অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-১৭+১৮

0
114

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১৭তম_পর্ব
~মিহি

আয়নার দিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে তিরা। এখন মনে হচ্ছে তার প্রতিচ্ছবিও বোধহয় তাকে কিছু বলার জন্য উৎকণ্ঠা। তিরা আয়নায় তাকিয়ে নিজেই আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো।

-” আয়নার ভেতরের জগতটা নাকি সম্পূরক হয় তবে আয়নার জগতে তিরা কি বড্ড সুখী? সে কি তার নিয়নকে পেয়েছে তার জগতে?”

কথাটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিরা। একটু ভালো থাকতে শুরু করেছিল সে, কেন দেখা হলো নিয়নের সাথে? তিনটা বছর লেগেছিল তিরার মুভ অন করতে, এক মুহুর্তের দেখাতে সব নষ্ট হয়ে গেল। তিরা আবারো দুর্বল হয়ে পড়লো। তিরার মাঝেমধ্যে সত্যিই মনে হয় নিয়ন যদি সত্যিই বিয়ে করে তিরা ভালো থাকতে পারবে? শেষবার যখন দেখা হলো তিরা রাগের মাথায় নিয়নকে বলেছিল তার ওয়াইফের কাছে যেতে কিন্তু একসময় তো কথাটা সত্যিই হবে। নিয়ন তো কখনো ফিরবে না তার কাছে। মাঝেমধ্যে নিয়ন তিরার কাছে ফেরার যে নাটকটা করেন এটা কেবল ক্ষণিকের। তিরা কখনোই নিয়নকে মেনে নিতে পারবে না আর না পারবে তাকে পুরোপুরিই ভুলে যেতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিতেই লক্ষ করলো নিষাদের রিপ্লাই এসেছে।

-“আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি, সো গিল্টি ফিল করার কিছু নেই। আর আপনার ডাক্তার কনসাল্ট করা উচিত, আমাকে পছন্দ না হলে অন্য ডাক্তার দেখান।”

নিষাদের এই টেক্সটে তিরার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠলো। তিরা আইডির নামটা ভালোভাবে খেয়াল করলো,”নিষাদ আরিফিন অর্ণব”। অর্ণব নামটা সুন্দর, তিরার ভালো লাগলো নামটা।

-“আপনার অর্ণব নামটা সুন্দর।”

-“ধন্যবাদ, আপু রেখেছিল নামটা।”

তিরা আর কী কথা বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। তার ইচ্ছে করছে কথা আগাতে কিন্তু বলার কিছু পাচ্ছে না।

-“আপনার অসুবিধে না থাকলে আমরা আরেকদিন দেখা করি কোথাও? আসলে গতকালের ব্যবহার নিয়ে আমি খুব গিল্টি এখনো।”

-“শিওর। আজ বিকালে আমি ফ্রি, আপনি কোথায় দেখা করবেন জানায়েন আমাকে।”

তিরা ‘আচ্ছা’ লিখে ফোনটা রাখলো। নিয়নের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। অবাস্তব জিনিসের মোহে ছুটে লাভ নেই, নিজের কথা ভাবতে হবে একটু। তিরার হঠাৎ মনে হলো নিশাত তার উপর রেগে আছে। নিশাতকে কল করলো তিরা। সাথে সাথেই রিসিভ করলো নিশাত।

-“বল, অবশেষে মনে পড়লো যে আমি আছি দুনিয়াতে।”

-“দোস্ত! স্যরি রে।”

-“তুই ভাইয়ার সাথে যে ব্যবহার করছিস…”

-“উনি তো আমাকে মাফ করে দিছে।”

-“কখন?”

-“একটু আগে।”

-“উহুম..উহুম….”

-“আরে ধূর!”

-“আচ্ছা আমি নানিবাড়িতে আসছি, নেটওয়ার্ক নাই। রাখ পরে কথা হবে।”

তিরা কিছু বলার আগেই কল ড্রপ হলো। তিরা ভেবেছিল নিষাদকে নিয়ে অর্ণবের সাথে দেখা করতে যাবে কিন্তু নিশাত নেই তার মানে একা দেখা করতে যেতে হবে। তিরা খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়লো। পরক্ষণেই মনে হলো তার যাওয়া উচিত।

___________________________________

-“দুঃখিত লেট করে ফেললাম।”

অর্ণবের ডাকে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো তিরা। নীলরঙা শার্ট গায়ে জড়ানো। তিরা ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। পলক লজ্জিতবোধ করে চোখ সরিয়ে নিল।

-“আপনি কি আমার ভয়ে নীল শার্ট পড়ে এসেছেন?”

-“না না! তা কেন হবে?”

-“আচ্ছা বুঝলাম।”

-“এখন বলো তোমার সমস্যা কী? ধীরেসুস্থে বলো।”

-“আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আপনাকে দেখা করতে বলেছি শুধু একটু ভালোমতো স্যরি বলার জন্য।”

-“উমম…রিলেশনশীপ ইস্যু আসলে মেয়েরা সহজে শেয়ার করতে পারেনা। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।”

-“নিশাত বলেছে আপনাকে এসব?”

-“না, গেস করলাম। নিজের লাইফ এক্সপিরিয়েন্স থেকে এটুকু আন্দাজ করা যায়।”

-“মানে?”

-“আপনার লাইফেও কেউ ছিল?”

-“হুম, ছিল একজন। তবে আমার ভালোবাসার মাত্রাটা বোধহয় বেশি ছিল সেজন্য কিছু টেকেনি।”

-“স্যরি…”

-“স্যরি বলার কিছু নেই। আমি শুধু তোমার প্রবলেমটা সলভ করতে চাই।”

-“আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম, রিলেটিভ হয় আমার। দেড় বছর সব ঠিকঠাক ছিল। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশীপ, তো মাঝখানে একবার বাড়িতে জানাজানি হলে মোটামুটি কথা অফ ছিল তবে আমাদের মধ্যে সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে হঠাৎ ওর ব্যবহার পাল্টে যায়। কোন কারণ ছাড়াই ব্লক করে আমাকে।”

-“কিছুই বলেনি?”

-“বলেছিল সময় হলে বলবে। নিশুকে নাকি বলেছিল আমার স্কুললাইফের ক্রাশকে আমি এখনো ভালোবাসি। এটা আমি নিয়নকে জ্বালানোর জন্য বলেছিলাম যে আমার স্কুললাইফে একজন ক্রাশ ছিল। বিষয়টা এতদূর যাবে আমি ভাবিনি। আমাকে অনেক আগে একজন টেক্সট করেছিল ওকে চেনে এরকম বলে। আমি তখন নিয়নের সাথে কথা বলে ব্লক করেছিলাম মেয়েটাকে। তবে নিয়নের ব্যবহারে আমি অনেক শকড ছিলাম। একরকম বাধ্য হয়েই মেয়েটাকে আনব্লক করে নক দিলে সে বলে, সে নিয়নের এক্স ওয়াইফ।”

-“মেয়েটা যে সত্যি বলেছে তার প্রমাণ আছে?”

-“আমাকে নিয়নের কিছু ছবি দিয়েছিল যেগুলো নিয়নের আইডিতেই ছিল তবে ছবিগুলো সম্পর্কে ডিটেলস বলেছিল। এ থেকে এটা বোঝার উপায় নেই যে সে নিয়নের এক্স ওয়াইফ ছিল।”

-“আচ্ছা তারপর?”

-“নিয়নের কাছে আমার আইডির পাসওয়ার্ড ছিল।সে দেখেছিল এসব। ওর ধারণা হয় আমি ওকে অবিশ্বাস করেছি। এমনিতেই সম্পর্ক তো শেষের দিকেই, এসবের পর আর কিছুই বাকি ছিল না। তবে আমি এসব থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেও পারছি না। হয়তো তিন-চারমাস সব ঠিক থাকে, তারপর নিয়নের সাথে কথা বলার জন্য পাগল পাগল অনুভব হয়। মনের কথা শুনে যখন নিয়নকে টেক্সট করে বসি, নিয়ন কখনো বলেনা আসল সত্যিটা কী। কেন সে আমাকে ছেড়ে গেছে এখনো জানিই না আমি! নিয়ন কিছুক্ষণ ভালো করে কথা বলে তো আবার এমন ভাব করে যেন চেনেই না। আমার মনে হয় ওর লাইফে কেউ আছে কিন্তু যখন ও আমার পাথে ভালোবাসা কথা বলে ইভেন হুটহাট ‘আই লাভ ইউ’ বলে ওখন সব ধারণা পাল্টে যায় কিন্তু আমি ওর এই কথার উত্তর দিতে পারিনা। মন সায় দেয় না ওকে মেনে নিতে আর না পুরোদমে ভুলতে পারি।”

-“টক্সিসিটি কী জানো? কাউকে ছেড়ে না দিয়ে ধরে রেখে কষ্ট দেওয়া। নিয়ন সেটাই করছে। তুমি তার প্রতি যে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা দেখাও তার সদ্ব্যবহার সে করছে।”

-“সবচেয়ে কঠিন কাজ কী জানেন? সত্য জেনেও তা মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য নিজের মনের সাথে প্রতিনিয়ত যে যুদ্ধটা করতে হয়!”

তিরা মাথা নিচু করলো। চোখ ছলছল করছে তার। অর্ণব রুমাল বাড়িয়ে দিল। তিরা রুমালটা নিয়ে চোখ মুছলো। অর্ণব ততক্ষণে সেখান থেকে উঠে কফি অর্ডার করতে গিয়েছে। তিরা সামনে অর্ণবকে না দেখে স্বস্তিবোধ করলো। কারো সামনে কান্নাকাটি করতে সে বরাবরই অস্বস্তিবোধ করে, এটা তো পাবলিক প্লেস। তিরার মনে আছে ছোটবেলায় তার মা তার এক বান্ধবীর সামনে তাকে বকেছিল বলে সে কান্না করেছিল তবে বান্ধবীকে লুকিয়ে। তার বান্ধবী যেখানেই আসতো, সে সেখান থেকে সরে আরেক জায়গায় গিয়ে কান্না করতো। ছোটবেলার কথা মনে পড়তেই তিরার মন আগের চেয়ে খানিকটা ভালো হলো। তখন সময়টা ভালো ছিল তার। পড়াশোনায় ভালো ছিল, সবার চোখে ভালো ছিল সে। জীবনে নিয়ন নামক মানুষটার উপস্থিতি ছিল না, পারিবারিক অশান্তি ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিরা।

-“নিন কফি।”

-“আমি কফি খাইনা।”

-“ওপস স্যরি! আমার শুনে নেওয়া উচিত ছিল। দাঁড়ান আমি চেঞ্জ করে জুস আনছি। জুস খাবেন?”

-“সমস্যা নেই, কফি-ই দিন।”

-“কিন্তু আপনি তো কফি খান না।”

-“মানুষ মনের কথা শুনে কয়দিনই বা চলতে পারে? দিনশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে চলাটাই তো পার্মানেন্ট, অভ্যেস করে নিচ্ছি।”

তিরা কফির মগটা নিজের দিকে আনতে গেলে সরিয়ে নিল অর্ণব। তিরা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালে সে বললো,”নিজের প্রতি বিশ্বাস সঠিক হলে সবসময় যুদ্ধ করে চলতে হয় না। ইউ জাস্ট নিড আ রাইট ডিসিশন ইন লাইফ!”

চলবে…

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১৮তম_পর্ব
~মিহি

তিরার রাবিতে ভালো পজিশন এলো, পাশাপাশি ভালো একটা সাবজেক্টও। বাবা-মাকে ছেড়ে একদিনও না থাকতে পারা তিরার সামনেই একা থাকার সময়গুলো অপেক্ষা করছে। রেজাল্ট নিয়ে তিরার উচ্ছ্বাস নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য যে সবসময়ই স্বপ্ন দেখেছে, সে-ই মেয়েটাই পরীক্ষার সময়টুকুতে দোয়া করেছে ঢাবিতে যেন তার পজিশন না আসে। ঢাকায় থাকা তিরার পক্ষে সম্ভব হতো না। নিয়নের সাথে ভুলেও কখনো মুখোমুখি হওয়ার যন্ত্রণায় সে পড়তে চায় না। এ যন্ত্রণায় সে পড়েছিল বছর দুয়েক আগে। কলেজ থেকে একটা কনটেস্টের জন্য ঢাকা গিয়েছিল তার গ্রুপ। ফেরার পথে মারাত্মক জ্যাম। বাসে জানালার ধারের সীটটা বরাদ্দ ছিল তার জন্য। জানালায় হেলান দিয়ে বাইরে তাকাতেই তিরার চোখ পড়লো বাইকে থাকা নিয়নের দিকে। তিরা চোখ কচলে আবার তাকালো। একবার ভাবলো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে বোধহয়। এমন হ্যালুসিনেশন প্রায়ই হতো তিরার। পাশে নিশু কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। তিরা আলতো করে ধাক্কা দিল তাকে। নিশাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ মেলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ফেলল। তিরা জানালার বাইরে ইশারা করতেই নিশাত সেদিকে তাকালো।

-“তুইও কি সেটাই দেখতেছিস যেটা আমি দেখতেছি?” নিশাত ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো।

-“হুম।”

তিরা কিছু না বলে হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ মুহূর্তটুকু কতটা যন্ত্রণার ছিল তার তিরা আজও পরিমাপ করতে পারেনি।

অতীতের চিন্তাগুলো থেকে নিজেকে বের করে অর্ণবকে টেক্সট করলো তিরা।

-“রাজশাহী যাচ্ছি পার্মানেন্টলি!”

-“বিয়ে করতেছো? ছেলে রাজশাহীর?”

-“নাহ, রাবিতে চান্স পেয়েছি।”

-“গ্রেট! তো মিস.রাগকন্যা, বেস্ট অফ লাক। নতুন শহর, নতুন নতুন মানুষ। ভালো লাগবে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও।”

-“আপনি কি উড়ে উড়ে রাজশাহী গিয়ে হেল্প করে আসবেন?”

-“আসতেই পারি। আমার পাখা আছে, তুমি জানোনা?”

-“না তো!”

‘না তো’ লেখার সময় তিরার মুখটা মলিন হয়ে এলো। নিয়নের সাথে কথা বলার সময় তিরা একবার নমনীয় কণ্ঠে ‘না তো’ বলেছিল। না জানি কোন মায়ায় পড়েছিল নিয়ন, সেই ‘না তো’ রেকর্ড করে ফোনের রিংটোন রেখেছিল। নিয়নের পি.সির ওয়ালপেপারেও তিরার ছবি দেওয়া ছিল। সবকিছু কত দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়! অর্ণবের মেসেজগুলো আর দেখা হলো না তিরার। ফোনটা পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো তিরা।

-“তিরা ঘুমিয়েছো?” তারান্নুম বেগম ডাকলেন।

-“না আম্মু বলো।” তিরা উঠে বসলো।

-“মন খারাপ?”

-“না।”

-“তিরা, বাবা-মা সবসময় চায় তাদের সন্তান ভালো থাকুক, নিজের ভালো বুঝুক। এখন তোমার সে বয়স হয়েছে। এখন তুমি যাকে নির্ধারণ করবে, আমরা মেনে নিব। আমরা বিশ্বাস করি তুমি এখন ইনাফ ম্যাচিউর নিজেকে নিয়ে তবে এসব ভাবতে গিয়ে টেনশনে পড়ো না। ভার্সিটি লাইফ সামনে, জীবনটা উপভোগ করো।”

-“জ্বী আম্মু।”

তারান্নুম বেগম তিরার মাথায় হাত বোলালেন, কপালে চুমু খেয়ে অশ্রুসজল চোখখানা লুকিয়ে খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে গেলেন। তিরা অনুভব করলো তার বাবা মা তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে অথচ সে অন্ধের মতো নিয়নকে বিশ্বাস করে বাবা মায়ের প্রতি অভিমান পুষে রেখেছিল। তিরা বিছানা থেকে উঠে ড্রয়ার খুললো। ড্রয়ারে নিয়নের দেওয়া আংটিটা যেটা সে হারিয়ে ফেলেছিল। এ আংটিটা তিরা ব্যাগ থেকেই খুঁজে পেয়েছিল তাদের ব্রেকআপের এক সপ্তাহ পর। কী অদ্ভুত অদৃষ্টের পরিহাস! সব শেষ হওয়ার পর পুরনো স্মৃতি ফেরার বিষাদ বড্ড ঘাতক।

অর্ণবের মেসেজ ইগনোর করেছে মনে পড়তেই তিরা ফোনের দিকে ধ্যান দিল। স্ক্রিনে সাতটা ম্যাসেজের নোটিফিকেশন, অর্ণব এতগুলো টেক্সট করেছে তাকে?

-“হারাইছো? পাখা লাগিয়ে খুঁজতে বের হবো?”

শেষ টেক্সটটা দেখে খানিকটা হাসলো তিরা। ডাক্তাররা নাকি গম্ভীর হয়! এই লোকটা এতটা অমায়িক কেন?

-“হারাইনি।”

-“তো কি প্রাক্তনের কল্পনায় হারিয়েছিলে?”

-“নাহ! আপনি হাসপাতালে না?”

-“না, আমার অফ ডে ছিল। কেন? হাসপাতালে থাকলে রোগী হয়ে আসতে?”

-“আমার বয়েই গেছে!”

-“আচ্ছা আচ্ছা, থাকো আমার একটু কাজ আছে।”

তিরা বিদায় জানিয়ে অর্ণবের প্রোফাইল ঘাটতে লাগলো। পোস্ট দুয়েকটা দেখে ফোন রেখে দিল। অর্ণব খুব অদ্ভুতভাবে তিরার ভাবনায় দখল বসিয়েছে। এত অকস্মাৎ কোনো ছেলে তার চিন্তার জগতে ঢুকতে পারেনি। তিরার বেখেয়ালি মন আবার বলছে, এবার মুভ অনটা করে ফেল। তিরা শুনতে পাচ্ছে সে কথা তবে আদৌ কি তা সম্ভব? তার এবং অর্ণবের এইজ গ্যাপ কত হতে পারে? সাত, আট নাকি নয়? স্কুললাইফে তিরার এক ম্যাম বলেছিল, পার্ফেক্ট রিলেশনশীপ হয় কমপক্ষে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের এইজ গ্যাপে। তিরা অবশ্য তখন এ কথা জেনে খুশি হয়েছিল কারণ তখন সে নিয়নের প্রেমে মত্ত ছিল। তাদের এইজ গ্যাপ পাঁচ ছিল অথচ বোঝাপড়ার মামলায় দুজনেই খুব বাজেভাবে ফেইল মেরে এখন তিরার জীবনটা অলমোস্ট নরক হতে হতে হয়নি। এখন এসব থিওরিতে আর বিশ্বাস করেনা তিরা। নিজের ভালো থাকা, ভালো লাগা, বোঝাপড়া, কমফোর্ট জোন কোনো থিওরির উপর নির্ভর করে না। কে কার সাথে ভালো থাকতে পারে এটা এইজ গ্যাপ কিংবা অন্য কোনো টার্ম নির্ধারণ করতে পারে না। তাহসানের গানটা তিরার কানে বেজে উঠে ক্ষীণ স্বরে, “চলো ভেঙে দেই সে দেয়াল, সমাজের ঠুনকো খেয়াল….”

________________________

পরের চারটে দিন তিরা ঘর ছেড়ে বেরোলো না। স্কুল কলেজের বন্ধুরা একসাথে হয়ে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে, স্যাররা স্টুডেন্টদের সফলতার কেক কাটছেন। সবকিছুর মাঝে তিরার অনুপস্থিতি কোনো আহামরি বিষয় না। তিরা না যাওয়ায় নিশাতেরও এসব নিয়ে মাথাব্যথা কম। তবে তিরা ঘরে বসে দেখে একেকজনের ছবি। জীবনের রঙিন মুহূর্তগুলো অতীব করছে সবাই। তিরার রেজাল্টটাও খারাপ নয় তবে সে এখন কারো মুখোমুখি হতে চায় না। ভেবেছিল আজও বাড়িতেই থাকবে কিন্তু সকাল সকাল নিশাত ফোন করে আর্জেন্টলি তার বাড়িতে যেতে বললো। তিরা কারণ জিজ্ঞাসা করার সময়টুকু পেল না। চটজলদি তৈরি হয়ে নিশাতের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোলো সে।

নিশাতের বাড়িতে পৌঁছে তিরার কেবলমাত্র রাগটাই হলো। নিশাতের বোরড ফিল হচ্ছিল তাই সে এমন হন্তদন্ত হয়ে তিরাকে ডেকেছে। তিরার ইচ্ছে করছে দেয়ালের সাথে নিশাতের মাথাটা বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে। কী করে এমন একটা বান্ধবী যে তার কপালে জুটেছিল আল্লাহ ভালো জানে। নিশাত তিরাকে নিয়ে নিজের ঘরে বসলো। বসামাত্র তিরার ফোনে নোটিফিকেশনের সাউন্ড বেজে উঠলো। তিরা ফোন বের করে দেখলো অর্ণব টেক্সট করেছে,”কোথায় তুমি?”

মেসেজের শব্দে নিশাত ইতোমধ্যে বাঁকা চোখে তাকিয়েছে। তিরা তা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারলো না।

-“কী রে! তোকে আমি ছাড়া কে টেক্সট করলো?”

-“অর্ণব ভাইয়া।”

-“এহ ওয়েট! নিষাদ ভাইয়া? ভাইয়া তোকে টেক্সট করেছে? কাহিনী কী? বলিসনি তো কিছু, কবে থেকে এসব?”

-“আরে যেমন কিছু না। উনি এজ আ ডক্টর আমার খোঁজ নিলেন জাস্ট, জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় আছি।”

-“তাই না? আচ্ছা ঠিক আছে, ভাইয়াকে বল তুই আমার এখানে। সাথে এটাও বল তোর ভাইয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে, উনি যেন এখনি এখানে আসে।”

-“আজব আমি এসব কেন বলতে যাবো? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

-“বলে দেখ। ভাইয়া যদি না আসে তাহলে বুঝবো তোদের মধ্যে কোনো কেমিস্ট্রি নাই আর যদি….”

নিশাতের জেদের চক্করে তিরা শেষমেশ বাধ্য হলো অর্ণবকে দেখা করার কথা বলতে। তিরা ভেবেছিল অর্ণব এসবে মোটেও গুরুত্ব দিবে না। সে নিশ্চিত মজা ভেবে উড়িয়ে দিবে বিষয়টা। এটা ভেবেই ফোন রেখে নিশাতের সাথে গল্পে মত্ত হলো তিরা। আধঘণ্টা বাদে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তিরার হৃদস্পন্দনের বেড়ে গেল আচমকাই। অর্ণব সত্যিই এসেছে কি? নাহ! বোধহয় অন্যকেউ। তবুও তিরার মনে ক্ষীণ আশা জমলো বোধহয় অর্ণব এসেছে। ধীর পায়ে সে এগোলো দরজাটা খুলতে।

চলবে…