অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-১৫

0
263

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১৫তম পর্ব |

অদূরে পেঁচার ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। নেত্র পল্লব খুলতেই দৃশ্যমান হলো অন্ধকার রজনী। নিশারচর প্রাণীদের অদ্ভুত ডাকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলো। গাড়িতে আমি একাই। অনুভব করলাম আমার শরীরে মোটা শাল জড়িয়ে আছে। আশেপাশে গভীর দৃষ্টিপাত করলাম ইফাজকে দেখার আশায় কিন্তু দূর-দূরান্তে আঁধার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি আস্ত এক বোকা মেয়ে যে কি না গাড়ির দরজাও খুলতে পারি না। পারি না বলতে ভুল হবে, জানিই না কোথায় চাপ দিলে দরজা খুলবে।
একা অন্ধকার রজনীতে ভীষণ ভয় পাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি, এখন সময় কত? ইফাজ কোথায়? কোন বিপদ হয়নি তো? আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেল?
হাজারও চিন্তার মাঝে গাড়ির দরজায় কেউ কড়াঘাত করল। ভয়ে এই শীতেও রীতিমত ঘামছি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

– কে?

আমার কথার আওয়াজ শুনে কড়াঘাত থেমে গেল। আমি আজও ভাবছি চোর ডাকাত হবে হয়তো। মনে মনে সব দোয়া দুরুদ পাঠ করে গুটিশুটি মেরে গাড়ির সিটের উপর পা উঠিয়ে বসে আছি। মিনিট পাঁচেক পর আবারও সেই আগের মত কড়াঘাত করছে কেউ। এবারের কড়াঘাত থেমে থেমে না; অনবরত কড়াঘাত করেই যাচ্ছে। আমি ভয়ে এবার কান্না’ই করে দিলাম। ভয়ে দুই হাত মুচড়ে লাল করে ফেলেছি। পরিশেষে আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে দু’হাতে কান চেপে ধরলাম। না আর সহ্য করতে পারছি না।
কানে হাত চেপে কতক্ষণ ছিলাম জানা নেই।
নেত্র পল্লব খুলতে সামনে দৃশ্যমান হলো হাস্যজ্বল মুখশ্রীর ইফাজকে।

– ভয় পেলে বউ? আমার সাহসী বউ সামান্য আওয়াজ শুনে ভয় পায়, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো; আমার বউ কয়েকঘন্টা আগে শাশুড়ি নামক রিনা খানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে।

ইফাজের কথা শুনে কান্না থেমে গেল আমার। বলে কি এই বদ শিল্পী! আমি কখন ইফাজকে কিডন্যাপ করলাম! উল্টো এই বদ শিল্পীটা আমাকে সবার সামনে উঠিয়ে এই অন্ধকারে নিয়ে এসেছে।

– আপনার মাথা! আমি কখন আপনাকে কিডন্যাপ করলাম। আমার এমন উদ্দেশ্যে থাকলে আপনাকে নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতাম। আপনিই তো সকলের সামনে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেন।

আমাথ কথায় ইফাজ মাথা চুলকে সুন্দর হাসি উপহার দিলেন।
– ইয়ে মানে বেশি ভয় পেয়েছো হিবারাণী?

ইফাজের কথার চক্করে তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে এতক্ষণ চোর-ডাকাত, ভূত-প্রেত আমাকে আক্রমণ করেছিল। শুকনো ঢুক গিলে ইফাজের কথার প্রত্যুওরে বললাম,
– আরে ইফু, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আপনি জানেন ভূত আক্রমণ করেছিলো। প্রথমে হয়তো একটা ছিলো, আমি তো সাহসী মেয়ে ভয় পাইনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হয়তো সেই ভূত আরো বন্ধুদের নিয়ে আসে আমাকে ভয় দেখাতে, তাদের পরিশ্রম সফল হয়েছে। আমিও অনেক ভয় পেয়েছি ইফু!

ছোট বাচ্চাদের ন্যায় এতক্ষণ ইফুর কাছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা পেশ করলাম। ইফাজ খুব মনোযোগ সহকারে আমির কথা শুনলেন, সবটুকু শোনার পর এমন রিয়েক্ট করলেন যেন আমি কোন রূপকথার গল্প শোনালাম।

– আচ্ছা হিবারাণী, সেই ভূতগুলো কেমন ছিলো শুনি?
– আমি কি করে জানবো। আমি কি গাড়ির দরজা খুলে দেখেছি নাকি? আর আমি তো দরজাই খুলতে জানি না।
– তা জানবে কীভাবে? জানবে শুধু কীভাবে, কখন চোর, ডাকাত, ভূত দেখবে। চলো আজ তোমাকে ছোট ভূত দেখাবো।

ইফাজ যে পাগল হয়ে গিয়েছে তা এখন বুঝতে পারছি। বেচারা ইফাজ দেড় বছরে একদিকে বউয়ের বিরহ তো অপরদিকে গলায় শাকচুন্নি ঝুলেছিল। এজন্যই মাথার তার ছিড়ে গিয়েছে হয়তো। নয়তো কেউ নিজ ইচ্ছায় ভূত দেখতে চায়! তাও আবার আমার মতন এমন নিষ্পাপ বাচ্চাকে নিয়ে!

গাড়ি থেকে নামতেই ইফাজ একটি রুমাল দ্বারা আমার চোখ বেঁধে দিলো। ইফাজ আমার হাত ধরে এগিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে।

– প্রিয়লতা! বিশ্বাস আছে তো আমার উপর?

ইফাজের কথায় মুচকি হাসলাম। মাথা নেড়ে ইশারায় হ্যাঁ জানালাম। আমার কান্ড দেখে ইফাজ আমার হাতের পিঠে নিজের অধর ছুঁয়ে দিলেন। ইফাছের এহেন কান্ডে আমি থমকে গেলাম। ইফাজ এই প্রথমে আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আবারও আমাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ইফাজ। এক কদম দুই কদম এমনভাবে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেল। হঠাৎ ইফাজ এক জায়গায় থেমে আমাকেও থামিয়ে দিলো। আমার হাত ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেল।
ইফাজ বলে কয়েক বার সম্বোধন করার পর ফাজের কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। অবশেষে অধৈর্য হয়ে চোখে বেঁধে রাখা রোমাল খুলে ফেললাম।

আমি বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি একটি বাগানের মধ্যাংশে। যতদূর চোখ যায় শুধু ফল ফলাদির গাছে ভরপুর। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হচ্ছে আমি গ্রামে চলে এসেছি। এক এক গাছে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি,” এটা কোন জায়গায় নিয়ে আসলো ইফাজ আমাকে? আর আমাকে একা কোথায় চলে গেলো? আকস্মিক খেয়াল করলাম কিছু বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পায়ে হেঁটে সেখানে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, ইফাজ ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। ইফাজের কান্ড দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এই ছেলেটা কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে ছিল! আর এখন কি সুন্দর খেলছে বাচ্চাদের সাথে। আমাকে দেখা মাত্রই কিছু বাচ্চা ছেলে বলে উঠে,

– এই ভিতুর ডিম আপু, আমরা আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু উল্টো আপনি ছোট বাচ্চাদের মত কান্না করে দিয়েছেন। আপনি কি ভেবেছিলেন আমরা ভূত? হা হা হা আরে না গো! আমরা ভূত না আমরা তো ছোট বাবু। আসেন আমাদের কাছে আমাদের ছুঁয়ে দেখেন, আমরা ভূত না আমরা ছোট বাবু।

ছোট বাচ্চাদের কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। আসলে, আমি মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট চিন্তা ভাবনা করি আর কন্ড করে বসি যার জন্য পরবর্তীতে আমি নিজেই হাসি।

বাচ্চাদের কাছে এগিয়ে যেতেই তারা আমার হাতে ব্যাট ধরিয়ে দিলো। আমি তো এসব খেলা জানিনা। কিভাবে খেলে পারি।
আমাকে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইফাজ আমার কাছে এলেন।

– ভয় পাচ্ছো কেন হিবারাণী? খেলতে পারো না, আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো। তোমার এই বর থাকতে তোমার কোন কষ্ট হবে না। তোমাকে যেমন ভালোবাসবো যেমন সবদিকে পারদর্শী করব, যেন ভবিষ্যতে কেউ তোমার পানে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে সাহস না পায়।

ইফাজের কথা শুনে চোখে পানি এসে গেল। ইফাজ এমন কেন! আমাকে এতো বুঝে কেন? এত ভালবাসে কেন? আমি কি এসবের যোগ্য! আমি তো ইফাজের ধারে কাছেও নেই। কই ইফাজ আর কই আমি গ্রামের মেয়ে। ইফাজ এত বড়ো কণ্ঠশিল্পী আর কোথায় আমি গ্রামের সাধারণ মেয়ে।

ইফাজ আমাকে সুন্দর করে হাতে ধরিয়ে খেলা শিখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার তো সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আমি তো পেছন মাথা ঘুরিয়ে শুধু আমার ইফাজকে দেখছি। আমার তাকানো দেখে ইফাজ খেলা বন্ধ করে দেয়।

– কি বউ এভাবে কি দেখছ? প্রেম প্রেম পাচ্ছে নাকি?

ইফাজের এমন লাগামহীন কথায় লজ্জা পেলাম। লজ্জায় লাল হয়ে আমার দৃষ্টি নত করে ফেললাম।

আমার লাজুক রাঙ্গা মুখ দেখে ইফাজ নিজের মাথা চুলকে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

– এভাবে লজ্জা পেও না প্রিয়লতা, তোমার ঐ লাজুক রাঙা মুখ দেখে ইচ্ছে করে ভুল কিছু করে ফেলি। এই প্রিয়লতা! আজ না আমার কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে। আজ যে কোনো বাঁধা মানতে ইচ্ছে করছে না। কি করব এখন আমি?

——-

ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে অনেক মজা করলাম। এই বাচ্চারা নাকি পাশের বাসায় থাকে। আর আমরা এখন আছি গাজীপুরে। এটা নাকি ইফাজের বাড়ি। দু’তলা বিশিষ্ট এই বাড়িতে এখন আমি আর ইফাজ একা। আমি এখন একটা রুমে বসে আছি। এই রুমে একটা খাট আরৈকটা ড্রেসিং টেবিল। বাচ্চারা চলে যেতেই ইফাজ আমার হাতে নতুন শাড়ি ধরিয়ে চলে গেলেন। হালকা বেগুনি জামদানি শাড়ি। সাথে কিছু গহনাও ছিলো। শাড়ি পরিধান করে নিজেকে পরিপাটি করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত ঘসে যাচ্ছি।
দরজা খোলার আওয়াজে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম। আমার ইফু সাদা পাঞ্জাবি পরিধান করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে চোখ বন্ধ করে বড়ো নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইফাজের কান্ডে লজ্জায় মুড়ে যাচ্ছি। ইফাজের পানে তাকিয়ে দেখলাম ইফাজ মুচকি হেসে আমার দিকে আবারও তাকিয়ে আছেন।

– মাশাআল্লাহ, আমার হিবারাণী। পাগল করে দিবে তোমার এই সজ্জায়!

ইফাজের কথায় শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। ইফাজ আমার পানে এগিয়ে এসে সোজা কোলে তুলে নিলো।

ছাদের মোটা রেলিংয়ে আমাকে বসিয়ে নিজেও আমার পিছনে বসে গেলেন।

– প্রিয়লতা! দেখেছো আসমানের চাঁদখানা? কত সুন্দর কিরণ দিচ্ছে আমাদের! আমি কিন্তু এই কিরণে আমার প্রিয়লতাকেই দেখে যাচ্ছি। বেগুনি শাড়ি জড়িয়ে হালকা সাজে অপরূপ লাগছে। শুনবে না! আমার দেড় বছরের অপেক্ষার প্রহরের কথা!

ইফাজের কথা শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। দেড় বছরের আমার অপেক্ষার প্রহরের কথা শুনলে যে ইফাজ নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সেটা কি ইফাজ জানে?

– শুনবো না আমি কোন কথা। আপনি নিতান্তই অভদ্রলোক। আপনার সাথে আমি কথাই বলব না। কি ভয়ংকর মন আপনার? একটুও কি মায়া লাগে নি? একটুও কি কষ্ট হয় নি? মনে করেছেন আপনার হিবারাণীর কথা? আপনি না আমি হীনা অচল! আমাকে ছাড়া আপনার জীবন মূল্যহীন! আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। এই আপনার প্রতিশ্রুতি? এই আপনার ওয়াদা!
আপনি আমাকে গ্রামে রেখে আসুন। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি আর পারছি না ইফু! আপনিহীনা আমি আর পারছি না থাকতে। আপনি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। আপনার একটু ছোঁয়া পেতে আমি ছটফট করি।

আমা কথা শেষ হতেই ইফাজ পিছন দিক থেকেই শক্ত করে জরিয়ে ধরে রাখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। মিনিট পাঁচেক পর আমাকে আগের ন্যায় কোলে তুলে নিচে এনে অন্য ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সজ্জিত পুরো ঘরটি। টেবিলের উপর কদমফুলের ছড়াছড়ি। ইফাজ আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজা আটকে ফেললেন।
ইফাজ টেবিলের উপর থেকে কদমফুল এনে আমার সামনে ধরলেন। অশ্রুশিক্ত নয়নে বলতে লাগলেন,

” তোমাকে পাবার আকাঙ্খায় তৃষ্ণার্ত এই মন,
ছুঁয়ে দিতে চাই সর্বক্ষণ।
তোমার পরশের মাতাল হয়ে,
গভীরে যেতে চাই তোমারই স্পর্শে।
এই প্রিয়লতা,
কিসের এত বাঁধা কিসের এত মান!
মিলনায়তনে কেন এত ব্যবধান।
চলো না ভেঙে ফেলি হাজারও বছরের অভিমান,
অপেক্ষায় প্রহর গুনা সেই সময়টাকে দুমরে-মুচরে ফেলে রাখি একপ্বার্শে!
মিলে যাই সমমান।
সহ্য হচ্ছে না আর এই দুরত্বতা, মিটাতে চাই মনের তৃষ্ণা,
প্রিয়লতা কি বলবে আমায়! অসভ্য নাকি অসহায়!

চলবে………..