আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-০৩

0
84

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

প্রেম শব্দটা খুব ছোটো। কিন্তু এর ব্যাপ্তি বিশাল।ও মানেনা শাসন শুনেনা বারণ। ভবিষ্যতের পথে একসাথে হাঁটার স্বপ্নে একে অপরকে প্রেমের ডোরে বেঁধে ফেলতে মন চায়। সেদিন পড়া শেষ করে যাওয়ার সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। মেহরাব চলে যাবার জন্য উদ্যত হলে নুরবানু মুখ ফসকে বলে ফেলে,
—–এখন যাবেন না কিন্তু,ঠান্ডা লেগে আপনার জ্বর আসতে পারে?
নুরবানুর কথার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিলো যাতে মেহরাব একটু ধাক্কা খেয়ে ওর দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়াতে নুরবানুর ফর্সা গাল দুটো লজ্জা রাঙ্গা হয়ে উঠে। যা দেখে মেহরাবের বুকের ভিতরে ভালোলাগার শিহরণ বয়ে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—–এরকম বৃষ্টিতে ভেজা আমার অভ্যাস আছে।
এ কথা বলে মেহরাব বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নুরবানু ছাদে উঠে লঙ্গ স্কার্ট দুলিয়ে ময়ুরের মতো পেখম তুলে ঘুরে ঘুরে ভিজতে লাগলো। আর নীচে দাঁড়িয়ে মেহরাব ছাদে নুরবানু বৃষ্টিতে ভেজা দেখতে লাগলো। ওর পাগলামী দেখে মিটি মটি হাসতে লাগলো। যা পরীবানুর চোখ এড়ায়নি। হঠাৎ মনে হলো এই দৃশ্য যদি শ্বশুরের চোখে পড়ে তাহলে নুরবানুর পড়াশোনার পাট চিরজীবনের মতো শিকেয় উঠবে। এ কথা ভাবতেই দৌড়ে ছাদে চলে যায়। নুরবানুর তখন খেয়াল নেই পরীবানু ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। ও অপলক মেহরাবের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাবের চোখ পরীবানুর দিকে পড়ায় দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। তারপর পরীবানু নুরবানুর দিকে তাকিয়ে বললো,
——নুরবানু তুমি বৃষ্টিতে ভিজতেছো কেন? এমনিতেই তোমার ঠান্ডার ধাত আছে। দেখো আবার নিউমোনিয়া যেন হয়ে না যায়?
চমকে উঠে নুরবানু বলে
——তুমি কখন ছাদে এসেছো?
ওর কার্যকলাপ যেন পরীবানু বুঝতে না পারে তাই খিলখিল করে হেসে বলে,
—— আমায় নিয়ে অত ভেবো নাতো ভাবী? আসো আমরা দুবোন একসাথে ভিজি। দেখো আমার কিচ্ছু হবে না। কত মানুষই তো বৃষ্টিতে ভিজে। তাদের সবার কি নিউমোনিয়া হয়?
পরীবানু মেহরাবের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বলে
—-ননদিনী যে পথে পা বাড়িয়েছো না জানি কতবড় বিপদ ডেকে আনছো? এমন কিছু করো না তার মাশুল যেন তোমাকে সারাজীবন ধরে গুনতে না হয়?
——কি করবো ভাবি,ওকে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পারবে না বাসার সবাইকে ম্যানেজ করে আমাকে ওর হাতে তুলে দিতে?
—–তোমার বাবা মা ভাই তোমাকে জ্যন্ত পুতে ফেলবে তবুও ওর হাতে তোমায় তুলে দিবে না।
নুরবানু কান্নাজড়িত চোখে পরীবানুর দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরীবানু নুরবানু সেই দৃষ্টি দেখে বুঝেছিলো, মেহরাবের কাছ থেকে ওকে ফেরানো মুশকিল। খুব মায়া হলো পরীবানুর। ও বুঝতে পারছে নুরবানু সামনে ঘোর বিপদ এগিয়ে আসছে।

এদিকে বৃষ্টিতে ভেজার কারণে নুরবানুর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। সেদিন ছিলো ছুটির দিন। আসরের নামাজের পর সবাই লনে বসে চা খাচ্ছিলো। জ্বরের ঘোরে সারাদিন শোয়া থেকে নুরবানু উঠতে পারলো না। কিন্তু ঠিক বিকালে যখন মেহরাবের সাইকেলের বেলের শব্দ শুনলো বিছানা থেকে তড়াৎ করে উঠে পড়লো। জ্বরে নুরবানুর কাহিল অবস্থা দেখে বাবা কামরান চৌধুরী এবং ভাই শেহজাদ নুরবানুকে পড়তে বারণ করলো এবং মেহরাবকে চলে যেতে বললো। কিন্তু নুরবানু ওদের কথা শুনলো না বরং ঝড়ের গতিতে এসে শেহজাদকে বললো,
—–ভাইয়া আমার জ্যামিতির এক্সট্রা বুঝতে হবে, স্যারকে বসতে বলো।
মেহরাবেরও চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নুরবানুকে এক পলক দেখতে মন চাইছে। মেয়েটা বৃষ্টিতে জেদ করে ভিজে জ্বর বাঁধালো। যে মেয়েটা একসময় পড়া নিয়ে প্রচন্ড ফাঁকিবাজ ছিলো সেই মেয়েকে লেখাপড়ার প্রতি এতো সিরিয়াস দেখে ওর বাবা মা ভাই মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। মেয়ের এই উন্নতির জন্য কামরান চৌধুরী পুত্রবধু আর হাউজ টিউটরের উপর যারপরণাই খুশী হলেন। পুত্রবধু পরীবানুকে ডেকে বললেন,
—–মেহরাবকে চা আর নাস্তা দাও। ছেলেটা নুরবানুর পড়ালেখার প্রতি খুব যত্নশীল। অবশ্য তোমার ভুমিকা আছে। তুমিও নুরবানুর দিকে খেয়াল রাখো। তোমার শাশুড়ী মাতো সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
পরীবানু তো বুঝে নুরবানুর সিরিয়াসনেস কোথায়।কোথাকার জল এখন কোথায় গিয়ে গড়ায় কে জানে?স্টাডি রুমে এসে চা আর নাস্তা দিয়ে যায়। পরীবানু চলে যাবার পর নুরবানু মেহরাবের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে,
——চা,টা খেয়ে নিন?
——না,খাবো না,আগে বলো তুমি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালে কেন?
——এতে আপনার কি? আপনিও তো আমার কথা না শুনে বৃষ্টিতে ভিজলেন।
মেহরাব ওর প্রতি মেয়েটার এই আচরণ দেখে মনে মনে ভাবতে লাগলো
“একে কি বলে, ভালোবাসা না মায়া”?
এরপর নুরবানুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—–জ্যামিতির এক্সট্রাটা বের করো। বুঝিয়ে দিচ্ছি। আজ বেশীক্ষণ পড়তে হবে না।
——আমি আজকে পড়বো না। শুধু আপনাকে একটু দেখার জন্য পড়ার টেবিলে এসে বসেছি।
মেহরাবও মনে মনে নিজের এই চাওয়াটাকে অস্বীকার করতে পারলো না। ওর ও নুরবানুকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো।

রেজাল্ট ক্রমাগত ভালো হওয়াতে বাড়ির সবাই নুরবানুর উপর সন্তষ্ট। নুরবানু অনেক ভালো রেজাল্ট করে ক্লাস টেন এ প্রমোশন পেলো। শেহজাদ ঢাকা ভার্সিটি থেকে আইবিএ তে পড়াশোনা করে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। কিন্তু কামরান চৌধুরী আর জুলেখা বিবির ইচ্ছা ছিলো শেহজাদ যেন উচ্চতর ডিগ্রী নিতে বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু ঐ সময় কামরান চৌধুরীর টাইফয়েড ধরা পড়ে। সেরে উঠতে অনেক সময় লেগে যায়। বাধ্য হয়ে তখন শেহজাদকে ব্যবসার হাল ধরতে হয়। তাই ও বাড়ির সবাই নুরবানু মেয়ে হলেও ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। নুরবানুও মনে মনে প্লান করে বাবা মা ভাই ওকে যদি মেহরাবের সাথে বিয়ে না দেয় তাহলে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে মেহরাবকে বিয়ে করে সেখানেই সুখের সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
ভালোবাসার প্রশ্রয়ে নুরবানু আর মেহরাব একটু একটু করে সাহসী হতে থাকে। এরমাঝে নুরবানু স্কুল থেকে স্টাডিট্যুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায়। খবর পেয়ে মেহরাবও নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে একসময় হেরে গিয়ে নুরবানুর আর্কষণে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায়। তারপর টিচারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিনারাকে ম্যানেজ করে পাহারা বসিয়ে নুরবানু মেহরাবের সাথে দেখা করে বলে,
—–আপনি এখানে এসেছেন কেন?
—–তোমার দিকে খেয়াল রাখতে। হাজার হোক আমি তোমার গৃহশিক্ষক,আমার একটা দায়িত্ব আছে না।
নুরবানু ওর প্রতি মেহরাবের এই কেয়ারিং দেখে মনে মনে আবেগে আপ্লুত হয়। মেহরাব নুরবানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু নুরবানু বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। লজ্জায় ওর ভাসা ভাসা নয়নদুটি অবনমিত হয়ে যায়।
এভাবেই নুরবানু আর মেহরাবের প্রেমের পাট চলতে থাকে। এরমাঝে একদিন নিজের অলিখিত বিপদ নুরবানু ডেকে আনে।
সেদিন ছিলো নুরবানুর প্রিটেস্ট পরীক্ষার শেষদিন। বাড়িতে মা জুলেখা বিবি আর ভাবি পরীবানুকে বলে,
——-আজ আমাদের শেষ পরীক্ষার দিন। তাই সবাই মিলে একটু আনন্দ করবে। তোমরা গাড়ি দেরী করে পাঠিও।
জুলেখা বিবি নুরবানুর কথা বিশ্বাস করলেও পরীবানুর কাছে সন্দেহজনক লেগেছে। ওদের বাসা থেকে ওয়াকিং ডিসটেন্সে নুরবানুর ক্লাসের এক সহপাঠি থাকে। নুরবানুর পরীক্ষার সময় তিনঘন্টা। সকাল দশটায় শুরু হয় একটায় শেষ হয়। ড্রাইভার মতি নুরবানুকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসে। ঠিক দেড়টার সময় পরীবানু হাঁটতে হাঁটতে মিনারাদের বাসার সামনে চলে যায়। দূর থেকে তাকিয়ে দেখে,মিনারা স্কুল থেকে ফিরছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মিনারা কাছে চলে আসলে ওকে জিজ্ঞাসা করে,
——তুমি বান্ধবীদের সাথে আনন্দ করলে না?
প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
——আম্মুর শরীর খারাপ,তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। ভাবী, আমাদের বাসায় আসেন?
—–না,অন্য আর একদিন আসবো।
একথা বলে দ্রুত বাসায় চলে আসে আর মনে মনে ভাবতে থাকে মেয়েটা না জানি কি বিপদ ঘটায় কে জানে?
এদিকে প্রেমের নৌকায় পাল তুলে নুরবানু বেঙ্গল মিডিয়াম স্কুল থেকে বের হয়ে মেহরাবের সাথে রিকশার হুট তুলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যায়। আপাদমস্তক বড় ওড়না দিয়ে আবৃত নুরবানু জীবনে এই প্রথম একজন পুরুষের পাশে বসে রিকশা করে বের হয়। পুরুষালী সুবাসে নুরবানু আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অপরদিকে মেহরাব ভাবে এই বাচ্চা মেয়েটার প্রেমে সাড়া দেওয়া ওর ঠিক হলো কিনা? সেদিনেই ওরা প্রথম একসাথে বের হয়। তারপর নুরবানুদের সাথে মেহরাবদের রয়েছে সামাজিক বৈষম্য। ওদের নিজেদের গাড়ি, দোতলা বাড়ি সামাজিক স্ট্যাটাস সবই আছে। অপরদিকে মেহরাবের শুধু পড়াশোনা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছুই নেই। মেহরাবের স্বপ্ন ও মাইক্রোবায়োলজিতে পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে পিএইচডি করতে যাবে। তারপর বিশ্বসেরা একজন বিজ্ঞানী হয়ে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিবে। মেহরাব জানে না এই প্রেমের শেষ পরিনতি কি? ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো নুরবানুর হাতের আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। কি সুন্দর লম্বা লম্বা আঙ্গুল। পরক্ষণেই মেহরাব নিজেকে সামলে নেয়।নুরবানুর বিশ্বাসের অমর্যাদা ও করবে না। ওর প্রতি নুরবানুর ভালোবাসাকে ও কখনও অপবিত্র হতে দেবে না। দু,জনেই চুপচাপ। নিরবতা ভেঙ্গে মেহরাব নুরবানুকে বললো,
—–আজ তোমার এভাবে আমার সাথে বের হতে ভয় করলো না?
—–না করেনি,আমি আপনাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করি। আর—-
——আর কি?
খুব আস্তে করে বললো,
——আমার নিজের থেকে বেশী আপনাকে ভালোবাসি।
দু,জনে তো মনের আনন্দে ঘুরছে। এদিকে অফিস থেকে শেহজাদ বের হওয়ার সময় ড্রাইভার মতি বলে,
—–স্যার আপাকে তো স্কুল থেকে এখনও নেওয়া হয়নি?
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শেহজাদ বলে,
—–এখন তো বিকাল পাঁচটা বাজে। ওর পরীক্ষা তো শেষ হয়েছে একটায়। এতোক্ষণ স্কুলে কি করে?
—–আপু বললো,আজ পরীক্ষা শেষ, বান্ধবীরা সবাই মিলে একটু মজা করবে।
—–ঠিক আছে। বাড়ি যাওয়ার পথে ওকে স্কুল থেকে তুলে নিলেই হবে।
কিন্তু স্কুলে গিয়ে মানুষ তো দূরের কথা কোনো কাকপক্ষীও নাই। অজানা বিপদের আশঙ্কা নিয়ে শেহজাদ বাড়ি ফিরলো।

চলবে