অনুরাগের ছোঁয়া পর্ব-২০

0
419

#অনুরাগের ছোঁয়া
#নবনী-(লেখনীতে)
#পর্ব_২০
||
অনেক রাত হয়ে গেলো অনুষ্ঠান শেষ হতে।আমি রুমে এসে দরজা আটকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।তার পর ফ্রেশ হয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পরলাম।

গতকাল রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারনে ঘুমও ভাঙল দেরি করে।প্রায় দশটার দিকে ঘুম ভাঙল আমার।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।কেউ হলুদ বাটছে,কেউ বা রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত।এসব কিছু দেখে আমার বিরক্তিকর লাগছে।যেখানে আমি এই বিয়েটা নিয়েই হ্যাপি না সেখানে এসব কিছু আমার যাস্ট অসহ্য লাগছে।আম্মু আমাকে দেখে বলল,”কিরে মা ঘুম থেকে উঠেছিস”। আয় নাস্তা করে নে, সবাই নাস্তা করে ফেলছে। শুধু তুই বাকী।আম্মু আমাকে ডায়নিং টেবিলে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজের হাতে খাবার খায়িয়ে দিতে লাগল।খেতে খেতে আমার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গরিয়ে পরল।আম্মু আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,”পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন?আমি মাকে জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফঁপিয়ে কেদে উঠি বলি,”আমি তোমাদের ছাড়া কীভাবে থাকব, আমি বিয়ে করতে চাইনা আম্মু। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, দূর বোকা মেয়ে এসব বলতে আছে,বিয়ের আগে সব মেয়েরা একই কথা বলে,দেখবি বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে গেছে।আর আমি জানি তোর মনে এখনো অনুরাগের জন্য জায়গা রয়েছে।আমি তোকে অনুরাগকে ভুলতে বলবা না।কিন্তু আবিরকে ও তুই কোন কষ্ট দিবি না,তার প্রাপ্য জায়গাটা তুই তাকে দিবি এটা আমার অনুরোধ তোর কাছে এটা বলে মা খাবার খায়িয়ে চলে গেলো।আমি অসহায়ের মতো মার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম মার কথাগুলো।আমার আসলেই এখন অনুরাগকে ভুলে আবিরকে নিয়ে ভাবা উচিত।কিন্তু আমিই বা কি করব অনুরাগকে ভুলা আমার পক্ষে অসম্ভব।কিন্তু আমি আবিরকে কোন কষ্ট দিবো না যথাসম্ভব আমার দায়িত্ব আমি পালন করার চেষ্টা করব।

এই কয়েক দিনে আবির একদম রাতে ঘুমাতে পারে নি।চোখ বন্ধ করলেই রিয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।হসপিটাল গেলে ও রিয়া তার থেকে অনেক দূরত্ব নিয়ে থাকত।রিয়ার দূরত্বটা কেনো জানি আবিরের সহ্য হচ্ছে না।তার সব কিছু এলোমেলো লাগছে।ঐ দিন আবির রিয়ার ডায়রীটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।সে রিয়াকে কোন মতে বুঝতে দেয়নি যে সে ডায়রিটা পরছে।রিয়া ডায়রীটা আবিরের হাত থেকে এক প্রকার কেড়ে নিয়েছে।রিয়ার বাচ্চামো ভাবটা দেখে সেদিন আবির মনে মনে মুচকি হেসেছিলো।কিন্তু এখন সব কিছু আবিরের বিস্বাদ লাগছে।সে ভেবে পাচ্ছে না যে, সে কী করবে এক দিকে ছোঁয়া আরেকদিকে রিয়া সে কি করবে।আজকে তার হলুদ, আগামীকাল তার বিয়ে কিন্তু এসব কিছুতেই যেনো হেলদুল নাই।সে নিজের রুমের খাটে দু হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে আছে।

সন্ধ্যার দিকে আত্মীয় স্বজন সবাই আসতে শুরু করল।আমি হলুদের লেহেঙ্গা পরেছি আজকে।সাথে খো্পায় গাঁদা ফুলের গাজরা।হাতে ও গলায় ফুলের মালা পরানো হয়েছে সাথে মাথায় ফুলের টিকলি।সবাই এসে একটু একটু হলুদ দিচ্ছে আর মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।সবার শেষে অনুরাগ স্ট্রেজে এলো।আজকেও তাকে দেখতে অপূর্ব লাগছে।হলুদ পাঞ্জাবীতে তাকে যাস্ট অসাধারন লাগছে।আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।সে স্ট্রেজে উঠে আমার পাশে বসল।তারপর একটু হলুদ নিয়ে সবার অগোচরে আগে তার গায়ে লাগাল তারপর বাকীটুকু আমার গালে লাগিয়ে দিলো।তার এহেম ঘটনায় আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম।আমার তাকানো দেখে সে একটা চোখ টিপ মারলো।এরকম ঘটনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, সাথে সাথে আমি বিষম খেলাম। সে দ্রত আমাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো আমি সাথে সাথে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিলাম।আমি তার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল..
–আপনি আমার গায়ে আপনার লাগানো হলুদ লাগালেন কেন?

উনি আমার কাছে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

–হাতে মেহেদী দেওয়ার সময় আমার নাম লিখতে পারো তাই আমি ভেবেছি আমার গায়ের লাগানো হলুদ তোমাকে লাগিয়ে দেই।

–বাজে কথা বলবেন না।

–তাই।লাগিয়েছি বেশ করেছি আমার বউকে আমি লাগিয়েছি তাতে তোমার কী?

শেষের কথাটা শুনে আমার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে হয়ে গেলো আমি তার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলি,

–কি বললেন আপনি?

–কিছুনা বলে তিনি আবারো একটা চোখ মেরে চলে গেলেন।

আমি আহম্মকের মতো তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন পর গান বাজনা চলতে লাগল।দেখলাম অনুরাগ গিটার নিয়ে গান গাইতে শুরু করল…

ফুলে পাইলা ভ্রমরা
কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে
ফুলে পাইলা ভ্রমরা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা

(উনি আমার কাজিন রিতাকে টেনে নিয়ে গেলো এটা দেখে আমার প্রচুর রাগ হলো।সবাই নাচতে লাগল)

কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে
ফুলে পাইলা ভ্রমরা
কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে
ফুলে পাইলা ভ্রমরা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা

(আমার কাজিনরা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো।উনি আমার পাশে গিটার নিয়ে ঘুরছে আর গাইছে..)

সোয়া চন্দন ফুলের মালা
সখি গুনে লইয়া আইলা(২)
কৃষ্ণ দিলাই রাধার গলে..
বাসর হইলা উজালা..
বাসর হইলো উজালা গো
বাসর হইলো উজালা
ময়ুর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা।

(গিটার রেখে উনি আমাকে এক টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।তারপর তার দুই হাত আমার কোমড় ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আমাকে নাচাচ্ছে সাথে নিজেও নাচছে আর খালি গলায় গাইছে)

নাচে গায়ে খেলে তারা
কৃষ্ণ প্রেমের প্রেমিক যারা্
নাচে গায়ে খেলে তারা
কুল ও মানের ভয় রাখে না
ললিতা আর বিশখা…
ললিতা আর বিশখা গো
ললিতা আর বিশখা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে
ফুলে পাইলা ভ্রমরা..(২)
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা..(২)

নাচ শেষ হয়ে গেছে অনেক্ষন কিন্তু তাতে আমাদের দুজনের কারো খেয়াল নাই।আমরা দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।অনুরাগের চোখ যেন আমাকে অনেক কিছু বলতে চাইছে।তার চোখে আমি আমার জন্য অসীম ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি।তার চোখে জল চিকচিক করছে।আমি তাকে কিছু বলতে যাব তখনই সে আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেলো।আমি সাথে সাথে আশে পাশে তাকে খুঁজলাম কিন্তু তাকে পেলাম না।

অনুষ্টান শেষ হয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে।এখন সবাই একসাথে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছে।ছাদেই খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।অনুরাগের মা অর্থাৎ আন্টি আমাকে বিরিয়ানি খায়িয়ে দিচ্ছে।আমি প্রথমে আন্টির হাতে খেতে ইতস্তবোধ করছিলাম।কিন্তু আন্টি আমাকে বলল,”আমি তোকে নিজের মেয়ের মতো মনে করি।আমার কত শখ ছিলো একটা মেয়ের কিন্তু আল্লাহ আমাকে একটা মেয়ে দিলো না।আমার কত আশা ছিলো তোকে নিজের মেয়ে করে আমার ঘরে নিয়ে যাব কিন্তু…সেসব কথা থাক এখন।মায়ের হাতে খেতে কিসের লজ্জা এবার হা কর তো।আন্টির কথাগুলো শুনে আমার মনে একরাশ ভালো লাগা তৈরী হলো,আসলেই আন্টি অনেক ভালো।আন্টির কথামতো আমিও ভালো মেয়ের মতো আন্টির হাতে খেয়ে নিলাম।খাওয়ানো শেষ হলে আন্টি আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে গেলো।

আমার চোখ জোড়া একজনকে অনেকক্ষন ধরে খুঁজছে।কিন্তু কিছুতেই কাঙ্খিত মানুষটির দেখতে পাচ্ছি না।তাই মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেলো।অনুরাগের জন্য অনেকটা চিন্তা ও হচ্ছে।তাই মুড অফ করে চেয়ারে বসে আছি।তখনই আমার মার দুঃসম্পর্কের একটা কাজিন এসে বলল,”আমি তোর খালা হই।তোর মার বিয়েতে শেষ দেখা হয়েছিল তোর সাথে।তুই তখন ছোট ছিলি,দেখতে দেখতে তোরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

সে যেতেই আমি শব্দ করে হু হা হেসে দিলাম।তার কথায় মন খারাপটা হাসির রূপ নিলো।আমাকে নাকি আমার মায়ের বিয়েতে দেখেছে,আমার তখন জন্ম হয়েছে নাকি।মহিলাটার মাথায় মনে হয় সমস্যা আছে।

রুমে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলাম।সারা গায়ে হলুদ থাকায় শরীর কিছুটা চুলকাছিল তাই শাওয়ার নিলাম।বেলকনিতে টাওয়ালটা মেলে দিতে গেলে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আমাকে বেলকনির দেয়ালের সাথে মিশিয়ে হাত দুটো চেপে ধরল।আকস্মিক এরূপ ঘটনায় আমি ভয়ে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলি।কেউ আমার কপালে আসা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলল।আমি আস্তে আস্তে চোখজোড়া খুলে যাকে দেখি তাতে ৪৪০ ভোল্টের শক খাই।কারন অনুরাগ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখদুটো ভিষন লাল হয়ে আছে।মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো হয়ে আছে।তাকে দেখতে পাগলের মতো লাগছে।এই মুহূর্তে তাকে দেখে আমার ভীষন ভয় লাগছে।সে আমার হাত দুটো আর চেপে ধরে বলল..

–ছোঁয়া প্লিজ এখনো সময় আছে বিয়েটা ভেঙে দাও।এই বিয়েটা হলে তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।না তুমি সুখে থাকবে, না আমি না আবির।আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। তার জন্য আমি প্রতিনিয়ত তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।আর কী করলে তুমি আমায় ক্ষমা করবে বল তুমি চিৎকার করে বলল।

–আমার লাগছে ছাড়ুন।

–লাগুক।আমার ও লাগছে প্রতিনিয়ত আমার বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তুমি সেটা দেখতে পারছো না।একটা কথা শুনে রাখ যখন তুমি কবুল বলে আবিরের হবে সেদিন হবে আমার শেষ দিন এটা বলে ছোঁয়াকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।

ছোঁয়া সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে পরল।তার সব পাগল পাগল লাগছে।অনুরাগ এসব কি বলে গেলো।সে যদি কিছু করে বসে তাহলে আর বিয়ে ভাঙলে বাবার সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে।কি করব আমি।এসব ভেবেই সে বেলকনিতে বসে বসেই কাঁদতে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে সে সেখানেই ঘুমিয়ে পরল।



#চলবে?