অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০২

0
135

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
২য়_পর্ব
~মিহি

“আপনার দোয়া কবুল হইছে। এক্স প্রেমিকের অ্যাক্সিডেন্ট হইছে, খুশি হন!” নিয়নের ত্যাড়া কথা তিরার হৃদয়কে মুহূর্তে ব্যবচ্ছেদ করে ফেললো।

একটা মানুষ কতটা অসহনীয় হতে পারে তা নিয়নকে দেখে উপলব্ধি হলো তিরার। এই মানুষটাকে সে এত ভালোবেসেছিল? এই মানুষটার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে সে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছিল? একটুও কি পরোয়া করে লোকটা এসবের?

-“কাঁদছিস ক্যান তুই? চোখের বারোটা বাজাইছিস। মরছি আমি?” নরম গলায় প্রশ্ন করে নিয়ন।

-“আপনি এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারেন? এই যে আপনার ক্ষণে ক্ষণে রঙবদল! কেন? আমি যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। দয়া করে আর ভালোবাসার নাটক করে আমায় ভাঙতে আসিয়েন না প্লিজ।”

-“গাধার বাচ্চা সবসময় এক লাইন বেশি বুঝিস! কাছে আয় তো একটু।”

-“আমার কথা আপনার কানে যাচ্ছে আদৌ? নিজের মতো করে ভাবতেছেন সব। আপনার ওয়াইফ কোথায়? তাকে ডাকেন। আমি চলে যাচ্ছি।”

-“চৌদ্দটা বউ আমার, একেকদিন একেকটার সাথে থাকি। কোনটাকে ডাকবো বলেন।”

তিরা দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। নিয়নের এ ব্যবহার তার অপরিচিত নয়। তুই করে ডাকার সময়টুকুতে নিয়নের ব্যবহার ছিল তার প্রেমিকের মতো কিন্তু আপনি করে ডাকার মুহূর্তটুকু নিয়ন অপরিচিতের মতো আচরণ করছে। এ অভ্যেসটার সাথে তিরা ভালোভাবেই পরিচিত। রাগে মস্তিষ্কে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে তার কিন্তু কিছু করার নেই। নিয়ন ভুলেও তাকে সোজাভাবে উত্তর দিবে না। তিরা আড়চোখে নিয়নের দিকে তাকায়। কপালে ব্যান্ডেজ, পায়েও অনেকটা আঘাত লেগেছে। ছোট ছোট চুলগুলো ব্যান্ডেজের উপর এসে পড়ছে। জাগতিক মায়া যেন সবটুকু নিয়নের চেহারায় ভর করেছে। তিরা মাথা নাড়ালো। আবারত ভুল করতে যাচ্ছিল সে। বেহায়া মনটা নিয়নের কাছে গিয়ে কপালে আলতো করে হাত বোলানোর স্বপ্ন বুনছিল। এ স্বপ্ন দেখা নিজের সাথে অন্যায়। তিরা চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা মুছে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে মেহবুবা খানম এবং নিয়নের বাবা নাইমুর রাহমান দাঁড়িয়ে। তিরা এসেছিল তার ফুপ্পির সাথে। আশেপাশে তাকে খুঁজে না পেয়ে তিরা তৎক্ষণাৎ একাই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। নাইমুর রাহমান বোধহয় তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিরার সাহস নেই তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলার। নিজেকে প্রচণ্ড দুর্বল অনুভব হচ্ছে তার। মাথা ঘুরছে প্রচণ্ডভাবে। রিকশায় উঠে নিজের বাড়ির ঠিকানা বললো সে, আবারো ফুপ্পির বাড়িতে যাওয়ার দুঃসাহস সে দেখাতে চায় না। রিকশার হুডটা তুলে দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে তিরা। হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে তার।

_______________

২রা আগস্ট, ২০২০||

বিয়েবাড়ির ব্যস্ততায় ফুপ্পির সাথে খেতে বসার সুযোগ পেল না তিরা। মেহবুবা খানম এবং নিজের দাদীর সাথেই খেতে বসলো সে। বিয়েবাড়ি বলে কথা, এক টেবিলে তারা ছাড়াও আরো আত্মীয় রয়েছে। যার বিয়ে হচ্ছে তাকে অল্প চেনে তিরা, তার ফুপ্পির দূর সম্পর্কের ননদ হয়। তিরার পাশেই এক ভদ্রলোক বসেছেন। তিনি মেহবুবা খানমের সাথে গল্প করছেন। প্রসঙ্গক্রমে নিয়নের নাম উঠতেই তিরার কানেও আসে কথাগুলো।

-“মেহবুবা! তোমার ছেলেকে দেখলাম, এত বড় চুল রেখেছে কেন? ছেলে মানুষ এত বড় চুল রাখলে মানুষজন কী বলবে! দেখতেও কী বাজে লাগছে, এসব কি ভদ্র পরিবারের সন্তানদের শোভা পায়? তোমার স্বামী একজন শিক্ষক, ছেলেকে এই শিক্ষা দিয়েছে সে?”

-“আপনি ভুল ভাবছেন চাচা, ও সুন্নতি বাবরি রেখেছে। এটা একান্তই ওর ইচ্ছে…”

-“ইচ্ছে বললেই হলো? তোমরা মানলে কেন? ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে পারলে না? এমন ছেলেকে মেরে সোজা করা উচিত!”

মেহবুবা খানম কিছু বললেন না। তিরা স্পষ্ট দেখলো তার চোখ ছলছল করছে। খেতে বসা একজন মানুষকে আঘাত করে কথা বলার মতো নিকৃষ্ট কাজ কোনো নিকটাত্মীয় করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হলো তিরা।

সমস্যাটা সেখানে থেমে গেলেও পারতো কিন্তু থামলো না। এ বড় চুল নিয়ে ঝামেলাটা আরো বিস্তর হলো। শেষমেশ নিয়নের বাবা নাইমুর রাহমান এবং নিয়ন দুপুরবেলায় চলে গেলেন ও বাড়ি থেকে। তিরার খারাপ লাগলো, কেন খারাপ লাগলো জানে না সে তবে নিয়নের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল তার। একটা মানুষকে কেবলমাত্র তার চুলের জন্য এতটা অপমানিত হতে সে কখনো দেখেনি। তিরার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। সে তখন টু কিংবা থ্রিতে পড়ে সম্ভবত। ফুপার সাথে তেমন সখ্যতা ছিল না তার। সেবারই ফুপার সাথে মেলায় বেড়াতে গিয়ে সখ্যতা হয়। নিয়নও এসেছিল। এক বাইকেই তারা তিনজন ছিল। তিরার মনে আছে সে একটা ডলফিনের গ্যাস বেলুন কিনেছিল। এটা নিয়ে নিয়ন তাকে বেশ বোকা বানিয়েছিল। বলেছিল, গ্যাস বেলুনে সুচ ফোটালে বেলুন বেশিদিন টেকে। তিরা হেসেছিল। সে কি এতই বোকা? নিয়নের সাথে এ সামান্য কথোপকথনটুকুই মনে আছে তার। এর বাইরে তাদের কখনো কথা হয়নি।

তিরা নিজের ফুপ্পির ফোন থেকে নিয়নের বাবার নাম খুঁজে ফেসবুকে সার্চ করলো। সেখান থেকে নিয়নের আইডি পেল। আইডি পাওয়ার পর তিরা কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের মতো বসে রইলো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। রিকোয়েস্ট দিবে? না থাক! নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে শেষমেশ রিকোয়েস্ট দিল তিরা। তার উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। নিয়নের প্রোফাইলের এলোমেলো কথাগুলোতে বারবার নজর বোলাচ্ছে সে। অদ্ভুতভাবে তার হৃদস্পন্দনের গতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে। শেষমেশ নিজের এ উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রিয় সখী নিশাতের শরণাপন্ন হলো সে।

-“নিশু! শোন, একটা কাহিনী হয়েছে।”

-“কী কাহিনী?”

তিরা নিশাতকে বিয়েবাড়ির সমস্ত ঘটনা শুরু থেকে বললো এবং নিয়নকে নিয়ে যে তার মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে তাও বললো।

-“রিকোয়েস্ট দিছিস যখন ধৈর্য ধর। নাহলে মেসেজ দে!”

-“ধূর! মেসেজ দিয়ে কী বলবো?”

তিরা আসলেই জানেনা সে মেসেজে কী বলবে। নিয়নের হয়তো তার কথা মনেও নেই। তিরারই বা কতটুকু মনে আছে? ছোটবেলার সেই বেলুনের ঘটনাটা, আর একবার নিয়নের সাথে কথা হয়েছিল ফুপ্পির বাড়িতেই। সেটাও ছোট থাকতেই! তিরা টিভিতে সিআইডি দেখছিল। নিয়ন তাকে প্রশ্ন করেছিল এটার ফুলফর্ম কী! এটুকু বিষয় নিশ্চয়ই কেউ মনে রাখে না, নিজের মামীর ভাতিজির কথা তো ভুলেও না। এত দূরের সম্পর্ক সে চিনবেও না। তিরা আশা ছেড়ে দিল। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করলে করবে আর নাহলে তিরা এ বিষয়ে আর বাড়তি কিছু ভাববে না সিদ্ধান্ত নিল। এ কেবল কথার কথা, মনে মনে ঠিকই তিরা নিয়নকে নিয়ে ভাবলো। ছেলেটার জন্য মনের এককোণে অনুভূত সূক্ষ্ম যন্ত্রণাটাও উপেক্ষা করতে পারলো না।

___________________

-“আপা এসে গেছি, এখান থেকে কোনদিকে যাবেন?”

-“এখানেই থামান মামা।”

রিকশা থেকে নেমে টাকা পরিশোধ করে বাড়ির দিকে এগোলো তিরা। দরজায় কলিং বেল বাজতেই তিরার মা তারান্নুম বেগম দরজা খুললেন। তিরাকে ভেতরে টেনে এনে সজোরে চড় বসালেন তিরার গালে। তিরা বুঝে উঠতে পারলো না তার সাথে কী হলো।

-“মা, কী হয়েছে?”

-“প্রেম উতলে পড়তেছে তোর? কেন হাসপাতালে গেছিস তুই? তোর তো ঐ ছেলের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই, তাহলে কেন গেছিস ওকে দেখতে?”

-“ফুপ্পি নিয়ে গেছিল।”

-“চিনিস আমাক? আমি তোর মা! আমার পেট থেকে তুই হইছিস নাকি তোর পেট থেকে আমি হইছি? ভূগোল বুঝাও আমাকে? এক থাপ্পড় দিয়ে সব প্রেম বের করে দিব।”

-“আমার মনে কোনো প্রেম নাই যেটা তোমার থাপড়ায়ে বের করা লাগবে। ফুপ্পি নিয়ে গেছিল দেখে আমি গেছি। বিশ্বাস না হলে তোমার ননদকে কল করে শোনো!”

তিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে সজোরে আরেকটা থাপ্পড় আঘাত হানলো। তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা দূরে ছিটকে গেল সে। মায়ের অগ্নিদৃষ্টির সামনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। বড়সড় ঝড়ের আভাস পাচ্ছে সে। নির্ঘাত আজ একটা তুফান আসবে এ বাড়িতে।

চলবে…