওয়া উচিত আমার জানা নেই।আমার ও ভীষন ভয় করছে অনুরাগকে নিয়ে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় অনুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

–অ-অনুরাগ আপনি কি করছেন। ওটা ফেলে দিন প্লিজ।

–ফেলে দিবো তার আগে তুমি বলো, তুমি এই মুহূর্তে আমাকে বিয়ে করবে।

–,কি বলছেন কি আপনি।

–তুমি আমাকে বিয়ে করবে নাকি আমি নিজেকে শেষ করে দিবো বলে বাটন চাপ দিতে নিলেই..

আমি কান্না করতে করতে জোরে চিৎকার করে বলি,

–প্লিজ এরকম করবেন না।

–তাহলে তুমি বল আমাকে বিয়ে করবে।

তার কথা শোনে আমি অসহায় চোখে মা বাবার দিকে তাকালাম।তারা চোখের ইশারায় রাজি হতে বললেন।আমি তাদের থেকে চোখ সরিয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই সে উঠে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

–ছোঁয়া তুমি আর না করো না।আমি জানি যে তুমি অনুরাগকে ভালোবাসো।আর অনুরাগও তোমাকে নিজের থেকে বেশী ভালোবাসে।প্রথমে হয়তো সে একটু ভুল করেছে, তারপর সে তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে।আমার মনে হয় তোমার অনুরাগকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া দরকার।

তার কথা শোনে আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝাই।তারপর অনুরাগকে বলি,

–আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি আছি এবার গানটা নামিয়ে ফেলুন প্লিজ।

আমার কথা শোনা মাত্র সে দৌড়ে এসে সবার সামনে আমাকে জরিয়ে ধরল।তার এহেম কান্ডে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার পাশাপাশি দাঁড়াল ঠিকই কিন্তু হাত থেকে গান নামায়নি।আমি তাকে গান রাখতে বললে সে আমাকে বলে,বিয়ে হওয়ার আগ অব্দি সে গান হাতেই রাখবে। তার ধারনা সে গান হাতছাড়া করলেই আমি তাকে বিয়ে করবো না।তার এরকম পাগলামী দেখে আমি মনে মনে অনেক হাসলাম কিনতু মুখে প্রকাশ করলাম না।

ছোঁয়ার মা বাবা, অনুরাগের মা বাবা সবাই আবিরের মা বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন।তারাও হাসি মুখে সব মেনে নিলে ও আবিরের মার কথা হচ্ছে বউ ছাড়া বাড়ি ফিরলে তাদের মান সম্মান থাকবে না।এই মাঝেই আবির রিয়ার হাত ধরে সামনে এসে বলে..

–মা বাবা তোমাদের কোন আপত্তি না থাকলে আমি রিয়াকে বিয়ে করতে চাই।

আবিরের কথায় রিয়া, আবিরের মা বাবা সহ অনুষ্ঠানের সবাই চমকে উঠলো।আবিরের কথায় রিয়া প্রচন্ড শক খায়।আবিরের মা রিয়াকে মাথা থেকে পা অবদি দেখে বলে, আমার কোন আপত্তি নেই।আশা করি কারো কোন আপত্তি থাকার কথা না।আবিরের মার কথায় সবাই মাথা নাড়াল যে, তাদের কোন আপত্তি নেই।রিয়ার মা ও অনুষ্ঠানে এসেছিলো।আবির রিয়ার মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানে যে তার মেয়ে আবিরকে কতটুকু ভালোবাসে তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন।এর মাঝে রিয়া কিছু বলতে নিলে আবির তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।তাই রিয়া আর কিছু না বলে কাচুমাচু হয়ে আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

একটু আগে দু’জোড়া কপোত-কপোতীর বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।বিয়ে শেষ হতেই অনুরাগের মুখে তৃপ্তির হাসি।আর ছোঁয়া মনে মনে অনুরাগের গুষ্টি উদ্ধার করছে।

রিয়া আজকে মনে মনে অনেক খুশি তার ভালোবাসার মানুষটিকে যে, এভাবে সে পাবে রিয়া কোন দিন ভাবতেই পারেনি।খুশিতে তার চোখে জল এসে গেছে।তার সামনে একটা রুমাল দেখতে পেয়ে সে সামনে তাকিয়ে দেখে আবির তার দিকে রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে বলছে,তোমার মুখে হাসিই মানায় জল না।আবির মুচকি হাসি দিয়ে বলল,নাও এটা দিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নাও।



#চলবে?