আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-১

0
203

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

প্রত্যেক নরনারীর জীবনে ভালোবাসা আসে,হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে, কেউবা দরজা খুলে তাকে বসিয়ে দেয় মনের ঘরে। আবার কেউবা বৈষম্যের দেওয়ালে মাথা ঠুকে হয় প্রত্যাখ্যাত। আবার কেউবা ব্যর্থ প্রণয়ের হোমানলে পুড়ে খাক হয়ে যায় তবুও যুগযুগান্তর ধরে ভালোবাসার মানুষটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এই শত সহস্র রজনীর অপেক্ষার প্রহরে কত শিউলি ঝরে যায়, কত বকুলের মালা শুকায় তার হিসাব কেউ রাখে না। তেমনি প্রিয়মানুষটার জন্য একবুক কষ্ট নিয়ে কেঁদে কেঁদে প্রতি রজনীতে সিথানের বালিশ ভিজায় নুরবানু। ও জানে ভালোবাসা কোনোদিন আর ওর দরজায় কড়া নাড়বে না। তবুও আজ ও ভীষণ খুশী। সন্তানতুল্য আয়ানের প্রেম আজ সফলতার মুখ দেখেছে। যা এই চৌধুরী পরিবারের শত বর্ষের নিয়ম ভেঙ্গেছে।
এই চৌধুরী পরিবারে জমিদারদের নীল রক্ত বইছে। আয়ানের বাবা শেহজাদ চৌধুরী চৌধুরী এন্ড সন্স কন্সট্রাকশনের মালিক। তবে আয়ান ওর বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে নিজেকে বিজনেস আইকন হিসাবে প্রতিষ্টিত করতে পেরেছে। ইউকে থেকে বিবিএ এমবিএ করে এসেছে। ছোটোবেলা থেকেই ও নুরবানুর ছায়ায় বড় হয়েছে। এ লেভেল কমপ্লিট করে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রীগুলো নিয়ে শুধু ওর ফুফিমার জন্য দেশে ফিরে এসেছে।
নুরবানুর সেই দুর্ঘটনার সময়ে আয়ানের জন্ম। যদিও নুরবানু ডাক্তার হিসেবে নিজেকে আজ সুপ্রতিষ্টিত করেছে তারপর মানুষের এই দীর্ঘজীবন পার করতে বেঁচে থাকার অবলম্বনের দরকার হয়। আয়ান ছিলো নুরবানুর বেঁচে থাকার অবলম্বন। নুরবানুর জীবনের নদীতে কত জল গড়িয়েছে কত পার ভেঙ্গেছে তবুও আয়ানকে বুকে জড়িয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। নুরবানু ফুপু হলেও আয়ান উনাকে মায়ের আসনে বসিয়েছে। এক্ষেত্রে আয়ানের মায়ের ভুমিকা আছে। যেদিন অষ্টাদশী ননদের জীবনে ভালোবাসার অপরাধে চরম বিপর্যয় নেমে আসে সেদিন পরীবানু ছায়ার মতো নুরবানুর পাশে ছিলো। নুরবানুর পাশে সেদিন মা বাবা ভাই কেউ ছিলো না। ওর এমন অসহায়ত্বে একমাত্র ভাইয়ের বউ হয়ে বোনের মতো ননদকে আগলে রেখেছে। অপরিনত বয়সের নুরবানু সেদিন নিজের আবেগ ইমোশনকে সামলাতে না পেরে একটা বড় ভুল করতে যাচ্ছিলো সেই ভুলের মাশুল নুরবানুকে কঠিনভাবে দিতে হয়েছিলো। পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। সুর্যের আলো দেখা বন্ধ হয়ে গেল। ওকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। পরীবানু স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ীর হাতে পায়ে ধরে কঠিন শর্তের বিনিময়ে নুরবানুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলো। অথচ এই ভুলটা এতো কঠিনভাবে দমন না করলেও হতো। কিন্তু জমিদারী রক্ত বলে কথা। সবটাতেই একটা স্বৈরাচারী মনোভাব প্রতিফলিত হয়।
জন্মের সময় তুলতুলে গোলগাল ফর্সা নয় তবে বেশ উজ্জ্বল ছিলো আয়ানের গায়ের রং। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, দেখতে খুব মিষ্টি লাগতো। নুরবানু তখন এইচএসসি সেকেন্ডইয়ারে পড়তো। যখন ওর পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়, ঘর হতে বের হতে পারতো না, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে মেন্টাল ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো তখন আয়ানকে নিয়ে ও ব্যস্ত থাকতো। আয়ান যতক্ষণ পাশে থাকতো নুরবানু সবকিছু ভুলে থাকতো। নুরবানুর পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে আজ আয়ানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আয়ান অবশ্য মেয়েটির সাথে চার বছরের রিলেশনে ছিলো।অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আয়ানের প্রেম আজ সফলতার মুখ দেখছে। নুরবানু আজ ভীষণ আনন্দিত।
তবুও নিজের যন্ত্রণার অতীতকে নুরবানু আজও ভুলতে পারেনি। মাঝে মাঝে সবকিছু ফ্লাসব্যাকের মতো মনের আয়নায় ভেসে উঠে। আজ নুরবানুর অফ ডে। আয়ান বায়না ধরেছে ওর সাথে বিয়ের শাড়ি কিনতে নুরবানুকে যেতে হবে। নুরবানুর ইচ্ছে হচ্ছে না। বিয়ের শাড়ি দেখলে নুরবানুর ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। লালশাড়ি পরে বউ সেজে নুরবানুর কোনোদিন শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হবে না।
পুরো বাড়িটা আজ নতুনরুপে সেজেছে। একমাস ধরে এই ত্রিপ্লেক্স বাড়িটা রঙ করা হচ্ছে। বাড়ির প্রতিটি ফার্নিচার রঙ করা হয়েছে। মার্বেল টাইলসগুলো মিস্ত্রি ডেকে আরো ঝকঝকে করা হয়েছে। সিড়ির কর্ণারে রাখা সেই জমিদারী আমলের ফুলদানী। বেশ ঘষামাঝা করাতে ফুলদানীটার সৌন্দর্য ফিরে এসেছে। নুরবানু ওর তিনতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে পুরোবাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছে। জমিদার বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা। যদিও জমিদারী নেই তাতে কি? রেশটাতো চলনে বলনে নুরবানুর ভাই ঠিকই রেখেছে। এই জমিদারী চালচলন নুরবানুর বাবার মাঝে ও বহাল তবিয়তে ছিলো। আয়ানের ডাকে নুরবানু ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।
——-কি ফুফীমা তুমি এখনও রেডী হওনি? আজকে তোমার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। আমি জানি আজ তোমার অফ ডে। তুমি শপিং এ আমার সাথে যাবে।
——তোর মাকে নিয়ে যা,আমাকে আবার টানাটানি করছিস কেন।
ছেলে আর ননদের কথাশুনে পরীবানু নিজের বেডরুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
—-নুরবানু তুমি এখনও রেডী হওনি। শপিং এ যাবো বলে আজ তো আরলি ব্রেকফাস্ট করা হলো। তুমি না গেলে তোমার ভাইপো কিন্তু না যাওয়ার জন্য বেঁকে বসবে। আজতো আবার ওয়ার্কিং ডে। মিরপুরের বেনারশী পল্লী থেকে আয়ান বিয়ের শাড়ি কিনতে চেয়েছে। যদিও বনানী থেকে খুব বেশী দূর নয় কিন্তু রাস্তায় কতক্ষণ যানজটে বসে থাকতে হবে কে জানে?
ওদের সবার কথাশুনে আয়ানের দাদী নিজের রুম থেকে বের হয়ে এসে বললো,
——কিরে দাদুভাই তুই শপিং করবি মিরপুর থেকে?
——কেন দিদিভাই,সমস্যা কি?
——আমাদের জমিদারী নাই তবে জমিদারের খেয়ালখুশী থাকলে তো দোষ নাই। দেশের বাইরে থেকে শপিং করলে কি এমন ক্ষতি হতো?
——অনেক অর্থের অপচয় হতো। যে বিয়েতে খরচ যত কম সে বিয়েতে আল্লাহপাকের রহমত ততবেশী। আর আমি নিজেকে জমিদারের উত্তরসুরী হিসাবে ভাবতে চাই না। বরং এতে বৈষম্যের দেওয়াল তৈরী হয়। তুমি আমার সাথে একমত নাই হতে পারো। শাসক নয় জনগনের সেবক হতে হয়। তাহলে তুমি নিজেকে জমিদার ভেবে আত্মঅহমিকায় ভুগবে না। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরী হয় না। ইসলাম আমাদের সে শিক্ষাও দেয় না। ইন্ডিয়া থেকে লোক এসে আমাদের মিরপুর থেকে শপিং করে নিয়ে যায়। সুতরাং আমাদের দেশের কারিগরেরা এখন অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ি তৈরী করে। যা বিদেশে রপ্তানী হয়।
——তোর সাথে কথা বলতে আসাটাই ভুল। শুধু জ্ঞান দিতে চাস। যাই আমার নামাজ পড়া বাকি আছে। সেটা বরং আদায় করে নেই।
——-ফুফী তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। জুবাইদাও বলেছে তুমি শপিং এ না গেলে ও বিয়ের শাড়ি কিনবে না।
অগত্যা কোনো উপায় না দেখে নুরবানু ওদের সাথে শপিং এ গেল। বেনারশী পল্লীতে শপিং প্রায় শেষ। আয়ান বিল পেমেন্ট করতে কাউন্টারে গিয়েছে। এমন সময় জুবাইদা একটা মেরুন লাল রঙের জমিনে গোল্ডেন জরিবুটি দেওয়া শাড়ি নিয়ে এসে নুরবানুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—–ফুফীমা দেখোতো শাড়িটা কেমন লাগছে?
—–সুন্দর। তোর বিয়ের শাড়ি তো কেনা হয়েছে। এটা আবার কার জন্য?
—–আয়ান তোমার জন্য পছন্দ করে কিনেছে।
সাথে সাথে নুরবানুর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,
——আয়ান জানে না আমার বিবর্ণ জীবনে আমি কখনও রঙের প্রলেপ লাগাই না? তারপর ও কেন শাড়িটা কিনলো? আমার পক্ষে এই শাড়ি পড়া কখনও সম্ভব না।
নুরবানুর অসন্তষ্টি দেখে পরীবানু বললো,
——থাক তুমি মন খারাপ করো না। বেচারা কিনে ফেলেছে যখন তখন বাড়ি নিয়ে যাই। তোমার মন না চাইলে শাড়িটা তোমার পরার দরকার নেই।
জুবাইদা ভেবে পেলো না ম্যাম কেন লালশাড়িটা দেখে এতো রিঅ্যাক্ট করছে। আয়ান বিল মিটিয়ে সবাইকে নিয়ে গাড়িতে বসলো। আজ আয়ান নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। জুবাইদা ওর পাশের সিটে বসেছে। পিছনের সিটে নুরবানু আর পরিবানু বসে আছে। নুরবানু জানালা দিয়ে অপলক বাইরে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। হয়ত ওর বেদনার অতীত ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পরিবানু ঠিক বুঝতে পারছে। পরিবানু যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে নুরবানু তখন ফ্রক পড়তো। বিয়ের পাঁচবছর পর আয়ানের জন্ম হয়। সারাদিন নুরবানু পরিবানুর পিছনে ঘুরঘুর করতো। আয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুপুর তিনটা বাজে। গাড়ির আয়না দিয়ে দেখতে পারছে নুরবানুর মুখটা ভার হয়ে আছে। ও বুঝতে পারছে ফুফুর রাগের কারণ কিন্তু গায়ে মাখতে চাইছে না। আসলে এভাবে তো কখনও কোনো জীবন চলতে পারে না। ফুফুকে ঐ ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বললো,
——ফুফু আমার খিদে পেয়েছে। চলনা কোথাও বসে একটু কিছু খাই।
সাথে সাথে নুরবানু স্বাভাবিক হয়ে বললো,
—–এতোক্ষণ বলিসনি কেন খিদে লেগেছে?
——মনে হলো তোমার মুড ভালো না তাই একটু হেজিটেট করছিলাম।
এ কথা শোনার সাথে সাথে নুরবানু স্বাভাবিক ফর্মে ফিরে আসলো। ওদের সবাইকে নিয়ে একটা রেস্ট্রুরেন্টে কিছু খেয়ে নিলো। এরপর জোবাইদাকে মহাখালীতে ওদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আয়ানরা বাসার দিকে রওয়ানা দিলো।

বাড়িতে ফিরতেই গোধুলী নেমে এলো। নুরবানু ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসর আর মাগরিব একসাথে পড়ে নিলো। পরীবানু শপিং এর ব্যাগ শাশুড়ী মায়ের ঘরে রেখে নামাজ আদায় করে কিচেনে গিয়ে আকলিমাকে চা আর পাকোড়া বানাতে বললো। এরপর শাশুড়ী মায়ের ঘরে এসে শাড়িগুলো দেখাতে লাগলো।
হেমন্তের বিকেলে ঝুপ করে সন্ধা নেমে যায়। এসি চালানো যায় না। ফ্যানও খুব হালকা করে ছাড়তে হয়। শীত শীত অনুভূত হয়। নুরবানু ত্রিশ বছর আগে এরকম এক হেমন্তের রাতের স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। ও যদি সেদিন মেহরানের হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারতো তাহলে ওর বাবা ভাই কি করতো? ওদের দু,জনকে কি মেরে ফেলতো নাকি নুরবানুকে ত্যাজ্য করে দিতো? কিন্তু নুরবানু তো ওর পরিবারকেও খুব ভালোবাসে। লোকমুখে শুনেছিলো মেহরানকে মেরে তুরাগের পাড়ে ফেলে দিয়েছিলো। ওকি বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে নুরবানু জানে না। আর নুরবানুকে ওর বাবা চামড়ার বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছিলো। ফর্সা শরীরে সেই দাগগুলো চিড়ে রক্ত বের হয়েছিলো। কেউ এগিয়ে আসেনি। পরীবানু আসতে চেয়েছিলো বলে শেহজাদ রেগে নিজের স্ত্রীকে বলেছিলো,
—–বেশী বাড়াবাড়ি করলে সন্তানকে রেখে চিরজনমের মতো যেন বাবার বাড়ি চলে যাও।
তারপরও পরীবানু ছুটে এসে কামরান চৌধুরীর পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো।
চলবে