উল্টোরথে-৮
তিথি ডিকেনের নম্বরটা কেটে দিলো। আবার কল করছে দেখে নম্বরটা ব্লক করে রাখল৷ যদিও বিশেষ লাভ নেই, অন্য নম্বর থেকে ফোন করতে পারে। কক্সবাজার থেকে তিথি চলে আসার পর থেকে তিন চার দিন পরপর বারবার কল করে যাচ্ছে। তিথি ডিকেনের বাসায় গিয়ে গালাগাল করে এসেছে। কেন এরকম প্রতারণা করল ডিকেন!
তিথি অনেক শক্ত মেয়ে। বাসার ছোটো মেয়ে, বাবা মায়ের বেশি বয়সের সন্তান। মা একটু বেশি ছাড় দিয়েছিলেন তিথিকে। তিথি বাসা থেকে চলে যাওয়ায় তিনি সব চাইতে বেশি অপমানিত হয়েছেন। স্বামী, ছেলে ছেলের বউ কেউ তাকে ক্ষমা করেনি। তিথিকে তো নাই। সবার ভয়ে তিথির সাথেও তিনি কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন।
কেন এমন হলো, ডিকেন স্বাভাবিক একটা ছেলে হতে পারত না! পালিয়ে বিয়ে করে কতজন, সবাই সব মেনেও নেয়! ডিকেন মিথ্যাবাদী, প্রতারক!
তিথি সব ছবি ডিলিট করে ফেলেছে ফোন থেকে। শুধু একটা ছবি আছে, ছবিটা ডিকেনের স্টুডেন্ট লাইফে, তিথি প্রতিদিন ছবিটা দেখত! কেন যেন এটা ডিলিট হয়ে যায় নি! অথবা তিথি করতে পারেনি।
বাসায় ফিরে তিথি জিনিসপত্র নামিয়ে নিলো। তিথির শাশুড়ী তিথিকে দেখে বললেন, এত কিছু?
পারভেজ গিয়েছিল নিউমার্কেটে। ও আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলো।
ওহ আচ্ছা। কিছু খেয়েছ?
জি। খেয়েছি।
তিথি নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকল না। নতুন জিনিসগুলো দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে ফেলল। সব গুছিয়ে নিতে নিতে পারভেজ এসে পড়ল।
বাহ, রুমটা সুন্দর করে সাজিয়েছ।
তিথি উত্তর দিলো না। নিজের রুমটা কিভাবে সাজাবে ডিকেনের সাথে প্ল্যান করেছিল। সাজানো সেরকমই হয়েছে৷ তবে অন্য কারো ঘর। ঘরটা তিথির হয় নি!
তিথি, গোল্ডের জিনিসগুলো পরো। বউ বউ লাগুক।
তিথি পরল। সত্যিই আয়নায় চেহারাটা বদলে গেল কিছুটা। পোশাকে তিথি সালোয়ার কামিজ রেগুলার পরত না। সব সময় ওড়নাও পড়ত না। এই তিথিকে আয়নায় চিনতে পারে না নিজেই। কেমন দম বন্ধ লাগে! দম বন্ধ করে বাঁচতে হবে পরে জীবনটা!
তিথির ঘরে এসে সবাই খুব প্রশংসা করল। ভীষণ সুন্দর হয়েছে। তিথি যেন অন্য মানুষ, কোনো অতীত ছিল না তার!
রাতে সবার সাথে বসে খাওয়ার সময় পারভেজের ভাইয়া ভাবী তিথির সাথে কথা বলল হালকা পাতলা।
পারভেজ ঘুমাতে এসেছে। তিথি বসে আছে বাইরের দিকে মুখ করে।
তিথি, ঘুমাবে না?
হুম।
তোমার কি মন খারাপ?
না, কেন?
চুপ করে আছ তাই!
এমনিই। সারাদিন বাইরে ছিলাম, বাসায় ফিরে কাজ করেছি, একটু হাত পা ব্যাথা করছে।
পারভেজ উঠে তিথির কাঁধে হাত দিলো। তিথি পারভেজের দিকে তাকাল। পারভেজ তিথির ঘাড়ে আলতো করে ম্যাসাজ করে দিতে লাগল। তিথি মুখ ফিরিয়ে নিলো। হয়তো পারভেজ অন্য কিছু চাইবে আজ।
তুমি ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ো।
তিথি হাত সরিয়ে নিলো।
পারভেজের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। আজ ভেবেছিল তিথি কাছে আসবে। তিথি তাকিয়ে বুঝল।
এখন কি করা উচিৎ! তিথি এগিয়ে যাবে? তিথির তো ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে না করলে অভিনয় করতে হবে? তিথি কখনো ভাবে নি দাম্পত্যে এই অভিনয় করে চলতে হবে তাকে! করতে হবে, পারভেজ অনেক করছে তিথির জন্য৷ তিথি কিছুই করতে বলেনি পারভেজকে। তবুও করছে আর সেটা তিথির জন্য খারাপ হয় নি। ভালো হয়েছে।
তিথি পারভেজের হাতে হাত রাখল। পারভেজ বুঝতে পারল তিথির ইশারা। তবে মন থেকে তিথি এগিয়ে গেল কিনা, সেটা পারভেজ বুঝল না। বেশিরভাগ পুরুষ সেটা বুঝে না। বুঝতে চায়ও না। পারভেজ তিথিকে বুকে টেনে নিলো।
★★★
রাত গভীর হয়েছে। পারভেজ ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ। তিথির ঘুম আসে না৷ এটা সত্যি তার অতোটাও খারাপ লাগেনি। কিন্তু তবুও কিছু একটা নেই! কি নেই তিথি জানে না! বাইরে আঁধখাওয়া চাঁদ। তিথির ডিকেনের কথা মনে পড়ে। একটা মানুষকে যতটা ঘৃণা করা যায়, তিথি সেটাই করে কিন্তু ভুলতে পারছে না কেন! পুরোপুরি ভুলে যেতে কতদিন লাগবে তিথির!
★★★
ডিকেন গভীর রাতে উঠেছে। না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেও এখন খিদে পেয়েছে। ফ্রিজ থেকে তেহারি বের করে ওভেনে দিয়েছে। রুম থেকে টের পেয়ে ইরিন বের হয়েছে।
খাচ্ছ? আমাকে ডাকতে? গরম করে দিতাম।
ডিকেন বলল, তুমি ঘুমাও নি?
বাবু ঘুমাতে চায় না। ও ঘুমালে আর আমার ঘুম আসে না।
তুমি শুয়ে পড়ো।
ইরিন বসল। ডিকেনের বিরক্ত লাগছে। কেন যেন ইরিনকে ডিকেন সহ্য করতে পারে না। অথচ মেয়েটার কোনো দোষ নেই। একটু নরম, ভ্যাবদা মার্কা মেয়ে। তিথি অনেক শক্ত ধরনের একটা মেয়ে ছিল। কিছু একটা তিথির আলাদা আছে, যেটা ইরিনের মধ্যে নেই। ইরিন ঘরোয়া মেয়ে, রান্না করা, বাচ্চা নিয়ে সময় কাটানো, মাঝে মাঝে শপিং সাজগোজ ঘোরাঘুরি এগুলো নিয়েই সুখি!
তিথি কেমন, ইরিনের মত না! ইরিনের কথা জানার পরে তিথি এক মুহুর্তও অপেক্ষা করে নি। সোজা বাসায় চলে এসেছিল। তখন ডিকেন ইরিনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভয় পেয়েছে৷ কিন্তু কেন! এত ভয় কিসের ওর!
ইরিন যদি সব শুনে নিজে চলে যেত, সেটাই তো ভালো হতো!
ইরিন, ঘরে যাও।
তুমি আমাকে একদম দেখতে পারো না তাই না?
এটা কেন মনে হলো?
এমনিই।
ডিকেন প্রসংগ পাল্টে বলল, সামনের সপ্তাহে একটা রিসোর্টে যাব। সব গুছিয়ে রেখ।
কে কে যাচ্ছি? আমরা তিন জন?
তোমার মা, ছোটো বোনকে সাথে নিও।
ইরিন বলল, বাবুকে রেখে আমরা দুজন যাই?
ডিকেন বলল, না। এত ছোটো বাচ্চা মা ছাড়া রাখা ঠিক হবে না। তুমি ঘরে যাও।
ইরিনের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। কখনো তো ওকে একা নিয়ে কোথাও যায় না ডিকেন। মনে হয় যাবেও না!
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-৯
সকাল সাতটা। তিথি ছাড়া ছাড়া ঘুমিয়েছে, গাঢ় ঘুম হয় নি। পারভেজ তিথিকে ঘুমিয়ে আছে দেখে কাছে টানতে চাইল৷ ঘুমের মাঝে তিথি জড়োসড়ো হয়ে গেল। পারভেজ জোর করল না।
উঠে পড়ল অফিসের গাড়ি চলে আসবে। কাল তিথি যেটুকু কাছে এসেছে, সেটাও অনেক। আস্তে আস্তে ঠিক হবে। তিথিকে অনেক দিন থেকে পছন্দ করত পারভেজ। তিথি কখনো সাড়া দেয় নি। তাকিয়ে দেখেও নি।
যে ছেলেটার সাথে তিথি ঘুরত, সে কি চাকরি করে সেটা পারভেজ জানে না তবে দেখতে ভীষণ সুদর্শন ছিল। তিথি হয়তো সেই ছেলেকে এখনো ভুলে যেতে পারে নি।
পারভেজ বের হয়ে গেল। তিথির ঘুম ভাঙল আননোন নম্বরের ফোনে। ডিকেনের ফোন! এতদিন অনেকবার অন্য নম্বর থেকে চেষ্টা করেছে, তিথি ধরে ভয়েস শুনে কেটে দিয়েছে৷
আজ কাটল না।
হ্যালো!
তিথি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
ডিকেন ফোন কেটে যাচ্ছে না দেখে কথা বলতে লাগল, তিথি, আমারও কিছু বলার আছে, আমি শুনেছি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তবু আমাকে একটু বলার সুযোগ দাও, প্লিজ!
তিথি অনেকক্ষণ পরে বলল, বলো।
সুযোগ পেয়ে ডিকেন বলল, আমি তোমাকে সবই জানাতাম কিন্তু…..
তিথি ফোনে সব বলা সম্ভব না। একদিন আমাকে আধঘন্টা সময় দাও, প্লিজ!
সেটা সম্ভব না।
তিথি কোনোদিন তো তোমার কাছে কিছু চাইনি!
তিথি মনে মনে বলল, না চাইতেও সবটা দিয়েছিলাম তোমাকে! তুমি তার যোগ্যই ছিলে না।
কি বলতে চায় ডিকেন? এখন কি ই বা বলার আছে!
তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাইছ, তোমার বউ জানে?
ডিকেন বলল, না।
তাহলে? তাকে জানাও, সে তো আমাকে প্রসটিটিউট বলতেও ছাড়ে নি!
ডিকেন চুপ করে রইল, ইরিনকে তারপর থেকে আর সহ্য হচ্ছে না কিন্তু মায়ের জন্য কিছু বলতেও পারে নি!
তিথি, ইরিন আমাদের সম্পর্কে কিছু জানত না।
এখন জানে? আমাকে তো বিশ্বাস করে নি। অবশ্য তুমি ভালো বশ করতে পারো৷ আমার মত কঠিন মনের মানুষই তোমাকে চিনতে পারে নি, ও তো নরম বোকা টাইপের মেয়ে।
তিথি, আমি কাউকে বশ করিনি!
বাদ দাও, তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি ভালো আছি, আমাকে আর ফোন করবে না!
তিথি প্লিজ, একটা বার। তোমার কসম লাগে!
ডিকেন, এসব বলে কোনো লাভ নেই।
তিথি আমি আগামীকাল তোমার কলেজের সামনে থাকব বারোটার দিকে। তুমি আসবে। না আসলে মনে করব তুমি শুধু সময় কাটিয়েছ আমার সাথে, আমাকে ভালো বাসোনি!
এটা ভাবলে আমার কি! আমি আসব না।
আমি জানি তুমি আসবে।
ডিকেন ফোন কেটে দিলো।
দ্বিধার দোলাচলে তিথি ভাসতে লাগল, যাবে? আর তো কিছুই বাকি নেই, পারভেজকে ঠকানো হবে গেলে!
না তিথি যাবে না। কিছুতেই যাবে না।
সারাদিন তিথির অস্থিরতার মধ্যে কাটল। পারভেজ ফেরার পরেও অস্থিরতা কমল না।
তিথি, চলো সামনের দোকান থেকে ফুচকা খেয়ে আসি।
তিথি পোশাক পাল্টে বের হলো। পারভেজের সাথে ফুচকা খেল, চা খেল। অস্থিরতা ঢাকার চেষ্টার ত্রুটি রাখল না। রাতে পারভেজের ডাকে সাড়াও দিলো। তবে নিজে সক্রিয় হতে পারল না। পারভেজ অবশ্য এতে অখুশি হলো না। তিথিকে কাছে পেয়েই সে খুশি! মনের খবর কোন পুরুষ কবে রাখে!
সকাল হলো আবারও। তিথি সকাল সকাল স্নান সেরে নিলো। তিথি যাবে না কিছুতেই। কিছুতেই না।
কিন্তু সাড়ে এগারোটার দিকে তিথি হঠাৎই রেডি হয়ে বের হলো। শাশুড়ীকে বলল, কলেজে যাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন!
চলবে
শানজানা আলম