ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-০৯

0
392

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৯

একে একে পাঁচ থেকে ছয়খানা মাইক্রো ছাড়লো। ইরা, কুহু সাথে আরও কয়েকজন একই মাইক্রোতে গাদাগাদি করে বসেছে। সবার সামনের ছিটে বসে আয়াত। লুকিং গ্লাস দিয়ে বরংবার না চাইতেও চোখ পড়ছে ইরার উপর। মন বারবার চাইছে তাকাতে তার দিকে। কিন্তু কেন? আয়াত কি তবে ভয় পেলো? ইরার আজগুবি কথাগুলো কি মন-মস্তিষ্ক মেনে নিলো? কি হতে পারে সারপ্রাইজ? জানালার বাইরে তাকিয়ে ইরা। বাতাসের দাপটে তার স্নিগ্ধ চুলগুলি উড়ছে। মায়াময় মুখখানায় এসে পড়ছে বেবি হেয়ারগুলো। ইরা সেগুলো সরাতেই বিরক্ত হয়ে পড়ছে। ক্লান্ত বিকেল। সূর্য প্রায় হেলে পড়েছে। বাতাস ঘেরা বিকেলের এই জার্নিটা অতটাও খারাপ লাগছে না।

কনেপক্ষের বাড়িতে যেতে যেতে বেজে গেলো সাড়ে সাতটা। সুবিশাল গেট সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন রঙের মরিচবাতি দিয়ে কয়েকফুট রাস্তা সাজিয়েছেন ওনারা। সুন্দর! তবে ক্ষনস্থায়ী। ইরা ফিক করে হেসে ওঠে। বিয়ে হলে হয়তো এতকিছুর স্বার্থকতা ছিলো। সব বিয়ের মতোই গেট ধরা নিয়ে ঘটে গেলো এক বিস্তর ঘটনা। তর্কাতর্কি চললো অনেকক্ষণ। তবুও কোন মিমাংসা হলো না। ইরা এতক্ষণ চুপ ছিলো। যখন দেখলো থামছেই না,সে নিজে সামনে গেলো। কয়েকজন মহিলা আর দু’জন ছেলে কোমর বেধে ঝগড়া করছে। কুহু ওদের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। ইরা গিয়েই বলে উঠলো,

‘ কি সমস্যা আপনাদের? ‘

একজন মহিলা হৈ হৈ করে উঠলো,

‘ আপনারা কি বোঝেন না? গেট ধরেছি। টাকা লাগবে টাকা! ‘

‘ ডিমান্ড কত? ‘

ইরা সহজ কথায় চকচকে হাসি ফুটলো প্রতিপক্ষের। একজন মেয়ে পুরো বত্রিশটা দাঁত বের করে বলে উঠলো,

‘ কুড়ি হাজার!’

ইরা চোখ বড়ো হয়ে উঠলো। পুরো বিষ হাজার? ইরা কর্কষ গলায় বলে ওঠে,

‘ কখনো কুড়ি হাজার চোখে দেখেছেন? ‘

ইরার কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো মেয়েগুলো। লাগলো তুমুল ঝগড়া। বরপক্ষ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আয়াত হতভম্ব হয়ে ইরার ঝগড়া দেখছে। ইরার সাথে তাল মেলালো কুহু। প্রায় আধঘন্টা ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে চুপ হলো ইরা। সামনে তাকিয়ে দেখলো ওরা ও ক্লান্ত। কিন্তু একজন নয়! তার চোখ ইরাতে সীমাবদ্ধ। অপলক চোখে তার’ই দিকে তাকিয়ে ছেলেটি। ইরার মাথায় চট করে দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। আস্তে করে যে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, সে কোনে গিয়ে দাড়ালো ইরা। ছেলেটা তবুও তাকিয়ে। ইরা আস্তে করে গলা খাঁকড়ি দিতেই ভ্রম ভাঙলো ছেলেটির। ইরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

‘ কেমন আছেন? ‘

ছেলেটি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ আমায় বলছেন? ‘

ইরা লজ্জামাখা হাসি হাসলো। বললো,’ আপনার মতো হ্যান্ডসাম আর কে আছে এখানে? ‘

ইরা কথাগুলি ছেলেটির কর্নকুহরে পৌছাতেই মুখে ফুটে উঠলো লজ্জা। ঘোর লজ্জা। লজ্জায় লাল হওয়ার মতো লজ্জা। ইরা একটু ভরকে গেলো। ছেলে মানুষের এতটা লজ্জা হয়? ইরা দেখেনি কখনো। কিন্তু লজ্জাটাকেই কাজে লাগাতে হবে। রাত হচ্ছে। বাড়িও তো ফিরতে হবে। ইরা আবারো মৃদু হেঁসে বললো,

‘ বললেন না যে-‘

ছেলেটির মাথার ঝাঁকড়া চুলে হাতের বিচরণ চালালো। দাঁতগুলি বের করে হেঁসে উঠে বললো,

‘ আগের থেকে এখন অনেকটা ভালো আছি। ‘

ছেলেটির ন্যাকামো দেখে মন চাইলো ঠাটিয়ে চড় বসাতে ইরার। কিন্তু এমনটা করা যাবে না। ইরা জোরপূর্বক হাসলো। বললো,

‘ আপনারা আমরা তো আত্মীয় তাইনা? ‘ বলেই থামলো ইরা। ছেলেটির মতিগতি বুঝবার চেষ্টা করলো থেমে। ছেলেটা শক্ত করে বললো,

‘ অবশ্যই। ‘

‘ এসব ঝামেলা ভালো লাগছে আপনার? এতে তো আমাদের’ই সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। প্লিজ এগুলা থামান। যেতে দিন না। ‘

ছেলেটি কিছু ভাবলো। ইরার মন বললো কাজ হবে। আবার মনে হলো এতটা সহজ হবে না। কিন্তু হলো সহজ। ইরার কথায় ফেঁসে ছেলেটি দ্রুত গিয়ে সাজানো দুটো টেবিল সড়িয়ে দিলো। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠলো সবাই। সাথে আয়াত ও। তার সালাবাবু যে এমন সুন্দর একটি কাজ করে বসবে তা যেন কল্পনাতেও ভাবেনি আয়াত। কনেপক্ষের সবার মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। এতো আত্মীয়র মাঝে নিরবকে কেউ কিছু বললো না। নিরব আবারো গিয়ে দাড়ালো ইরার পাশে। আয়াত সেদিকে তাকাতেই থমকে গেলো। মনের মধ্যে জমলো রাগ। এতো কিসের কথা ছেলেদের সাথে ইরার? আয়াত বুঝলো না! বুঝতে চাইলো না! তবে কি ইরা তাকে সেই সারপ্রাইজ দেবে না? আয়াতের মনে নামলো বিষন্নতার ছাপ। শুকনো ঠোগ গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আয়াত। আর কত বড় হলে পরিবারের উপর, নিজের পিতার উপর কথা বলা যায়, এ নিয়ে ভাবনার তার শেষ নেই তার। নিজের বোকামোর জন্য নিজেকে রেললাইনে গিয়ে মাথা দিতে মন চাইলো আয়াতের। আয়াতের মামা আয়াতকে নিয়ে গেলো স্টেজে। আর দেখা মিললো না মায়াবতীর।
___

‘ ভাবী কাজ হয়ে গেছে! এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘

কুহুর এই এক বাক্য যেমন খুশি করলো ইরাকে, তেমনি রেগে গেলো ‘ভাবী’ শব্দটি শুনে। নিজেকে শান্ত রেখেই ভির ঠেলে বেড়িয়ে এলো দু’জন। ঢাকা শহরটাকে দাওয়াত দিয়েছে মনে হলো ইরার। এতো মানুষ! একটু ফাঁকা জায়গা পেতেই ইরা কুহুকে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি বললো? ‘

কুহুর এক কথায় জবাব, ‘ কাজ হয়ে যাবে। ‘

ইরা ছোট্ট শ্বাস ফেললো। সেদিনের বিয়ের কথা মনে পড়লে আজও বুক ফেটে আসে ইরার। কষ্ট হয়। অনেক ক্ষত! আকাশ নামক মানুষটাকে অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে ইরা। কতদিন কথা হয়না! দেখা হয়না! আর মেসেজ ও আসে না। ইরাকে চুপ দেখে কুহু বললো,

‘ চলো স্টেজের কাছে যাই। আয়াত ভাই ইসারায় ডাকছিলো তখন। ‘

‘ কিন্ত-‘

‘ কিন্তু কি? বোমা ফাটবে, আর দেখবে না? চলো! ‘

সম্মতি জানিয়ে বললো ইরা, ‘আচ্ছা চলো। ‘

ইরা আর কুহু স্টেজের বিরাট কয়েকটা প্লাস্টিকের পিলারের কাছে গিয়ে দাড়ালো। এগুলো মূলত সূন্দর্যের জন্য দেয়া। সাথে প্লিস্টিকের লতা-পাতা জড়ানো।

বিয়ের বর যেখানে একরাশ লজ্জা নিয়ে মুখে রুমাল গুজে থাকে, সেখানে আয়াত চোখ জদ্দুর যায় ততোদূর পর্যন্ত চোখের বিচরণ চালাচ্ছে। কাউকে খুজছে! মুখে এতোটুকুও লজ্জার আভাস নেই। আর না মনে হচ্ছে সে বিয়ে করতে এসেছে। কুহু আয়াতের অবস্থা দেখে ঠোট টিপে হাসলো। ইরার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ভাবী তোমায় খুজছে। ‘

ইরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে উঠলো,’ কুহু ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। ওনার মতো মানুষকে ইরা জিবনেও জিবনে আসতে দেবে না। ‘

ইরার কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আয়াতকে ডেকে উঠলো কুহু,

‘ ভাইয়া কাউকে খুজছো? ‘

আয়াত তড়িৎ গতিতে সেদিকে তাকালো। ইরার পাশে কুহুকে দেখতেই তার উত্তেজিত চোখজোড়া শান্ত হলো। কুহুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হাত উঁচিয়ে ইরাকে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করলো আয়াত। পাশ থেকে দুষ্টু হেঁসে কিঞ্চিৎ ঠেললো ইরাকে কুহু। দু’ ভাই বোনের কাজে বিরক্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করলো ইরা।

আয়াতের বুক ধুকপুক করছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে আয়াতের হৃদয়। সময় আসন্ন। এখনি তার জিবনে চলে আসবে কেউ! অন্যকেউ! তার মায়াবতীকে সে হাড়াবে চিরকালের জন্য। আয়াতের ভাবনা সঠিক হলো। পাত্রীকে আনা হলো। কাজি সাহেব তার কাজে ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু বিয়ের মঞ্চে ঘটে গেলো আশ্চর্য এক ঘটনা। পাত্রী আসর থেকে উঠে দাড়ালো। ভরা আসরে সোজাসাপ্টা বলে উঠলো,

‘ একজন লম্পটকে আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না। বিয়ের আগে যার তিন বছরের সম্পর্ক ছিলো অন্য মেয়ের সাথে , তাকে তো নয়’ই! ‘

#চলবে…