একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব-০৬

0
252

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-৬

দ্রুত হাতে মোবাইল থেকে কবিতা বের করে আউড়ে নিলাম বার দুই তিন। মনে পড়ল সবটুকু। গলাটাও ভিজিয়ে নিলাম দুই ঢোক পানি নিয়ে। এখন সব ঠিক থাকলেই হলো। মনে মনে নিজেকে বললাম, “এত বড় হয়ে এটুকু পারবি না? তোর পুচকে ভাস্তিও তো স্টেজে দাঁড়িয়ে টুকটুক করে গান গায়। আর তুই? ছি!”

কাজ হলো না তেমন। আফ্রিতার পর আমার পালা হলো। আমি বিরস মুখে স্টেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার চেহারা নিশ্চিত বাংলার পাঁচের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছিল না! পরে দেখেছি, কয়েকজন বন্ধু ছবি তুলেছিল। এখনো ওরা এটা বলে হাসাহাসি করে যে, আমাকে কেউ নিমপাতার রস বেটে খাইয়ে স্টেজে তুলে দিয়েছিল। আমি কবিতাও বলেছি সেই রসের সাথে মিলে চিবিয়ে চিবিয়ে।

কথা সত্যি৷ আমি যখন কবিতা বলতে শুরু করলাম দেখলাম সুর, অভিব্যক্তি কিছুই আসছে না৷ শুধু বলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আটকে গেলাম, মনে করে বললাম আবার। সর্বোপরি অতি বাজে কবিতা আবৃত্তি যাকে বলে! শুধু মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন বলে রক্ষা। নইলে পুরো হলের লোকজন হাসাহাসি করে খুন হয়ে যেত!

তবে পুরোপুরি বাঁচতে পারলাম কোথায়? মঞ্চ থেকে নেমে পেছনে যেতেই হাসির রোল পড়ে গেল। এক ছেলে বলল, “তুই কি রিডিং পড়ে এলি?”

আরেকজন বলল, “ও বাচ্চা ছেলে। মাত্র কথা শিখেছে। ওকে এসব বলিস না।”

আরেক মেয়ে সুর তুলল, “রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা শুনলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতেন।”

“তোকে কবিতা আবৃত্তি করার ভয়াবহ বুদ্ধিটা কে দিল রে? তুই তো গোয়েন্দাই ভালো ছিলি।”

“ও মাসুদ রানা দি গ্রেট এজেন্ট থেকে মাসুদ রানা দি গ্রেট রিসিটর হতে চেয়েছিল।”

অপামনে নীল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল। কী দরকার ছিল যা পারি না তা করে দেখাতে যেতে? নিজের সামর্থ্য বোঝার ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল। পুরো জীবন যেসব এড়িয়ে চলেছি সেসব জায়গায় হুট করে ঢুকে যেতে চাইলেই যে হবে না তা তো বোঝাই যায়৷ কিন্তু এটুকু বোঝার বুদ্ধিও আমার নেই বুঝি!

ওদের কথাগুলো আমার এত বেশি গায়ে লাগার কারণ কিন্তু আফ্রিতা। এমনিতে নাম মাসুদ রানা বলে কত পঁচানিই তো খেয়েছি। সেসব গায়ে লাগাইনি কখনো। কিন্তু আজকের পুরো ব্যাপারটা ঘটল এমন মানুষের সামনে যাকে মনেপ্রাণে চাই। আমি এতদিন ভাবতাম আফ্রিতা বুঝি আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তা না৷ ও দেখলাম সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে। তখনই কথাটা মাথায় খেলে গেল, ও যদি আমাকে পছন্দ করত তাহলে এরকম হাসাহাসি করতে পারত না। পছন্দের মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা যায় না৷ উল্টো যারা করে তাদের ওপর রাগ লাগে৷ আফ্রিতা আমাকে পছন্দ করে না এটা পরিষ্কার। কখনো করবে না সেটাও এক প্রকার নিশ্চিত। আমি তাহলে হাভাতের মতো কেন ওর পেছনে পড়ে আছি? তার মানে কি আমার সত্যিই ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দিনভর আড্ডা দেয়া ছ্যাঁচড়াদের কাতারে পড়ে গেলাম?

ফেরার পথে আফ্রিতার চোখে চোখ পড়ল। ওর চোখে স্পষ্ট বিদ্রুপের হাসি দেখতে পেলাম। যেন চোখ নাচিয়ে বলছে, “খুব তো বাহাদুরি দেখাতে গিয়েছিলে৷ একটা কবিতাই তোমায় কুপোকাত করে দিল৷ ভেবেছিলে আফ্রিতাকে জিতে নেবে? এত সোজা?”

আমি তীব্র অপমান আর অভিমান নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এতদিন যা বলেছে সেসব শুধু আমার আর ওর মধ্যে ছিল। আজ এত লোকের সামনে ও আমাকে এক প্রকার অপমানই করল। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আফ্রিতার অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি৷ আর কোনোদিন পর মুখও দেখব না। দেখা হলে ওর মতোই না চেনার ভান করে চলে যাব।


‘যেই ভাবা সেই কাজ’ প্রবাদটা যে কতটা কঠিন সেটা বুঝলাম এরপর। সারাদিন মাথায় আফ্রিতা ঘোরে। ওকে প্রথম দেখা থেকে অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত প্রতিটা দৃশ্য ছবির মতো চোখের পর্দায় ভাসতে থাকে। আমি ডুবতে থাকি হতাশায়৷ একদিন ভাবলাম সিগারেট খাব। সিগারেট জিনিসটার সাথে আমার বনিবনা কোনোদিন হয়নি। বন্ধুদের সাথে বার কয়েক খাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফুসফুস সহ্য করতে পারে না৷ আমারও গন্ধটা বিশেষ গ্রহনযোগ্য লাগে না। এবার সিগারেট ধরার শেষ চেষ্টা করলাম৷ আমার ক্লাসের এক ছেলে যে ‘ডিপজল’ নামে খ্যাত, তার কাছে গিয়ে বললাম সিগারেট দিতে। সেই ছেলের চেহারায় ডিপজলের একটা ছায়া তো আছেই, কথাবার্তাও লাগামছাড়া। বলে ফেলল, “কেন ভাউ *** খাইছো?”

আমি গরম হয়ে বললাম, “যা বললাম দে।”

সে একটা সিগারেট দিল। খেতে গিয়ে এক টান দিতেই বুঝলাম জিনিসটা গাঁজা। আমি গন্ধের শেষ। পরে সেটা ফেলে দিয়ে কুলিটুলি করে একটা চুইঙ্গাম চিবিয়ে স্থির হলাম। ডিপজল তো খুবই বিরক্ত৷ বার কয়েক মেয়েমানুষ বলে গালি দিয়ে বসল। আমি ওর থেকে দূরে গিয়ে বসলাম।

ক্লাসে বসে আফ্রিতার কথা মনে পড়ে, ঝিমিয়ে পড়ি বলে সামনের দিকে বসা শুরু করলাম৷ স্যারদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। জীবনে প্রথমবারের মতো এক ক্লাসে পড়াও পেরে ফেললাম৷ ম্যাম খুশি হয়ে বললেন, “তুমি আসলে ভালো ছাত্র মাসুদ, শুধু একটু চেষ্টা করলেই দারুণ রেজাল্ট করতে পারবে।”

বাসায়ও পড়াশুনা শুরু করলাম। পড়ার জন্য না আসলে, আফ্রিতাকে ভুলে থাকার জন্য। প্রথম প্রথম ফেসবুক, ইউটিউবে সময় কাটাতাম, সিনেমা দেখতাম, ঠিক কাজে দিত না। বিরক্ত লাগত৷ দেখলাম পড়াশুনায় ডুবে থাকলেই ওর চিন্তা তেমন আসছে না৷ তাই যতটুকু সময় পাই বেশিরভাগ সময় পড়ি।

এদিকে পরীক্ষা চলে আসছে। পরীক্ষার জন্যই আমার মান সম্মান অনেকটা বেঁচে গেছে। নইলে সেদিনের অনুষ্ঠানের রেশ অনেকদিন থাকত। ক্লাসের ফাঁকে চায়ের আড্ডায় জমিয়ে আমার প্রেস্টিজের হালুয়া বানানো হতো।

আফ্রিতার সাথে দেখা হয় না বললেই চলে। লাইব্রেরিতে ঢুকি না৷ ওকে দু’একদিন ঢুকতে দেখে প্রয়োজন থাকলেও সেমুখো হইনি। ক্যান্টিনে যাই এমন সময় যখন ওর আসার সম্ভাবনা থাকে না। দূর থেকে চোখাচোখি হলেও ভাব ধরি যেন জীবনে ওই মুখ চোখে দেখিনি। নিজের পরিবর্তনে আমি নিজেই অবাক।

তবে ঝামেলা হয় রাতে। ঘুম আসে না। শুয়ে থাকলে আফ্রিতার হাসি হাসি বিদ্রুপ মাখা মুখটা ভাসে আর অস্থির লাগে। গান শোনা শুরু করলাম, বেশিদিন পারলাম না এ জিনিস। সুখের গান শুনলে গা জ্বলে, দুঃখের গান শুনলে বুক জ্বলে। এ কেমন যন্ত্রণা!

পরে রাত জেগে বিভিন্ন রকমের বই পড়তে শুরু করলাম। প্রেমফ্রেম জাতীয় না, সায়েন্স ফিকশন, ইতিহাস, রাজনীতি, আর সবচেয়ে বেশি থ্রিলার। পড়তে পড়তে আর কিছু মনে থাকে না৷ একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে আবার নিয়ম করে পড়া।

বেশ কায়দা কসরত করে দুঃখ ভুলে পুরো মাসটা পার করে দিলাম৷ তারপর এলো সেমিস্টার। এবার একটা জিনিস বেশ ভালো লাগল, অন্য সময়ের মতো পড়ার চাপে জেরবার অবস্থা হলো না৷ সব বুঝি, সবই পারি। প্রথমবার মনে হলো, জীবনটা শুধু দুঃখেরই নয়, কষ্ট পেলে সেটার বিপরীতে ভালোটাও উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে, শুধু খুঁজে বের করতে হয় তাকে।

কিন্তু গোলমালটা লাগল পরীক্ষার আগের দিন৷ বিকেলবেলা তিন্নিকে প্রাইভেট ব্যাচে দিয়ে ফেরার পথে ভাবলাম একটু হেঁটে যাই। পার্ক ঘুরে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ ওপাড়ে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম৷ চোখ কচলে কয়েকবার দেখে নিয়ে নিশ্চিত হলাম, যা দেখছি ঠিক দেখছি।

(চলবে)