ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১২

0
565

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১২

‘ এতো রাতে তুমি বাইরে? ‘

সোডিয়ামের মৃদু আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো আকাশের মুখশ্রী। ফর্সা মুখখানায় এলোমেলো ভাবে বেড়ে ওঠা দাড়ি, মাথার চুলগুলো, কেমন রুক্ষ-শুষ্ক মনে হলো ইরার। ব্রিজের নিচে পানির স্রোতের শব্দ স্পষ্ট কানে বাজছে। ইরার তবুও তঠস্ততা পরিবর্তন হলো না। অসর দু’টি পায়ে ভর দিয়েই দাড়িয়ে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশের প্রশ্নের পরপরই কুহু ইরার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। ছেলেটির কন্ঠ শুনে বোঝা যায়, ইরা আর সে আগাম পরিচিত। কুহু বললো,

‘ কে ছেলেটা ইরা? চেনো? ‘

ইরা উত্তর দিলো না কুহুর। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘ সামান্য কাজ ছিলো। ‘

আকাশ বড়বড় চুলগুলো হাত দিয়ে উল্টে নিলো। মুহুর্তে মুখে নেমে এলো একগুচ্ছ কালো মেঘ। ছোট্ট করে বললো,

‘ কি কাজ? ‘

‘ এতোকিছু আপনাকে কেন বলবে ইরা? ইরা কে উনি? ‘ বলে উঠলো কুহু। ইরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কুহুর পাণে তাকিয়ে রইলো। আকাশ বললো,

‘ তোমার কাজ থাকতেই পারে। বাদ দাও। ভালো
আছো? ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘

এরপর খানিক সময় কাটলো নিস্তব্ধতায়। ব্রিজের নিচের পানির স্রোত, তার শব্দ, দমকা হওয়ায় পরিবেশ হয়ে উঠেছে অন্যরকম।

‘ আমায় জিজ্ঞেস করবে না? আমি কেমন আছি? ‘

ইরা চমকে উঠলো। অবাক চোখে তাকালো আকাশের দিকে। ‘আমায় জিজ্ঞেস করবে না?’ শব্দটিতে কষ্টের ছাপ! তবে কি লোকটি ভালো নেই? কেন থাকবে না? সে তো অন্যের এক কথাতেই ইরাকে ত্যাগ করেছে। বিয়ের অসরে ‘ধর্ষিতা’ বলেছে। ইরা আকস্মিক হেঁসে উঠে বললো,

‘ আপনার করুনা করে জিজ্ঞেস করাটা মানায়, আমার কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। মানায় না! ‘

‘ তবু একবার জিজ্ঞেস করবে না? ‘

ইরা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শান্ত গলাতেই বললো,

‘ কেমন আছেন? ‘

মনের এতো এতো কথা, চাপা কষ্ট, হৃদয়পোড়া যন্ত্রণাগুলি মুহুর্তে উবে গেলো আকাশের। বুকে নেমে এলো সুবিশাল পাহারের চাপ। এগুলো তো সে বলতে চায়, কষ্ট ভাগাভাগি করতে চায়! কিন্ত হায়, হলো না। ইরা তো জানতেই চায়না। নিজ হতে জিজ্ঞেস করলে হয়তো আকাশ খোলা আকাশের নিচে চিৎকার দিয়ে বলতো, আমি ভালো নেই। কিন্তু এখন আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এতটুকু ইচ্ছে নেই তাকে জানানোর, যে আদতেও জানতে চায় না। আকাশ বললো। তবে কন্ঠ কেমন শোনালো,

‘ ভালো আছি। ‘

‘ আপনি না বলেছিলেন সিগারেট খান না? ‘

আকাশের সহজ উত্তর, ‘ ক’দিন যাবৎ খাই। নাহলে মাথায় উদ্ভট সব চিন্তা আসে। ‘

ইরা আর কিছু বললো না। বলতে ইচ্ছে হলো না। কয়েক সেকেন্ড দাড়িয়ে থেকে কুহুর ডান হাত খিচে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো ইরা। আকাশের বুক কেমন করছে। মন চাইছে আরও কথা বলতে। কিন্তু চাইলেই কি হয়? তারও তো সন্মান আছে! সে সন্মানে আঘাতের উপর আঘাত একমাত্র সে’ই করেছে। বিশ্রীভাবে কটু কথা বলেছে। হানি হয়নি? হয়েছে! ইরা কুহুকে নিয়ে হাটতে লাগলো বাজারের দিকে। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো ইরা, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশ।

বাজারের খুব কাছাকাছি এসে দাড়ালো দুজনে। মনের ভেতর থাকা প্রশ্ন বলে উঠলো কুহু,

‘ ছেলেটা কে ইরা? ‘

বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইরা। বললো, ‘ এনিই সে, যার সাথে আমার বিয়ে ভেঙেছে। ‘

‘ মনে হলো ভালো নেই লোকটা! ‘

কুহুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো ইরা। এদিক ওদিক তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘ সেটা তার ব্যাপার। ‘

‘ তুমি কি সত্যিই ভালো আছো? ‘

কুহুর হঠাৎ এমন প্রশ্নে তাজ্জব চাহনি নিয়ে তাকায় ইরা। বলে,’ থাকতাম! আজ যদি তোমার ভাইকে উচিৎ একটা শিক্ষা দিতে পারতাম। ‘

‘ চলো, তোমায় বাড়ি অব্ধি এগিয়ে দিয়ে আসি। ‘

‘ পাগল হয়েছো? তুমি ফিরে যাও! আমি পারবো যেতে। ‘

কুহু মৃদু হেসে বললো, ‘ আচ্ছা। ‘

ইরাকে ভ্যানে তুলে দিয়ে কুহুও চলে গেলো। ইরা বাড়ির সামনে নেমে পড়লো। ভারা মিটিয়ে বাড়ির কলিং বেল চাপতেই খুলে দিলো রিয়াদ। ইরা ভরকে গেলো। রিয়াদের মুখ লাল টকটকে। কখনো এতটা রাগ সে দেখেনি। দেখলেও মনে করতে পারলো না। রিয়াদ একটি কথাও না বলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দাড়ালো। আহেরা, ইলিমাও আছেন। ইরা ধির পায়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আহেরা ছুটে এলেন। বললেন,

‘ কই ছিলিস এতক্ষণ? তোর জন্য কি পাগল হয়ে যাবো? রাত কত খেয়াল আছে? সারে দশটা! এত রাত অব্দি কার সাথে ছিলিস? ‘

ইরা হকচকিয়ে তাকালো। বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ হয়ে উঠলো সে। আহেরা এতটা জোর গলায় তার সাথে কখনো কথা বললেনি। তাহলে আজ? ইরা ভাবীর দিকে একপলক তাকালো। ইলিমা যেন এটার’ই অপেক্ষা করছিলেন। ইরা তাকাতেই ইসারায় জলদি রুমে যেতে বললেন। ইরা শুকনো ডোগ গিলে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হুংকার দিয়ে উঠলো রিয়াদ,

‘ দাড়া! ‘

থেমে গেলো ইরার পা। পিছু ফিরে না তাকিয়ে সেভাবেই দাড়িয়ে রইলো। রিয়াদ ফের বলে উঠলো,

‘ একেই সারাটা দিন কিছু না কিছু শুনতে হয়’ই। তারউপর তুই কি শুরু করেছিস? কালকেও কিছু না বলে কোথাও চলে গেছিলি! আর আজ ফিরলি রাত সাড়ে দশটায়। দু’দিন তুই বাড়ির বাইরে পা রাখবি না ইরা। একটিবারের জন্যেও যেন এ কথা না শুনি তুই বাইরে গিয়েছিলি। ‘

ইরা পিছু ফিরলো। শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বললো,

‘ আমার ভার্সিটি আছে ভাইয়া। ‘

‘ থাকুক। দুইদিন না গেলে কিছু হবে না! ‘

ইরা চুপ হয়ে গেলো। আহেরা অনুনয়ের স্বরে বললে, ‘ এটা করিস না রিয়াদ। কয়েকদিন পরেই নাকি ওর পরিক্ষা। ‘

‘ বাড়িতে পরুক। পারলে ওর জন্য টিচার রাখছি। ‘

আহেরাও আর কিছু বললেন না। ছোট ছোট পায়ে রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। রিয়াদ যে বাক্য একবার মুখ থেকে বের করেছে, তার একটি হরফ ও নরচর করবে না সে। ইরার রাগ হলো, প্রচন্ড রাগ! নিজেকে ছিঁড়ে ফেলার মতো রাগ। কিছুই হলো না! না হলো নিজের কার্জস্বিদ্ধি, না হলো আয়াতের মোক্ষম একটা শাস্তি! তারউপর এখন নিজের’ই বাইরে যাওয়া বন্ধ। সবমিলিয়ে নিজের গালে থাপড়াতে মন চাচ্ছে। রাগে, দুঃখে গটগট করে উপরে চলে গেলো ইরা। কাঁধের ওড়নাটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে চুপ করে বসে রইলো সে। দুইদিন! কম কথা? এ যেন মটেই সহ্য হচ্ছে না ইরার। দোষ অন্যকারো, সে সাজা পাচ্ছে। একবার নয়, বারবার। এটাই একমাত্র কারন রাগের।

__

আয়াতদের বাড়িতে চলছে ভয়াভয় ঝড়। ত্রপা বেগম বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ শুরু করেছেন। ছেলের সম্পর্ক আছে, তাও তিন বছরের! এটা কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করবেন না। তার ছেলের কোন দোষ নেই। এ’কথা মনেপ্রাণে জবছেন তিনি। তিনি একের পর এক কথা শুনিয়ে চলেছেন তনয়া আর ইরাকে। তার মতে, বিদেশ ফেরত ছেলেটাকে দুজনে মিলে এমন সর্বনাশ করেছে। এ যেন সবটাই প্লান করা। ইরফান আলী ছেলের সাথে এসেছে থেকে কোন কথা বলছে না। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন নেই বললেই চলে। আছে শুধু কুহু। আয়াত ছাঁদে গিয়েছে আধঘন্টা হলো। সব মিলিয়ে বাড়ির রুপ নিকষ কালো।

ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে আটকে গেলো কুহু। দু’চোখ ভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে একটি পোস্ট পড়ছে সে। ‘আয়মান রিয়াদ’ প্রফাইল থেকে পোস্টটি করা হয়েছে। নিয়োগ পোস্ট। তাদের একজন টিউটর লাগবে, আর সেটা অতি শীগ্রই। কুহু ফোন নিয়ে এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো।

__

সকাল তখন নয়টা। তখনো চোখভর্তি ঘুম। বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে ইরা। জ্বলজ্বলে সূর্যের তুখোড় রোদ মুখে পড়লেও ঘুম ভাঙছে না ইরার। রাত দেড়টায় ঘুমালে কার ঘুম এত সকালে ভাঙবে? ভাঙবার কথা নয়। কিন্তু ঘুম ভাঙলো ইলিমার ডাকে। চোখ ডলতে ডলতে তাকালো ইরা। বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ ভাবী,ভাই আমায় ভার্সিটি যেতে নিষেধ করেছে। ডেকো না তো! ‘

‘ আগে উঠবি তো। দেখ কাকে নিয়ে এসেছে তোর ভাই। হোম টিউটর। ‘

মুহুর্তে চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো ইরার। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো এবারে। অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,

‘ সত্যি নাকি? ‘

‘ নিচে গিয়ে দেখ। ‘

মাথার কাছ থেকে ওড়নাটা টেনে ঠিক হয়ে বেড়িয়ে পড়লো রুম থেকে ইরা। কিন্তু নিচে গিয়ে এমন একটি দৃশ্য দেখবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ইরা।

#চলবে…..