আমার বোনু পর্ব-১৪+১৫

0
328

#আমার_বোনু
#Part_14
#Writer_NOVA

আদিল পানির গ্লাস আর ঔষধ এনে অথৈ এর দিকে বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু মুখে কোন কথা বললো না। অথৈ কান্না চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। সে ঔষধ খাবে না এমন একটা ভাব। আদিল পাশে বসে জোর করে ঔষধগুলো খাইয়ে দিয়ে বললো,

— নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলে দিতে পারো। তবে একটা শর্ত আছে। আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি যাতে না হয়। যদি তোমার কারণে ওর অসুবিধা হয় তাহলে তোমার খবর আছে।

অথৈ ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগলো। কয়েকদিন যাবত অথৈ এর ওপর আদিল পূর্বের থেকে বহুগুণ বেশি যত্নশীল হয়ে গেছে। কিন্তু মুখে বেশি একটা কথা বলে না। বললেও গম্ভীর কন্ঠের কাঠ কাঠ জবাব। আদিল খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে অথৈ থমথমে কন্ঠে বললো,

— আমাকে কি মাফ করে দেয়া যায় না?

আদিল পেছন ফিরে বললো,
— ঘুমানোর সময় হয়েছে ঘুমাও।

— তুমি আমার কথার উত্তর দাও।

— আমি আবারো বলছি অথৈ। তুমি প্রেগন্যান্ট। তাই আমি তোমাকে এতো সেবাযত্ন করছি। নয়তো আমি যে কি করতাম নিজেও জানি না। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ তুমি আমার বাচ্চার ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করো না। তাহলে কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে যাবে।

— আদি প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও।

আদিল ভ্রুকুটি কুঁচকে বললো,
— তোমাকে তো আমি সুযোগ দিয়েছিই অথৈ। আমি বলেছি তোমায় ডিভোর্স দিবো না। তোমায় আগের থেকে বেশি যত্ন নিবো। সেটা অবশ্য আমার বাচ্চার জন্যই। তবে তোমার সাথে আমার প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা হবে না। তুমি আমায় চোখের সামনে দেখতে পারবে কিন্তু ছুঁতে পারবে না। এটাই তোমার শাস্তি। তবে তুমি ডিপ্রেশনে গিয়ে আমার বাচ্চার কোন সমস্যা করতে পারবে না।

অথৈ করুন সুরে ডেকে উঠলো,
— আদি!

আদিল হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
— বোন তার ভাইকে ভাবীর কাছ থেকে নিয়ে যাবে। বিষয়টা কিন্তু একেবারে অযাচিত ও অযৌক্তিক। অথচ তোমায় এমনভাবে কানপড়া দিয়েছে যে তুমি সেই বিষয় নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছিলে। তোমার কি সামান্য কমন সেন্স নেই? ওহ থাকবে কি করে? তুমি তো তখন হিতাহিত জ্ঞনশূন্য হয়ে গেছো। কথা বাড়িয়ো না। চুপচাপ শুয়ে পরো।

আদিল কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো,
— তবে একটা কথা জানো কি অথৈ? মেয়েরা মেয়েদের বড় শত্রু। কথাটা মানুষ এমনি এমনি বলে না। আমি তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। তোমার বান্ধবীর না তোমার সুখটা সহ্য হচ্ছিলো না৷ তাই তোমাকে এমন কানপড়া দিয়েছে। আর তোমার নিজেরো বোধহয় সহ্য হচ্ছিলো না। ঐ যে একটা প্রবাদ আছে না, “সুখে থাকতে ভুতে কিলায়”।তোমাকেও ভুতে কিলিয়েছে। তোমার মাথা থেকে ভুত নামানোর জন্য আমাকে তো এতটুকু স্টেপ নিতেই হবে।

অথৈ ঠোঁট চিপে কান্নাটা আটকে নিলো। পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। আদিল খালি গ্লাস নিয়ে নিচে চলে গেলো। কিছু সময় পর এসে দেখে অথৈ ঘুমিয়ে গেছে।আদিল এগিয়ে এসে অথৈর শরীরে কাঁথা টেনে দিলো। তারপর লাইট বন্ধ করে অথৈ কে জড়িয়ে ধরে সেও শুয়ে পরলো।

— মাসফি বস!

জিকু ডাকতেই মাসফি নামের ছেলেটা ফাইলের থেকে চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু বলবে?

জিকু মাথা ঝাঁকালো। মাসফি কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। জিকু যেই মুহুর্তে মুখ খুলবে সেই মুহুর্তে সে বললো,

— জিকু, তোমায় একটা কাজ দিয়েছিলাম আমি।

জিকু দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বললো,
— সেই কাজের কথা বলতে এসেছিলাম আমি।

মাসফি নড়েচড়ে বসলো। চেয়ার ডানে-বামে নাড়াতে নাড়াতে বললো,
— হুম বলো।

জিকু দম ছেড়ে বললো,
— মির্জাদের একমাত্র দূর্বলতা তাদের বোন। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন। বোনকে তারা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। বোনের দিকে যারা বাজে দৃষ্টিতে তাকাবে তার চোখ উপড়ে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।

মাসফি মুখে রহস্যময় হাসি টেনে বললো,
— আই লাইক ইট।

জিকু মাসফির কথা শুনতে পায়নি। তাই একটু জোরে চেচিয়ে বললো,
— জ্বি বস! কিছু বললেন?

মাসফি টেবিল থেকে পেপারওয়েটটা নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে গেলো। পেপারওয়েট ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে আবার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে খেলতে লাগলো। কাচের দেয়ালের সামনে গিয়ে বাইরের ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। সাথে সাথে বাইরের নিকেষ কালো আধারের মতো তার মুখটাও আঁধারে ছেয়ে গেলো। মুখ শক্ত করে বিরবির করে বললো,

— যেই আগুনে আমি এতদিন পুড়েছি তোরাও সেই আগুনে পুরবি। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

কথাগুলো বলতে বলতে বাম হাতটা কাচের দেয়ালের ওপর রাখলো। মুখটা তার রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। জিকু এক পলকে মাসফির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ তার বসের মতিগতি সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ তাদের রুমের দরজায় এক মহিলা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো,

— মাসফি বাবা, অদিতি মায় অনেক পাগলামি করতাছে। ওরে কিছুতেই থামান যাইতাছে না।

মাসফির রক্তিম বর্ণ মুখে নিমিষেই চিন্তার ভাজ পরলো। পেপারওয়েটটা ছুঁড়ে জিকুর হাতে দিলো। জিকু অল্পের জন্য ক্যাচ মিস করতো। আর ক্যাচ মিস হলে পুরো নাক ফাটতো। কারণ মাসফি না দেখেই জিকুর নাক বরাবর পেপারওয়েটটা ছুঁড়ে মেরেছিলো। পেপারওয়েট ছুঁড়ে মাসফি এক সেকেন্ডও দেরী করেনি৷ দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।

কলেজ ছুটি দিয়েছে আধা ঘণ্টা হবে। এখনো ঊষাকে নিতে কেউ আসেনি। ঊষা বিরক্তিতে কলেজ গেইটের সামনের দিকে পায়চারি করছে। তার ইচ্ছে করছে পায়ে হেঁটে কিংবা রিকশা করে বাসায় চলে যেতে। বাসের কথা একবার মনে আসতেই সেদিনের কথা ভেবে আৎকে উঠলো। তারিন ওর সাথে রাগ করে কলেজ আসেনি। ও থাকলে দুজন বকবক করতে করতে যাওয়া যেতো। ঊষা বিরক্তি নিয়ে এদিক সেদিক তাকালো৷ কলেজ পুরো ফাঁকা।

হঠাৎ ঊষার মনে হলো সে রূপান্তিকে দেখলো। কিন্তু রূপান্তি ওকে দেখে মাথা নিচু করে অন্য দিক দিয়ে চলে গেলো। ঊষা কিছুই বুঝলো না। রূপান্তির এমন ব্যবহারে সে অবাক হয়ে আপনমনে বললো,

— এই রূপান্তি এত ভালো কবের থেকে হলো🤷‍♀️?

রূপান্তিকে নিয়ে বেশি ভাবলো না। তার এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকতে একটু ভয় ভয় করছে। উত্তর দিকের দেয়ালের পাশে বখাটেদের দেখা মিলে। দিনে-দুপুরে জুয়া খেলা, গাঁজা খাওয়া আর মেয়ে দেখলে উত্যক্ত করা এদের প্রধান কাজ।রাস্তার ডান পাশ, বাম পাশ আবারো দেখলো। না, কোন ভাইয়ের আসার নাম-গন্ধ নেই। মোবাইল বের করে অরূপের নাম্বার ডায়াল করলো। অপরপাশ থেকে শোনা গেলো,

— আপনি যেই নাম্বারে ডায়াল করেছেন তা এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন।

ঊষা চরম বিরক্তিতে মোবাইল বন্ধ করে দিলো। সিদ্ধান্ত নিলো একাই চলে যাবে। গটগট পায়ে হাঁটতে লাগলো। কিছু দূর পর ঠাওর করতে পারলো সে কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেয়ালের পাশ ঘিরে যাওয়ার সময় বখাটে ছেলেদের নজর পরে যায়। দুপুরের প্রখর রোদে রাস্তায় মানুষ নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা রিকশা, গাড়ির শা গতিতে চলে যাচ্ছে। ঊষা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে সামনে এগুতে লাগলো। কিন্তু বিধি বাম! ছেলেগুলো ওকে ঘেরা দিয়ে ফেললো। ঊষা ভয়ে এবার ঘামতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো পিছিয়ে দিবে একটা দৌড়। তবে সেই সুবিধা করতে পারলো না। একটা ছেলে এসে ওড়না টেনে ধরলো।ঊষা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। ঊষা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতে লাগলো। ছেলেগুলোর মধ্য একজন বিচ্ছিরি একটা হাসি দিয়ে ঠোঁট চোখা করে চুমু দেখালো। তখুনি পাশ থেকে একজন আগন্তুক বলে উঠলো,

— আরে বস আস্তে ওড়না ধরেন। মেয়েটা ব্যাথা পাচ্ছে তো।

লিডার দেখতে ছোকরাটা ভ্রু কুঁচকে ব্যক্তিটার দিকে তাকালো। যে ছেলেটা ঊষার ওড়না ধরেছে সেই ছেলেটাকে আগুন্তক ছেলেটা এক পলক দেখে নিলো। লিডার ছোকরাটা তার সাথের জনকে বললো,

— দেখতে নিরইব্বা কে আইছে।

নিরব নামের ছেলেটা দৌড়ে সেদিকে গেলো। ঊষা তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখার জন্য উঁকি দিলো।তবে নিরবের কারণে মুখ দেখতে পারলো না। নিরব এগিয়ে গেলে সেই ব্যক্তিটা মুখের মধ্যে একটা পাঞ্চ মারলো।মুখ থুবরে নিরব পরে গেলো। আগুন্তক ভাব নিয়ে শার্ট ঝাড়া মেরে বললো,

— ত্যারা বাপ আয়া!

~~~রাখতে জানলে আর থাকার ইচ্ছে থাকলে কেউ কখনো হারায় না❤️।

কিছু কথাঃ
অনেকেই অথৈ-কে সাপোর্ট করছেন। বলছেন ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। আচ্ছা আপনাদের সাথে আমি একমত। ওকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। অবশ্যই ওকে সাথে সাথে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত ছিলো যদি সে প্রেগ্ন্যাসির কারণে এমনটা করতো তাহলে। অন্যের উস্কানিতে যে মেয়ে নিজের ননদের সাথে এমনটা করে তার কি আদোও এত সহজে ক্ষমা করা উচিত? অযাচিত একটা বিষয় নিয়ে মাতামাতি করাও বা ঠিক? “বোন তার স্বামীকে কেড়ে নিবে।” কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয় কি? জানেন এই টাইপের মেয়েদের জন্য যে একটা সুন্দর সংসার নষ্ট হয়ে যায়? যারা অন্যের উস্কানিতে একটা সুন্দর সংসারে অশান্তি লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়, তারাও বা কোন মন-মানসিকতার মানুষ? এখন যদি অথৈ এর এই অপরাধকে আদিল প্রশ্রয় দিতো তাহলেই তো সংসারটা ভেঙে যেতো। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব লেগে যেতো। আর আদিল তার স্ত্রীকে মূল্য দেয় না তাও বা আপনাদের আগ বাড়িয়ে কে বলেছে? আমি কিন্তু এই ঘটনার প্রথম দিকেই বলেছি আদিল তার স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় দেয়, অনেক কেয়ারও করে।একটা পুরুষের কাছে বোনের জায়গায় বোন, স্ত্রীর জায়গায় স্ত্রী। কারো সাথে তো কারো জোড়া নয়। তবে একটা কথা সত্যি মাঝে মাঝে কিছু কুটনি টাইপের বোনের জন্য ভাবীর সংসার নষ্ট হয়। আবার কিছু কুটনি টাইপের ভাবীর কারণে বোন তার ভাইয়ের চোখের বিষ হয়। নিজের চোখেও এমনটা দেখেছি।

#চলবে

#আমার_বোনু
#Part_15
#Writer_NOVA

— ত্যারা বাপ আয়া!

কন্ঠটা ঊষার খুব পরিচিত লাগলো। তাকিয়ে দেখলো যাকে ভাবছিলো সেই। ঈশান সিনেমাটিক ভাবে নায়কের স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইকে দেখতেই ঊষার সাহস বেড়ে গেলো। ঝাড়া মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে ঈশানের কাছে চলে গেলো। ঈশান ঊষার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো,

— নিজেকে নিজে কবে রক্ষা করতে শিখবি? তুই আসলেই বলদী একটা। একেবারে হলদী খেতের বলদী।

ঊষা কপাল কুঁচকে অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখলো। ঈশান দুই আঙুল দিয়ে ওর গাল জোরে টান মারলো। ওমনি ঊষা দুম করে ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলো। ঈশান পিঠে হাত দিয়ে চেচিয়ে বললো,

— তুই শুধু আমার সাথেই পারবি। কই এতখন তো ওদের সাথে পারলি না।

বখাটেদের লিডার এবার গর্জে উঠে যে ছেলেটা ওড়না ধরেছিলো তাকে বললো,
— তাকায় তাকায় কি দেহস? যা বেডারে সাইজ কর।

ছেলেটা দৌড়ে এসে ঈশানকে ঘুষি মারতে নিলেই ঈশান খপ করে হাত ধরে জোরে মোচড় লাগালো। ছেলেটা ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। ঈশান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— এই হাত দিয়ে আমার বোনুর ওড়না টেনে ধরেছিলি তাই না? অপেক্ষা কর তুই। তোর এই হাত আর সচল থাকবে না।

হাত মোচড় দিয়ে ধরে রেখেই এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো ঈশান। বেশি সময় খুঁজতে হলো না। কাঙ্খিত বস্তুটা পায়ের কাছেই পেয়ে গেলো। বাম হাতে ইটের বড় টুকরাটা তুলে নিলো। তারপর ছেলেটার হাত নিচে রেখে ইট দিয়ে দিলো এক বারি। লাগাতার বারি দিতেই থাকলো। ঊষা ভয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেলো। ছেলেটার আর্তনাদে বাকিগুলো ভরকে গেলো। হাতটাকে আধা থেঁতলে ঈশান তবেই ছাড়লো। ছেলেটা নিচে পরে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ঈশান একবার সেদিক তাকিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললো,

— ঠোঁট চোখা করে চুমু কে দেখিয়েছিলো?

সবগুলো চুপ মেরে গেলো। ঈশান রেগে চিৎকার করে উঠলো।

— জলদী বল কে দেখিয়েছে। নয়তো সবগুলোকে পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে ফেলবো।

লিডার ছেলেটা ভয়ে ভয়ে আঙুল দিয়ে পাশের ছেলেটাকে দেখিয়ে দিলো। ওদের লিডারের দেখাতে দেরী ঈশানের সেটাকে ধরতে দেরী না। মুখে কয়েকটা ঘুষি মেরে আগে চোখে সরিষা ফুল দেখালো। যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। তারপর দুই আঙুল দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে পকেট থেকে লাইটার বের করলো। আগুন জ্বালিয়ে ঠোঁটের মধ্যে অনেক সময় ধরে রাখলো। ছেলেটা ছটফট করছে। তার শক্তি না থাকায় ভালো করে নড়তেও পারছে না। বেশ কিছু সময় ধরে রাখার পর ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে লাইটার পকেটে রাখতে রাখতে বললো,

— যা আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু যে হাল করেছি তাতে অন্ততপক্ষে সাত দিন ঠিকমতো খেতে পারবি না।

এবার বাকি ছেলেগুলো উঠেপড়ে দৌড় লাগাতে নিলেো। কিন্তু তা পারলো না। পাশেই ডেকোরেশনের দোকান ছিলো। সেই দোকানের ছোট, বড় অনেক বাঁশ রাস্তার পাশে রেখে দিয়েছে। ঈশান সেখান থেকে একটা মোটা বাঁশ নিয়ে একচোট সবগুলোকে পিটাতে লাগলো। কিছু সময় পিটিয়ে ঈশান ঘাড় কাত করে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

— একটা এখান থেকে পালাবি, তাহলে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলবো।

ওর ঠান্ডা স্বরের হুমকিতে কেউ পালালো না। সবগুলো দৌড়ে এসে ঈশানের পা জড়িয়ে ধরলো। লিডার মতো ছোকরাটা বললো,

— ভাই ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো মাফ করে দেন।

ঈশান একবার ঊষার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমার বোনুর কাছে মাফ চা।

ঈশান বলতে দেরী হুরমুর করে ঊষার পায়ে পরতে দেরী নয়। ঊষা আচমকা এমন হওয়ায় ভড়কে গেলো। পা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

— আমার পা ধরতে হবে না। আমি মাফ করে দিয়েছি।

সবগুলল পুনরায় ঈশানের সামনে এসে মাথা নিচু করে বসে বললো,
— ভাই, আফায় মাফ করে দিছে৷ এবার আপনিও করে দেন।

ঈশান হুমকির স্বরে বললো,
— আরেকদিন যদি আমি তোদের এই জায়গায় দেখি তাহলে সেদিন হবে তোদের শেষ দিন।

ঈশান আর কথা বাড়ালো না। হুমকি-ধমকি দিয়ে ঊষাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। একটা ছেলে ভয়ে ভয়ে মুখ কুচোমুচো করে জিজ্ঞেস করলো,

— ভাই আপনার নাম কি?

ঈশান পেছন ঘুরে মাথা চুলকে এক গাল হেসে শয়তানি করার ভঙ্গিতে বললো,
— ঈশান মির্জা!

ওর নাম শুনে যেনো সাথে সাথে সবগুলোর গলা শুকিয়ে এলো। এই ঈশানের অনেক কথা তারা শুনেছে। কিন্তু কখনো নিজের চোখে দেখেনি। ঈশানের রাগ আর পাওয়ারের বিষয় তারাও অবগত। আজকে তারা ওর বোনের দিকে নজর দিয়েছে এটা ভেবেই গলা শুকিয়ে এলো। পড়িমরি করে উল্টো দিকে দিলো ছুট। পিছু ফিরে আর তাকালো না।সেকি দৌড়! এই দৌড় শেষ হওয়ার নয়।ঈশান হাসতে হাসতে বোনকে নিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

ঊষা বর্তমানে তার ছোট তিন ভাইয়ের ওপর চরম বিরক্ত। কিচেনে এসেছিলো শখ করে একটু পুডিং বানাতে৷ কিন্তু তার শয়তান তিন ভাই তাকে জ্বালিয়ে ভাজা ভাজা করছে। হুট করে তিন ভাইয়ের বিকেল বেলায় আগমন। বড় দুই ভাই না থাকায় তারা যেনো বোনকে জ্বালাতে আশকারা পেয়ে যায়। আজও তাই হয়েছে। এই তো একটু আগে ইশাত নিজের মুখের একটা চাবানো চুইংগাম ওর সামনে এনে হাত দিয়ে ইচ্ছে মতো দলা মোচড় করে ঊষাকে বললো,

— কিরে জরিনার মা, খাবি?

ঊষা হাতের খুন্তি উঁচিয়ে বললো,
— তুই কি যাবি😤?

ইশাত মুখ দিয়ে টক করে শব্দ করে বললো,
— আজকাল ভালো করলে ভালো নেই। আমি কত সুন্দর ভালোবেসে তোর জন্য এনেছিলাম।

ঊষা রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো,
— খাচ্চোর ছেমড়া। সর সামনের থেকে। তোর মুখের চাবানো চুইংগাম আমি কেন খাবো? তার মধ্যে আবার হাতের ময়লা সব লাগালি। তোরটা তুই খা। নয়তো তোর বউকে দে।

ইশাত আফসোসের সুরে বললো,
— আজ একটা বউ থাকলে কি তোকে সাধি?

ঊষা ওর হাতের খুন্তি রেখে ওর চুল টান দিয়ে বললো,
— ভালো চাইলে যা এখান থেকে। আমাকে কাজ করতে দে। নয়তো বড় ভাইয়ু, মেজো ভাইয়ু এলে তাদের কাছে বিচার দিবো।

ইশাত মুখটাকে কালো করে বললো,
— খাবি না ভালো কথা। তাই বলে এভাবে আমার চুইংগামকে অপমান করতে পারিস না। ওরও তো মান-সম্মান আছে।

ঊষা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইশাত মুখ কুচোমুচো করে বললো,
— যাচ্ছি, যাচ্ছি। ঐভাবে চোখ রাঙিয়ে বাচ্চা ছেলেটাকে ভয় দেখাস না।

চুইংগামটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মেরে ইশাত দফা হলো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দুটো ঘূর্ণি দিয়ে ডান্স দিয়ে ঈশান, অরূপকে বললো,

— জ্বালিয়ে রেখে এসেছি। এবার কে যাবি বল?

অরূপ হাত তুলে সামনের পাটি দাঁত দেখিয়ে বললো,
— এবার আমি যাই।

ঈশান ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,
— জলদী আসিস। পরের ট্রিপে কিন্তু আমি।

অরূপ নাচতে নাচতে কিচেনের দিকে ছুটলো। বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু সময় মুখ আর পেট ধরে হেসে নিলো। তারপর মুখটাকে ইনোসেন্ট করে ভেতরে ঢুকলো। ইশাত ঈশানকে তার কান্ডকারখানা বলছে আর দুই ভাই লুটোপুটি খেয়ে হাসছে। হঠাৎ দুই ভাইয়ের কানে টান পারতেই চেচিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখে জিনিয়া দুজনের কান টেনে ধরেছে। জিনিয়া চোখ দুটো ছোট করে বললো,

— ওরে বিচ্ছু পোলা। আজ এই কাহিনি হচ্ছে? আমিও তো বলি হঠাৎ তিনজন বাড়িতে কেন? আমার আদুরিনী, ননদিনীকে জ্বালাতে তোমরা দল বেঁধে চলে এসেছো?

ইশাত ঈশান দুজনে একসাথে চেচিয়ে উঠলো,
— ভাবী লাগছে ছাড়ো।

— লাগুক, লাগার জন্য ধরেছি।

সিড়ির ওপর থেকে অথৈ জোরে চেচিয়ে বললো,
— আচ্ছা করে কান মলে দাও ভাবী।

অথৈ কে দেখে ইশাত, ঈশান দুজনের মুখ কালো হয়ে গেলো। ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঈশান জিনিয়াকে বললো,

— বড় ভাবী তাকে বলে দিও যতদিন অব্দি নিজেকে সে শুধরাতে না পারবে ততদিন যেনো আমাদের সামনে না আসে।

অথৈ মুখ গোমড়া করে নিজের রুমে চলে গেলো। তার পাপের শাস্তি এসব। তাই তাকে সবার কটু কথা সহ্য করতেই হবে। ইশাত জিনিয়াকে বললো,

— ছাড়ো ভাবী লাগছে তো। তুমি যদি আমাদের কান না ছাড়ো তাহলে কিন্তু এই শুক্রবার তোমাকে জ্বালিয়ে তেজপাতা করবো।

জিনিয়া কান মোচড় দিয়ে বললো,
— তবে রে পাঁজি…..

আরো কিছু বলার আগে ঊষার চিৎকারের আওয়াজ এলো কিচেন থেকে। জিনিয়া কান ছেড়ে সেদিকে ছুটলো। গিয়ে দেখে অরূপ সেখান থেকে পালিয়েছে। জিনিয়া জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে?

ঊষা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে তেজীস্বরে বললো,
— শয়তানগুলো, আজ আমার সাথে লেগেছে। দেখো তো ক্যারামেলের কি অবস্থা করেছে। অরূপ ভাইয়ু এসে বললো, “দে বোনু তোকে আমি কাজে সাহায্য করে দেই”। আমিও ভালো মনে দিলাম। আমি কি জানি এদের মনে শয়তানি বুদ্ধি ঘুরছে।দেখো তো আমার ক্যারামেল পুড়িয়ে কি করেছে? একেবারপ কুচকুচে কালো করে ফেলছে। কার ভালো লাগে এসব? কোথায় বাদড়টা? গেলো কোথায়? আজকে আমি ওকে আলুভর্তা করবো।

ড্রয়িংরুম থেকে আবারো তিন ভাইয়ের হো হো হাসির আওয়াজ আসছে। ঊষা যতটা মুখে হুমকি-ধমকি দিলো কাজে কিছুই দেখালো না। চুপচাপ নিজের মতো করে পুডিং বানাতে মনোযোগ দিলো।তার এখন ভাইদের সাথে আগ বাড়িয়ে লাগার মুড নেই। অবশ্য তিন ভাই তাই চাচ্ছে। বোনের রান্না ভেস্তে দিতে। জিনিয়া ঊষাকে সাহায্য করতে চাইলেও সে করতে দিলো না।

প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে গেছে। এবার জ্বালানোর পালা ঈশানের। ঈশান একটা ললিপপের খোসা ছাড়িয়ে কিচেনে ঢুকলো। ঊষার সামনে এসে সেই ললিপপ ওয়াক থু শব্দ করে একদলা থু থু ছিটালো। তারপর ঊষার মুখের সামনে ধরে বললো,

— নে বোনু খা।

ঊষা একবার দাঁত কিড়মিড় করে ওর দিকে তাকালো। সেই রাগী চাহনি তোয়াক্কা করে ঈশান বললো,

— খেয়ে দেখ অনেক মজা। তোর প্রিয় অরেঞ্জ ফ্লেভারের।

ঊষা হাত মুঠ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— এই তোরা এতো খাচ্চোর হইছিস কবের থেকে? তোর থু থু দেওয়া ললিপপ আমি খাবো? সরলি সামনের থেকে? নয়তো গরম দুধ শরীরে ঢেলে দিবো।

ঈশান মন খারাপের ভান করে বললো,
— এতো ভালোবেসে ললিপপটা সাধলাম তাও নিলি না।

— ওয়াক ছিঃ! তোর মুখের ঐ ললিপপ আমি খাবো?ঐ খাচ্চোর তুই এসব ভাবিস কিভাবে?

ঈশান কাঁদো কাঁদো ভান ধরে অভিনয় করে বললো,
— শ্বশুর বাড়ি না যেতেই ভাইদের পর করে দিচ্ছিস বোনু। আর শ্বশুর বাড়ি গেলে কি করবি? হু এখন তো সব তোর ঐ জামাই। আর আমরা ঠনঠনাঠন ঘন্টা।

ঊষা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
— দূরে গিয়া মর শয়তান। তোরা সবগুলি ফন্দি করে একের পর এক আমাকে জ্বালাচ্ছিস। আমি তোদের চিনি না ভাবছিস?

— চলে যাবো আগে আমার ললিপপ নে।

— সর ঈশাইন্না।

— থাক না নিলে আর কি করার। আমার ললিপপ আমি খাই।

হাতের ললিপপটা মুখে পুরে নিয়ে শব্দ করে চেটেপুটে চাকুমচাকুম করে ঈশান খেতে লাগলো। মনে হচ্ছে না জানি কোন অমৃত খাচ্ছে। ঊষা ওর কাঁধে ধাক্কা মেরে বললো,

— কিচেন থেকে যা তো। আবার দেখা যাবে কোন আকাম করে ছুট লাগিয়েছিস।

ঈশান মুখ থেকে ললিপপ বের করে বললো,
— এটা খা তাহলে চলে যাবো।

— ছোট ভাইয়ু সর বলছি। মেজাজ এমনিতেই অনেক গরম। আর গরম করিস না।

— খাবি না?

— খাচ্চোর তোর মুখেরটা আমি খাবো কেন?

— সত্যি খাবি না?

— না খাবো না।

— আচ্ছা! তাহলে দেখ আমি কি করি।

শেষের কথাটা ঈশান আস্তে বলেছে। তাই ঊষা শুনতে পেলেও বুঝতে পারেনি৷ ঊষা আপনমনে পুডিং-এর জন্য দুধ জ্বাল করতে লাগলো। খুন্তি দিয়ে অনরবত নাড়ছিলো যাতে নিচে লেগে না যায়। আর ঈশানের সাথে কথা বলছিলো। ঈশান ফট করে ওর মুখের ললিপপটা দুধে ছুঁড়ে মেরে দিলো দৌড়। ওকে আর পায় কে! যাওয়ার আগে হাসতে হাসতে বললো,

— এবার বোঝ ঠেলা।

ঊষা রেগে গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে বললো,
— ভাইয়ুরে তোদের আজকে খবর আছে🤬।

~~~মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। কোনকিছু পাওয়ার আগে ও হারিয়ে ফেলার পর আফসোস করে। কিন্তু থাকতে মূল্য বুঝে না।

#চলবে