আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-০৭

0
631

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭

রুপ্সিতা আলমারির উপর থেকে টুল দিয়ে উঠে আলিফের ট্রলি নিচে নামিয়ে একটা শাড়ি পড়ে যাওয়ার জন্য আলাদা রেখে নিজের সব জামাকাপড় গুছিয়ে নেয়।
রাত নয়টার দিকে আলিফ ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় খাটের পাশে ট্রলি দেখে বুঝলো রুপ্সিতাই নামিয়েছে।এই দু’দিনে জানা হয়ে গেছে এই মেয়ে কি করতে পারে আর না পারে।তাই এসবে মাথা না ঘামিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ায়।রুপ্সিতা শাশুড়ীকে রাতের রান্নায় সাহায্য করেছে।এতে রান্না করাটাও দেখে নিলো।এভাবে কয়েকদিন দেখলে আস্তে আস্তে রান্না শিখে যাবে।
রুপ্সিতার শশুর পুরোনো কোন বন্ধুর সাথে দেখা করে বাসায় ফিরেছেন।এখন আর চাকরি করতে হয়না উনাকে।দুই ছেলেই এখন কর্মীক।

রাতের খাবার শেষ করে আলিফ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।জামাকাপড় কালকেই গোছানো যাবে।রুপ্সিতা রুমে এসেই শুয়ে পড়েছে।দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হলোনা।

পরেরদিন রুপ্সিতা আলিফ দুজনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।বাসে উঠে রুপ্সিতা জানালার পাশে বসেছে।জার্নিটা খুব ভালোই কেটেছে।রুপ্সিতার বমি করার অভ্যেস নেই।দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা জার্নির পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছায় দুজনে।
গাড়ি থেকে নেমে আলিফ একহাতে ট্টলি অন্যহাতে রুপ্সিতার হাত মুঠো করে ধরে।
শক্তপোক্ত হাতের বাধনে নিজের হাত বাধা পড়তেই রুপ্সিতা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে হাত দুটোর দিকে।আলিফের এতদিকে খেয়াল নেই।আলিফ রুপ্সিতার হাত শক্ত করে ধরে রাখার কারণ রুপ্সিতা এখানে কিছুই চেনেনা।
একটু সামনে গিয়েই সিএনজি ভাড়া করে নিজেদের গন্তব্যে পাড়ি জমায়।

ঘন্টাখানেক পর ওরা দুজন আলিফের মামাবাড়িতে এসে পৌঁছায়।সবাই বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলো।মামি এগিয়ে এসে রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরেন।রুপ্সিতা ও জড়িয়ে ধরে সালাম দেয়।
আলিফ সোফায় গা এলিয়ে বসে।আলিফের বড়মামার দুই মেয়ে এক ছেলে।বড় মেয়ে বিবাহিত।ছেলে আর ছোট মেয়ে বাকি আছে।ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরেই ঘুরে বেড়ায়।ছোট মেয়ে মাহি এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে।একটু গায়ে ঢলে পড়া স্বভাবের।সেটা হোক ছেলে হোক মেয়ে।একেকজনের এরকম গায়ে গা ঘেষে থাকার অভ্যেস আছে।
মাহি দৌঁড়ে এসে আলিফের পাশে বসে বলল,কেমন আছো ভাইয়া?
আলিফ হাসিমুখে জবাব দিলো,ভালো আছি আমি।তুই কেমন আছিস?

মাহি মুখে হাসি টেনে বলে,ভালো ছিলাম এখন তোমাকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেছি।

মাহির মা রুপ্সিতার সাথে মাহিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল আলিফ আর রুপ্সিতাকে তাদের থাকার ঘর দেখিয়ে দিতে।
মাহি ওদেরকে আসতে বলে সামনে এগিয়ে গেলো।রুপ্সিতা চারপাশ দেখতে দেখতে হাটছে।আলিফ ওর হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল,ঠিক করে হাটো।এখানে সাতদিন থাকবে সো বাড়িটা পরেও দেখতে পাবে।এখন দেখতে গিয়ে পড়ে হাড়গোড় ভাঙলে হসপিটালে বসে থাকতে হবে তোমার আর ঘোরা লাগবেনা।

রুপ্সিতা ভেঙচি কেটে আলিফের সাথে হাটা ধরলো।ওদেরকে রুম দেখিয়ে দিয়ে মাহি বেরিয়ে গেলো।রুপ্সিতা ট্রলি থেকে একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।পরনের শাড়ীটা চেঞ্জ করা দরকার।রুপ্সিতা বেরিয়ে আসতেই আলিফ ঢুকলো ওয়াশরুমে।
আলিফ বেরিয়ে দেখে টেবিলের উপর নাস্তা রাখা।রুপ্সিতা বসে বসে কিছু একটা ভাবছে।

মাত্রই মাহি নাস্তার ট্রে রেখে গেলো।রুপ্সিতার সাথে কথাও বলল না।কেমন টেরা চোখে তাকিয়ে চলে গেলো।রুপ্সিতা ভাবছে মেয়েটার আবার কি হলো?দিব্যিতো উনার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে।ধুর বাবা আমার এসব ভেবে কাজ নেই।
রুপ্সিতার ভাবনার মাঝেই আলিফ বলে উঠলো,কি ভাবছো রুপ্সি?

রুপ্সিতার হুস ফিরতেই ভাবনাটাকে সাইডে রেখে বলল,নাহ!কিছুনা।
আমার ক্ষিধা পেয়েছে চলুন নাস্তা করি।
আলিফ বলল,ক্ষিধা লেগেছে বসে আছো কেন?খাওয়া শুরু করে দিলেই পারতে।
তারপর দুজনেই নাস্তা সেরে একটা ঘুম দিলো।পাঁচ ঘন্টার জার্নি কি কম কথা নাকি?ক্লান্ত থাকায় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো।আজ আর এখানে কাঁথা না থাকায় রুপ্সিতা এমনিতেই শুয়ে পড়েছে।হয়তো উনাদের কাঁথা রাখতে মনে নেই।নতুন বউ উনাদের কাছে কাঁথার জন্য যেতেও লজ্জা করছে।

রাত আটটায় রুপ্সিতার ঘুম ভেঙে গেলো।জামা কাপড় সব কুচকে উলটপালট হয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।ভাগ্যিস আলিফ জেগে নেই তাহলে ওকে এই উদ্ভট অবস্থায় দেখে কি না কি ভাবতো?
কিন্তু রুপ্সিতা বুঝতে পারছেনা হয়তো এই অবস্থায় রুপ্সিতাকে দেখলে আলিফ কয়েকটা হার্টবিট মিস করে যেতো।
নিজের কুচকানো জামা টেনেটুনে ঠিক করে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হলো।মাথার চুলগুলো হাত খোঁপা করে তাতে একটা কাঠি গুঁজে দিয়ে বারান্দায় পা বাড়ালো রুপ্সিতা।এখান থেকে দুরের উঁচুনিচু রাস্তাগুলো দেখা যাচ্ছে।সবকিছু কেমন ছোট ছোট মনে হচ্ছে।আসলে আলিফের মামার বাড়িটা উঁচু স্থানে হওয়ায় সবকিছুই ছোট ছোট মনে হচ্ছে।এখানে এসে রুপ্সিতার মন খুশিতে ভরে গেছে।ভাবতেই ভালো লাগছে ওরা এখানে সাতদিন থাকবে।হঠাৎই গান গাইতে মন চাইলো তাই দেরি না করে গান ধরলো।

“আমার একলা মনের আকাশ রাখি তোমার জন্য খুলে”
“আমার অবুজ সবুজ স্বপ্নগুলো সাজাই ফুলে ফুলে”(2)
“আমার সকল চাওয়া আর সকল পাওয়া,বুকে বয়ে যাওয়া সুখের হাওয়া তুমি নিতেই পারো”

“তোমার ইচ্ছে হলে মনটা শুধুই আমায় দিতে পারো”(2)

আলিফ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে।গানটা শুনে মায়ার কথা মনে পড়ে গেলো।মায়া প্রায় সময় গানটা গাইতো।যতই মায়ার স্মৃতিগুলোকে মনের কোনে চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে ততই তারা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে।
লম্বা দুটো শ্বাস নিয়ে আলিফ বলল,গানটা কি তোমার খুব পছন্দের?

রুপ্সিতা চমকে ওঠে পেছনে ঘুরে তাকায়।আলিফতো ঘুমিয়ে ছিলো উঠলো কখন??
রুপ্সিতাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলিফ ক্ষীণ স্বরে বলল,কি হলো?উত্তর দিচ্ছো না যে?

রুপ্সিতা আলিফের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দূরের পথেরদিকে দৃষ্টি মেলে বলল,নাহ!এমনি মন চাইলো তাই গাইলাম।

ওহ বলে আলিফও বুকে হাত ভাজ করে সামনের দিকে তাকালো।
কিছুক্ষণ পর বলল,কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে?

রুপ্সিতা হাতের আঙ্গুলে হিসাব করছে আর একটা করে জায়গার নাম বলছে।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত,চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির,মহামায়া লেক,সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক,গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত,বাঁশবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকত,কুমিরাঘাট সীতাকুণ্ড,চেরাগি পাহাড়,ছাগলকান্দা ঝর্ণা,নজরুল স্কয়ার,কুমারীকুন্ড,জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর শেষ।এই জায়গা গুলোতেই ঘুরবো।

আলিফ কোমরে হাত দিয়ে বলল,তুমি বাদ রেখেছো কোনটা?তুমিতো চট্টগ্রামের সব দর্শনীয় জায়গার নামই বলে ফেলেছো।এত।নাম তুমি কিভাবে জানো?

রুপ্সিতা হাত উল্টে বলল,গুগল আছে কি করতে?তার কাছ থেকেই জেনেছি।

আলিফ বলল,তুমি সাতদিন কেন একমাস থাকলেও এই জায়গা গুলো ঘুরতে পারবেনা।এখান থেকে একেকটা জায়গা কতদূর তুমি জানো?
একজায়গায় গিয়ে ফেরত আসলে এতই টায়ার্ড হবা যে পরেরদিন আর বের হওয়ার ইচ্ছা থাকবেনা।
রুপ্সিতা মুখটা পানশে করে বলল,তাহলে আমরা এখানে দুইমাস থাকবো।তাহলেইতো সব ঘুরতে পারবো।

আলিফ তাচ্ছিল্য করে বলল,হ্যাঁ সাতদিন থাকতে পারো কিনা সেই চিন্তা করো।নাকি কালই বস ফোন দিয়ে বলে আলিফ এক্ষুণি অফিসে আসো।
রুপ্সিতা রেগে গিয়ে বলল,কি কচুর বস আপনার?বেটাকে সামনে পেলে দুইটা চটকানি মারতাম।মানুষ নতুন নতুন বিয়ে করে কত জায়গায় ঘুরে।আর আমি একজায়গায় আসতে না আসতেই চলে যাওয়ার চিন্তা করতে হচ্ছে।
রুপ্সিতার বলার ভঙ্গি দেখে আলিফ শব্দ করে হেসে দিলো।

রুপ্সিতা রেগে বলল,একদম হাসবেন না।তাহলে আপনার চুল টেনে সব ছিড়ে ফেলবো।
আলিফ হাসি থামিয়ে বলল,তাহলে সবাই তোমাকে বলবে ঐ দেখো আলিফ টাকলার বউ যাচ্ছে।আমার কিছুই হবেনা।

রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়তেই দুজনে নিচে গেলো।আলিফ আর রুপ্সিতা যখন এসেছিলো তখন আলিফের মামা বাসায় ছিলেন না।এখন ডাইনিং এ আছেন।আলিফ রুপ্সিতাকে খোঁচা দিয়ে বলল,সালাম করো মামাকে।আর হ্যাঁ বেশি কথা বলা বা হাসাহাসি করবেনা।মামা এসব পছন্দ করেনা।

রুপ্সিতা সালাম দিলে আলিফের মামা উত্তর নিয়ে আলিফকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করেছেন।আলিফ ও ভালো আছি আপনি কেমন আছেন মামা বলে কথার পিঠে আর একটা কথাও বলেনি।
সবাই চুপচাপ খাচ্ছে কেউ কথা বলছেনা।রুপ্সিতা আলিফের মামাকে আগাগোড়া স্ক্যান করছে।উনার মাথায় চুল নেই টাকলা যাকে বলে আরকি।আলিফ রুপ্সিতার দিকে আড়চোখে বারকয়েক তাকিয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝলো রুপ্সিতা মামার মাথার দিকে তাকাচ্ছে বারবার।

হঠাৎ আলিফের বলা,সবাই তোমাকে বলবে ঐ দেখো আলিফ টাকলার বউ যাচ্ছে।কথাটা মনে করে রুপ্সিতা উচ্চস্বরে হাসতে যাবে তার আগেই আলিফ ওর মুখ চেপে ধরেছে।সবার দৃষ্টি খাবারের দিকে কেউ এদিকে তাকাচ্ছেনা।
রুপ্সিতার মুখেরদিকে তাকিয়েই আলিফ বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে এখন কিছু একটা গন্ডগোল করবে তাই মুখ চেপে ধরে রেখেছে।

রুপ্সিতার শ্বাস আটকে আসছে।আলিফের হাতটা মুখ থেকে অনেক কষ্টে সরিয়ে পানি খেয়ে রুমে চলে এসেছে।রড় বড় শ্বাস নিচ্ছে রুপ্সিতা।কিছুক্ষণ পর আলিফ ও রুমে চলে আসে।
তোমাকে বলেছিলাম না মামার সামনে বেশি কথা বলবানা আর হাসবাও না।
রুপ্সিতা চোখ গরম করে বলল,তাই বলে এভাবে মুখ চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলবেন?আর একটু হলেতো আমি ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যেতাম।কারো মুখ চেপে ধরলে নাক সহ ধরেন কেন?এতে মানুষ শ্বাস নিতে পারে?ভবিষ্যতে মুখ চেপে ধরার আগে নাক বাদ দিয়ে ধরবেন।জীবনে কারো মুখ চেপে ধরেন নি নাকি?

আলিফ জবাব দেওয়ার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো।রুপ্সিতা ভাবছে ওর বস ফোন দিয়েছে।অগ্নিমুখ করে আলিফের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরিফ কল দিয়েছে সানি নাকি ওদের সাথে কথা বলবে।আলিফ মোবাইল রুপ্সিতার সামনে নিয়ে দুজনেই সানির সাথে কথা বলে।মোবাইলের স্ক্রিনে সানির মুখ দেখতেই রুপ্সিতার সব রাগ উবে গেলো।আলিফ ভাবছে মেয়ে মানুষ এত রাগ কিভাবে করে?
সবশেষে ইরিন সানিকে বলল,তোমার চাচ্চু আর মামনীকে বল গুড নাইট।

সানি বলল,আমার নানুর বুট নাই।
সানির কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ।রুপ্সিতা হাসতে হাসতে আলিফের বাহুতে একটা চাপড় মারলো।
আলিফ ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে রুপ্সিতার দিকে।আজব মেয়ে মনে হচ্ছে আমি ওর বন্ধু তাই চাপড় মেরে দিলো।
#চলবে………..।

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)