আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-০২

0
101

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

কামরান চৌধুরী সেদিন শর্ত দিয়েছিলেন, নুরবানু যদি আর কোনোদিন এমন কাজ করে তাহলে নুরবানুর জায়গা তো এ বাড়িতে হবেই না বরং পরীবানুকেও সন্তান রেখে চিরজনমের মতো এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। পরীবানুও বিনা দ্বিধায় এই শর্ত মেনে নেয়। নুরবানু এই পরিবারের মেয়ে হলেও সেই থেকে ঐ পরের বাড়ির মেয়েটি নুরবানুর জীবনে সবচেয়ে আপনজন হয়ে উঠে।
নুরবানু যখন নিজের পিতৃগৃহের কয়েদখানায় কিছুদিন বন্দী ছিলো তখন এই পরীবানু ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত তখন স্বামী শেহজাদ চৌধুরীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে পরীবানু বইগুলো নুরবানুর কাছে দিয়ে আসতো। আবার ফজরের নামাজ পড়ার সময় বইগুলো নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিতো। আজও নুরবানুর মনে পড়ে পরীবানুর সেই কথাটা—-
“এ বাড়ির বন্দী আর্গল ভাঙ্গতে হলে নুরবানু তোমার পড়াশোনার বিকল্প নেই। ভালোবাসা ছাড়াও বাঁচা যায় কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে বাঁচা যায় না”।
কথাটা সবার জীবনেই শতভাগ সত্যি। নুরবানু সেদিন মা রুপী ভাবির কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলো বলে আজ নিজের জীবনের স্বাধীনতার সাধ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
দরজা নক করার শব্দে স্মৃতির আঙ্গিনা থেকে নুরবানুকে ফিরতে হলো।
——কে?
——-নুরবানু চা খাবে না?
——-একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে,পরে খাবো। ( আসলে নুরবানুর এখন স্মৃতির উঠোন থেকে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না)
আকাশে আজ পূর্ণচাঁদের চন্দ্রালোকিত রাত। চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে নুরবানুর বিছানার উপর ছড়িয়ে পড়েছে। পরীবানু চলে যাবার পর নুরবানু আবার ওর ভাবনার অতল সাগরে ডুব দিলো। এরকম এক চন্দ্রলোকিত রাতে মেহরাবের সাথে ওর হৃদয়ের আদান প্রদান হয়েছিলো। নুরবানু একরকম জোর করেই মেহরাবের কাছে ওর ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিলো। নুরবানু তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। মন তখন উড়ুউড়ু। যৌবনের ফুল কেবল সদ্য ফুটতে শুরু করেছে। তার সৌন্দর্য নুরবানুর দেহসোষ্ঠবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কথিত আছে নুরবানুর পূর্বপুরুষ তুর্কমেনিস্তান থেকে আগত। অবশ্য ওকে দেখলে বুঝা যায়। ঝা চকচকে রুপ পুরো অবয়বে ছড়িয়ে পড়েছে। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং বড় পাপড়িওয়ালা ভাসা ভাসা ব্রাউন মনিওয়ালা চোখ, গোলাপী ঠোঁট মেদহীন পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চির বলিষ্ঠ শরীর হালকা লালচে আভার চুল সব মিলিয়ে অপূর্ব। ঐ সময় ওকে দেখা মাত্রই যে কোনো পুরুষই ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য। এই জন্য একটু গরীব আবার মেধাবী এমন ঘরের ছেলে বোনের শিক্ষক হিসাবে শেহজাদ নিয়োগ দেয়। সচরাচর বাহিরে বের হওয়া নুরবানুর বারণ ছিলো। যদিও বড় ওড়না গায়ে জড়িয়ে নুরবানু স্কুলে যেতো তারপরও ঘর থেকে নুরবানু খুব একটা বের হতো না। স্কুলে আসা যাওয়া তাও আবার নিজেদের প্রাইভের কারে করে যাওয়া আসা করতো। খুঁজে পেতে এমন একটা ছেলে শেহজাদ টিচার হিসাবে যোগাড় করলো যে কোনোদিন ওর বোনের মুখের দিকে তাকাতে সাহস পাবে না। নুরবানুর পরিবার খুব রক্ষণশীল। এইজন্য নুরবানু যখন পড়তে আসতো আপাদমস্তক বড় চাদরে ঢেকেই টিচারের সামনে পড়তে বসতো।
ওদিকে মেহরাবও ছিলো প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। যা নুরবানুকে ওর দিকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য করে। শ্যমলা রং, মাথা ভর্তি চুল, ঠোঁটের উপর হালকা গোঁফের সারি ছ,ফিটের মতো লম্বা, চোখদুটো অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত। বয়সের তুলনায় ভারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলো মেহরাব। নুরবানু পড়াশোনায় খুব মনযোগী ছিলো না। কিন্তু মেহরাবের পাল্লায় পড়ে ও বইমুখী হতে বাধ্য হয়েছে। মেহরাব ছাত্রহিসাবে প্রচন্ড মেধাবী। ঢাকাভার্সিটিতে তখন কেবল মাইক্রোবাইলজিতে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। মিরপুর এক নাম্বারে পাইকপাড়া জোনাকী রোডে নুরবানুদের বাড়ি ছিলো। মেহরাবের বাড়ি ছিলো পীরেরবাগ। ও সাইকেলে চড়ে নুরবানুকে পড়াতে আসতো। মেহরাব যখন নুরবানুর বাসার গেটের সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজাতো এই শব্দটা নুরবানুর পুরো শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে দিতো। ঐ শব্দটা শোনার জন্য ও অপেক্ষা করতো। যে ম্যাথকে নুরবানু ভয় পেতো সেই ম্যাথের ফরমুলা মেহারাবের কাছে শেখার পর ওর কাছে পানির মতো সহজ হয়ে যায়। যেমন বুঝাতো বীজগনিত তেমনি বুঝাতো পাটিগনিত। সুদকষা, ঐকিক নিয়ম, এমনকি জ্যামিতি এমনভাবে বুঝাতো নুরবানুর পরে আর মুখস্ত করা লাগতো না। মাঝে মাঝে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নুরবানু মেহরাবের গভীর আয়ত চোখ দুটির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতো। সেই সাথে পড়াতো পদার্থ রসায়ন আর জীববিজ্ঞান। আর্কিমিডিসের সুত্র নিউটনের সুত্র, মহাকর্ষ, অভিকর্ষ এতো সুন্দরভাবে মেহরাব ওকে বুঝিয়ে দিতো যে পরবর্তীতে ওর কাছে এসব সহজ হয়ে যায়। এমনকি ইংরেজী গ্রামার যখন বুঝাতো নুরবানু ওর ইংরেজী উচ্চারণ শুনে অবাক হয়ে যেতো। ভার্ব ন্যারেশন টেন্স সব কিছু খুব সুন্দরভাবে মেহরাব ওকে বুঝিয়ে দিতে। এদিকে নুরবানুর রেজাল্টও ভালো হতে থাকে। বাড়ির লোকজনও মেহরাবের উপর খুব খুশী। নুরবানু যে মেহরাবের উপর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়ছিলো সেটা পরীবানু বুঝতে পারতো। মেহরাবের যখন আসার সময় হতো নুরবানু ছাদে উঠে মেহরাবের পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আবার পড়িয়ে যাওয়ার সময় আড়ালে দাঁড়িয়ে নুরবানু ওর চলে যাওয়া পথের দিকেও তাকিয়ে থাকতো। এর মাঝে পরীবানু খেয়াল করলো পড়াশোনার পাশাপাশি মেহরাব প্রতিদিন একটা করে গোলাপ নুরবানুর জন্য নিয়ে আসে। এটা দেখে পরীবানু ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। যদি শেহজাদের চোখে পড়ে তাহলে দুটোকে কেটে টুকরো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিবে। অগত্যা টেনশনের ভার বইতে না পেরে নুরবানুকে জিজ্ঞাসা করলো,
——এসব কি হচ্ছে নুরবানু?
——তুমি কিসের কথা বলছো ভাবি?
——মেহরাব প্রতিদিন তোমার জন্য গোলাপ আনে কেন?
——ও—ও এটাতো আমার ভালো পড়াশোনার পুরুস্কার।
পরীবানু এ কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আসল বিষয়টা হচ্ছে নুরবানু মেহরাবকে বলেছে যে প্রতিদিন একটা করে গোলাপ না দিলে ও পড়া রেডী করবে না। মেহরাবও ভেবেছে বয়স কম এ ধরণের আবদার করতেই পারে। তাই ও প্রতিদিন একটা করে গোলাপ নুরবানুর জন্য নিয়ে আসে। এছাড়া সেসময় নুরবানুকে পড়ানোর বিনিময়ে ওকে তিনহাজার টাকা দেওয়া হতো। যার ফলে মেহরাবের পরিবার ও খুব স্বাচ্ছন্দে চলতো। মেহরাবের বাবা এজিবি অফিসের কেরানী ছিলো। উনি ঐ সময় যা বেতন পেতেন মেহরাব নুরবানুকে পড়িয়ে তার থেকে বেশী ইনকাম করতো। মেহরাবরা ভাড়া বাসায় থাকতো। এছাড়া ওরা তিনভাইবোন ছিলো। ওর ছোটোভাইটা ঢাকা কলেজে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো। আর ছোটো বোনটা ক্লাস এইটে পড়তো। মেহরাবেরও সে সময় টাকার দরকার ছিলো। তাই নুরবানুকে প্রচন্ড যত্ন সহকারে পড়াতো।
তবে পড়া বুঝতে গিয়ে নুরবানু যে মনে মনে প্রেমের পাট বুঝার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলো সেখবর আর কেউ না পেলে পরীবানু ঠিক বুঝেছিলো।

চলবে