আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-০১

0
1858

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( উপন্যাসটি পুরোটা পোস্ট হবে পেজে।) ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
আজ রবিবার । অন্য দিন হলে আজকের দিনটা সকাল দশটা অব্দি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিত অভীক । কিন্তু আজ সেটা সম্ভব না । সকাল দশটা অব্দি তো দূরে থাক ; কাল সারা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়েছে টেনশনে ! কোন মানে হয় ! শেষে মেঘার কথায় হ্যাঁ বলতেই হলো সম্বন্ধ দেখতে যাওয়ার জন্য । মেয়েটা আসলে খুব ভালো করে জানে , কিভাবে দাদাকে ব্ল্যাকমেল করে নিজের কাজ আদায় করতে হয় ! ওই পুরনো ট্রিকস টাই কাজে লাগালো তাই মেঘা শেষে । যখন মুখের কথায় কাজ হলো না , তখন টেম্পোরারি অনশন করে রাজি করিয়ে নিল দাদাকে ! সিম্পল ।
যদিও অভীক অনেকবার বুঝিয়েছে , কোন অচেনা মেয়ের ওপর ও ভরসা করে না । একবার যেভাবে ঠকেছে জীবনে ! তারপর তো এইসব বিয়ে রিলেশনশিপ নিয়ে ভাবার কথাই মাথায় আসেনি কখনও ! আর স্রমনার মতন যদি আবার কোন বাইরের মেয়ে এসে ওদের ভাই বোনের সম্পর্ক টা কে নষ্ট করে দেয়ার চেষ্টা করে ! টাকা আর প্রপার্টির জন্য মেঘাকে দূরে করে দেয়ার চেষ্টা করে অভীকের কাছ থেকে ! তাহলে কি হবে ! কিন্তু এইসব কথা কে বোঝাবে মেয়েটাকে ! ওর তো ওই একটাই কথা , মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে অভীক না কি শুধু ওকে নিয়ে আর বিজনেস নিয়েই ভেবেছে ! কিন্তু এবার আর না । এবার ওকে নিজের লাইফটা নিয়েও একটু ভাবতে হবে ! এগোতে হবে জীবনে । আর এখন আবার ওর থার্টি থ্রি । এখন বিয়ে করবে না তো কখন করবে !

সত্যি ! এত যুক্তির ঠিক কি উত্তর দেবে অভীক ! কিভাবে বলবে যে মা বাবা চলে যাওয়ার পর মেঘাই ওর জীবন । নিজের বোন ছাড়া কাউকেই আর নিজের করে ভাবতে চায় না অভীক ! আর স্রমনা যেই ধাক্কাটা ওকে দিয়েছে একটা সময় , আজও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি অভীক মনে মনে । মানুষকে বিশ্বাস করার স্বভাবটাই তাই শেষ হয়ে গেছে ওর । কিভাবে বলবে এত কথা ও মেঘাকে ! আর তার ওপরে যদি অনশন করে ব্ল্যাকমেল শুরু করে , তাহলে তো আরোই কোন কথা বলার জায়গা থাকে না ! কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতেই রেডি হলো সেদিন মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য । যদিও মনে প্রচণ্ড অনিচ্ছা । তাও জোর করেই অন্ধকার মুখে বেরোলো মেঘার সঙ্গে , মেয়েটাদের বাড়ির উদ্যেশে ।
ওদের উকিল কাকু সম্বন্ধটা এনেছে । লোকটা মেঘার বেস্ট ফ্রেন্ড । আগে যদিও বাবার ভালো বন্ধু ছিল ! যাইহোক , এই লোকটার সাথে মিলেই মেঘা ওকে ফাঁসিয়েছে । সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই মাঝ রাস্তা থেকে উকিল কাকু গাড়িতে উঠলো ; তারপর অভীকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো ,
————— ” কি রে ! শুনলাম না কি তুই ঐশীর ফটোটাও দেখিসনি ! এত রাগ কিসের বল তো ? তোর বোন তো একটা ঠিক ডিসিশন ই নিয়েছে । এটাই তো বিয়ের বয়স তোর ।”
কথাটার অভীক কোন উত্তর দেয়ার আগেই এবার মেঘা তাল মিলিয়ে বললো ,
—————- ” ঠিক বলেছ উকিল কাকু । বোঝাও তো একটু দাদাকে ! ”
এই কথায় অভীক এই মুহূর্তে বেশ রেগেই বললো ,
————— ” উফ , হয়েছে তোর ? যাচ্ছি তো সেই মেয়ে দেখতে ! তাহলে এত কথা কিসের !”
এর উত্তরে উকিল কাকু এবার অল্প হেসে বললো ,
—————- ” তো যাচ্ছিস যখন , একটু খুশি মনেই যা । আর তোর জন্য কোন খারাপ মেয়ের সম্বন্ধ আনিনি আমি ! ঐশীদের ফ্যামিলি যদিও তোদের তুলনায় সাধারণ ! ওর বাবা রিটায়ার্ড স্কুল টিচার । কিন্তু মানুষ হিসেবে ওদের কোন তুলনা হয় না । আগে বৌদি যখন বেঁচে ছিল , সেই মানুষটাও ছিল অমায়িক । মেয়ে টা ঠিক মা বসানো হয়েছে ।”
কথাগুলো এক সঙ্গে বলে গেল উকিল কাকু । কিন্তু অভীকের এইসব শুনেও মুখে কোন হাসি এলো না । কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়েই রইলো ও !
এরপর যখন কিছুটা সময় পেরিয়ে মল্লিকবাগান এসে পৌঁছলো তখন ঘড়িতে দুপুর ১২ টা । অভীক এই মুহূর্তে আবিষ্কার করলো ওদের গাড়িটা একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে উকিল কাকুর ইনস্ট্রাকশনে । যাইহোক , এরপর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে ওদের যতটা সম্ভব আপ্যায়ন করে এনে ঘরে বসালো । অভীক এবার চারিদিকটা চোখ বুলিয়ে বুঝলো ছিমছাম , সুন্দর গোছানো একটা বাড়ি । খুব দামী ফার্নিচার , শো পিস , ইন্টেরিয়ার , এইসব নেই যদিও , কিন্তু সাধারণের মধ্যেও বেশ রুচি আছে সব কিছুর । সে বাটিক প্রিন্টের কুশন কভার হোক , কি দেয়ালে লাগানো হাতে আঁকা ছবি , সবই ঘরের হালকা রঙের সাথে মানিয়ে গেছে । আর সব থেকে ভালো লাগছে উল্টোদিকের সাজানো দেয়াল আলমারি টা । কত বাংলা সাহিত্যিকের বই এখানে ! শীর্ষেন্দু থেকে সুনীল , রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র , বিভূতিভূষণ , সবার জায়গা আছে এই দেয়াল আলমারিতে । কথাগুলো এক মনে ভাবছিল অভীক । আসলে ইঞ্জনিয়ারিং কমপ্লিট করে ইনটেরিয়ার ডেকরেশনের ওয়ার্কশপ করেছিল একটা , এমবিএ পড়ার সাথে সাথে । ছোট থেকেই এই ঘর সাজানোর প্রতি আলাদা একটা ইন্টারেস্ট আছে ওর । সেই জন্যই কারোর বাড়ি গেলে এইসব খেয়াল করাটা ওর স্বভাব ! যাইহোক , সেদিন অভীকের এই ভাবনার ভিড়ে ই ঐশী এসেছিল বসার ঘরে । প্রথম দর্শনে হালকা লাল রঙের একটা শাড়ি , কপালে ছোট্ট একটা টিপ , আর খোলা চুলে একবার হলেও থমকে দিয়েছিল অভীককে সেদিন মেয়েটা ! তবে সেই মুহূর্তে ও জোর করেই নিজের মনটাকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে , আর ভেবেছিল অন্য কথা । কিভাবে এই মেয়েটাকে আজ না বলবে ! সোজাসুজি বলে দেবে ; না কি কোন মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে কাটিয়ে দেবে সম্বন্ধটা ! কিন্তু এইসবের ভিড়েই ঐশী সবার মাঝে অভীককে দেখে হেসেছিল আলতো ভাবে । আর না চাইতেও অভীকের দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেছিল হঠাৎ ! একটা অন্য রকম ভালো লাগায় ।
<২>
যাইহোক , সেদিন এরপর বাড়ির সবাই মিলে ওদের আলাদা কথা বলার কথা বলেছিল । অভীক জানতো , এরকমই কিছু একটা হবে এরপর । সব এরেঞ্জ ম্যারেজেই তো এটা কমন । আলাদা কথা , হবিজ কি , জীবনের এইম কি , এইসব জিজ্ঞেস করেই তো বিয়ে ফাইনাল হয় ! কিন্তু অভীক তো এখানে বিয়ে করতে আসেনি । ও এসেছে স্ট্রেট কাট ‘না’ বলতে । তাই এই আলাদা কথা বলার সুযোগটা সেদিন কাজে লাগিয়ে সোজাসুজি বলে উঠেছিল ঐশীকে ,
—————– ” সরি , আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না । আসলে আমার বোন আর উকিল কাকুর জোরাজুরি তে আমি এখানে এসেছি । মেঘার কোন কথায় আমি আসলে না বলতে পারি না ! বাট আমি বিয়ের ব্যাপারেই ইন্টারেস্টেড নই । আই এম জাস্ট ভেরি হ্যাপি টু বি সিঙ্গেল .. কিন্তু এত কথা আমার বোনকে বুঝিয়েও বোঝাতে পারিনি ! যাইহোক , এটাই বলার ছিল । আর সরি , আজ আপনাদের টাইমটা ওয়েস্ট হলো এইভাবে ! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ..”
কথাগুলো একসাথে বলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অভীক । কিন্তু এই মুহূর্তে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ঐশী অদ্ভূত রকম হাসি মুখ করে নিজের মনে একটা প্রণাম ঠুকে বলে উঠলো ,
————- ” যাক বাবা ! বাঁচা গেছে । ”
এটা শুনে অভীক বেশ অবাক হয়েই এবার তাকালো ওর দিকে ! কিন্তু ওর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ঐশী বলে উঠলো আলতো হেসে ,
—————- ” আসলে আমিও চাইনি এইসব । আপনাদের সঙ্গে এমনিও আমাদের স্ট্যাটাস কিছু মেলে না ! তার ওপরে আপনি এত বড় বিজনেস ম্যান । আপনার সাথে তো আমার কখনোই মিলবে না ! কিন্তু অনিমেষ কাকু , মানে আপনার উকিল কাকু কে তো এত কথা বলা যায় না ! বাবার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু । তাই বাবাও মুখের ওপর না বলতে পারেনি । যাইহোক , ভালোই হলো । এখন তো আর কোন সমস্যাই নেই ! আমি পরে অনিমেষ কাকুকে এটা বলে দেব যে আমাদের কথা বলে ঠিক কিছু মেলেনি । কোন পছন্দ অপছন্দ ম্যাচ করেনি । তাই এই বিয়েটা পসিবেল না । যাইহোক , চলুন , আজ আমাদের বাড়ি থেকে দুপুরে খেয়ে যাবেন । ”
কথাগুলো বেশ হাসি মুখে বলে ঐশী আর দাঁড়ালো না । ঘরটা খালি করে দিয়ে বেরিয়ে এলো বসার ঘরে , সবার সামনে । যদিও মেঘা , উকিল কাকু , ঐশীর বাবা বেশ অবাকই হলো ! এত তাড়াতাড়ি দুজনে কি কথা বললো কে জানে ; এটা কেউই ঠিক ভেবে পেল না ! তবে এই সময়ে আরেকজন ও একা ঘরে কয়েক মিনিট অবাক হয়েই দাঁড়িয়েছিল ! অভীক কে রিজেক্ট করে দিল শেষে ! মানে অভীকের সম্বন্ধটা পছন্দই ছিল না মেয়েটার ! এটাও সম্ভব ! এতদিন তো জেনে এসেছিল ও এলিজিবল ব্যাচেলার । অফিসে , পার্টিতে , কত জায়গায় মেয়েরা ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য নিজে থেকে চেষ্টা করে । এই তো , সেদিন ওদের ডিজাইনার শপ ‘ আরাধ্যার ‘ ইনোগ্রেশন পার্টিতেই , কলকাতার সব থেকে নামি মডেল মালিনি তো ওকে ডিরেক্ট নিজের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য বলছিল , টু হ্যাভ সম ফান .. যদিও অভীক এইসবে কখনোই রেসপন্স করে না । কিন্তু সেই অভীক সেনগুপ্ত কেই একজনের ম্যারেজ মেটেরিয়াল হিসেবে ঠিক লাগেনি ! এটা জেনে কেমন যেন তেঁতো লাগলো ভেতরটা । সত্যি ! মেয়েটা তাহলে জীবনে কেমন ছেলে চায় কে জানে ! কথাটা আনমনেই মনে হলো ওর । তবে এইভাবে আর একা একা দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে এলো এবার অভীক ড্রয়িং রুমে । কিন্তু এসে দেখলো ঐশী এই মুহূর্তে বেশ যেন খুশি খুশি হয়েই কথা বলছে সবার সঙ্গে ! তবে অভীকের ও তো এই সময়ে খুশি হওয়ার কথা ! ও যা চেয়েছে , অবশেষে তো তাই হলো । তাহলে অভীকের এরকম অস্বস্তি হচ্ছে কেন ভেতরে ! যেন এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না ঠিক । এরকম খারাপ লাগার তো কথা ছিল না ওর ! কথাগুলো যেন বেহিসেবী ভাবে মনে হলো এখন ।

চলবে।