আমার বোনু পর্ব-১৮+১৯

0
303

#আমার_বোনু
#Part_18
#Writer_NOVA

— আপা-আপনি!

ঊষার বিস্মিত গলা শুনে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। তবে সেটা আকাঙ্খিত মানুষটাকে দেখতে পাওয়ার নাকি অন্য কিছুর ইঙ্গিতে তা ঊষার বোধগম্য হলো না। সে দাঁড়িয়ে মুখের হাসি টেনেই জিজ্ঞেস করলো,

— কেমন আছো ঊষা?

ঊষা হঠাৎ করে মুখটা কঠিন করে ফেললো। কড়া গলায় জবাব দিলো,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

অসহায় গলায় সে বললো,
— আমাকে জিজ্ঞেস করলে না কেমন আছি?

ঊষা মুখ ঘুরিয়ে তার উত্তর দিলো,
— প্রয়োজন মনে করছি না।নিশ্চয়ই ভালো আছেন। খারাপ থাকলে তো আর এখানে আসতে পারতেন না।

সে কথা বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে মাথা নাড়িয়ে ঊষার কথার তাল মিলিয়ে বললো,
— তাও ঠিক কথা!

ঊষা সামনে এগুতে এগুতে বললো,
— হঠাৎ এখানে কেন পিয়াস সাহেব? আপনি না বিদেশে ছিলেন।

পিয়াস নামের ছেলেটা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। যেটা ঊষার কাছে রহস্যময় লাগলো। তার এতখন ভয় করলেও এখন করছে না। বরং সে পিয়াসের ওপর ঢেঢ় বিরক্ত।

হুট করে এত সকালে তার আগমনে ঊষা যে বিরক্ত তা বুঝতে পেরেছে পিয়াস। কিন্তু এছাড়া যে কিছু করার ছিলো না। ঊষাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাই দেরী করেনি। সকালবেলা এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই ঊষাদের বাড়িতে হাজির। পিয়াস একগাল হেসে বললো,

— তোমাকে না খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো জানো। দেরি করিনি তাই।

ঊষা নিজের বিরক্তিটা লুকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— এখন নিশ্চয়ই দেখেছেন।সো, যেতে পারেন।

পিয়াস দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,
— তাড়িয়ে দিচ্ছো?

— অনেকটা তাই।

থেমে দম টেনে ঊষা বললো,
—আমার ভাইয়ুরা এলে সিনক্রিয়েট হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার হাসবেন্ড রাগ করতে পারে।প্লিজ আমায় আর কোন ঝামেলায় ফেলেন না।এমনি বহু ভেজালে পরেছি আমি আপনার জন্য।

ঊষার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই সে তার হাসবেন্ডের কথা বলেছে।এই কথাটা মনে হতেই পিয়াসের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। হাসবেন্ডের কথা শুনেই সে হতবাক। চোখ দুটো ছলছল হয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?

ঊষা নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো,
— হুম!

— মিথ্যে কথা! আমি বিশ্বাস করি না।

— আপনার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আমার কিছু আসে-যায় না।

পিয়াসের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করছে। চোখের পানির ফোঁটাগুলো পিয়াস নিচে পরতে দিলো না। দৃষ্টি উপরের দিকে দিয়ে শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। ঊষা তা দেখেও কিছু বললো না। পিয়াস তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

— যার জন্য এতদূর থেকে এলাম সেই নাকি অন্য কারো হয়ে গেছে। এর থেকে বড় কষ্ট কি হতে পারে।

ঊষা উত্তর দিলো না। সে একটা জিনিস খেয়াল করেছে। সেটা হলো ছেলেটা কারণে-অকারণে হাসে। পিয়াসের মুখে এখনো হাসি। তবে তা কষ্ট লুকানোর। আবার শার্টের হাতায় চোখ মুছলো। ঊষা কিছু বলার আগে পিয়াস হাত দিয়ে থামিয়ে বললো,

— তোমার নতুন জীবন সুখের হোক। সেই কামনা করি। তবে একটা কথা জানো কি ঊষা?

ঊষা জিজ্ঞাসা সূচকভাবে উত্তর দিলো,
— কি?

পিয়াস দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে শ্বাসের শব্দ ঊষার কানে এসে বারি খেলো। তারপর সে বললো,

— তোমাকে পাওয়ার আক্ষেপ আমার সারা জীবন থাকবে। এ আক্ষেপ শেষ হওয়ার নয়। তুমি আমার হলেও পারতে! কিন্তু বিধাতা কেন রাখলো না তা তিনি ভালো জানেন।

পিয়াসের কথায় একরাশ বিষন্নতা প্রকাশ পেলো। ঊষার এই প্রথম পিয়াসের জন্য খারাপ লাগলো। ছেলেটা তো কোন দোষ করেনি। জন্মদিনের ফাংশনে তাকে দেখে পছন্দ করেছিলো৷ তারপর বিয়ে করার জন্য পাগলামি করেছে। তবুও ওর প্রতি ঊষার কেমন জানি একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করেছে। ওর জন্য এত দ্রুত জিবরানের সাথে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো। সাথে ঊষার মনে অজানা ভয়ও কাজ করেছিলো। পিয়াস ফিরে আসলে কি ঘটবে সেই আশঙ্কায়। কিন্তু পিয়াসের বর্তমান আচার-আচরণে সে কিছুটা অবাক। পিয়াস করুন কন্ঠে বললো,

— আসি! ভালো থেকো।

ঊষা কিছু বলার আগেই পিয়াস হনহন করে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। ঊষার বুক চিড়ে একটা চাপা শ্বাস বের হয়ে গেলো।

দোতালায় সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে সবকিছু লক্ষ্য করছিলো জিবরান। সে প্রথম থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। বিরবির করে আপনমনে বললো,

— এত সুন্দর ব্যবহার কেন পিয়াসের? কোন ঘাপলা নেই তো! আমার এখন ঢেঢ় সন্দেহ হচ্ছে।

লিফটের সুইচ টিপে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আরান। ছয় তালায় যেতে হবে তাকে। হাতে একটা ছোট প্যাকেট। সম্ভবত সেখানে কিছু ঔষধপত্র আছে।মিনিট খানিকের মধ্যে পৌঁছে গেলো। আরান লিফট থেকে বের হয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটলো। বাম দিকে আট কদম যাওয়ার পর A5 নামের ফ্লাটে কোলিং বেল চাপলো। প্রথমবার বেল বাজানোর পর কারো রেসপন্স এলো না। দ্বিতীয়বার বাজানোর আগে খট করে দরজা খুলে গেলো। বিদেশি এক ছেলে দরজা খুলে উঁকি দিলো। শুদ্ধ বাংলায় জিজ্ঞেস করলো,

— কাকে চাই?

আরান বিদেশি ছেলের মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনে বেশ অবাক হলো। মুখে বিস্মিতভাব বজায় রেখে ভ্রু চুলকে বললো,

— আমি মাসফি ভাইয়ের কাছে এসেছি।

— ওহ আচ্ছা। ভেতরে আসুন।

আরান ভেতরে ঢুকলো। ছেলেটা পিছন ঘুরে সরু চোখে আরানকে এক পলক দেখে জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি মাসফি বসের কি হোন?

আরান জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— আমি উনার ছোট ভাই।

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বললো,
— আরান!

আরান অচেনা ছেলের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো। মাথা চুলকে বোকা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি কি আমায় চিনেন?

ছেলেটা হাসলো। নিচুস্বরে বললো,
— আপনি মাসফি বসের চাচাতো ভাই তাই না?

আরান মাথা ঝাকালো। সে স্বভাবতই প্রশ্ন করে বসলো,
— আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।

ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— আমি জিকু! মাসফি বসের এসিস্ট্যান্ট।

আরান হাতটা লুফে নিলো। হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো,
— ওহ আচ্ছা। আপনাকে আগে কখনও দেখিনি তো, তাই চিনতে পারিনি।

জিকু হাত ছাড়িয়ে এক টুকরো হাসি বিলিয়ে দিলো। চোখ দুটো এদিক সেদিক ঘুরিয়ে বললো,

— আপনার কথা মাসফি বসের কাছে অনেক শুনেছি। আপনাদের দুজনের ছবিও দেখেছি। সেই সুবাদে চিনি।

আরান সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে জিকুকে জিজ্ঞেস করলো,
— ভাই কোথায়?

জিকু স্বাভাবিক গলায় বললো,
— সোজা গিয়ে বামের রুমটায় তাকে পাবেন।

আরান, জিকুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলো। রুমের দরজা ভিড়ানো ছিলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো মাসফি অদিতির মাথায় চিড়ুনি করে দিচ্ছে। আরান জিজ্ঞেস করলো,

— কেমন আছো ভাই? কেমন আছিস আপু?

মাসফি চিড়ুনি রেখে এক পলক আরানের দিকে তাকালো। অদিতি মুচকি হাসলো। কিন্তু উত্তর দিলো না। আরানের সাথে অদিতির আবার বেশ ভাব। মাসফি মাথায় আবার চিরুনি চালান করে বললো,

— হুম ভালো তুই?

আরান ঔষধের প্যাকেটটা মাসফির পায়ের কাছে রেখে খাটে বসলো। দুই হাত খাটের ওপর রেখে মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

— আলহামদুলিল্লাহ।

মাসফি তীক্ষ্ণ চোখে ঔষধের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ঔষধ কে পাঠিয়েছে রে?

আরান মাথা না উঠিয়ে বললো,
— পাপা।

আরানের উত্তর শুনে মাসফির চোখ জোড়া আরো তীক্ষ্ণ হয়ে গেলো। সাথে কপালে চিন্তার ভাজ পরলো।দ্রুত তাড়াহুড়ো করে উঠে ঔষধের প্যাকেট হাতে নিলো। তারপর আরানকে আদেশের সুরে বললো,

— তুই একটু অদিতির চুলে বিনুনি করে দে। আমি আসছি।

মাসফি দৌড়ে বের হয়ে গেলো। আরান অবাক চোখে ভাইয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। সেসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো না। তবে সে চিন্তায় পরে গেলো। জীবনে সে কারো চুলে বেনুনি করেনি। এখন সে কিভাবে পারবে? ভাই তো তাকে আচ্ছা ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো। সে আর দেরী করলো না।চুপচাপ অদিতির কাছে গিয়ে বসলো। চিরুনি হাতে নিয়ে বেনুনী করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।

~~~আমরা সমাঝোতার মাধ্যমে সমস্যা মিটমাট না করে অভিমানে সম্পর্ক নষ্ট করতে বেশি পারদর্শী🥀।

#চলবে

#আমার_বোনু
#Part_19
#Writer_NOVA

অথৈ দুধের গ্লাসটা হালকা শব্দ করে টেবিলে রাখতেই ঊষা খাতা থেকে চোখ উঠিয়ে তাকালো। সে মনোযোগ সহকারে খাতায় পাঠ্য বইয়ের প্রশ্ন লিখছিলো। অথৈ এর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অথৈ এক ধ্যানে ঊষার খাতায় তাকিয়ে রইলো। ঊষা জোরে শ্বাস টেনে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু বলবে মেজো ভাবী?

অথৈ কোন কথা বললো না। ধপ করে ফ্লোরে বসে ঊষার পা পেচিয়ে ধরলো। হঠাৎ অথৈ এর এই কাজে ঊষা হকচকিয়ে গেলো। জলদী করে উঠে পা ছাড়িয়ে নিলো। এতে চেয়ারের সাথে ধারাম করে একটা বারিও খেলো। ঊষা থতমত খেয়ে বললো,

— আরে আরে করছো কি? তুমি আমার পা ধরছো কেনো?

অথৈ চোখ তুলে তাকালো। অথৈ এর চোখের দিকে তাকিয়ে ঊষা আৎকে উঠলো। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সেই চোখে পানি টলমল করছে। নাকের ডোগা লাল হয়ে গেছে। অথৈ নাক টেনে কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,

— আমায় মাফ করে দিও প্লিজ। আমি সত্যি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত। আমি সত্যি লজ্জিত এমন একটা ঘৃণিত কাজের জন্য। কিভাবে করতে পারলাম এটা? নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। তুমি আমায় মাফ করে দাও ঊষা। ভেতরে ভেতরে আমি আমার বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হয়রান। অন্যের কথায় কিভাবে প্রভাব পরলো আমার মধ্যে? আমি সত্যি অনেক খারাপ। নয়তো এমন কাজ করতে পারতাম না।

ঊষা এক দৃষ্টিতে অথৈ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। আজকের অথৈ এর সাথে সেদিনের অথৈ এর আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার চোখ দুটো আজ বলে দিচ্ছে সে আসলেই অনুতপ্ত। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ঊষা তবুও পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞেস করলো,

— তোমাকে আমার কাছে কে পাঠিয়েছে?

অথৈ চোখ মুছতে মুছতে বললো,
— কেউ পাঠায়নি। আমি নিজে এসেছি। বিশ্বাস করো আমি সত্যি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার সাথে এমন করবো না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।

কথাগুলো বলেই অথৈ আবারো ঊষার পায়ের দিকে হাত বাড়াতে নিলে ঊষা পিছন দিকে দুই লাফ দিয়ে সরে গিয়ে বললো,

— আরে আরে ভাবী করো কি? তুমি আমার বড়। তুমি আমার পায়ে হাত দিলে আমার পাপ হবে।

অথৈ জোর দিয়ে বললো,
— কোন পাপ হবে না। আমি যে পাপ করেছি তার মাফ একমাত্র এটাতেই আছে।

— ভাবী প্লিজ পায়ে হাত দিয়ো না। উঠো!

— তাহলে বলো তুমি মাফ করে দিয়েছো?

ঊষা নিষ্পলক চোখে অথৈ এর দিকে তাকালো। অথৈ এর চোখ দিয়ে অনরবত পানি পরছে। যা দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ সে অভিনয় করছে না। ঊষা ঝুঁকে অথৈর কাঁধ ধরে ওকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। তারপর মুখে হাসি টেনে বললো,

— এই অবস্থায় একটু সাবধানে থাকতে হয়। তুমি নিচে কেন ঝুকছো? যদি বাই চান্স তোমার পেটে চাপ পরে যেতো? তাহলে তো বাচ্চার ক্ষতি হতো। যাও তোমাকে মাফ করে দিলাম। এমনটা আর জীবনেও করো না।

অথৈ চোখ মুছে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
— সত্যি তুমি আমায় মাফ করে দিয়েছো?

ঊষা মুচকি হেসে বললো,
— হ্যাঁ গো ভাবী।

কথাটা বলেই ঊষা দুই হাতে অথৈ কে জড়িয়ে ধরলো। অথৈ এতে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ঊষা অথৈকে স্বান্তনা দিলো না। সে কাঁদুক, মন উজাড় করে কাঁদুক। এতে মনটা হালকা হবে।

— তিন বিচ্ছুগুলি! তোরা কি সরবি? আমাকে আর হেল্প করতে হবে না। অনেক কাজ করে উদ্ধার করে ফেলছো। কাজ কমানোর থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

কিচেন থেকে জিনিয়ার চেঁচানোর আওয়াজ এলো। অর্ণব, আদিল ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তারা মিটমিট করে হাসছে। আজকে ইশাত,ঈশান, অরূপ বাগে পেয়েছে জিনিয়াকে। ওর অবস্থা নাজেহাল না করে ছাড়বে না। আবারো জিনিয়ার গলার স্বর পাওয়া গেলো।

— তোমরা কি এখান থেকে যাবে?

অপরপাশ থেকে হি হি শব্দ ভেসে এলো। তিনজন উচ্চস্বরে হাসছে। ঊষা পাপ্পিকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। আদিল এক ধ্যানে ল্যাপটপে কাজ করছে। অর্ণব, অনলকে পাশে বসিয়ে কমলার খোসা ছাড়িয়ে কমলা খাইয়ে দিচ্ছে। ঊষা কপাল কুঁচকে ভাইদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে? ভাবী এমন চেঁচাচ্ছে কেনো?

আদিল ল্যাপটপের থেকে চোখ না তুলেই বললো,
— বলতে পারি না। তুই গিয়ে দেখে আয়।

অর্ণব একটা কমলার কোষ নিয়ে অনলের মুখে তুলে দিয়ে ঊষার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আজকে শয়তানগুলো তোর ভাবীর সাথে লেগেছে।

ঊষা মুখ চেপে হেসে পাপ্পিকে কোলে নিয়ে কিচেনের দিকে ছুটলো। কিচেনে গিয়ে হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যাথা। তিনজন আটা দিয়ে সাদা ভূত হয়ে গেছে। অরূপ গলায় পুইশাকের ডাট ঝুলিয়ে রেখেছে। কানে দুলের মতো করে পুইশাকের পাতা ঝুলানো। ইশাতের মাথায় টিকলির মতো করে বরবটি রাখা। ঈশান একটা মাছ দুই হাতে পরম যত্নে ধরে রেখেছে। হাত দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইছে। মনে হচ্ছে সে মাছটাকে গান শুনিয়ে ঘুম পারাচ্ছে। জিনিয়া ঊষাকে দেখে কোমড়ে দুই হাত রেখে অভিযোগের সুরে বললো,

— দেখছো ঊষা, তোমার তিন ভাই কিরকম পাগলামি শুরু করেছে।

ঊষা আবারো হাসতে লাগলো। সাদা ভূত দেখে পাপ্পি ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। ঈশান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো। তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে হুশশ শব্দ করে পাপ্পিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— এই কালু চুপ থাক। দেখিস না আমি মাছটাকে ঘুম পারাচ্ছি। তুই চেঁচালে তো ও উঠে যাবে।

ঊষা চোখ দুটো রসগোল্লা করে বললো,
— লাইক সিরিয়াসলি ছোট ভাইয়ু! তুই মাছকে ঘুম পারাচ্ছিস?

ঈশান উত্তর দিলো না। শয়তানি ভঙ্গিতে বাঁকা হাসলো। ঊষার নজর গেলো ইশাতের দিকে। ইশাত একটা বোল নিয়ে তাতে দুটো চামচ দিয়ে ড্রাম পিটাচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে এমন ভাব নিচ্ছে যে সে বড় কোন স্টেজে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। অরূপ মোবাইল বের করে ইউটিউব থেকে গান ছাড়লো। সেই গানে গলার পুইশাক ধরে নাচতে লাগলো। থেকে থেকে শাকের ডাট-টাকে ওড়নার মতো ঠিক করে নিচ্ছে। পাপ্পি ঊষার কোল থেকে নেমে অনরবত ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। ইশাত তার বাদ্যযন্ত্র থামিয়ে ঠোঁট কামড়ে পাপ্পির দিকে তাকালো। তারপর চোখ, মুখ কুঁচকে বললো,

— এই সর তো তুই। একদম ডিস্টার্ব করবি না। দূরে যা।

জিনিয়া কপাল চাপড়ে বললো,
— আজকে এরা কিচেন ছাড়বে না। রাতে না খেয়ে থাকো তোমরা। আমি কিছু রান্না করছি না।

জিনিয়া তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে ওদের একেক কিছু বলতে বলতে কিচেন থেকে বের হয়ে গেলো। ড্রয়িংরুম থেকে,অনল পাপ্পিকে ডাকতেই পাপ্পি সেদিকে ছুটলো। ঊষা দরজায় হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে ওদের কান্ড দেখতে লাগলো। এখনো এদের নাচানাচি থামেনি। অরূপ ঊষাকে ডাকলো।

— বোনু আয় আমাদের সাথে জয়েন কর।

ঊষা,মাথা নাড়িয়ে নাকচ করে দিলো। অরূপ মেয়েদের মতো ভেংচি কেটে কোমড় হেলিয়ে দুলিয়ে নাচতে লাগলো। ওদের কান্ড দেখে ঊষা হাসতে হাসতে অবস্থা নাজেহাল। অরূপ এবার একটা গান ছেড়ে চেচিয়ে সেই গানের সাথে গলা মিলাতে লাগলো। গানটা ছিলো এরকমঃ

— যার বউটা কালা, কালারে কালা।
যার বউটা কালা, তারি কপাল ভালারে!
রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে কারো নজর লাগে না।
না না না নারে না!

পরের কলিটা ঈশান ধরলো। মাছটা রেখে হাত দুটো উঁচু করে চেচিয়ে গলা মিলালো,

— যার বউটা মোটাআআআ, মোটারে মোটা।
যার বউটা মোটা, তারি কপালটাই ভালারে!
বৈশাখ মাসে ঝড়-তুফানে ঘরের খুঁটি লাগে না।
না না না নারে না!

অরূপ আবার পরের কলি গান গাইলো,
— যার বউটা চিকনা, চিকনারে চিকনা।
যার বউটা চিকনা, তারি কপালটা ভালারে!
ছায়া-ব্লাউজ বানাইতে বেশি কাপড় লাগে না।

ঈশান ইশারা করে ইশাত গান গাইতে বললো।ইশাত মাথা ঝাঁকিয়ে গানের তাল উঠালো। তারপর সে গাইলো,

— যার বউটা ধলা। ধলারে ধলা!
যার বউটা ধলা, তারি কপাল ভালা।
আন্ধার রাইতে ঘরের মধ্যে চেরাক বাতি লাগে না।
না না না নারে না!

ঈশান একটু থেমে কি জানি ভাবলো। তারপর বললো,
— বিয়া করলে চিকনা মাইয়াই করমু। জামা-কাপড় বানাইতে বেশি কাপড় লাগবো না।

অরূপ হাই তুলে বললো,
— আমি মোটা মেয়ে বিয়া করবো। বৈশাখ মাসের ঝড়েতে তাহলে ঘরের খুটি লাগবো না।

ইশাত দুই চামচ একসাথে বারি দিয়ে বললো,
— আমি ধলা বিয়া করমু। তাহলে আন্ধার রাইতে চেরাক বাতি লাগবো না।

ঊষা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— ঐ আশা বাদ দে সেজো ভাইয়ু। তোকে আমার বান্ধবী তারিনকেই বিয়ে করতে হবে৷ তাই অন্য মেয়ে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর।

ইশাত চেচিয়ে বাপ্পারাজের স্টাইলে বললো,
— নাআআআআআ এ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি নাআআআ।

ওর বলার ধরনে পুরো কিচেনে আবারো উচ্চ হাসির রোল পরলো। ঊষা তাকিয়ে তাকিয়ে ভাইদের কান্ড দেখতে লাগলো।

~~~ ছেড়ে যাওয়ার জন্য হাজার অযুহাত দেওয়া যায়। কিন্তু ধরে রাখতে চাইলে একটা কারণই যথেষ্ট।

#চলবে