ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১০

0
386

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১০

রাত নয়টা। দূরে কোথায় ঝি ঝি পোকার দল ডাকছে। একটু আগে হলে হয়তো এই ডাক কারো কান অব্দি পৌছাতো না। কিন্তু এখন বিয়ে বাড়ির প্রতিটি কোনা কোনায় ছেয়ে আছে নিস্তব্ধতা। নিকষ কালো নিস্তব্ধতা! কারো মুখে টু শব্দটি নেই। সকলের দৃষ্টি থমকে গেছে। আৎকে ওঠা চাহনি নিয়ে নতুন বউয়ের দিকে তাকিয়ে সকলে। বিয়ের আসরে বরকে ‘লম্পট’ বলে বিয়ে ভাঙা নারী প্রথম দেখছে কেউ! এ বিশ্বাস যোগ্য নয়। অবাক হওয়ারই’ কথা। তেমনি অবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে আয়াত তাকালো তার হবু স্ত্রী’র দিকে। লম্পট? আর আয়াত? দুচোখ ভর্তি অবিশ্বাস আয়াতের। নিস্তব্ধতা ভাঙলো। অবাকের পালা শেষ হয়ে কানাকানি শুরু হলো। কেউ কেউ ভির থেকেই চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,’আমজাদ সাহেবের মেয়ে কি পাগল হলো নাকি? এসব কি বলছে তনয়া?’ তবে এই কথাগুলি কান অব্দি পৌছালো না তনয়ার। তড়িঘড়ি করে মঞ্চ থেকে নেমে এলো সে। ঘৃনাভরা চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ ছিহ্! আপনি এতটা নিচ? তিন বছরের ভালোবাসা আপনাদের আর আপনি এখানে বসে আছেন বিয়ে করতে? কোন আশায়? এ বিয়ে হবে না! না, কিছুতেই না। ‘

আয়াতের সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ এর মতো ছুটে গেলো কিছু। আকস্মিক এই নির্মম ঘটনায় উঠে দাড়ালো আয়াত। মুখে ভেসে উঠলো প্রশ্ন! তনয়ার একটি কথাও মাথায় ডুকলো না আয়াতের। বাকরুদ্ধ, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। ইরফান আলী কয়েকহাত দূরে দাড়িয়ে সবটা শুনছেন। আমজাদ সাহেব কোথথেকে ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। কড়া গলায় বললেন,

‘ তনয়া এসব কি বলছো জানো তুমি? আয়াতের সম্মন্ধে সব কিছুই আমি জানি। ‘

তনয়া ঠাট্টা হাসলো। আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ সবটা জানো না তুমি! ওনাকে জিজ্ঞেস করো তো, ইরা কে? ‘

মুহুর্তে আয়াতের মুখে ভেসে ওঠে নির্লিপ্ততা। ইরফান আলী অবাক হলেন। কুহুর বান্ধবী হিসেবেই পরিচিত এই ইরা। আর তাকেই ঠকালো আয়াত? মেয়েটা মুখ বুঝে কেন সহ্য করলো? ইরফান আলী ছুটে গেলেন ছেলের কাছে। বললেন,

‘ এসব সত্যি আয়াত? কুহুর বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো তোমার? ‘

আয়াত মাথা নিচু করে নিলো। ইরফান আলী যা বুঝার বুঝে নিলেন। কয়েক’শ লোকভর্তি বিয়ের মঞ্চে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন ছেলেকে। আয়াতের তবুও কোন হেলদোল দেখা গেলো না। ইরফান আলীর কষ্ট হচ্ছে ত্রপা বেগমের কথা ভেবে। এতকিছু শুনলে কি হবে?শরীর খারাপের জন্য তিনি আসতে পারেননি। রাগে ফুসে উঠলেন ইরফান আলী,

‘ চুপ করে দাড়িয়ে আছো কেন? বলো! কেন এ বিয়ের আগে বললে না তুমি এসব? এভাবে মান-মর্যাদা ডোবালে আমাদের? ‘

আয়াত তবুও চুপ। একটি বাক্য আর উচ্চারণ করলো না। ইরফান ছেলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। অতঃপর তাকালেন তনয়ার দিকে। তনয়া রাগে ফুসছে যেন। ইরফান নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ এসব কিভাবে তুমি জানলে মা? ‘

‘ এটা ইমপর্টেন্ট নয় যে আমি কিভাবে জানলাম। একজন মেয়েকে কিভাবে ঠকালো আপনার ছেলে, ইমপর্টেন্ট এটা। আব্বু, আমি এ বিয়ে করবো না। ‘

আমজাদ হোসেন তিক্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ইরফান আলীর দিকে। ছেলের এই গুনগুলো কেন গোপন করলো, তা জানতেই হবে তাকে। তিনি দৃষ্টি সড়িয়ে নিলেন। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ তোমায় এসব কে বলেছে তনু? ‘

তনয়া হাতের ভাজ থেকে ফোন বের করলো। ইরার খুব সাথে আয়াত, ইরার কানের কাছে মুখ। সেই ছবিটি দেখালো তনয়া। আমজাদ আলী রাগে শরীর কাঁপে উঠলো দেখামাত্র। আয়াতের মামা শক্ত করে আয়াতকে ধরে সামনে টেনে নিলেন। বললেন,

‘ তুই কেন এটা করলি আয়াত? কুহুর বান্ধবী তো দেখতেও খারাপ নয়! কেন ঠকালি বলবি স্পষ্ট করে? ‘

‘ আমি বলছি! ‘

তৃতীয় কারো আওয়াজে সবাই তাকালো সেদিকে। ইরার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে কুহু কিছুটা দূরে। সবার চোখে উত্তেজনা। কুহু আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ এই মেয়েটাই সে, যাকে আয়াত ভাই ঠকিয়েছে। কিন্তু কি জানেন তো ফুপা? আপনার ছেলেকে তবুও কিচ্ছু বলেনি ইরা। জানেন, ইরাকে দাওয়াত অব্ধি আয়াত ভাই দিয়েছে! ইরা আসতেই চায়নি। আমি নিয়ে এসেছি। আর মিথ্যে যে কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না এটাই তার বাস্তব প্রমান! ‘

ইরা অবাক হয়ে কুহুর দিকে তাকালো। এসব কি বলছে কুহু? হাতের উল্টোপিঠে আস্তে করে চিমটি কাটলো ইরা। কুহু ভ্রু কুঁচকে ধির গলায় ইরাকে বললো,

‘ কি সমস্যা? চিমটি দিচ্ছো কেন? ‘

‘ এতো বাড়াবাড়ি করার কি দরকার? চুপ থাকো! ‘

কুহু দুষ্ট হেঁসে ইরার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘ আয়াত ভাই চরম অন্যায় করেছেন। তনয়া আপু যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা একদম ঠিক। ‘

কোলাহল দ্বিগুন হলো। সবাই জেনে গেলো এ বিয়ে হওয়ার নয়। শেষ পরিনতির অপেক্ষা সবার। তনয়া আর এক মুহুর্তে সেখানে না থেকে বেড়িয়ে গেলো। ইরফান আলী আমজাদ হোসেনের সামনে গেলেন। নিচু স্বরে বললেন,

‘ আমি সত্যিই দুঃখীত। এতো আয়োজন সব বৃথা হলো। আমি জানতাম না আয়াত এমন কিছু করেছে। ‘

ইরফান আলীর নিচু স্বর রাগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলো আমজাদ হোসেনের। ‘ পড়ে দেখে নেব!’ বলে তিনিও স্থান ত্যাগ করলেন। ইরফান দিশেহারার মতো তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তার চাকরি যাবে নিশ্চিত। তিনি বিষন্ন চোখে মেঝের দিকে চাইলেন। ছেলেকে কেন বুঝলেন না তিনি? তার ছেলে তো বড় হয়েছে। আর ছোট নেই! নিজে পিতা বলে পিতা ডাকার অধিকার তুলে নেওয়ার থ্রেট করাটা মোটেই উচিত হয়নি। তিনি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললেন। আহত দৃষ্টি মেলে ইরার দিকে চাইলেন। মাথা নিচু করে ইরা। ইরফান আলী ইরার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলেন। ইরা তাকালো। মানুষটির চোখ নোনাজলে টইটুম্বুর। তিনি আদুরে গলায় বললেন,

‘ এসব আগে বলোনি কেন মা? ‘

ইরা ইতস্তত করতে লাগলো। এগুলো তো সে ভাবেই নি। এখন যদি সে নিরুত্তর হয়ে পড়ে, আর বিয়েটা এই লোকটার সাথে তার হয়ে যায়, তখন? ইরা শুকনো ডোগ গিললো। বললো,

‘ আপনার ছেলে আমায় কখনো বোঝেই নি। এতোদিন কথা বলে, স্বপ্ন দেখিয়ে জাস্ট টাইম পাস করেছে। আমাদের সম্পর্কটা তো আমি শেষ’ই ভেবেছিলাম। জানিনা, তনয়া কিভাবে জেনে গেলো। ‘

ইরফান আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে,

‘ যা হয় ভালোর জন্যই হয়। তনয়া জেনে নিজে বেঁচেছে। একটা কথা বলবো মা? ‘

অজানা ভয়ে ডান চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপতে থাকলো ইরার। আটকানো গলায় বললো,

‘ জ্বি বলুন। ‘

‘ তুমি কি চাও? ‘

এবার গলা শুকিয়ে কাঠ ইরার। বিয়ে ভাঙার কথা ছিলো, ভেঙেছে! কিন্তু এগুলোর মুখোমুখি হতে হবে এ তো ভুলেও ভাবেনি ইরা। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। এই লোকটাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে, জিবন শেষ করা একই কথা। ইরা শক্ত হলো। নিজেকে সামলে আয়াতের মুখোমুখি গিয়ে দাড়ালো। কড়া গলায় বলে উঠলো,

‘ যে আমায় আদেও কখনো ভালোবাসেনি। এতটুকু অনুভূতি আমার জন্য যার মনে নেই, তার সাথে আর নয় আঙ্কেল! আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে শিখে নিয়েছি। যে আমায় চায় না, আমি তার জিবনে থাকতে চাই না। ‘

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বাঁকা হেঁসে আয়াতের দিকে তাকালো ইরা। কিন্তু আশ্চর্য! আয়াতের মুখে হাসি। মুচকি হেঁসে তার’ই দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আয়াত। ইরা অবাক হলো, পিলে চমকে উঠলো। আয়াতের এখন আকাশস্পর্শী রাগ হওয়া উচিত। ইরাকে ধ্বংস করার মতো কঠিন চোখে তাকানো উচিত। কিন্তু এ কি? ইরা থমকে গেলো। আয়াত নিজের ঘারে একটু চুলকিয়ে ইরার উপর কিঞ্চিৎ ঝুকে বলে উঠলো,

‘ সারপ্রাইজটা দারুন ছিলো। ভেবেছিলাম বিয়েটা হয়েই যাবে। কিন্তু ওস্তাদ তুমি শেষ রাতে বাজিমাৎ করলে। আহ্! কি শান্তি। এর জন্য যা চাইবে তুমি আর কুহু, তাই পাবে! ট্রাস্ট মি, মনটাই ভালো হয়ে গেলো। ‘

#চলবে…