এল এ ডেইস পর্ব-১০+১১

0
192

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১০
লেখনী – মাহীরা ফারহীন

“চি চি” শব্দে ডাকছে হ্যামস্টার। মাহীন বলল,
“হ্যা হ্যা এইতো চলে এসেছি। তুই মনে হচ্ছে অনেক এক্সাইটেড।”
বলে মুচকি হাসল ও। মাহীন ওর চুনোপুঁটিকে নিয়ে সাইকেলে চেপে স্কুলে যাচ্ছে। সাইকেলের ঝুড়িতে চেপেছে চুনোপুঁটি। প্রাইমারি গ্রেডে প্রাণী যত্ন নেওয়া শেখানো হয় প্রতিমাসে কয়েকদিন করে।সেজন্যেই আজকে মাহীন নিজের চুনোপুঁটিকে সাময়িক সময়ের জন্য স্কুলে দিয়ে দিবে। রাস্তা ভর্তি গাড়ির লম্বা বহর। পরিষ্কার আকাশের পটভূমিতে পেলব সাদা মেঘরাশি ধীর গতিতে বাতাসের সঙ্গে ভেসে চলেছে। রাস্তায় রোদের ঝাপটায় চকচক করছে স্কুলের হলুদ বাসগুলো। স্কুলে পৌঁছেই সাইকেলটা পার্কিং-এ রেখে আসল। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল, নায়েল ও লিও একসাথে লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মাহীন দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তার দুধারে অরিগন এস গাছের ঝাকড়া ডালপালা ভেদ করে ঝুড়ি ঝুড়ি রোদ পরে চিকচিক করছে রুপালি রাস্তা। লিও ও নায়েল থেমে গিয়েছে। লিও উল্লসিত চিত্তে বলল,

“আরেহ হ্যামস্টার। ওকে হাতে নেই মাহীন?”

মাহীন ওর ওয়েস্ট ব্যাগ থেকে চুনোপুঁটিকে বের করে হাতে নিল। লিও ওকে হাতে তুলে নিলো। নায়েল বলল,

“হাউ কিউট! কি নাম ওর?”

“চুনোপুঁটি।”

নায়েল ভ্রু কুঁচকে চাইল। বলল,”কি বললা বুঝিনি। আবার বলো।”

মাহীন এবার ধীরে ধীরে বলল,”চুঁ..নো..পু…টি”। নায়েল এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

লিও সহাস্যে বলল,”চিঁনপুটি সিম্পল। এটা বুঝতে এত সময় লাগতেসে?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”না, চুঁনোপুটি।”

নায়েল বলল,”চিয়ানপটি?”

মাহীন বলল, “আহা যেমন তোমাদের সুবিধা হয় তেমনই ডাকো।”
‘এমনিতেই এমন অদ্ভুত নাম তোমরা সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবে না। শেষে নামটাকে আরোও গোঁজামিল দিয়ে জটিল বানিয়ে ফেলার চেয়ে এটাই ভালো।’ বিড়বিড় করে বলল মাহীন।
লিওর হাত থেকে নায়েল চুনোপুঁটিকে নিতে যাচ্ছে তখন হঠাৎ সে লাফ দিয়ে হাত থেকে নেমে গেল। এবং গেটের দিকে ছুটে গেল। মাহীন সঙ্গে সঙ্গে হ্যামস্টারটির পিছু নিলো। গেটের বাইরে বের হতে চুনোপুঁটিকে আরোও ছয় সাত গজ এগিয়ে যেতে হবে। সেই সময় গেট দিয়ে একটা সাইকেল প্রবেশ করছিল। মাহীন উচ্চস্বরে বলল,

“এই থামো!”

কিন্তু সাইকেলের মালিক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইল। তবে সাইকেল থামালো না। নায়েলও উদ্বিগ্ন গলায় উচ্চস্বরে বলল,

“এই সাইকেল থামাও নাহলে চিয়ানপোটী তোমার সাইকেলের নিচে চাপা পরবে।”

হ্যামস্টারকে মাহীন কিছুতেই হাতের নাগালে পাচ্ছে না। উল্টাপাল্টা ছুটে যাচ্ছে। এবং সেটা হঠাৎ করে ঠিক সাইকেলের চাকার নিচে পরল। সজোড়ে ব্রেক কোসল মেয়েটা। হ্যামস্টার এতক্ষণে আর জীবিত নেই। মাহীন স্তব্ধ হয়ে মেয়েটার সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলে বসে থাকা মেয়েটা হতবিহ্বল হয়ে গেছে। আশেপাশে যারা যাওয়া আসা করছিল তারাও থেমে গিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে এদিকে চেয়ে আছে। মাহীনের কষ্টে চোখের কোণায় উষ্ণ নোনা জল জমা হলো। সুন্দর রোদৌজ্জ্বল পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিষাদে ছেয়ে গেল। সাইকেলার মেয়েটার জন্য রাগে গা রি রি করে উঠল। ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো,

“বাহ এত বার করে বোললাম সাইকেলটা থামাও, সাইকেলটা থামাও কিন্তু তুমি তো কানে তালা দিয়ে বসে আছো। শুনবা কি করে!”

নায়েল ও লিও দুইজনই ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা সাইকেল থেকে নামল। লাল চুল, গাড়ো বাদামি চোখ। ত্রিভুজ আকৃতির সুন্দর মুখখানা। ফর্সা গড়ন এবং গালে সামান্য হালকা ফ্রেকল রয়েছে। তার মিষ্টি সৌন্দর্যটা ধারাল। মেয়েটা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নরম কন্ঠে বলল,

“আসলে আমি তোমার হ্যামস্টারকে চাপা দিতে চাইনি। আমি তো ওকে দেখতেই পাইনি। যখন শুনলাম হ্যামস্টারের কথা ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গিয়েছে।”

মাহীন কঠিন স্বরে বলল, “চুপ করো। তোমার ফালতু কথা আমি শুনতে চাই না। আর এসব বাহানা দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা এতবার সাইকেল থামানোর কথা বলার পরও না থামানোর কি কারণ থাকতে পারে?”

লিও বলল,”দেখো মাহীন একটু শান্ত হও। অবশ্যই ওর দোষ আছে কিন্তু তাই বলে ও এটা ইচ্ছে করে করেনি।”

নায়েল মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলল,”দেখো হয়তো তুমি হঠাৎ করে বুঝতে পারোনি কি হয়েছে। তবে আমরা বলা মাত্রই তোমার সাইকেলটা থামানো উচিৎ ছিলো।”

মেয়েটা সামনে এগিয়ে এসে ক্লেশপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“ম্যাহিন আমাকে ক্ষমা করে দাও। যেটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে সেটা পূরণ তো করতে পারব না। তোমার হ্যামস্টারকে ফিরিয়ে তো আনতে পারব না। কিন্তু তুমি যা বলবা আমি তাই করব।”

মাহীন মেয়েটার প্রতিটা কথা শুনে যেন আরোও রেগে উঠছে। রাগে চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গিয়েছে। নিতান্তই এক ছোট প্রাণী হলেও তার প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা ছিলো মাহীনের। বাবা বিদেশে চলে আসার পর থেকে এই ছোট্ট নরম নিষ্পাপ প্রাণীটিই মাহীনের সর্বক্ষণের সাথী ছিল। বুকে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপে কঠিন স্বরে বলল, ”

আমার নাম তোমার মুখে নিবা না। তাও আবার ভুল উচ্চারণ করছো। আর আমার জন্য কিছু করতে চাইলে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। তাহলেই আমি সবচাইতে বেশি খুশি হবো।”

বলেই উল্টো ঘুরে দ্রুত গতিতে গটগট করে স্কুল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তখন সাইলোহ ও জেনেট স্কুলে প্রবেশ করছিলো। এখানে কয়েকজন কে জট পাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসল। জেনেট জিজ্ঞেস করল,

“এই এখানে কি ঘটছে?”

লিও ম্লান স্বরে বলল,”মাহীনের হ্যামস্টার মারা গেছে।”

সাইলোহ চোখ ছোট করে বলল,”হ্যামস্টার? মানে যেটাকে স্কুলে দেওয়ার জন্য আজ আনার কথা ছিলো?”

নায়েল সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। জেনেট উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কিন্তু কিভাবে?”

লিও লাল চুলো মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল,”এই মেয়েটার সুবাদে। তোমরা এখনো ওর সাইকেলের নিচে চুনপুঁটির লাশ দেখতে পারো।”

এটা বলা মাত্র ওরা সাইকেলের দিকে চাইল। এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সাইলোহ মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তুমি, তোমার জন্য এসব কান্ড ঘটেছে। কি নাম তোমার?”

মেয়েটা মিনমিন করে বলল,”ক্যারোল।”

“তুমি কি এখানে নতুন?” জিজ্ঞেস করল সাইলোহ।

“হ্যা আমি জুনিয়র গ্রেডে। এবং এটাই আমার স্কুলের প্রথম দিন।”

জেনেট বলল,”ওয়াও এর চাইতে খারাপ ভাবে আর কোনো কিছুর শুরু কিভাবে হতে পারে।”

ক্যারোল অসহায় ভঙ্গিতে আকুতি ভরা গলায় বলল,
“প্লিজ দেখো আমি জানি আমার দোষ আছে কিন্তু আমার তো ম্যাহিনের সাথে কোনে শত্রুতা নেই। এমনকি এটা আমার স্কুলের প্রথম দিন। কাউকে চিনিও না। দয়া করে তোমরা তোমার বান্ধবীকে বোঝাও, ও যেন আমাকে মাফ করে দেয়।”

স্কুলে প্রবেশ করে চত্ত্বর ধরে হাঁটতে হাঁটতে রায়েদ এগিয়ে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে দেখল লম্বা রাস্তার একপাশে একটা সাইকেল পরে আছে। সেই সাইকেলকে ঘিরে পাঁচজন ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়েদ যখন হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু কাছাকাছি আসল তখন শুনতে পেল লিও বলছে,

“আহ আমরা জানি না। তবে নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে কানছে ও।”

সাইলোহ বলল,”আমাদের ওকে খোঁজা দরকার।”

ক্যারোল বলল,”আমি কি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?”

জেনেট চিকন কন্ঠে বলল,”না বোন, মাহীনের চ্যনপটি কে খুন করেছো এটাই কম কিছু না। তুমি এখন ওর থেকে দূরে থাকো। এটাই তোমার জীবনের জন্য ভালো।”

নায়েল বলল,”ওফ মাহীন ওর চিয়ানপটিকে খুব ভালোবসতো। ক্যারোলের জন্য সে মারা গিয়েছে সেজন্য চরম রাগ তো হবেই। এখন কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে।”

সাইলোহ বলল,”ও যেরকম মেয়ে ও আমাদের সামনে কাঁদবে না। কোথাও বসে কাঁদছে বোধহয়। চলো ওকে খুঁজি।”

লিও বলল, “এক মিনিট চনপোটিকে উঠাতে হবে না?”

“হ্যা চলো আমরা ওকে তুলে এনে চত্ত্বরেই কোথাও কবর দেই।” বলল নায়েল।

বাকিরা ওর কথায় সায় জানাল। ক্যারোল তাড়াহুড়ো করে নিজের সাইকেলটা তুলে ওদের পিছু পিছু ছুটে গেল। ওরা চলে যেতেই রায়েদ আবিষ্কার করল যে, ও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এবং ওদের কথা শুনছিল এতক্ষণ যদিও এটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। কোথায় কী হচ্ছে, কে কে কথা বলছে সেদিকে কখনোই দৃষ্টিপাত করে না ও। আবার হাঁটা ধরল। এখনো ক্লাস আরম্ভ হতে দেড়ি আছে। কাজেই রায়েদ হাঁটতে হাঁটতে স্কুল বিল্ডিংয়কে পাশ কাটিয়ে লাইব্রেরির দিকে চললো। মাহীনের হ্যামস্টার মারা যাওয়ার ব্যাপারটা ওর মনে সাময়িক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সেসব নিয়ে আর ভাবতে চাইল না। তবে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো। কড়া রোদের ঠেলায় উপরে চোখ মেলে তাকানো দায়। স্যকামোর গাছটার বিস্তর ডালপালার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কোনোক্রমে চোখ পিট পিট করে চাইল ওপরের দিকে। দেখলো চারতলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে কনক্রিটের চওড়া প্রসস্থ রেলিঙের ওপর কেউ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সেই ক্ষুদ্র মানুষটি সহ গোটা বিল্ডিংটিকেই সূর্যের আলোর বিপরীত দিক থেকে আগাগোড়া কালো লাগছে। রায়েদ প্রথমে শুধু একটা অবয়ব দেখতে পেল। তাতেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই মাথা চাপড়ালো। তারপর দ্রুত গতিতে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠলে লাগল। অথবা দৌড়ে যাচ্ছেও বলা যায়। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। এক রত্তি অজানা আশঙ্কার অবকাশ হলো মনে। চিন্তা এবং অস্থিরতা কপালে গভীর রেখার সঞ্চার করেছে। ভাবছে, ‘এই মাহীন মেয়েটা পাগল আছে কিন্তু তাই বলে এতটা। যতই পাগলামি করুক দেখে যতটা শক্ত মনে হয়েছিলো, শুধু হ্যামস্টার মারা যাওয়াতেই এই অবস্থা! তাই বলে প্রেমিকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও বেশির ভাগ মানুষ সুইসাইড করতে যায় না। আর ওকে দেখো।’ ভাবতে ভাবতেই একদম উপরের তলায় এসে পৌঁছল। ছাদের দরজা হা করে খোলা। রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করলো। একদম কড়া রোদে উত্তপ্ত ছাদ এর মধ্যে মাহীন কিভাবে বসে আছে সেটাই ও ঠাহর করতে পারল না। রোদের তোরে চোখ পিট পিট করে দেখল বাম দিকে ওর দিক থেকে উল্টো ঘুরে বাইরে পা ঝুলিয়ে রেলিঙের ওপর বসে আছে মাহীন। রায়েদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে থেকে ভাবল, ‘ওফ ওকে এখন কি বলে কি করব? মেয়েটাকে দেখে মনে হয় যেন কেউ ভেঙ্গে পরলে ও সামলাতে পারবে। সেখানে ওর নিজেরই করুন দশা। ওকে দেখে যা মনে হয় আসলেও ও তেমন কিনা এ ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে এখন। তবে আমি এখন ওকে কি বলবো? কাউকে কমফোর্ট করা তো দূরের কথা, কারোও সাথে ভালো ভাবে কথাও বলি না আমি। কত বছর আগে কবে কাকে সান্তনা দিয়েছিলাম তা তো মনেও নেই। সান্তনা কিভাবে দিবো সেটাও ভাবতে হচ্ছে এমনই মানুষ আমি। আর আমিই এখানে এসে হাজির হয়েছি মাহীন তোমার ভাগ্য এতটাই খারাপ।’ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। তারপর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে মাহীন থেকে দুই হাত দূরে রেলিঙের ওপর উঠে বসল। তারাহুরো করে সেখানে গিয়ে পৌছায়নি, ফলে মাহীন চমকে উঠতে পারে বলে। তারপর নিচে পরতে আর কতক্ষণ দেরি। মাহীন একবার আঁড়চোখে এদিকে চাইল। চোখে মুখে চমক খেলে গেল। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ওর চোখ মুখ কিছুটা ফুলে আছে এবং নাকে লালচে আভা। তবে ও কাঁদছে না। হঠাৎ রায়েদকে এখানে দেখে আবারও সেই অস্বস্তি বোধটা ধরে বসল। রায়েদকে দেখলেই হৃদপিণ্ডে স্বাভাবিক ভাবে চলতে যেন মহা সমস্যা হয়। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল মাহীন। রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বলল,
“তোমার হ্যামস্টার মারা গিয়েছে জানি। কিন্তু তুমি এই চারতলা বিল্ডিংয়ের ছাঁদে রেলিঙের ওপর কি করছ? সুইসাইড করার এত শখ?”

শান্ত কন্ঠেই কথাটা বলতে চাইলেও শোনালো তা টিটকারির মতো। মাহীন ভ্রু কুঁচকে চাইল ওর দিকে। বলল,
“মনে আছে, সেই যে আমি বলেছিলাম তোমার বোধহয় ওভার থিংক করার বদঅভ্যেস আছে। সেটা আসলেই আছে। তোমাকে কে বলেছে আমি এখানে সুইসাইড করতে এসেছি?”

রায়েদ তিক্ততা সঙ্গে বলল, “সারা দুনিয়ায় এত জায়গার অভাব পরেছিলো যে তোমাকে এই রেলিঙের ওপর উঠে বসতে হলো। এখান থেকে তো তুমি পরেও যেতে পারো।”

“এখন আমরা দুজনেই পরে যেতে পারি।” মুখ বাঁকা করে উত্তর দিল মাহীন।

“আর অন্তত তোমার এতটুকু আক্কেল জ্ঞান থাকা উচিৎ যে এই কড়া রোদের নিচে বসে থাকলে সান বার্ন হবে। এর মধ্যে কিভাবে বসে থাকতে পারো তুমি?”

“আমার কিছুই হবে না, আমি সানস্ক্রিন লাগিয়ে আছি। কিন্তু সান বার্ন তোমার হবে।”

রায়েদ এটা শোনা মাত্র ভাবল, আসলেই তো আমি সানস্ক্রিন লাগিয়ে নেই। সান বার্ন হলে আমারই হবে।”

মাহীন অন্য দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে যেন মুখ থেকে অন্তত কয়েকটা শান্তনার বাক্য বের হয়। হৃদয়টাও কেমন সবসময় দ্রিমদ্রিম শব্দ করেই চলেছে। ওহ না সবসময় নয়, যখন এই মেয়েটা আশেপাশে থাকে শুধু তখন। গুছানো কথাগুলোও অগোছালো হয়ে যায়। এমনটা তো কখনো হতো না। এত অগোছালো তো রায়েদ ছিলো না। লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

“ওই মেয়েটা ক্যারোল মানে যার সাইকেলের নিচে চাপা পরেছে তোমার হ্যামস্টার সে এই স্কুলে নতুন। এমনকি আজই তার প্রথম দিন।”

মাহীন অবাক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। রায়েদ বলে গেল, “এবং না ও তোমাকে চিনতো না তোমার সাথে কোনো শত্রুতা ছিলো। হয়তো ওর দোষ ছিলো কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছুই করেনি।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “দয়া করে ওই মেয়েটার গুনগান গেও না।”

“ঠিক আছে। কিন্তু এটা তো মানছো যে তোমার ছোট চ্যানপোটি…মাহীন মুখ গোমড়া করে থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ হেসে ফেললো।
তারপর হাসি হাসি মুখেই বলল,”তুমি নামটা না উচ্চারণ করলেই ভালো।”

রায়েদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভাবল,’অন্তত ওর মুখে হাসি তো ফুটল।’ হঠাৎ শুধু ওকে হাসতে দেখেই ভালো লাগার এক চিলতে পরশ ছুঁয়ে গেল ওকে। বুকের ওপর থেকে এক অস্থিরতার ভার নেমে গেল এক নিমিষেই।
মুখে জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা এটার মানে কী?”

মাহীন বলল,”কোনটার?”

“এইযে তোমার হ্যামস্টারের নামটার।”

মাহীনের ভ্রু দুটো সূচালো গলো। দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, “চুনোপুঁটি মানে…উম..মানে ওই যে ছোট খাটো জিনিস পত্র”।

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,”হুম বুঝেছি।” তারপর মনে মনে ভাবল, ও সম্ভবত নিজেই জানে না এই অদ্ভুত নামটার মানে কি।”

মাহীন এতক্ষণে নিজে থেকে বলল,”আর তুমি এখানে কি করছ? আমাকে খুঁজে পেলে কি করে?”

“তোমাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজে বের করার তো মতলব ছিলো না আমার। তবে তোমার কপাল খারাপ যে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করার সময় তোমাকে আমারই চোখে পরেছে।”

মাহীনের কেন জানি কথাটা শুনতে ভালো লাগল। মিষ্টি মিষ্টি অনুভূতিরা মনের আঙ্গিনায় এসে জড়ো হলো। ও সুইসাইড করবে ভেবে ছুটে এসেছে ও। হাসিহাসি মুখে বলল,
“আর তুমি ভেবেছ আমি সুইসাইড করতে এসেছি এবং তাই ছুটে এসেছো।”

রায়েদ কিছু বললো না। হাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, “ক্লাস তো শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। চলো যাই। আর তোমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে কাহিল হয়ে গিয়েছে।”

মাহীন রেলিঙ থেকে নামতে নামতে বলল, “তাই ওরা আমাকে খুঁজছে?” বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল,”আর আসলেই এখানে বেশিক্ষণ বসা তোমার জন্য ভালো হবে না। সান বার্ন হলে তো আবার আমার দোষ দিবা।”
রায়েদের বুক ফেড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১১
লেখনী – মাহীরা ফারহীন

বেলা দশটা বাজছে। শিক্ষার্থীরা যার যার পথে এগিয়ে চলেছে। করিডোর ও ক্যাফেটেরিয়া হইচই ও চিৎকার চেচামেচিতে গমগম করছে। র‌্যবিট লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে চলেছে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। আজ ওর সঙ্গে ওর সবসময়ের সঙ্গী লেক্সি নেই। কাজেই ও একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে হেলেদুলে হাঁটছিল। ক্যাফেটেরিয়ার কাছাকাছি আসতেই দেখলো লিম জু ভেতরে প্রবেশ করছে। ‌র‌্যবিট থমকে দাঁড়ালো। তারপর ভাবল, “আরেহ দুর্ঘটনাজনিত মেয়ে। তাহলে এখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। দেখি কি অবস্থা ওর”। ভেবেই সেদিকে এগিয়ে গেল। লিমের কাছে পৌঁছে ওর সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। লিম র‌্যবিটকে দেখা মাত্র বিরক্ততে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। র‌্যবিট বলল,”কি খবর লিম? আজকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে?”

লিম কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,”হ্যা ঘটেছে। মাহীনের হ্যামস্টার মারা গেছে।”

র‌্যবিট বেদনার্ত কন্ঠে বলল,”আহা এটা শুনেছি। তবে আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করছি।”

লিম ঝাঁঝের সঙ্গে বলল,”তোমার কি মনে হয় আমার সাথে শুধু দুর্ঘটনাই ঘটে!”

“উম আমি তো তাই দেখে এসেছি।”

“ওহ হ্যা আসলেই ঘটে এবং সেগুলোর কারণ তুমি। তোমার জন্য আমি সবসময় ঝামেলায় পরি।”

র‌্যবিট ইতস্তত করে বলল,”ওহ না মানে ওই তো সেই দিনই শুধু আমার জন্য আঘাত পেয়েছিলা। বাই দ্যা ওয়ে তোমার পায়ের ক্ষতটা ঠিক হয়েছে?”

“কিভাবে ঠিক হবে? তুমি টাকা দিয়েছিলা চিকিৎসা করার জন্য?”

বলে লিম জু কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ক্যাফেটেরিয়ার একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে এক দল ছাত্রছাত্রী মিউজিকাল করছে। চিৎকার করে গান গাইতে ব্যস্ত তারা। এখানে উপস্থিত অনেকেই তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাইছে বা তালি দিচ্ছে। র‌্যবিট ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “আহ আমার দেওয়ার কথা ছিলো নাকি। কিন্তু আমার যতদূর মনে পরে তখনই মাহীন তোমার চিকিৎসা করেছিল।”

লিম জু বিরক্ত কন্ঠে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে। আমার ক্ষত একদম ঠিক হয়ে গিয়েছে। এবং দয়া করে আমার জান ছাড় এখন।”

তখনই নায়েল কলিমোর সেখানে এসে দাঁড়াল। তারপর ওদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
“কি সমস্যা তোমরা কি ঝগড়া করছো?” ‌

র‌্যবিট ভাবলেশহীন মুখে বললো, “আহ না আমি কারোও সাথে ঝগড়া করি না।”

লিম বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, “ওফ আমাকে জ্বালিয়ে মারল ও। দয়া করে এখন আমার পিছু পিছু এসো না।”

বলে অন্য দিকে চলে গেল। নায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”তুমি আর শুধরালা না।” বলে নায়েল ক্যাফেটেরিয়ানের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

র‌্যবিট বলল,”ওহ হ্যা। একটা কথা তো জিজ্ঞেস করাই হলো না। এই মাহীন মনিটর কবে থেকে হলো?”

নায়েলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। জিজ্ঞেস করল,”মানে কি বলছো? ও মনিটর হতে যাবে কেন?”

“মনিটর না হলে গতকাল আমার বাসায় অভিযোগ পত্র নিয়ে এসেছিলো কেন?”

নায়েল অবাক হয়ে বলল,”একমিনিট ও তোমার বাসায় গিয়েছিল! কই একবারও তো বলেনি কার বাসায় গিয়েছিল। তাহলে তোমাকে চিনলো না কেন?”

“আমি তো বাসায় ছিলাম না। এবং সম্ভবত মাহীন এখনো জানে না আমার নাম রাবিত। র‌্যবিট বলেই আমাকে চিনে।”

নায়েল সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা তুমি অকামটা কি করেছো যে ভাইস প্রিন্সিপাল অভিযোগ পত্র পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন?”

র‌্যবিট অন্য দিকে চেয়ে ইতস্তত করে বলল,
“না..মানে..আসলে তেমন কিছুই না। আমাদের চলার পথে কতশত ঝুটঝামেলা আসে, সেগুলোর সাথেই মানিয়ে নিয়ে চলতে গিয়ে আমরাও ঝামেলায় জড়িয়ে যাই, বোঝই তো।” শেষের কথাগুলো বিজ্ঞের মত বলল ও।

নায়েল ঠোঁট উল্টে, ভ্রু উঁচু করে বলল, “ওরে হ্যা বুঝি তো চলার পথে ঝামেলা আসে নাকি তুমি বাঁধাও। সবই বুঝি।”

র‌্যবিট বিচলিত ভাবে হাসল। নায়েল একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে কাউন্টারের কাছ থেকে সরে আসল। সাথে সাথে র‌্যবিটও চললো। র‌্যবিট বলল,

“আচ্ছা মাহীনের হ্যামস্টারকে আসলে খুন করলো টা কে? সবাই বলছে একটা নতুন মেয়ে, আজই প্রথম স্কুলে এসে এই কান্ড ঘটিয়েছে।”

নায়েল একটা গোল টেবিলের সামনে থেমে গেলো। টেবিলে জেনেট ও লিও বসে আছে। তার সামনের টেবিলে ক্যারোল বসে আছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল,

“ওই যে মেয়েটার লাল চুল। ওই মেয়েটা।”

র‌্যবিট ওর ইঙ্গিত অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। তারপর অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

“ওউ এই মেয়েটা সেই দুর্ভাগা। আহা শি ইজ হেলা বিউটিফুল! খুব অন্যায় হয়েছে ওর সাথে।”

নায়েল কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”থাপ্পড় না খেতে চাইলে বাজে কথা বলো না।”

তখনই মাহীন ও সাইলোহ ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করল। নায়েল লিওর পাশে নিজের চেয়ারে বসল। মাহীন ও সাইলোও এসে সামনে দাঁড়াল। র‌্যবিট জিজ্ঞেস করল,”বাই দ্যা ওয়ে ওর নাম কি?”

জেনেট জিজ্ঞেস করল, “কার?”

র‌্যবিট বলল, “আরেহ এই মেয়েটার, হ্যামস্টার খুনি।” এ কথা শোনা মাত্র মাহীন নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বিরক্তিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।”

লিও বলল, “ক্যারোল। পুরো নাম জানি না।”

র‌্যবিট ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,”আরেহ! ক্যারোট।”

সাইলোহ ঠোঁট বাঁকা করে বলল, “বয়রা না কালা? ও বলসে ক্যারোল আর তুমি শুনো কিনা ক্যারোট। আসলেই মনে হয় র‌্যবিট হয়ে গেসো। সব জায়গায় ক্যারোট দেখতে পাও।”

র‌্যবিট গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “হুহ আমি বয়রাও না। কালাও না। আমি ইচ্ছা করেই ওকে নাম দিসি ক্যারোট। আমার নাম রাবিত যদি র‌্যবিট বানাতে পারো। তাহলে ক্যারোল কেনো ক্যারোট হতে পারবে না? আর এমনিতেও আমাদের টার্টলও আছে।”

নায়েল বলল, “আরেহ আসলেই তো ক্যারোল নামের সাথে ক্যারোট নামটা যায়। এবং দেখো ক্যারোলের চুলের রঙও গাজরের মত গাঢ় কমলা।”

সাইলোহ বলল, “এনিওয়েজ এই একটা জিনিসে অমত করলাম না, যাও।”

মাহীম হঠাৎ বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠে বলল, “এই র‌্যবিট! এক মিনিট তুমি একটু আগে কি বললা, তোমার নাম রাবিত?”

র‌্যবিট সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। এবং বলল, “হ্যা হ্যা ওইটাই আমিও বলতে চাচ্ছিলাম। হয়তো জানো না কিন্তু গতকাল তুমি আমারই বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলা। এবং দুঃখজনক ভাবে আমার কতগুলো স্টাফড গ্রেপ লিফসে ভাগ বসিয়েছ।”

সাইলোহ টিটকারি মেরে বলল,”ইশ তোমাকে হার কিপটা বললেও হার কিপটেরা লজ্জা পেয়ে যাবে।”

র‌্যবিটের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”ধ্যাৎ আমি মজা করছিলাম।”

মাহীন সেসব তোয়াক্কা না করে বলল,”তো তুমি টার্কিশ?”

“এভেত”। গর্বের সঙ্গে বলল র‌্যবিট।

লিও ভ্রু কুঁচকে বলল,” কি বললো ও এখনি?”

মাহীন বলল, “এভেত মানে ‘হ্যা’। তাই না র‌্যবিট?”

র‌্যবিট হেসে মাথা ঝাকাল। তারপর পাশের টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সাইলোর পাশে বসে পরলো। সাইলোহ লাফ দিয়ে উঠে বলল, “এই! তুমি আমাদের সাথে বসছো কেন?”

র‌্যবিট ভাবলেশহীন মুখে বললো, “এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বললাম, কি হয়েছে তোমার? পক্স হয়েছে না হাম হয়েছে?”

মাহীন বলল, “থাক না বসুক। সমস্যা কি?”

লিও বলল, “হ্যা বসুক।”

সাইলোহ কিছুক্ষণ দোনোমোনো করছিলো। তবে কিছুক্ষণ পর আর কিছু বললো না।
.
.
.
পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবু ডুবু করছে। আকাশের ক্যানভাসে তুলি দিয়ে আকা লাল, কমলা গোলাপি ও হালকা বেগুনি রঙের গাঢ় আঁচড়। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘগুলো সূর্যের মরা আলোয় সোনার তরলের মাখানো বলে মনে হয়। তবে প্রকৃতির এ স্বর্গীয় দৃশ্য মাহীনকে অতটা টানছে না। মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক তীব্র কষ্ট জমা হয়ে আছে। এ কষ্ট সবকিছুকে বিষাদ করে দিয়েছে। নিজের কামরায় জানালার উইন্ডোশীলে বসে আছে। আকাশের দিকে চেয়ে নিজের ভাবনায়ই ডুবে আছে। ভাবছে, কেন? কেন আমার সাথেই এমন হয়? আমি সবসময় সকলের ভালো চাই। অচেনা মানুষকেও চিন্তাভাবনা না করেও সাহায্য করতে চলে যাই। আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয় তখন যখন আমি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি। অথচ যেসব জিনিস আমার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে সেগুলোই আমার থেকে দূরে চলে যায়। হয়তো চুনোপুঁটি আসলেই একটা চুনোপুঁটি প্রাণীই ছিলো বটে। কিন্তু আমার কাছে ও আরোও অনেক বেশি কিছু ছিলো। পাঁচ বছর ধরে আমার সাথে আছে। পাঁচ বছর পূর্বে বাবার ক্যালিফোর্নিয়া চলে আসার পূর্বে শেষ বার আমাকে দেওয়া উপহার এই চুনোপুঁটি ছিলো। আমার বয়স তখন এগারো ছিলো। এই এতদিন কত স্কুল পাল্টেছিলাম তখন বান্ধবীকে হারিয়েছি কিন্তু চুনোপুঁটি সবসময় আমার সাথেই ছিলো।
.
.
.
.
তখনই টেইলর সুইফট এর “সেফ এন্ড সাউন্ড” গানটা বাজতে শুরু করলো। মাহীন চমকে উঠে বিছানায় পরে থাকা নিজের সেল ফোনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। যেতে ইচ্ছে করছে না তবুও উঠে গিয়ে সেল ফোনটা হাতে নিলো। ডিস্টার্বার কল দিচ্ছে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু কল রিসিভ করলো না। ফোনটা হাতে নিয়েই এসে উইন্ডোশীলে বসল। বাজতে বাজতে ফোনটা কেটে যাওয়ার পর আবার বাজতে লাগল। এবার মাহীন ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠ শোনা গেল, “হ্যালো মাহীন! কী খবর?”

মাহীন বিষন্ন কন্ঠে বলল, “ভালো না।”

“কেন? কি হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। বাই দ্যা ওয়ে তুমি এই সময় আমাকে ফোন দিচ্ছো কেন? এখন তো ওখানে মাত্র ভোর বেলা।”

“হ্যা জানি। সূর্যদয় দেখতে দেখতে তোমার সাথে কথা বলছি। কিন্তু বলো না কি হয়েছে?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”চুনোপুঁটি মারা গেছে”।

ওপাশ থেকে অবাক স্বরে বলল, “কি! চুনোপুঁটি মানে তোমার হ্যামস্টার। ইয়া আল্লাহ কিভাবে?”

“অনেক লম্বা কাহিনী।”

“আচ্ছা ঠিক আছে বুঝেছি। বলা লাগবে না। এই জন্যেই তোমার মন মেজাজা খারাপ।” মাহীন কিছু বলল না। ওপাশ থেকে আবার বলল,

“আহ মাহীন এখন এসব নিয়ে মন খারাপ করে থেকো না। এমনিতেও চুনোপুঁটি তোমার কাছে পাঁচ বছর ধরে ছিলো। এই হ্যামস্টাররা আর কত দিনই বা বাঁচে? এমনিতেও ও তোমার কাছে সারাজীবন থাকত না। আর প্রতিটা জিনিস যেগুলো তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যায় তার বদলে আরোও ভালো কিছু তোমার কাছে কোনো এক মাধ্যমে চলে আসে। আর প্রতিটা জিনিসেরই দুই রকম কোইন্সিকোয়েন্স দাঁড়ায়। ভালো ও খারাপ। এবং তোমাকে ভালোটাই নিতে হবে।”

মাহীন ম্লান কন্ঠে বলল, “আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার লাইফ লেসনগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকেই দিচ্ছো। এখন এসব দার্শনিকের মত কথা বলে আমার মাথা খারাপ করো না।” একটু থেমে আবার বলল, “আচ্ছা তুমি কেমন আছো?”

“আরেহ আমি ভালো ছিলামই কিন্তু এখন তুমি জিজ্ঞেস করলা দেখে আরোও ভালো হয়ে গেছি। আচ্ছা তোমার মনে হয় একটু একা একা থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি আর বেশি ডিস্টার্ব করলাম না।”

মাহীন সায় জানিয়ে কল কেটে দিলো। তারপর ভাবল, বাহ ডিস্টার্বারেরও আবার এই বোধ আছে যে ও আমাকে ডিস্টার্ব করছে। অবশ্য সবসময় যদি এই বোধ কাজ করতো তাহলে ওর নাম ডিস্টার্বার দিয়ে সেভ করতাম না।’

তার প্রায় আধা ঘণ্টা পর মি. মোর্শেদ বাড়ি ফিরলেন। সারাদিন কাজের পর বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি যখন ফ্রেশ হতে ভেতরে গেলেন তখন নাইম মাহীনকে ডাকতে আসল। দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,

“হীন হীন বাবা আসছে। নিচে আয়। আর তাড়াতাড়ি বল আমার চুনোপুঁটিকে কোথায় গুম করেছিস?”

মাহীন ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “এক প্রশ্ন বারবার করবি না। বলসি না আমি প্রথমে বাবাকে বলবো। চল নিচে।”

ওরা দুজন একসাথে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। মিসেস নাসরিন রাতের খাবার টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছেন। মাহীনকে আসতে দেখে বললেন,

“এই যে এই মেয়েটা এই সময় কামরা থেকে বের হচ্ছে। কোনো কিছুতে আমাকে একটু সাহায্য করে না। তখন থেকে সবকিছু একাই করতে হচ্ছে আমাকে।”

মাহীন পানসে কন্ঠে বলল, “প্রতিদিনই তো করি।”

মিসেস নাসরিন বললেন, “আর আজকের কি?”

তখনই মি. মোর্শেদ ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই মাহীনের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কি ব্যাপার মা? তোর মুখটা এমন বিষন্নতায় ভরে আছে যে।”

মিসেস নাসরিন বললেন, “হ্যা ওকে জিজ্ঞেস করো কি হয়েছে। স্কুল থেকে আসার পর থেকে গুম মেরে বসে আছে।”

মি. মোর্শেদ নিজের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বললেন,
“তাই? কি হয়েছে রে তোর?

নাইম বলল, “হ্যা বল না। আমার হ্যামস্টারকে হারায় ফেলছিস নাকি?” বলেই মুখে এক লোকমা ভাত পুরলো।

মাহীন বলল,”এহ! চুনোপুঁটি আমার হ্যামস্টার ছিলো তোর না।”

মিসেস নাসরিন বললেন, “ছিলো মানে? কি হইসে চুনোপুঁটির?”

মাহীন ক্লেশপূর্ণ কন্ঠে বলল, “ও সাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেসে।” নাইম ও মি.মোর্শেদ খাওয়া থামিয়ে দিলেন। নাইম, মিসেস নাসরিন ও মি. মোর্শেদের মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে গেল।নাইম উৎকন্ঠিত গলায় বলল, “তুই আমার চুনোপুঁটিকে সাইকেলে চাপা দিয়ে খুন করলি!”

মাহীন বলল, “আমি কখন বললাম আমার সাইকেলে চাপা পরেছে। ওটা আরেকটা শিক্ষার্থীর সাইকেল ছিল।”

মিসেস নাসরিন, “আহারে। এইজন্যে আমি মানা করেছিলাম চুনোপুঁটিকে নিয়ে স্কুলে যাইস না। কিন্তু কে শুনে কার কথা।”

মি.মোর্শেদ নরম কন্ঠে বললেন, “কিছু হবে না। ওটা তো আমি তোকে এনে দিয়েছিলাম। আমিই না হয় আরেকটা হ্যামস্টার এনে দিবো।”

মাহীন বলল, “না থাক। অন্য হ্যামস্টার তো আর চুনোপুঁটি হবে না। চুনোপুঁটি আমার সব কথা বুঝতো এবং আমার সাথে কথাও বলতো।”

নাইম বলল, “তুই এত বেখেয়াল কেন? কি এমন করছিলি যে চুনোপুঁটি কারোও সাইকেলের নিচে পরল?”

মাহীন বলল, “ও আমার বন্ধুর হাতে ছিলো। তখন হঠাৎ করে লাফ দিয়ে ছুটে যায় এবং ওই সময় একটা মেয়ে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করছিলো সাইকেল নিয়ে। তখন ওর সাইকেলের তলায় পরে।”

নাইম মুখ কুঁচকে বলল, “ইশ!”

মিসেস নাসরিন বললেন,”কি আর করা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। মন খারাপ করিস না।”

মি. মোর্শেদ বললেন, “যদি বলিস আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি? এখানে আসার পর থেকে সকলে মিলে একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি। কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। চল। কোথাও বেড়িয়ে এলে মনটাও ভালো হয়ে যাবে। ”

মিসেস নাসরিন বললেন, “হ্যা এখানে আসার পর থেকে একবারও বের হওয়াই হয়নি।”

মাহীন চিন্তিত গলায় বলল,” কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়?”

নাইম ঝট করে বলল, ” ইওসেমিতে ন্যাশনাল পার্ক।”

মাহীন নিমিষেই হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল, “হ্যা জায়গাটা অসাধারণ। এই একটা ব্যাপারে তোর সাথে একমত।”

নাইমের মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।