আলিঙ্গনে ভালোবাসার মোহ জেগে উঠে পর্ব-০২

0
106

#আলিঙ্গনে_ভালোবাসার_মোহ_জেগে_উঠে
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অনুভূতিরা ছন্দ হারিয়েছে দুঃখরা তাতে তাল মিলিয়েছে। বুদ্ধিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠছে। মনের আনাচে-কানাচে বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তিক্ততা হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলছে। বিষণ্নতা মস্তিস্ক জুড়ে বিরচন করছে। নিজাম সিকদারের পাশে বসে আছে মরিয়ম তালুকদার। মরিয়ম তালুকদার আহত দৃষ্টিতে নিজাম সিকদারের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। নিজাম সিকদার তা উপলব্ধি করতে পেরে ঠান্ডা মস্তকে শুধালো,

“আপনি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন ভাবি?” নিজাম সিকদারের প্রতিটি বাক্য মরিয়ম তালুকদারের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল। সে আমতা আমতা করে বলল,

“আসলে একটাই তো ছেলে বিয়ে দিয়েছি। সবাই চাইছে আপনার মেয়েটা আমাদের বাড়ি সাতটা দিন থাকুক। নতুন বউ বাড়ি না আসলে কেমন দেখায় আপনিই বলুন।” নিজাম সিকদার বুঝল মরিয়ম তালুকদারের কথা। তিনি মরিয়ম তালুকদারকে আশ্বস্ত করে বলল,

“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি মেয়েকে বুঝিয়ে আপনার বাড়ি পাঠাচ্ছি।”

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রজনীর নিস্তব্ধ আঁধার দেখতে মগ্ন ছিল আফিফা। মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে গিয়েছে। মনের শহরের অচলিত বিরহের মিছিল শুরু হয়েছে। আফিফার ভাবনার মাঝেই দরজাটা শব্দ করে জানান দিল কক্ষে কেউ প্রবেশ করেছে। আফিফা দৃষ্টি দিয়ে দেখল তার বাবা এসেছে। আফিফার পরনে এখনো বিয়ের সাজসজ্জা রয়েছে। মেয়েটার মুখশ্রী বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে তার জীবনের সব রঙ সাদা হইয়া গেছে। নিজাম সিকদার মেয়ের মস্তকে হাত বুলাতে বুলাতে শুধালো,

“বাবা ওপরে রাগ করেছিস মা?”

“ভাগ্যের ওপরে কারো হাত নেই আব্বু। তুমি শুধু শুধু নিজের দিকে দোষ টেনে নিবে না। আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেন বলতে পারো আব্বু? ছোট বেলায় মা হারালাম আজ আমার জন্য কোনো মা তার সন্তান হারালো। শেষে এসে একটা বাচ্চা ছেলেকে আমার বিয়ে করতে হলো। আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আব্বু সহ্য করতে পারছি না। সবকিছু হারানোর যন্ত্রনা এতটা তীব্র হয় কেন আব্বু?” মেয়ের বলা প্রতিটি বাক্য নিজাম সিকদারের বুকে ছিদ্র করে দিয়ে গেল। নিজাম সিকদার কাঁদছে। মেয়ের অশ্রুকণা গুলো বাবার হৃদয়টা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। নিজাম সিকদার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধালো,

“আফরাতে মা এসেছে তোকে নিয়ে যেতে। উনার এক মাত্র ছেলের বউ তুই। ওদেরও আশা থাকতে পারে। তুই না করিস না মা৷ তুই সাতটা দিন ওদের বাড়ি থেকে আয় তারপর আমি নিজে তোকে নিয়ে আসব।”

“এমনটা তো কথা ছিল না আব্বু।”

“আমি জানি এমনটা কথা ছিল না। কিন্তু ওদের দিকটাও আমাকে ভাবতে হবে।”

“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না আব্বু।”

“ওরা আমাদের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করল। আর আমরা এতটুকু পারব না?” আফিফার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও মরিয়ম তালুকদারের সাথে যেতে হলো।

তালুকদার বাড়িতে আফরাতকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছিল। এমন সময় আফিফাকে নিয়ে প্রবেশ করল মরিয়ম তালুকদার। আফিফাকে দেখেই আফরাতের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ স্থির হয়ে গেল। সে মুগ্ধ নয়নে আফিফার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আফিফা মস্তক নুইয়ে মরিয়ম তালুকদারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আফরাত আহত কণ্ঠে বলল,

“এই অবস্থায় মেয়েটাকে না নিয়ে আসলেও পারতে আম্মু। এমনিতেই মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো না। সে বধহয় একা থাকতে চেয়েছিল। তুমি কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিতে গেলে!” আফরাতের কথায় সবাই বিস্ময় নয়নে আফরাতের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। এই ছেলেটা এতটা পল্টিবাজ হয়ে গেল কি করে? একটু আগেই বউ বউ করে মাথা খাচ্ছিল হঠাৎ করেই সুর পালটে ফেললো! আফিফার প্রথম আফরাতের কথা ভালো লাগলো। কেউ অন্তত তার মনের ব্যথা বুঝেছে। কিন্তু কাল যে ছেলেটা আপু আপু বলে মস্তক ঝালাপালা করে দিত। আজ সেই ছেলেটা তাকে মেয়েটা বলে সম্মোধন করছে!

“তুমি আমার সাথে আমার কক্ষে এসো তোমাকে আর কষ্ট করে এসব পড়ে থাকতে হবে না।” আফরাতের কথায় লজ্জা পেল আফিফা। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তার বর তাকে কক্ষে ডাকছে ভাবা যায় এগুলো! তবে আফিফার ক্লান্ত কায়াটা আস্তরণে শায়িত হতে চাইছে। মন বলছে এগিয়ে যা আফিফা মস্তিষ্ক বলছে থেমে যা আফিফা। আফিফা দ্বিধাদ্বন্দে ভূগছে। তখনই মরিময় তালুকদারের বলল,

“তুমি আফরাতের সাথে যাও মা। আজকে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কালকে প্রভাত বেলা তুমি আত্নীয় স্বজনদের সামনে আসবে।” আফিফা মস্তক নাড়িয়ে আফরাতের সাথে আফরাতের কক্ষে গেল। আফরাতের কক্ষে এসেই আফিফার মস্তক জ্বলে উঠল। এটা কোনো মানুষের কক্ষ হতে পারে! আফিফার মনে হচ্ছে এটা আস্ত একটা গোয়াল ঘর। আফিফা চারপাশে একবার আঁখিযুগল বুলিয়ে নিল। আফিফার পর্যবেক্ষণের মাঝেই আফরাত শুধালো,

“তোমার কষ্ট হচ্ছে না?”

“একটু হচ্ছে তুমি আমার থেকে দূর থাকবা।”

“আমি কি তোমার কোলে উঠে বসে আছি! আফরাতের কথায় জ্বলে উঠল আফিফা। এই ছেলেটা সহজ হয়ে কথা বলতে পারবে না! সে ছোট বলেই কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে নাকি? আফিফা রাগান্বিত হয়ে বলল,

“বাচ্চা ছেলে একদম বেশি কথা বলবে না।” আফিফার বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই আফরাত উত্তপ্ত হয়ে গেল। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

“আরেকবার বাচ্চা বললে সত্যি কোলে উঠে বসে থাকব। যে আমার পাটকাঠির মতো শরীর এক হাত রাখলেই মর্মর করে ভেঙে যাবে। তুমি নিজের দিকে আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনো? আমি তোমার থেকে উচ্চতায় লম্বা তুমি আমার থেকে বয়সে বড় হলে-ও দেখতে আমাকেই তোমার বড় লাগে।” আফিফা তাকিয়ে দেখল আসলেই আফরাতের মুখশ্রীতে ঘন কালো চাপদাড়ির জন্য আফরাতকে একটু বয়ষ্ক লাগছে। আফিফার আঁখিযুগলে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ করে এতটা পাজি হয়ে গেল কি করে! আফিফা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“একদম আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবে না।”

“আমি তোমাকে ছুঁয়েছি? এত নষ্ট তোমার মন ছি! বিয়ে হতেই পারল না বরকে উস্কে দেওয়া শুরু করে দিয়েছ! আমাকে তোমার এত লোভী মনে হয়? শুনো আমার এত তাড়া নেই বুঝেছ।”

“একটা থা’প্প’ড় দিব মানুষ হয়ে যাবে।”

“আমাকে দেখে তোমার বিড়াল মনে হয়!”

“আমি তোমার বড় বোন হই ভুলে যেও না।”

“তিনবার কবুল বলে বর হিসেবে গ্রহণ করেছ। আমাকে ভাই বলতে তোমার লজ্জা করছে না।”

“আমাকে বিয়ে করতে তোমার লজ্জা করল না?”

“পরী যদি নিজে যেচে পড়ে জিনের কাছে আছে। জিন তো সুযোগের ফায়দা লুফে নিবেই।”

“তোমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট।”

“স্বামীর সাথে রাগ করলেও সাওয়াব পাওয়া যায়। আরো কিছু পাওয়া যায় কিন্তু আমি বলব না। আমি তোমার মতো অসভ্য না। আমার লজ্জা শরম বলতে কিছু আছে বুঝেছ।”

“মরে গেলে-ও বিশ্বাস করব না।”

“আমার এখনো বাসর হয়নি বাচ্চা হয়নি। তুমি মরে গেলে আমার সব স্বপ্ন পূর্ণ করবে কে?”

“তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো আফরাত।”

“আল্লাহ কি মুখ দিয়েছে চুপ থাকার জন্য!”

“তোমাদের বাড়িতে আসাই আমার ভুল হয়েছে।”

“আসলে কেন আমি কি তোমাকে আসতে বলেছি?”

“তোমার মতো বেকার ছেলের কাছে আসার ইচ্ছে আমারও নেই। তোমার মতো ছেলের সাথে যার বিয়ে হবে তার কপাল পুড়বে। আমার কোনো কিছু লাগলে তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হাত পাতবো?” মুহুর্তের মধ্যে আফরাতের মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে গেল। দু’টি আঁখিযুগল অসম্ভব ভাবে রক্তিম বর্ন ধারন করল। আফরাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“মজা করা ভালো মেয়ে। তবে মজার নামে কারো ব্যক্তিত্বে আঘাত করা ভালো না। তোমার দায়িত্ব আমি ঠিক নিতে পারব। দু’দিন আগেও কি আমি জেনেছিলাম তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে? যদি জানতাম অবশ্যই আমি কিছু করার চেষ্টা করতাম। আমি পুরুষ মানুষ কাপুরষ নই যে বাবার টাকায় তোমাকে খাওয়াব। আমার গুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে, এতে বাবা-মায়ের সামান্য সাহায্য আমি নিতে পারি। তার মানে এই নয় যে সারাজীবন একই রকম থাকব। যখন থেকে তোমাকে বিয়ে করেছি। তখন থেকে মস্তিষ্ক বলছে আমাকে তোমার দায়িত্ব নিতে হবে। রজনীর আঁধার কেটে গেলে কাজের খোঁজে দৌড়াতে হবে। আর তুমি বলছো আমার বাবা-মায়ের কাছে হাত পাতবে! আমি থাকতে সেটা কখনো হতে দিব না৷ প্রয়োজনে আমি কমলা খাটব মাস শেষে দুই তিন হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিব৷ তোমাকে সেটা নিয়েই চলতে হবে। এতে যদি তুমি সন্তুষ্ট না হও আমি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা খাটবো। আমি তোমাকে কথার কথা বুঝিয়েছি। তুমি আবার সত্যি সত্যি ধরে নিও না। আমি শিক্ষিত ছেলে ১০ হাজারের নিচে নিশ্চয়ই অর্থ পাব না। দরকার পড়লে পুরোটা তোমার হাতে তুলে দিব।”

“আর নিজে বাবা-মায়ের কাছে ভিক্ষা করবে।”

“তোমার দায়িত্ব নিতে পারলেই হয়েছে। আমার টা আমি বাবা-মার থেকে সাহায্য নিব। আমার উপার্জনের পরিমান যখন বৃদ্ধি পাবে তখন নিব না। মানুষ এক লাফে গাছে উঠতে পারে না।” আফরাতের কথায় মুগ্ধ হলো আফিফা। ছেলটা দারুন কথা বলতে জানে। তবে এই মুহূর্তে আফরাতকে তার ভিষণ বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ করেই সব মুগ্ধতাকে আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘের দল গ্রাস করে ফেললো।

চলবে…..