একথোকা কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৬

0
184

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া
#পর্বঃ৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১১,

” আপনারা অনেকে বলেন না ধারা এতো রা’গী আর ব’দমে’জাজী কেনো! এই মানুষ টা হলো ধারার এতো বে’পরোয়া স্বভাবের। কারোর গুরুত্ব নেই ওর কাছে শুধু এই মানুষ টার জন্য। ”

সৃজানের উত্তরে তাহিরা,তৃপ্তি আর শ্রাবণ তিনজনেই আশ্চর্য হয়ে তাকায় সৃজানের দিকে। শ্রাবণ কাপা গলায় উত্তর দেয়,

” কে এই মহিলা? সেটা তো বলো সৃজান। ”

“উনি আমাদের মা। অবশ্য উনাকে মা বলা যায় কি না সন্দেহ। ”

সৃজানের উত্তর ফের একদফা অবাক হয় শ্রাবণ,তাহিরা,তৃপ্তি। ওরা যতদূর জানে সাজিয়ার বাবা মা’রা যাওয়ার আগে আগে ওদের মা তাকে তা’লাক দিয়ে চলে গিয়েছে। পরে আবার অন্য জায়গায় বিয়ে করেছেন উনি। কিন্তু তার জন্য ধারার উনার কারণে এত বেপ’রোয়া স্বভাবের হওয়ার কি যুক্তি, বুঝতে পারছেনা সবাই। সাজিয়া ঐদিকে তার মায়ের সাথে চি’ৎকার চেঁ’চামেচি করে হাত ধরে গেটের বাইরে দাড় করিয়ে দেয়। তখনই ধারাকে গেটের কাছে দেখতে পায় সবাই। ধারা হাত মুষ্টিমেয় করে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে বোন আর মায়ের মাঝখানে। সৃজান ধারাকে দেখে ভ’য় পেয়ে যায়। আবার না কোনো অ’ঘ’টন ঘটায় তাদের মা-কে দেখে। সে তাহসিনকে তাহিয়া কোলে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ধারাকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর জাপ্টে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে। ধারা ইতিমধ্যে রা’গে কাপছে। চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পরছে। শ্রাবণ শুধু একবার ধারার দিকে তাকিয়ে দেখলো তাকে। ধারার এই অবস্থা দেখে ভেতর থেকে দুম’ড়েমু’চড়ে যাচ্ছে শ্রাবণ। যতোই ধারা তাকে স’হ্য করতে না পারুক সে তো ভালোবাসে ধারাকে। সেখানে ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি স’হ্য করা অনেক কঠিন। তাহিরা দেবরের করুণ চাহনী লক্ষ্য করে শ্রাবণের পাশে এসে দাড়ায়। একহাতে তাহসিনকে ধরে শ্রাবণের কাধে আরেক হাত রেখে ভরসা দেয়। এরপর সেও হাঁটা ধরে ধারার ঘরের দিকে। আর এদিকে শ্রাবণ আর তৃপ্তি সাজিয়ার কাছে যায়। সাজিয়াও কাঁদছে গেইটের সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পরেছে সে। তাদের মা উনারও চোখে অঝরে অশ্রু ঝ’ড়ছে। তৃপ্তি লামকে একপাশে দাড় করিয়ে সাজিয়ার কাছে বসে জড়িয়ে ধরে সাজিয়াকে। বিয়ে হয়ে একসাথেই শ্বশুড় বাড়িতে ঢুকেছে তারা। কিন্তু এতোদিনেও তার জা-কে সে এতোটা ভে’ঙে পরতে দেখেনি। সবসময় বড় বোনের মতো তাকে ঠিক ভুল শিখিয়ে সংসার গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এভাবে কাদতে দেখেনি। সাজিয়ার এই অবস্থা দেখে শ্রাবণ সাজিয়ার মায়ের সামনে গিয়ে বলে,

” দেখুন জানিনা আপনার সাথে আপনার সন্তানদের সম্পর্ক ঠিক কেমন। তবে এটুকু বুঝেছি সম্পর্ক টা বাকি ১০টা মা সন্তানের সম্পর্কের মতো স্বাভাবিক নয়। তাই অনুরোধ করছি আপনি এই মুহুর্তে চলে যান। দেখছেন তো আপনাকে দেখে সবাই কতটা হাইপার হয়ে গিয়েছে, কাঁদছে। তবুও আপনি মুর্তির মতো এখানে দাড়িয়ে আছেন। অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। ”

শ্রাবণের কথায় সাজিয়ার মা মাথা নিচু করে আরও জোড়ে কান্না করায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সাজিয়া এই অবস্থা দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে তৃপ্তিকে মুচকি হেসে উঠে দাড়াতে বলে। তৃপ্তি উঠে দাড়াতেই সাজিয়াও উঠে দাড়ায়। নিজের কাপড় ঝেড়ে নিয়ে তার মায়ের সামনে দাড়িয়ে কাঠগলায় বলে,

” অনেক সহ্য করেছি আপনার এই ন্যাকামি, আমাদের প্রতি মিথ্যা ভালোবাসার নাটক৷ যদি সত্য ভালোবাসতেন আমার বাবাকে ম’র’ণ শয্যায় রেখে আপনি তা”লাক দিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করতেন না। তারপর আর সন্তান হলো না বলে আপনার মাতৃ সত্তা জেগে উঠে। আর আপনি বারবার এসে আমাদের ভে’ঙে গু’ড়িয়ে দিতে আসেন। ১২বছর হয়ে গেছে বাবা চলে যাওয়ার। এরমাঝে আপনার ১২বার আমাদের কাছে আসা হয়ে গিয়েছে। আপনি একবার করে আসেন আর আমাদের মানসিক শক্তি দুর্বল করে দিয়ে চলে যান। আপনি জানেনই আপনাকে আমাদের সহ্য হয়না। তবুও প্রতিবার আপনি বছরের শেষ দিকে আসেন আর চলে যান। চলে যেতে হয় আপনাকে। তবুও আপনি আসেন। তারমাঝে ধারার কতবড় ক্ষ’তি আপনি করেছেন সেটাও ভালোমতো মনে আছে আমার। হাতজোড় করি আর আসবেন না আমাদের জীবনে। এখন কি আপনার পায়ে পরবো কথাটা রাখার জন্য। এটাই তো বাকি আছে তাইনা? ”

সাজিয়ার কথা ফুরোতেই তার মা হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে গায়ের শাল চাদর টা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে আবার যেভাবে এসেছিলেন,সেই ভাবে চলে গেলেন। সাজিয়া হাফছেড়ে দাড়াতেই ধারার কথা মনে হলো তার। তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো,

” ধারা কোথায়? ”

“সৃজান ভাই ঘরে নিয়ে গিয়েছে। ”

তৃপ্তির ছোট্ট উত্তর। সাজিয়া শ্রাবণ আর তৃপ্তিকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।

১২,
বেলা গড়িয়ে এখন সময় টা বিকেল। সবাই মিলে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের বাঙালি নদীর ধারে এসে পরেছে। নদীর ধারে দাড়িয়ে গ্রামে ভ”য়ংক’র সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। নদীর ধারে আসতে হলে গ্রামের বড় ফসলী জমিগুলো পেরিয়ে আসতে হয়। মাঠে সোনার ফসল ধান, সর্ষে, ভট্টা, আখ, নানান রকমের শীতকালীন সবজি আর নদীর ধারে ১০-১২বছর বয়সী বাচ্চা ছেলেরা বড়শী ফেলে মাছ ধরছে। বড়শীতে ভাত গেঁথে ছোটো ছোটো পুটি ধরছে তারা নদী থেকে। শ্রাবণ,তাহিরা,তৃপ্তি,সৃজান,সাজিয়া এবং ধারা সবাই একসার হয়ে দাড়িয়ে এগুলোই দেখে যাচ্ছে। লাম আর তাহসিনকে সাজিয় তার বড় আম্মু আর ছোটো আম্মুর কাছে দিয়ে এসেছে। বাইরে এই ঠান্ডা বাতাসের মাঝে আনেনি বাচ্চা দুটোকে। দুজনকেই ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছে সাজিয়া আর তৃপ্তি। ওরা ঘুম থেকে উঠলে সাজিয়া তার বড় আম্মুকে বলে এসেছে যেনো একটা কল দেয়। বাচ্চা দুটো এতোটাও বড় নয় যে ঘুম থেকে উঠে মায়েদের না দেখলে কাদবেনা। হাড়কাঁপানো শীত আর এই ফসলের মাঠ জুড়ে হলুদ সবুজের সমারোহ পরিবেশ আবহাওয়াটা উপভোগ করার মতো। কিন্তু শ্রাবণ থম মে’রে দাড়িয়ে আছে। সকালের ঘটনাগুলো, সাজিয়ার তার মা-কে বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। সকালে তারা একসাথে ধারা কাছে গিয়ে দেখেছে সৃজান তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। ধারার তার মা-কে দেখে এতোটাই হাইপার হওয়ার মতো কি ব্যাপার হয়েছে অতীতে যে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে শান্ত করতে হয়! তাহিরা শ্রাবণকে এরকম নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার পাশে দাড়িয়ে বলে,

” চঞ্চল মানুষ যার গ্রাম দেখার এতো ইচ্ছে, এতো আগ্রহ সে এরকম চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না শ্রাবণ ভাইয়া। ”

” ব্যাপার তেমন কিছু নয় ভাবী। ”

” তাহলে কেমন কিছু ভাইয়া? ”

” সকালে তুমি তো চলে গিয়েছিলে ধারার কাছে। এরপর সাজিয়া ভাবী ওনাদের মা-কে কিছু কথা বলেছে। সেগুলো ঠিক মাথায় ঢুকছেনা আর মাথা থেকে যাচ্ছেও না। ”

” কি বলেছিলো বড় ভাবী? ”

তাহিরার কথার উত্তরে শ্রাবণ সাজিয়ার বলা সব কথা তাহিরাকে বলে। তাদের দিকে লক্ষ্য করে তৃপ্তি তখন বলে উঠে,

” এই তোমরা ভাবী-দেবর কি ফিসফিস করছো বলো তো? অনেকক্ষণ হলো খেয়াল করেছি তোমরা গল্প করেই যাচ্ছো করেই যাচ্ছো। আমাদের কিছুই বলছো না?”

তৃপ্তির কথায় হালকা হাসে শ্রাবণ। এরপর হাসিমুখেই উত্তর দেয়,

” তেমন কোনো কথা নয় ছোটো ভাবী। ঐ আর কি এই গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করবো, সেটাই ভাবীকে বলছিলাম। ”

সবাই শ্রাবণের কথায় হাসে। ছেলেটা অতিরিক্ত চঞ্চল, যার ফলে কোনো কথাই তার মুখে আটকায় না।নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলে। এদিকে শ্রাবণ সস্তি পায়। ধারাকে নিয়ে কথা বলছিলো সে আর তাহিরা এবং ধারাকে ঘিরেই তার চিন্তা ভাবনা এটা প্রকাশ করলে সাজিয়া বিষয়টা ভালো ভাবে নিতো না। সেজন্য সে সবার কাছে চেপে গেলো বিষয়টা। ধারা একটু বাকা চোখে তাকে দেখছে এই ব্যাপারটাও সে খেয়াল করেছে। শ্রাবণ দেখেও না দেখার মতো নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে দৃষ্টিপাত করলো।সৃজান তাদের নিজেদের জমিগুলো পরিদর্শন করে নিচ্ছে। তাদের জমি সব তাদের চাচারা আবাদ করে। পরে ভাগ করে নেওয়া হয়। কেমন আবাদ হয়েছে এটাই দেখছে সে ঘুরেফিরে। দেখা শেষে সবার কাছে এসে দাড়ালে সাজিয়া বাড়ি যাওয়ার তাড়া দেয়। তাহসিন আর লাম বাড়িতে আছে। উঠে তাদের না দেখলে যে কাঁদবে এটা বলেই সে আগে আগে যেতে থাকে। তার পিছু পিছু সবাই যাচ্ছে। সবার আগে সৃজান,এরপর সাজিয়া,তার পিছনে তৃপ্তি, তার পিছনেধারা, তার পিছনে তাহিরা এরপর শ্রাবণ। ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হয়, সেজন্য পাশাপাশি দুজন যাওয়া যাচ্ছে না। শ্রাবণ তাহিরাকে ফিসফিসিয়ে ডেকে ধারা আগে যেতে বলে। তাহিরাও সেই কথামতো ধানের ক্ষেতে নেমে চট করে ধারার সামনে চলে যায়। ধারা একটু ভ্রু কুঁচকে তাহিরাকে দেখে সে আপনমনে আগের মতো হাটতে থাকে। এরমাঝেই কানের কাছে কারোর ফিসফিসিয়ে কথা বলার শব্দ পায়। পিছ ফিরে দেখে শ্রাবণ। সে রাতের বেলা একবার পুকুরপারে আসতে বলছে সবার ঘুমানোর শেষে। ধারা কথাটা শুনে দাড়িয়ে রা’গী চাহনীতে তাকিয়ে শ্রাবণের মতো আস্তেই বলে,

” আপনার কথা কেনো শুনবো আমি? আপনাকে আমার সহ্য হয়না জানেন না?”

” ধারা প্লিজ, জাস্ট একটা কথা রাখেন। প্লিজ আসিয়েন, আমি কখন আসতে হয় মেসেজ করে দিবো। ”

” কিন্তু কি কারণে যাবো? ”

” আসলেই বুঝতে পারবেন। ”

ধারা আর কথা বাড়ালো না, এই লোককে আজ বুঝানো দরকার তার কোনো গুরুত্ব ধারার জীবনে নেই। এই ভেবে সে চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু রাতের বেলা পুকুরপাড়ে যাওয়া ঠিক হবে তো? চিন্তায় পরে গেলো ধারা।

চলবে?