আমার চাঁদ পর্ব-০২

0
216

___আমার চাঁদ

____সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান

পর্ব:- ০২

ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙে মেহরার। তাহমিদ তখন ঘুমে মগ্ন। তাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো কন্ঠে ডাকে। তাহমিদের ঘুম ভাঙতেই মেহরাকে দেখে হাসে। মেহরার পেটে মুখ গুজে বলে,

– এতদিনের স্বপ্ন ছিল এটা, বউ ডেকে তুলবে নামাজে। লোভ লাগিয়ে দিলে বউ,এবার তোমাকে ছাড়া ফজরে উঠবো কী করে?

– দ্রুত আমাকে নেয়ার ব্যবস্থা করো, তাহলেই তো হয়।

– নিয়ে তোমাকে খাওয়াবো কি?

– সবার মতো তুমিও শুরু করলে?

– মেহরা, আমাদের আবেগে আমরা বলি, বউ কি হাতি যে সব খেয়ে ফেলবে! আসলে ব্যপারটা হাতি না। একজন মানুষের চলতে গেলে টাকার আসলেই প্রয়োজন। দেখো আমি এখন হোস্টেলে থাকি, তোমাকে নিলে আমার একটা বাসা লাগবে, রান্নার জন্য চুলা,হাঁড়ি, খাবারের সামগ্রী লাগবে। তোমার জামা-কাপড় লাগবে, সেই জামাকাপড় রাখার আসবাব লাগবে। সব মিলিয়ে আসলেই টাকার প্রয়োজন, যেটা আমার নেই।

– বুঝেছি, এখন হিসাব কষে ফজর মিস করতে হবে না। দ্রুত ওঠো।

মেহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিলে পা বাড়ায়। মেয়েদের বিয়ে হওয়ার পরে বাবার বাড়িতে থাকলে সমাজের কত কথা শুনতে হয়! সেসব শুনেও না শোনার ভান ধরে তিনটা বছর পরে আছে।

——–

নামাজ শেষে তাহমিদ মেহরাকে চা করে আনতে বলে। তাহমিদ বারান্দায় বসে ভাবে কি করবে! সন্ধ্যায় বাজার শেষে বাসায় ফেরার পথে কিছু কথা কানে এসেছে। তীক্ষ্ণ কথাগুলো তীরের মতো বিষাক্ত। না যায় উপরে ফেলা না যায় ব্যথা সহ্য করা।

মেহরা চা বানিয়ে এনে দেখে তাহমিদ চিন্তায় মশগুল। মেহরার ডাকে তাহমিদের ঘোর কাটে। মেহরার হাত থেকে চা নিয়ে মেহরাকে বলে,

– মেহরা, একটা ছোট্ট কোম্পানি অনেক ধরেই আমাকে অফার করছে চাকরির জন্য। তবে বেতন বেশী না। এই ধরো, বিশ হাজারের মতো! কিন্তু ঢাকা শহরে এই বেতনে দু’জনের থাকা-খাওয়া কতটা টাফ সেটা তুমি ভালোই জানো। আমি চাচ্ছি তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রাখতে, আমার মাস্টার্স শেষ হলে তখন না হয় আমি গ্রামে যাবো নয়তো তোমাকে ঢাকায় আনবো। তুমি কি বলো?

– তোমার যেটা ভালো মনে হয়!

– আমি তোমার উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাই।

– দেখো,গত তিনটা বছর বাবার বাড়িতে কোনো কিছুর অভাবে ছিলাম না তবে শান্তির অভাবটা ছাড়া! প্রতিনিয়ত মানুষের কথা আমাকে খুবলে খেয়েছে। আমি এসব থেকে মুক্তি চাই। শশুড়বাড়িতে তোমাকে চাইলেই কাছে পাবো না তবে এই কথা থেকে তো মুক্তি পাবো!

তাহমিদ হাত দিয়ে মেহরাকে জড়িয়ে ধরে। মেহরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

– কেঁদো না, আর কাঁদতে হবে না ইনশাআল্লাহ।

———————–

তাহমিদ ফোন দেয় আহাদ খানকে, খুলে বলে ঘটনা। এমনি ছোট কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন সেটাও বলে। তাহমিদকে আশ্বস্ত করেন আহাদ খান। বলেন, ‘ আমি কথা বলছি মাহিনের সাথে’।

আহাদ খান মাহিন খানের সাথে কথা বলেন। মাহিন খান শুরুতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে তাহমিদের চাকরি হয়েছে শুনে রাজি হন।

মেহরার কাছে যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। তাহমিদ খুবই সামান্য আয়োজনে মেহরাকে নিয়ে যেতে চায়। সেই অনুযায়ী আয়োজন করাও হয়।

তাহমিদ গ্রামে চলে যায় বিয়ে উপলক্ষে। বাড়িতে সবাই মিলে কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়। আহাদ খান চাচ্ছেন মেহরাকে ও বাড়ি থেকে ছোট আয়োজনে নিয়ে আসলেও এ বাড়িতে বড় আয়োজন করবেন। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!

মেহরার পরিবারও গ্রামে এসেছে। তাদের বাড়িও রমরমা। আনন্দের মাঝেও বিষাদের ছোঁয়া।

আগে গ্রামে আসলে যারা তাচ্ছিল্য করে মেহরাকে কথা শুনাতো তারা যেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। মেহরার বেশ মজা লাগছে এসব।

মেহরার হলুদ সন্ধ্যার ঘরোয়া আয়োজন করেছে মেহরার কাজিন মহল। মেহরাকে হালকা সাজ দিয়েই স্টেজে নিয়ে গিয়েছে। মেহরা এ কথা তাহমিদকেও জানিয়ে দিয়েছে। তাহমিদ মেহরাকে হলুদ ছোঁয়াতে চলে আসে শশুড়বাড়ি। সবার থেকে লুকিয়েই যেতে হবে নয়তো শালা-শালিদের কশাইগিরিতে পকেটটা জবাহ হয়ে যাবে।

প্রাচীর টপকে মুখে রুমাল বেঁধে স্টেজে আসে তাহমিদ। এক শালিকে ডেকে হাতে কিছু টাকা গুঁজে মেহরাকে আড়ালে নিয়ে আসতে বলে। সেও টাকা পেয়ে মহা খুশি। মেহরার কানে এসে বলে,

– আপু৷ দুলাভাই ওপাশে অপেক্ষা করছে। তুমি ওয়াশরুমের কথা বলে আমার সাথে এসো।

মেহরা তো চমকে গিয়েছে। কত সাংঘাতিক কথা বলে এখান থেকে টপকাতে চাইছে!

তাহমিদ পায়চারি করছে আশপাশে। যদি কেউ দেখে ফেলে নিস্তার নেই। পিছন থেকে মেহরা এসে তাহমিদকে ছোঁয়। চমকে পিছনে ফেরে। বুকে থু থু দেয়ার ভান করে বলে,

– ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে বউ!

মেহরা হাসে। তাহমিদ মেহরাকে বলে,

– হেসো না বলছি, অঘটন ঘটে যাবে!

মেহরা হাসে। তাহমিদ মেহরাকে কাছে টেনে নেয়। কপালে চুম্বন করে হাঁটু গেড়ে বসে। এক হাত উপরে বাড়িয়ে বলে,

‘ আমার হৃদাসমানের পরি, আমার ফুটন্ত গোলাপ ফুল, তুমি কি তোমার জীবনে মূল্যবান সময়গুলো আমার সাথে পার করবে? তোমার হাসির কারণ হতে চাই,দুঃখগুলো ভাগ করে নিতে চাই। তুমি কি আমার ছন্নছাড়া জীবনকে গুছিয়ে দিবে? বলো তুমি কি আমায় ভালোবাসবে?

মেহরার দু’চোখ ভর্তি চল। তাহমিদের হাতে হাত রেখে মাথা নেড়ে হ্যা বলে। তাহমিদ উঠতেই বুকে ঝাপিয়ে পরে। চুমু আঁকে বুকে। প্রশান্তির হাসি হাসে তাহমিদও।

————-

সকাল হতেই তোড়জোড় শুরু হয় দু’বাড়ি। তাহমিদের মা মরিয়ম খাতুন সকাল হতেই রান্নাঘরে ব্যস্ত। তিনি চান নিজ হাতে বউকে বউ আদর করতে। সমাজে নিয়মের বাইরে তিনি বউয়ের জন্য এত আয়োজন করছেন। এসব দেখে তাহমিদের ফুফু বলে,

– এত মাথায় কেন তুলতে চাইছো ভাবি?

– আপা! এখানে মাথায় তোলার কি আছে? আমার একটা মাত্র পুত্রবধূ, আমার কি শখ আহ্লাদ নেই?

– হ্যাঁ, আহ্লাদ এত দিও না যে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া লাগে!

– সে আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে। নাহয় আপনার মতো শক্ত শাশুড়ী কি একা থাকার কথা বলুন? আপনার জায়গাটা তো বৃদ্ধাশ্রম থেকে আরো নিম্ন জায়গায়।

মরিয়ম খাতুনের কাট জবাবে তাহমিদের ফুফু চুপ হয়ে যায়। তাহমিদের বোন তাহমিনাও মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। অনলাইন থেকে বিভিন্ন ডেকোরেশন দেখাচ্ছে। তাহমিদের রুমটাও সাজানো হচ্ছে কাজিন মহল মিলে। সব মিলিয়ে বাড়িতে যেন আনন্দ উপচে পরছে।

———-

তাহমিদের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থেমেছে মাত্র। গাড়ি থেকে নামার পরেই মরিয়ম খাতুন মেহরার হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসেন। নিজ হাতে স্বর্নের বালা হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেন,

– এর আগে যত গহনা দিয়েছি ওগুলো তোমাকে দায়িত্ব এড়াতে দিয়েছি। আর এখন যেটা দিলাম এটা আমার ঘরে বউ হিসেবে এসেছো এজন্য উপহার দিলাম। পছন্দ হয়েছে?

মেহরার চোখে আনন্দের অশ্রু। মরিয়ম খাতুন জড়িয়ে ধরেন। বলেন,

– তাহমিনা তোমার ভাবিকে রুমে নিয়ে যাও, ভারি পোষাক পাল্টে আরামদায়ক পোষাক দাও।

মরিয়ম খাতুনের কথা পিঠে তাহমিদের ফুফু বলে ওঠেন,

– ভাবি কি বলেন? কত লোকজন আসবে, তারা দেখবে না বউকে সাজে?

– কেন বউ দেখতে আসবে নাকি বউয়ের সাজ দেখতে আসবে?

– সাজ উঠিয়ে ফেললে তো আর সুন্দর লাগবে না।

– দরকার নেই সুন্দর লাগার, আমার বউমা যেমন তেমনই সুন্দর।

মরিয়ম খাতুন তাড়া দিয়েন তাহমিনাকে। তাহমিনাও মায়ের আদেশ মতে মেহরাকে নিয়ে নিজের রুমে যায়। তাহমিদের রুম এখনো সাজানো বাকি।

হাফসিল্কের একটা শাড়ি পরিয়ে নিচে নিয়ে আসে মেহরাকে। ভারি সাজ উঠিয়ে অল্প সাজে নিয়ে এসেছে। ল্যাভেন্ডা শাড়ি সাথে হালকা সাজে মেহরাকে অপসারী লাগছিলো।

নিচে নামার পরে মরিয়ম বেগম মেহরাকে টেবিলে নিয়ে যান। মেহরার সকাল থেকে খাওয়া হয় নি। মরিয়ম বেগম নিজ হাতে খাইয়ে দেয় মেহরাকে। খাওয়া শেষে লিভিং রুমে এনে বসায় মেহরাকে। একে একে সব মেহমান এসে মেহরাকে দেখে যায়।

———–

রাত প্রায় পৌনে একটা। সব ঝামেলা মিটিয়ে রুমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় মেহরা। তাহমিদও রুমে এসেছে মাত্র। রুমে এসেই শাড়ি খুলে হাত পা মেলে শুয়ে ছিল মেহরা। এর মধ্যে তাহমিদ রুমে আসায় হকচকিয়ে যায় মেহরা। মেহরার হকচকিয়ে যাওয়া দেখে তাহমিদ হাসে। তাহমিদের হাসি দেখে মেহরা বলে,

– এই খবরদার!

– মহারাণী খবরদারী আজ মানবো না…….

চলবে,