আমার বোনু পর্ব-১৬+১৭

0
337

#আমার_বোনু
#Part_16
#Writer_NOVA

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সব ভাইকে বাসায় দেখা যায়। এই একটা দিন তারা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে। তবে আজকে আদিল নেই। ও একটা সিরিয়াস কেইস ইন্ভিস্টেগিশনের দায়িত্ব আছে। তাই আদাজল খেয়ে সব ছেড়ে সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে।

অর্ণব, অনল, ঊষা সোফায় বসে গল্প করছে। গল্পের মূল বিষয়বস্তু হলো অনলের লেখা। অনল সামনের আদর্শলিপি দেখে দেখে তার খাতায় পেন্সিল দিয়ে লিখছে। আর সেটা বাবা,ফুপিকে দেখাচ্ছে। তিন বিচ্ছুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। ইশাত, ঈশান, অরূপ বিপরীত সোফায় বসে লুডু খেলছে। মাঝে মাঝে ছক্কা, ছক্কা বলে চেচিয়ে উঠছে। পুরো ড্রয়িংরুম ওরাই উঠিয়ে ফেলছে।

অর্ণব বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোর পড়াশোনা কেমন চলছে বোনু?

ঊষা চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।

— কলেজে কোন ছেলে ডিস্টার্ব করে?

অর্ণবের কথা শুনে ঊষা ফট করে ঈশানের দিকে তাকালো। ঈশান খেলায় মত্ত। দুই হাতে নিজের গাল ধরে রেখে চার, চার বলে চেঁচাচ্ছে। ইশাতের পাকা গুটি খেতে আর চারের দরকার অরূপের। অরূপ ওর পাকা গুটি খেয়ে ফেলেছে। তাই ও এখন ইশাতকে বলছে অরূপের গুটি কাঁচা করে দিতে। অর্ণব ফের প্রশ্ন করলো,

— আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি বোনু।

— হ্যাঁ, ভাইয়া বলো।

— একটু আগে তো বললাম।

— না ভাইয়া কেউ ডিস্টার্ব করে না। কারো এতো সাহস আছে নাকি যে মির্জাদের বোনকে ডিস্টার্ব করবে?

অর্ণব খুশি হয়ে বোনকে বললো,
— এই তো সব কথার বড় কথা।

ঊষাও ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে মুচকি হাসলো। সামান্য বিষয়গুলো ঈশান একাই হ্যান্ডেল করে। তবে সব ভাইকে সেই বিষয়ের খুটিনাটি কথা বলে দেয়। অনল খাতায় একটা মাছ একে ঊষাকে দেখিয়ে বললো,

— দেখো রাণী আমি মাছ এঁকেছি।

ঊষা অনলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য খুশি হয়ে বললো,
— মা শা আল্লাহ! কত সুন্দর হয়েছে বাবা। কি মাছ এটা?

— এটা জাতীয় মাছ ইলিশ।

— ইলিশ মাছটা তো অনেক সুন্দর হয়েছে। দেখি তো তুমি আরো কি কি পারো।

— আমি পাখি আঁকতে পারি, আম আঁকতে পারি, ফুল আঁকতে পারি, শাপলা ফুলও পারি। তুমি দেখবা রাণী?

— হ্যাঁ, অবশ্যই দেখবো।

অর্ণব এক ধ্যানে বোন আর ছেলেকে দেখতে লাগলো। বোনকে কিছু দিন পর বিদায় দিতে হবে এটা ভেবেই তার বুক কেঁপে ওঠে।

অথৈ, জিনিয়া কিচেনে কাজ করছে। বিকেল থেকে একসাথে টুকটাক কাজ করে দিচ্ছে অথৈ। জিনিয়া অবশ্য মানা করেছিলো। কিন্তু সে শুনেনি।অথৈ সবজির ঝুড়িটা এগিয়ে দিয়ে জিনিয়াকে বললো,

— ভাবী, আমার অপরাধটা কি কখনো তারা মাফ করবে না?

জিনিয়া অথৈ এর দিকে না তাকিয়ে ছুড়ি দিয়ে আলুভাজির জন্য আলু কুচি কুচি করতে করতে বললো,

— মৌমাছির চাকে ঢিল দিলে তো তারা তোমায় হুল ফুটাবেই। তুমি সুস্থ নাকি অসুস্থ, পাগল নাকি মাতাল তাতো দেখবে না। তুমিও মৌচাকে ঢিল মেরেছো। তবে আল্লাহ তোমায় বাঁচিয়েছে। তুমি প্রেগন্যান্ট বলে আজও এই বাড়িতে। নয়তো চিরদিনের জন্য আদিল কে আর এই বাড়ি হারাতে তুমি। এখানে যে থাকতে পারছো তাতেই আলহামদুলিল্লাহ বলো।

অথৈ অসহায় গলায় বললো,
— আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত।

জিনিয়া এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— শুনো অথৈ কিছু কথা বলি। শুনতে খারাপ লাগবে আমি জানি। তবুও বলছি।

— হ্যাঁ ভাবী বলো।

— তুমি মোটেও অনুতপ্ত নয়। তুমি মুখে মুখেই বলছো তুমি অনুতপ্ত। কিন্তু তোমার কাজের মধ্যে সেই অনুতপ্ততা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার মধ্যে কি বিবেক বলতে কিছু নেই? তুমি কোন সাহসে নিজের সুখের সংসার ভাঙতে গিয়েছিলে? তাও একটা অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে? সত্যি বলতে তুমি ঊষাকে নিজের বোনের মতো ভাবতেই পারোনি। যদি ভাবতে পারতে তাহলে কখনও এসব কথা চিন্তা করতে পারতে না। তোমার ওপর আমার নিজেরও অনেক রাগ হয়েছিলো। কোন টাইপের মানুষ তুমি? তুমি তো নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছো। কখনো কি তোমার পরিবার কিংবা তোমার স্টাটাস নিয়ে কেউ কথা বলেছে বলো? কেউ বলেনি। তোমায় নিজের মানুষ বলে সবাই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু তুমি কি করলে? তাদের বিশ্বাস ভেঙে তাদের কলিজার টুকরোর বোনকে আঘাত দিলে। তুমি শুধু তাদের বোনকে আঘাত করোনি বরং তাদের হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরি চালিয়েছো। সেই জখম কবে সারবে তা একমাত্র তারা আর আল্লাহ ভালো জানে। তুমি এটাকে সামান্য বিষয় ভেবে হেয়ালি করছো। কিন্তু তুমি এর জন্য এখুনি নিজেকে শুধরে না নিলে ভবিষ্যতে বহুত পস্তাবে।

একটু থেমে জিনিয়া পুনরায় বললো,
— কথাগুলো তোমার ভালোর জন্যই বললাম। আমায় আবার ভুল বুঝো না। নিজের বিবেকবোধকে জাগিয়ে তুলো। আর কত তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে? এখনও সময় আছে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা বুঝতে শিখো। অন্যের কথায় নিজের মস্তিষ্ক চালনা করো না।

জিনিয়া ঝুড়িতে আলু কুচি নিয়ে বেসিনে গিয়ে ধোওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অথৈ থুম মেরে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে লাগলো। আদোও সেকি ঠিক কাজ করেছে!

ভাইকে দেখেই অদিতি পাগলামি থামিয়ে দিলো। দৌড়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— আমি ঔষধ খাবো না ভাইয়া। এই ঔষধ খেলে আমার খুব কষ্ট হয়। নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।

রূপা চাচী যিনি অদিতির দেখভাল করে সে করুন সুরে মাসফিকে বললো,

— বুঝিনা মাসফি বাবা, মাইয়াডা কিছুতেই ঔষধ খাইবার চায় না। ঔষধ দেখলেই ওর পাগলামি বাইড়া যায়। কি করমু আমি তুমি কও।

মাসফি বোনকে একহাতে আগলে রেখে রূপা চাচীকে বললো,
— ঔষধগুলো আমার হাতে দিন চাচী। আপনি বরং বোনের জন্য এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসুন।

রূপা চাচী মাথা হেলিয়ে বললো,
— আইচ্ছা বাবা। তবে ঔষধগুলান কিন্তু খাওয়ায় দিও। দুপুরেও খায় নাই।

রূপা চাচী পাশ কাটিয়ে কিচেনে চলে গেলো। মাসফি অদিতিকে নিয়ে ডিভানে বসলো। বোন তার গুটিসুটি মেরে বুকের সাথে মাথা হেলিয়ে রাখছে। ধীর কন্ঠে মাসফি ডাকলো,

— অদিতি!

অদিতি ক্ষীণ সুরে উত্তর দিলো,
— হুম!

— ঔষধ না খেলে তো তুমি সুস্থ হবে না। সুস্থ না হলে কি তোমায় তোমার ভালোবাসার মানুষ ফিরিয়ে নিবে বলো?

অদিতি দুই কান ধরে জোরে চেচিয়ে বললো,
— আমি ঔষধ খাবো না। আমি ঔষধ খাবো না।

মাসফি বোনকে সান্ত্বনা করার উদ্দেশ্য বললো,
— আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার ঔষধ খেতে হবে না। তোমায় আমি রূপকথার গল্প বলি। তুমি শুনবে?

অদিতি মাসফির বুকের থেকে মাথা উঠালো। ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা উপরনিচ নাড়িয়ে বুঝালো সে গল্প শুনতে রাজী আছে। মাসফি হাসিমুখে গল্প বলা শুরু করলো। বিয়ের বয়সী এক মেয়েকে কিনা রূপকথার গল্প শুনচ্ছে। লোকে শুনলে হাসবে। কিন্তু অদিতি এখন পুরো বাচ্চাদের মতো বিহেভ করে। ওকে সামলাতে হয় পুরো বাচ্চাদের মতো।

গল্প শুনতে শুনতে ভাইয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেছে অদিতি। মাসফির মনে হলো সে ছোট বাচ্চা ঘুম পারালো। বোনকে সেভাবে ধরে রেখে দৃষ্টি দিলো সামনের একটা ছবির ফ্রেমের দিকে। তবে মাথায় চিন্তা তার অন্য কিছুর। এই বিষয়টা সে আগে ততটা পাত্তা না দিলেও এখন তাকে ভাবাচ্ছে। বোন তার ঔষধ খাওয়ার পরই পাগলামি করে। নয়তো অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। যদিও অনেক আচার-আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। তবে ঔষধ খাওয়ার পর হিংস্র হয়ে যায়। কোনভাবে এই ঔষধের মধ্যে কিছু নেই তো? মাসফি মনে মনে ভাবলে আজই অদিতির ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।

বোনকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ব্লাংকেট টেনে দিলো। একটা ঝড়ে বোনের জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাসফি বিরবির করে চোয়াল শক্ত করে বললো,

— যে বা যারা তোর এই অবস্থার জন্য দায়ী তাদের আমি কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না।

~~~জীবনের চলার পথে যখন আপনি পাশে কাউকে চাইবেন তখন একটা কাকপক্ষীও পাবেন না।আর যখন নিজেকে গুছিয়ে একা চলতে শিখে যাবেন তখন পাশে থাকা মানুষের ভিড় পরে যাবে।

#চলবে

#আমার_বোনু
#Part_17
#Writer_NOVA

জিবরান রুমে ঢুকেই দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো। এলেমেলো পা ফেলে, চোখে মাদকতা নিয়ে ঊষার দিকে এগুতে লাগলো। ঊষা একটু আগেই ভাইদের সাথে রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসে পাঠ্যবই নিয়ে পড়তে বসেছিলো। মনটা তার অকারণেই আজ খুশি খুশি লাগছে। বহু সময় ভেবেও সেই খুশির উৎস খুঁজে পেলো না। দরজা আটকানোর শব্দে ঊষা চমকে উঠলো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো এলোমেলো পা ফেলে জিবরান এগিয়ে আসছে। ঊষা উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে আপনার? আপনি এভাবে হাঁটছেন কেনো?

জিবরান কোন উত্তর দিলো না। এগিয়ে এসে ধপ করে ঊষার ওপর পরে গেলো। ঊষা ওর বলিষ্ঠ দেহের নিচে চাপা পরে গেলো। এক হাতে জড়িয়ে জিবরানকে বললো,

— কি হয়েছে বলেন না!

জিবরানের থেকে এবারো রেসপন্স এলো না। সে ঊষার বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। কিছু সময় পর গলায় মুখ গুজে দিলো। ঊষা আচমকা এমন স্পর্শে শিহরিত হয়ে গেলো। তারা শরীরের প্রতিটা অঙ্গে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। জিবরান গলার দিকে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে মিনমিনে গলায় বললো,

— আই লাভ ইউ বউ। তুমি প্লিজ আমাকে ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না।

ঊষার বুকটা ধক করে উঠলো। জিবরানের কন্ঠের মাদকতা তাকে ঘোরে নিয়ে যাচ্ছে। আজ জিবরানের হলোটা কি? মনে মনে তাই ভাবছে৷ এর মধ্যে জিবরান আরেকটা কান্ড করলো। মাথা উঠিয়ে ঊষার মুখে অজস্র চুমু খেতে লাগলো। ঊষা এবার পুরো স্তব্ধ। জিবরানের এহেম কাজে তার যে কিরকম রিয়েকশন দেওয়া উচিত তাও ভুলে গেছে। তার গলা শুকিয়ে আসছে। কিরকম জানি একটা অনুভূতি হচ্ছে। সে এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়। মুখে চুমু খাওয়া শেষ হতেই জিবরান ঊষার ঠোঁটের দিকে নজর দিলো। ঊষা চোখ দুটো রসগোল্লা করে জিবরানের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। তবে তার কেনো জানি মনে হচ্ছে জিবরান আজ হুশে নেই। ঊষা কাঁপা কাঁপা গলায় অনুরোধের সুরে বললো,

— আমার ওপর থেকে সরুন প্লিজ।

জিবরান এক পলক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ঠোঁটের দিকে নজর দিলো। ঠোঁট বাড়িয়ে দিতেই ঊষা নিজের মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। জিবরান বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। কিছুটা রুক্ষস্বরে বললো,

— মুখ আগের জায়গায় রাখো।

ঊষা চোখ, মুখ খিচে বন্ধ করে রাখলো। কিন্তু জিবরানের কথা শুনে মুখ আগের জায়গায় রাখলো না। দুই হাতে জিবরানকে ধাক্কা দিতে দিতে বললো,

— আমার ওপর থেকে সরেন। আমি আপনার ভার সহ্য করতে পারছি না।

জিবরান আবারো গলায় মুখ গুঁজে নিচুস্বরে বললো,
— সহ্য না করতে পারলেও করতে হবে। এখন থেকে অভ্যাস করে নাও।

ঊষা চোখ বড় বড় করে জিবরানের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে আজ পাগল হয়ে গেছে। জিবরান ঊষার রিয়েকশন বুঝতে পেরে গলার কাছে কুটুস করে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। বিষয়টা বুঝতে ঊষার একটু সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারলো তখন যেই চেচিয়ে উঠবে তখুনি জিবরান ওর মুখ এক হাতে আটকে ফেললো। যার কারণে ঊষা আর চেঁচাতে পারলো না। জিবরান সাবধান করার উদ্দেশ্য বললো,

— করো কি, করো কি? আমাকে তোমার ভাইদের হাতে মাইর খাওয়াবে নাকি? চুপ করো।

ঊষা উম উম করতে লাগলো। জিবরান ওর হাত সরিয়ে নিলো। ঊষা হাঁপাতে লাগলো। কিছু সময় জোরে শ্বাস নিলো। জিবরান মাথা উঠিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এভাবে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করো। নয়তো আমি কন্ট্রোল লেস হয়ে যাবো।

ঊষা কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিবরানের দিকে তাকালো। নিজের মাথা একটু খাটাতেই বুঝতে পারলো। সাথে সাথে লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে গেলো। ওকে আরো লজ্জা দিতে জিবরান বললো,

— একদম গাল লাল করবা না। নয়তো কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলবো।

ঊষা লজ্জায় এবার লাল, নীল৷ মুখ ঘুরিয়ে হাত মুঠ করে চোখ বন্ধ করে রাখলো। জিবরান পূর্বের ন্যায় ঊষার বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। কিছু সময় কাটার পর জিবরান ধীর গলায় বললো,

— ঊষারাণী আজ রাতে আমার হবে? আমি তোমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নিতে চাই।

পুরো কথাটা কর্ণগোচর হতেই ঊষার হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ইঙ্গিত তাহলে এই দিকেই ছিলো। সে বুঝেও কেন বুঝলো না। জিবরান আবারো থেমে থেমে বললো,

— দিবে তোমার দহনে পুড়তে?

ঊষার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটা শিরায় শিরায় নাম না জানা অনুভূতি ছেয়ে গেছে। সে কোন উত্তর দিতে পারছে না। কি বলবে সে তাও জানে না। জিবরান ঊষার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ফের বললো,

— চুপ থাকা মানে সম্মতির লক্ষ্মণ। তোমার চুপ থাকাও কি আমি সম্মতি ধরে নিবো?

ঊষা চমকে উঠলো। সেই আওয়াজ জিবরানের কানেও পৌঁছিয়েছে। সে আর ঊষার থেকে উত্তরের আশা করলো না। মাথা উঠিয়ে ওষ্ঠ দুটো ডুবিয়ে দিলো ঊষার ওষ্ঠদ্বয়ে। ঊষা চোখ বড় করে বিছানার চাদর খামচে ধরে নিলো। তার আর কিছু বলার শক্তি নেই। সব শক্তি যে জিবরান কেড়ে নিচ্ছে।

সকালে গোসল শেষ করে টাওয়াল দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ঊষা বারান্দায় দাঁড়ালো। জিবরান এখন বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। ঊষা একবার ওর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো। সামনে দৃষ্টি দিয়ে চুল মুছতে মনোযোগ দিলো। সামনের বাগানে অনল আর পাপ্পি খেলছে। অনলের সাথে পাপ্পির বেশ ভাব জমে গেছে। আজকাল অনলের কাছে পাপ্পি থাকে। এমনকি নিজের রুমেও পাপ্পির ছোট ঘরটা নিয়ে গেছে।

অনল দূরে একটা টেনিস বল ছুঁড়ে মারছে। পাপ্পি সেটা দৌড়ে মুখে করে অনলের কাছে নিয়ে আসছে। লেজ নাড়িয়ে খুশিতে আবার ঘেউ ঘেউ করছে। ঊষা বারান্দায় গ্রিলের সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখেও অনলকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি করো অনল বাবা?

অনল টেনিস বলটা দূরে ছুঁড়ে মেরে ঊষার দিকে তাকালো। হাসি দিয়ে বললো,

— খেলতেছি রাণী।

ঊষা বিনিময়ে মুচকি হাসলো। কোন কথা বললো না। জিবরান ঘুমিয়েছে। জোরে কথা বললে ও উঠে যেতে পারে সেই চিন্তায়। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পরতেই ঊষা মৃদুস্বরে বললো,

— আসছি!

টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে দরজা খুললো। দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করলো। জিনিয়া চা নিয়ে এসেছে। ঊষাকে এত সকালে ভেজা চুলে দেখে চিন্তিত সুরে বললো,

— কি হয়েছে ঊষা তুমি ঠিক আছো? আজ এত সকালে গোসল করলে যে।

ঊষা ঠোঁটে হাত দিয়ে জিনিয়াকে হুশশ করে চুপ করতে বললো। কিন্তু জিনিয়া বুঝতে না পেরে আবারো জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি সুস্থ আছো তো? এই অবেলায় গোসল তুমি করো না। আজ হঠাৎ….

জিনিয়ার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে ঊষা জিমিয়ার হাত ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর নিচুস্বরে বললো,

— আস্তে কথা বলো। উনি উঠে যাবে।

জিনিয়া কপাল কুঁচকে বললো,
— কে উঠে যাবে?

ঊষা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। জিনিয়া উঁকি মেরে ভেতরের দিকে তাকালো। খোলা দরজা দিয়ে তাকাতেই দেখলো বিছানায় জিবরানকে শুয়ে আছে। জিবরানকে শুয়ে থাকতে দেখে নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে সুর টেনে বললো,

— ওহো, তাহলে এই ব্যাপার!

ঊষা লজ্জায় কিছু বলতে পারলো না। জিনিয়া তার ননদীকে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য মুখ টিপে হেসে বললো,

— এই তাহলে গোসলের রহস্য!

ঊষা হালকা চেচিয়ে উঠলো,
— বড় ভাবী!

— সরি গো ননদিনী। আমি তো আর জানি না আমার ননদাই এসেছে। যদিও আমার ছোট ভাই। আরেক সম্পর্কে তো ননদাই হয়। তা কখন এসেছে বিটকেলটা? বউয়ের টানে টানে চলে এসেছে। আর বোনকে জানায়ওনি।

ঊষা ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
— রাত ১১ টার দিকে এসেছিলো।

জিনিয়া ঠোঁট কামড়ে কিছু সময় হাসলো। তারপর দুষ্টামীর সুরে বললো,
— তা কোন ম্যাচ খেললো?

ঊষা চেচিয়ে শাসনের সুরে বললো,
— ভাবীই তোমার ছোট ভাই হয়।

জিনিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
— তাতে কি! আরেক সম্পর্কে ননদাই তো৷ সে সম্পর্কে বলেছি আমি।

— থামো তুমি। লাগামহীন কথাবার্তা।

জিনিয়া কাঁধ দিয়ে উষাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
— বারে, তোমারা কিছু করতে পারবে আর আমি বলতে পারবো না🤭।

— ভাবী চুপ করো তুমি।

জিনিয়া হাসতে লাগলো। ঊষা ঢেঢ় লজ্জা পেয়েছে। জিনিয়া হাসতে হাসতে বললো,

— হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। এই নাও চায়ের কাপ। আমি তো আর জানি না ও এসেছে। তাই এক কাপ চা নিয়ে এসেছিলাম। তুমি ওর জন্য এই চায়ের কাপ রেখে আসো। তোমরটা আমি নিয়ে আসছি।

— তোমার নিয়ে আসতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।

— উহু তোমার যেতে হবে না। তুমি ওর কাছে থাকো। ওকে একটু সময় দাও। সবসময় ব্যস্ত থাকে। নিজের কথা বলার সময় পায় না। সারাখন শুধু কাজ আর কাজ। তারপর ধকল তো কম গেলো না। ওর এখন তোমাকে প্রয়োজন। তুমি যদি ওর সামনে না থাকো তাহলে ও পুরো একা হয়ে যাবে।

জিনিয়া হাতের কাপটা ঊষার হাতে ধরিয়ে গালে হাত রেখে বললো,
— আমার ভাইটা না একটু পাগলাটে স্বভাবের। ওকে একটু সামলিয়ে রেখো। দেখবে একদম বাচ্চাদের মতো গুটিসুটি মেরে তোমার কাছেই রবে।

ঊষা মাথা হেলালো। জিনিয়া মুচকি হেসে চলে যেতে নিলো। ঊষা যখন চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে ঢুকবে তখুনি জিনিয়া পেছন থেকে ডাকলো,

— ঊষা!

— জ্বি ভাবী!

— আমিতো তোমাকে বলতে ভুলেই গেছি। যে কাজোর জন্য তোমার কাছে এসেছিলাম।

ঊষা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি কাজ ভাবী?

জিনিয়া ভ্রুকুটি কুঁচকে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,
— তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। আমি তাকে চিনি না। তোমার কোন ফ্রেন্ড হবে।সে বললো তুমি তার ফ্রেন্ড। আমি তাকে বসতে বলে নাস্তাপানি দিয়ে আসলাম। তোমাকে এর জন্য ডাকতে এসেছিলাম। এসে কথার পাল্লায় পরে ভুলেই গেছি। তুমি তাড়াতাড়ি নিচে এসো।

জিনিয়া দ্রুত নিচে চলে গেলো। ঊষা চিন্তায় পরে গেলো। এত সকালে ওর কোন ফ্রেন্ড আবার আসবে। ভেতরে ঢুকে ঊষা টেবিল লাইটের পাশে চায়ের কাপ রাখলো। কাপটা পিরিচ দিয়ে ঢেকে জিবরানের দিকে তাকালো। জিবরান এখনো ঘুমে। তাই ওকে জাগাতে মন চাইলো না। মাথায় চিড়ুনি চালিয়ে বড় করে একটা ঘোমটা টেনে দিলো। ধীর পায়ে রওনা দিলে ড্রয়িংরুমের দিকে।

সিঁড়ি বেয়ে যত নিচে নামছে ততই ঊষার হাত-পা কাঁপছে। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ব্যক্তিটার পেছন সাইড শুধু দেখা যাচ্ছে। তাতেই ঊষার ভীষণ ভয় করছে। আচ্ছা, ও কি তাহলে ফিরে এসেছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে সামনে এগুতেই চমকে গেলো ঊষা। যাকে ভেবেছিলো সেই এসেছে। থমকে যাওয়া কন্ঠে বিস্ময় ছড়িয়ে গেছে। বিস্মিত হয়েই থেমে থেমে বললো,

— আপ- আপনি!

~~~ নিজেকে ভালোবাসুন। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না সে কখনও অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। 🍂

#চলবে