এল এ ডেইস পর্ব-৮+৯

0
168

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৮
লেখনী-মাহীরা ফারহীন

পরন্ত বিকেলের এক চিলতে সোনালি রোদ এসে পরেছে মাহীনের কামরায়। জানালাটা হা করে খোলা। আজ সূর্যের মলিন চেহারা। তেজ কম। বাইরে বেশ বাতাস রয়েছে বলে পরিবেশটা ঠান্ডা। মাহীন একটা সাদা কালো চেক চেক রঙের কুর্তি পড়েছে। চুলগুলো আঁচড়াচ্ছে তখন নাইম হন্তদন্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করল। তারপর উচ্চকন্ঠে বলল,

“মাহীন! তুই কার অনুমতি নিয়ে নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড পাল্টিয়েছিস?”

মাহীন ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “তাতে কারোও অনুমতি লাগে নাকি আবার?”

“নেটফ্লিক্স তুই একা দেখিস না। আমিও দেখি। তাই আমার অনুমতি ছাড়া একটা শব্দও এদিক থেকে ওদিক হওয়া ঘোর অপরাধ।” তারপর একটু থেমে বলল, “তাড়াতাড়ি পাসওয়ার্ড বল?”

মাহীন নিরুত্তাপ কন্ঠে বললো, “পাগলের প্রলাপ।”

নাইম ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, “ধ্যাৎ বাজে না বকে ভালোয় ভালোয় পাসওয়ার্ডটা বল।”

“বলেছি তো।”

“কখন বললি?”

“পাগলের প্রলাপ।”

“আবার ফালতু কথা বল…নাইমের কথার মাঝখান দিয়ে মাহীন বলল, “এটাই পাসওয়ার্ড।”

নাইম বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, “আমাকে এত বোকা মনে হয় তোর? পাগলের প্রলাপ তো তুই বকছিস। এটা কোনো পাসওয়ার্ড হলো?”

মাহীন শ্রাগ করল। নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ পাকিয়ে বলল, “যদি না খুলে নেটফ্লিক্স তাহলে দেখে নিব তোকে।”

বলেই কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। মাহীন ফিচেল হাসি দিয়ে মনে মনে ভাবলো, তুই তো বোকাই। চুলগুলো আঁচড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছে ও। নরম সিল্কি ঘন চুলগুলো ঝলমল করছে। চোখে কাজলের আঁচড় দিল। তাহলেই নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। গলায় একটা কালো ওড়না পেঁচিয়ে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে না নামতেই পুনরায় নাইম এসে হাজির হল। এবার ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল, “তোর এত বড় সাহস আমার সাথে মস্করা করছিস! ভুল পাসওয়ার্ড দিয়েছিস আমাকে।”

মাহীন টিটকারির সুরে বলল,”হুহ তুই না বড় মুখ করে বললি, আমাকে এত বোকা মনে হয় তোর? হ্যা তাই মনে হয়। তাই তো তুই পাগলের প্রলাপের মত বাক্যটা পাসওয়ার্ড হিসেবে মেনে নিয়ে চলেও গেলি।”

নাইম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এবার চুপচাপ সঠিক পাসওয়ার্ড টা দে।”

তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। মাহীনই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস নাসরিন নিজের কামরায় ছিলেন।তিনি বাইরে বেরিয়ে আসলেন। মাহীন দরজা খুলল। দেখা গেল বাইরে একজন ফর্সা সোনালি চুলো সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ধূসর রঙের স্যুট। এবং তার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফটফুটে ৩ থেকে ৪ বছরের বাচ্চা ব্লন্ড বাচ্চা। মাহীন ঠিক চিনতে পারল না তাদের। মহিলা বলল,

“হ্যালো আমি সেলি। তুমি ম্যহিন তাই না? মাহীন মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো, ওর নাম ভুল ভাবে উচ্চারণ করার জন্য। তবে মুখে বলল,

” হ্যা আমিই মাহীন।” পাশ থেকে বাচ্চাটা মহিলার হাত ছেড়ে দিয়ে ঝড়েরবেগে মাহীনের পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। এদিকে মিসেস নাসরিন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেলি বললেন,

“হ্যালো মিসেস ন্যসরিন। আমাকে ক্ষমা করবেন হঠাৎ একটা জরুরী কাজে বেরোতে হবে বলে ফ্র্যাঙ্ককে আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি।”

মিসেস নাসরিন আন্তরিক হেসে বললেন,”কোনো সমস্যা নেই। ফ্র্যাঙ্ককে আমি খুব ভালোবাসি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

মাহীন ভেতরে চলে আসল। দেখল বাচ্চা ছেলেটা যার নাম সম্ভবত ফ্র্যাঙ্ক সে নাইমের পিএসফাইভ দখল করে আরামসে সোফার ওপর বসে আছে। নাইমকে ধারে কাছে কোথাও দেখা গেল না।

ফ্র্যাঙ্ক বলল,”সিস নেইম ব্রাদাহ কোথায়?”

ফ্র্যাঙ্ক কি বলল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,”কে কোথায় লিটল কিড?”

ফ্র্যাঙ্ক বলল, “তোমার ব্রাদাহ।”

এবার মাহীন বুঝতে পেরে এদিক ওদিক চাইল। দেখল মিসেস নাসরিনের কামরার দজরা একটু খোলা এবং নাইম ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন হালকা হেসে বলল,

“একটু অপেক্ষা করো ওকে আমি ডেকে আনছি।”

বলে সেই কামরার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই নাইম বলল,

“মাহীন দয়া করে আমাকে বাঁচা। এই বাচ্চা আমার জীবনটা ভাজা ভাজা করে দিল।”

মাহীন বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “বুঝলাম না কিছুই। ওই মহিলা কে ছিল? আর ওকে এখানে দিয়ে গেল যে? আগে তো কখনো দেখিনি।”

নাইম দীর্ঘকাল ফেলে বলল, “তুই বাসায় থাকিস কখন যে দেখবি। ওই মহিলার স্বামী বেশ কয়েকমাস আগে ক্যান্সারে মারা গিয়েছে। যখন সকালে হসপিটালে যায় তখন বেবি সিটার থাকে বাসায়। এই সময় বোধহয় থাকে না। এবং হুট করে কোনো কাজে বের হতে হচ্ছে বলে ওকে দিয়ে গেছে এখানে। তিন দিন আগে একবার এই সময় দিয়ে গিয়েছিল আমাদের বাসায়।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “আমি তখন কই ছিলাম?”

নাইম বলল, “তুই তখন তোর কোনো এক ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলি। কিন্তু এখন তুই আমাকে একা ফেলে যেতে পারবি না। এই বাচ্চা আস্ত একটা ফাজিলঝুড়ি।’

মাহীন হেসে বলল, ” ভালোই হইসে। তোর জন্য এটাই ঠিক আছে। আমার জরুরী কাজ আছে। আমি পারব না থাকতে।”

নাইম বলল, “ইশ কি স্বার্থপর তুই।” তারপর একটু থেমে বলল, “আচ্ছা যাহ নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড দে তাহলে তোকে যেতে দিব।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “পাসওয়ার্ড”

“আরেহ হ্যা ওটাই তো চাচ্ছি।”

“যেই জায়গাটায় তুই পাসওয়ার্ড লিখবি ওখানে কি লেখা থাকে?”

“ওখানে কি আবার লেখা থাকবে? কিছুই না। পাসওয়ার্ড লেখার জন্যেই তো খালি থাকে ওটা।”

“নাহ ওখানে হালকা করে কিছু একটা লেখা থাকে। চোখের কি মাথা খেয়েছিস? কখনো দেখিসনি?”

“ওহ ওখানে হালকা করে পাসওয়ার্ড লেখা থাকে।”

“এইতো দেখছিস। পাসওয়ার্ড ওখানে লেখাই আছে।”

“তুই আবার ফাজলামো করছিস! পাসওয়ার্ড কিভাবে পাসওয়ার্ড হতে পারে?”

“তুই এমন বলদ যে পাসওয়ার্ড বানানটাও করতে পারবি না। তাই তোর ওপর দয়া করে এমন পাসওয়ার্ড দিয়েছি যেটা ওখানে লেখাই থাকে। যাহ দেখ গিয়ে।”
বলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল মাহীন। সোফার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
“লিটল কিড, তোমার ব্রাদার সামনের রুমেই আছে। যত ইচ্ছে খেলো ওর সাথে।”

মিসেস নাসরিন দরজার পাশের ছোট কাবার্ডের মধ্যে কিছু একটা করছিলে। তিনি বললেন, “তুই এই সময় ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে কোথায় যাইস?”

মাহীন তাড়াহুড়ো করে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “বলেছিলাম না আমার স্কুলে ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট চলছে।সেটার কাজের জন্যেই এখন স্কুলে যাচ্ছি। চিন্তা করো না আমি দুই ঘন্টা পর চলে আসব।”

মিসেস নাসরিন বললেন, “দুই ঘন্টা! এতক্ষণ?”

মাহীন পায়ে স্নিকার্স পরতে পরতে বলল,”মা, আমরা একটা আর্টিকেল তৈরি করছি। সেটা আলাপ আলোচনা তো করতে হবে।” বলেই বেরিয়ে গেল।
এদিকে নাইম বেরিয়ে আসতেই ফ্র্যাঙ্ক ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পরল ওর গায়ের ওপর। তারপর বলল,

“ব্রাদা আজকে আমরা কি কি করব?”

নাইম বলল, “চল দেখি মাহীন ঠিক পাসওয়ার্ড দিলো কিনা। যদি খুলে যায় তাহলে আমরা এক সাথে বেবিস ডে আউট দেখব। কি বলিস?”

ফ্র্যাঙ্ক খিলখিল করে হেসে বলল, “আমি একদম ওই বাচ্চার মতোই এডভেঞ্চার করতে চাই।’
‘তাহলে তোর পেছনেও তিনটা চোর পরে থাকলে মন্দ নয়।’
ফ্র্যঙ্ক ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
‘অলরেডি একটা চোরের সরদার আমার পেছনে পরে আছে।’
‘সেটা আবার কে?’
‘তুমি।’
নাইম ছানাবড়া চোখে চাইল। বলল,
‘তাই বলে আমাকে চোরের সরদার বানিয়ে দিলি! কি ফাজিল রে বাবা।’
.
.
.
প্রায় পৌঁনে চারটার দিকে মাহী লাইব্রেরি পৌঁছল। লিম জু বোধহয় এখনো এসে পৌঁছোয়নি। সারি সারি সেলফ গুলো পেরিয়ে কোণার টেবিলটার কাছাকাছি আসতেই দেখল, সেই টেবিলে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রায়েদ মাদিহ বসে আছে। কোনো দিকেই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। মাহীনের হঠাৎ এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো। কেমন জানি এক অস্থিরতা কাজ করলো ছেলেটাকে দেখা মাত্র। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের অপর পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরল। ব্যাগ থেকে নিজের নোট খাতাটা বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা খুলে রায়েদের দিকে এগিয়ে দিল। রায়েদ মুখ তুলে চাইল। শক্ত চোয়াল। চেহারায় গাম্ভীর্যের ছাপ। তবুও মনে হয় কী নিখুঁত চেহারা।
ভারি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি?”
“আমার জানা মতে, আমাদের আজকে আলোচনা করার কথা ছিলো। এবং আমি আমার পছন্দসই দিকগুলো নোট করে এনেছি।” নিরুত্তাপ কন্ঠে জবাব দিল মাহীন। রায়েদ টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলোর নিচে চাপা পরে থাকা একটা নোট খাতা বের করল। নোটবইটা অনেক পুরনো বলে মনে হলো। প্রতিটা পৃষ্ঠাই কানায় কানায় ভরা। পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা নির্দিষ্ট পাতা বের করে মাহীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার নোট। পড়ে নাও একবার।” বলেই মাহীনের দেওয়া নোটটা হাতে নিলো। মাহীন নোটবুকটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগল। ওর লেখার বিষয় বস্তু কোনো মেন্টাল ডিসওর্ডার নয়। বরং মেন্টাল ট্রোওমা। ক্ষণকাল পরেই মাহীনের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো। মনে মনে ভাবল, আজব তো। ওর নোট পরে তো মনে হচ্ছে মানসিক কষ্ট নিয়ে কবিতা লিখেছে। এমন লেখা কেন? একদম ছন্দে ছন্দে মিলিয়ে। আর লেখা এত পেঁচানো যে দাঁত ভেঙে যাচ্ছে আমার। তবে খারাপ হয়নি লেখাটা। যা লিখেছে ভালোই তো হয়েছে।’ বেশ কিছুক্ষণ পর রায়েদ মাহীনের নোট বইটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,
” আর্টিকেল তিনটা প্যারায় বিভক্ত করলে সুবিধা হবে। তবে লিম জু কোথায়? ওর কোনো খবর নেই কেনো?”

মাহীন নিজের পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে বলল, “জানি না। ফোন দিয়ে দেখছি।” বলেই লিম জুর কনট্যাক্টটা বের করে কল দিল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে লিম জুর কন্ঠস্বর ভেসে আসল। মৃদুস্বরে বলছে, “মাহীন আমি এইতো কাছাকাছি এসে পরেছি।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “তোমার দেরি হচ্ছে কেন এত?”

লিম জু বলল, “আমি এসে বলছি।” ক্লান্ত স্বরে কথাটা বলেই কেটে দিলো ফোন। রায়েদকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখা গেল। তারপর বলল,
“তুমি কি আমার নম্বরটা তোমার মোবাইলে সেভ করে রেখেছ?”

মাহীন ভাবলেশহীন মুখে বলল,”প্রয়োজনবোধ করিনি।”

তারপর একটু থেমে বলল, “কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে সেদিন আমিই ফোন দিয়েছিলাম? তুমি তো ফোন ধরোইনি।”

রায়েদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলল,’মিসেস রে আমাকে তোমার নম্বর দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বুঝেছি।” মাহীন বিরক্ত হয়ে মনে মনে ভাবল,
এই মিসেস রে তো আচ্ছা মহিলা। আমার অনুমতি ছাড়াই আমার নম্বর ওকে দিয়ে বসে আছে।’ রায়েদের পেছনের বড় জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। ফলে টেবিলের পাড়ে রাখা বইগুলোর পৃষ্ঠা ফরফর করে এদিক ওদিক উড়ছে। বাতাসে রায়েদের ছোট ছোট রেশমি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মাহীন জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা তুমি কি কবিতা লেখো?”

রায়েদ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। যেন এহেন আজগুবি কথা ও এর আগে কখনো শোনেনি। বলল,

“কবিতা? কবিতা কি চাইলেই সবাই লিখতে পারে? এবং আমার কবিতা লেখার মত মন মেজাজ থাকে না।” তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, “কেন জিজ্ঞেস করলে?”

মাহীন বলল,”না মানে তোমার নোটটা পড়ে মনে হলো কবিতা পড়ছি। তবে খারাপ হয়নি।”

রায়েদ ওর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। তারপর বলল,
“আচ্ছা তুমি ” পিটিএসডি” নিয়ে এত কাহিনী কেন লিখেছ?”

মাহীন বলল,”কারণ পিটিএসডি মেন্টাল ট্রোওমা থেকে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এবং সেদিন যেটা বললাম সাইকোলজি নিয়ে, তাতে এটা পরিষ্কার যে আমাদের বয়সি ছেলে মেয়েরা সাধারণত ট্রোওমাটাইজড হয়ে যায় কিংবা ডিপ্রেশনে চলে যায়। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে পিটিএসডি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।” তারপর একটু থেমে আবার বলল,

” তুমি লিখেছ মেন্টাল ট্রোওমা নিয়ে এবং আমি লিখেছি মেন্টাল ট্রোওমা থেকে হতে পারে এমন ডিসওর্ডার নিয়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত ভাবে মিলে গেল।”

রায়েদ বলল, “তা বৈকি। এখন দেখা যাক লিম জু কি নোট করেছে।”

প্রথমে অস্বস্তি হলেও ক্রমেই তা কেটে গিয়েছে। এবং রায়েদের স্বাভাবিক ব্যবহারে ভালোই লাগছে। মুচকি হেসে ভাবল, ‘কোথায় রায়েদ খারাপ ব্যবহার করছে? কোথায়ই বা খারাপ আচরণ করছে? এর চাইতে আর কতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে কেউ? কেউ কেউ তো থাকতেই পারে একটু খিটখিটে স্বভাবের। তাই বলে কি সে খারাপ হয়ে যায়? হ্যা হতে পারে সে একটু অহংকারী স্বভাবের। আসলে সমস্যা রায়েদের মধ্যে নয় এখানকার ছেলে মেয়েদের মাথায় সমস্যা রয়েছে।’

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কি এমন ভাবছ যেটা তোমাকে এত হাসাচ্ছে?”

মাহীন ওর কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসল। বলল, “কোথায় হাসছি? আমি হাসছি কিনা সেটা দেখা বাদ দিয়ে তুমি তোমার কাজে মন দাও।”

রায়েদ কিছুই বলল না। মাহীন এদিক ওদিক চাইল। চোখে পরল টেবিলের একপাশে এবারও সেই হ্যারি পটার রেফারেন্সের কাপটা রাখা আছে। মাহীন বলল,

“তোমার এখানে এত ভালো লাগে যে বাড়ি থেকে কাপও এখানে এনে রেখেছ।”

রায়েদ এবার কিছুটা গম্ভীরমুখে বলল,”হুম তা তো লাগেই।”

মাহীন বলল, “হুম অনেক শুনেছি, যারা বই পড়তে ভালোবাসে তাদের স্বপ্ন লাইব্রেরিকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলা। তুমি তো দেখি আসলেই করে বসেছ সেটা।”

রায়েদ হালকা হাসল। এতটাই হালকা ভাবে যে তীক্ষ্ণ নজর না হলে চোখেই পরবে না। বলল,

“স্বপ্ন ছিলো কিনা জানি না। তবে হয়ে গিয়েছে।”এতটুকু বলে থেমে গিয়ে আবার বলল, “তুমি বই পড়ো না?”

মাহীন বলল, “খুব পড়ি।”
তখনই দেখা গেল সেলফের আড়াল থেকে লিম জু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। এসে মাহীনের পাশের চেয়ারে বসে পরল।

রায়েদ কাঠখোট্টা ভাবে বলল,
“পাঙ্কচুয়ালিটি কি জিনিস জানো? পুরো আধাঘন্টা দেরি করে এসেছ।”

লিম জু বলল,
“তো আমার কি দোষ? আমি সময় মতই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার মাঝে জামে পরেছি। তারপর আমার সাইকেলের চাকা পাঙ্কচার হয়ে গিয়েছিল। এবং তাতে একটা বাচ্চার চকলেট পরে গিয়েছিল। সে বাচ্চা এমন কান্না শুরু করল যে, মলে গিয়ে চকলেট কিনে দিয়েছি তারপর থেমেছে।” বলে প্রলম্বিত শ্বাস নিলো। মাহীন ও রায়েদ দুইজনই ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। মাহীন বলল,

” আর কোনো কিছু কি বাকি ছিল হওয়া? সেটাও ঘটিয়ে আসতা।” লিম জু বিচলিত ভাবে হাসল।

রায়েদ টিটকারি মেরে বলল, “দুনিয়ার দুর্ঘটনা তোমার সাথেই ঘটে। তোমার ভাগ্য একটা বলতে হবে।”

লিম জু নিজের ব্যাগ থেকে একটা নোট খাতা বের করতে করতে বলল,
“আচ্ছা বুঝলাম। আমাকে আর টিপ্পনি কেটো না দয়া করে। এবং এই নোট টাও দেখে নাও।”

বলেই টেবিলের মাঝে রাখল। মাহীন নোট টা ধরল না। রায়েদই প্রথমে সেটা নিয়ে দেখতে লাগল। লিম জু মাহীনের কানের কাছে মুখ এনে গলা খাদে নামিয়ে বলল, “তুমি এখানে ওর সাথে আধাঘন্টা যাবত বসে আছো। তোমার ঝগড়া টগড়া লাগেনি তো?”

মাহীনও ফিসফিস করে বললো, “ঝগড়া লাগবে কেন?”

লিম জু অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বললো, “ওর সাথে ঝগড়া না লাগার কোনো কারণ নেই। তবে লাগার হাজারটা কারণ আছে। এনি ওয়েজ।’

রায়েদ নোট টা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “আমার ঝগড়া করার মতো ইচ্ছাশক্তি নেই তাই ঝগড়া লাগেনি। সহজ ব্যাপার।”

মাহীন চোখ পাকিয়ে লিম জুর দিকে চাইল। রায়েদ নোটটা মাহীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও তুমি পড়ে দেখো।”

মাহীন নোটটা হাতে নিল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। পড়ার পর মাহীন মনে মনে ভাবল, বুলিং, এর পরিণতি এবং ডিসমোর্ফিয়া নিয়ে লিখেছে। ভালো ভাবেই প্রতিটা বিষয় খুটে খুটে নোট করেছে। যাক আমাদের মূল বিষয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটিয়ে বলল, “ভালোই হয়েছে। বিষয়বস্তুটা ঠিক ভাবেই বেছে নিয়েছ।খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক।” লিম জু মিষ্টি করে হাসল।

রায়েদ বলল, “এমন গোটা গোটা লেখা যে বুঝতে অসুবিধা হয়। তবে ভালো হয়েছে।”

লিম জু কে দেখে মনে হলো, দ্বিধান্বিত হয়ে আছে, শেষের কথাটা নিয়ে খুশি হবে নাকি খুঁতটা নিয়ে বিরক্ত হবে।

মাহীন বলল, “নিজের নোট এবং রায়েদের নোট দুটোই লিম জুর দিকে এগিয়ে দিল। তারপর বলল,

“আমাদের এগুলো তিনটা প্যারায় বিভক্ত করে পরিষ্কার ভাবে গুছিয়ে আবার লিখতে হবে।”

রায়েদ বলল,”আজ বারো তারিখ। সতেরো তারিখ এগুলো জমা দিতে হবে।”

মাহীন বলল,”সকাল নয়টার সময় থেকে না জমা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হবে?”

রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। লিম জু বলল, “আচ্ছা ল্যপটপ কে এনেছ?”

রায়েদ বলল, “আমি এনেছি।”

রায়েদ ওর ব্যাগ থেকে এ্যপল ল্যপটপ বের করল। এরপর ওরা নোটগুলো গুছিয়ে টাইপ করে ল্যপটপে তুলতে শুরু করল। মাহীন ও লিম নিজ নিজ মোবাইলেই টাইপ করে তুলছে। এবং শেষে সবগুলো ল্যপটপে তুলে দিবে। এতে সময় কম লাগবে।
কমপক্ষে সাড়ে চার হাজারের মতো শব্দ তিনজনের নোট মিলিয়ে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। কাজ প্রায় শেষ ওদের। কিছুক্ষণ পর মাহীন ও লিম জু বেরিয়ে যাবে।

তখন মাহীন বলল, “আহ আমার অনেক গরম লাগছে। আমি আইসক্রিম খাব।”

রায়েদ বিরক্ত কন্ঠে বলল, “সিরিয়াসলি বাইরে প্রচুর বাতাস হচ্ছে। এবং এখানে ফ্যান চলছে এর মধ্যে তোমার গরম কিভাবে লাগছে?”

মাহীন বলল, “কি জানি। আমি আইসক্রিম আনতে যাচ্ছি।”

লিম জু বলল,”কোথা থেকে আনবা? এখন স্কুলের বাইরে যাবা? এবং আমরা তো এমনিতেই একটু পর বের হবো।”

” মাহীন বলল, “মোটেও না। ক্যাফেটেরিয়া আছে কি করতে? ওটা তো খোলাই থাকে। এবং এখানে একটু কম খরচ পরবে।

লিম জু বলল, “আমার তো মনে পরে না ক্যাফেটেরিয়ায় কখনো বাইরের থেকে দাম কম পরেছে।” মাহীম শ্রাগ করল।

রায়েদ বলল, “এর মধ্যে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে স্কুল বিল্ডিংয়ে যেতে লাগবে তোমার দশ মিনিট। তারপর ঢিলা কম্পানি ক্যাফেটেরিয়ান দশ মিনিট লাগাবে তোমার আইসক্রিম খুঁজে বের করতে। তারপর তোমার ফিরে আসতে লাগবে দশ মিনিট যদি না রাস্তায় আবার নতুন কোনো ঘটনা ঘটে। মোটমাট আধাঘন্টার আগে তোমার সাথে আর দেখা হচ্ছে না।”

মাহীন বলল, “ভুল হিসাব। যেতে পাঁচ মিনিট, আসতে পাঁচ মিনিট এবং আইসক্রিম কিনতে দুই মিনিট। মোট বারো মিনিট।”

তারপর একটু থেমে বলল, “লিম তুমি কি আইসক্রিম নিবা?”

লিম জু অবাক হয়ে বলল, “আমি কি নিব মানে? তুমি কি শুধু নিজের জন্য নিতে যাচ্ছো না?”

মাহীন বলল, “অবশ্যই না। তাড়াতাড়ি বলো।”

লিম জু কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,”ম্যাঙ্গো ফ্লেভার।”
এবার মাহীন রায়েদের দিকে চেয়ে বলল, “তুমি?”

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে কঠোরভাবে বলল, “মাহীন দয়া করে ফাজলামো করো না। এসব কি ধরনের পাগলামি? এবং এতে আমাদের সময় নষ্ট হবে।

মাহীন বলল,”আহা আমাদের তো কাজ শেষ বলতে গেলে। কিই বা এমন বাকি আছে। আমাকে ছাড়াও তোমরা করে নিতে পারবে। “তারপর একটু থেমে আবার বলল,’আচ্ছা তোমার প্রিয় ফ্লেভার কি?’

রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “আমার কোনো আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছে নেই। এবং তোমার কাছ থেকে আমি নিবোও না।”

মাহীন বলল, “এই এক মিনিট আমি কখন বললাম আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি। হুহ শখ কত! শুধু পছন্দের ফ্লেভারটা জানতে চাচ্ছি, ফ্লেভার নিয়ে কথা উঠল তাই। তার মানে এটা না যে আমি তোমার জন্য আইসক্রিম আনব।”

রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কোনো পছন্দের ফ্লেভার নেই।”

মাহীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে।”

লিম জু করুন দৃষ্টিতে চাইল মাহীনের দিকে। মাহীন নিজের হাতে থাকা সেল ফোনের দিকে ইশারা করে হাঁটতে শুরু করল। সেলফ গুলো অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়ে আসল। তারপর লিম জু কে টেক্সট করল, “চিন্তা করো না। আমি তোমাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি না। আসলেই আইসক্রিম নিয়ে বারো মিনিট পর ফিরে আসব।” সাথে সাথে সিন হল। অপর পাশ থেকে লিম জু রিপ্লাই দিল,

“যত যাই হোক তুমি আমাকে কার সাথে রেখে গেছ খেয়াল আছে! তোমার না হয় অনেক সাহস বসে থাকো ওর সাথে। আমি পারব না।” মাহীন করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পাল্টা টেক্সট করল,

“রায়েদ কি করছে?”

লিম জু উত্তর দিল, “নিজের ল্যপটপের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে।”

মাহীন হেসে লিখল, “বাজি ধরে বলছি আমি না আসা পর্যন্ত ল্যপটপ থেকে মুখ তুলেও দেখবে না। এবং তুমিও কোনো উদ্ভট প্রশ্ন করে বসো না যেন।”

এবার লিম জু চোখে পানি টলমল করছে এমন একটা ইমোজি পাঠাল। মাহীন হেসে সেল ফোন বন্ধ করে পকেটে রেখে দিল। এরপর প্রায় ছুটতে ছুটতে স্কুল বিল্ডিংয়ে পৌঁছে ক্যাফেটেরিয়া থেকে একটি ম্যাঙ্গো ও দুটো কফি আইসক্রিম কিনল। তারপর ফিরেও আসল ছুটতে ছুটতে। লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে ভাবল, ‘আমার ধারণা কখনো ভুল হয় না। এবারও হবে না আশা করছি। যে কফি খায় তার কফির যেকোনো পদই ভালো লাগবে।’ ভেবে আনমনেই হাসল। লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল কোণার সেই টেবিলের দিকে। দেখল রায়েদ খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যপটপে টাইপ করতে ব্যস্ত এবং লিম জু নিজের সেল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। মাহীন তিনটা কাপ আইসক্রিম টেবিলের ওপর রাখতেই রায়েদ ল্যপটপের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ওর দিকে চাইল। মাহীন ঘড়ির দিকে চাইল। ওদের টেবিলের পাশের দেওয়ালেই একটা বড় দেয়াল ঘড়ি রয়েছে। মাহীনের যাওয়া আসাতে মোট চৌদ্দ মিনিট লেগেছে। রায়েদ বলল, “কোথায় তোমার না বারো মিনিটে আসার কথা ছিল? চৌদ্দ মিনিট কিভাবে হলো?”

মাহীন নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,”ওফ! আমার বারো মিনিটই লেগেছে। আমি যে এসেছি সেটা খেয়াল করতেই তুমি দুই মিনিট লাগিয়েছ।”

লিম জু চাপা হাসল। রায়েদ আইসক্রিমের দিকে তাকিয়েই বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো, ” কি আশ্চর্য! আমি তোমাকে বললাম আমার জন্য আইসক্রিম…”

মাহীন মাঝখান দিয়ে বলল, “আরে আজব তো, তোমার তো দেখি ওভারথিঙ্কিং এর সমস্যা আছে। আমি তো বলিনি একটা তোমার জন্য এনেছি। দুটোই আমার জন্য।”

রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের মণি ঘোরাল। লিম জুকে ওর আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে, নিজের জিনিস পত্র গুছাতে লাগল। কারণ ওদের কাজ শেষ প্রায়। নিজের আইসক্রিমটা খুলে খেতে খেতে লিম জু কে টেক্সট করল,

“লিম আমাকে ফোন দাও। কিন্তু তুমি নিজের কানে মোবাইল ধরবে না। শুধু ফোন দিয়ে বসে থাকবে।”

লিম সিন করে ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চাইল। মাহীন আবার টেক্সট করল, “যা বলছি তাই করো। এখন কোনো প্রশ্ন করো না।”

এবার লিম কন্টাক্ট নাম্বার বের করে মাহীনকে ফোন দিল। মাহীন স্বাভাবিক ভাবেই ফোন ধরল। তারপর কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শোনার ভান করল। এরপর বলল,

“না, না আমি কাছাকাছি আছি। কখন? আচ্ছা ঠিক আছে এখনি আসছি।বায়।” বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর তাড়াহুড়ো করে বললো,

“রায়েদ আমাদের এখুনি যেতে হবে। আবার দেখা হবে।”

বলেই রায়েদকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই
নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিল। লিম জু এবং ও একসাথেই বের হয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে।

রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর যেসব নোট ওরা এখানেই তৈরি করেছে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করল। একটা শীট তুলতেই দেখল তার নিচে সেই আরেকটা আইসক্রিম এখনো রাখা। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, “এই মেয়েটা আচ্ছা পাগল আছে তো! ঘূর্ণিঝড়ের মতো চলাফেরা করে। যেখান থেকে যায় সব ওলটপালট করে দিয়ে যায়। এসব করার কি দরকার ছিলো? প্রথম থেকেই জানা ছিলো আমার জন্য একটা আইসক্রিম ও আনবেই। কিন্তু একদম ঠিক টাইমে কে ফোন দিয়েছিল ওকে। লিম জুই দেয়নি তো? নাহলে সবকিছু এভাবে ক্ষাপে ক্ষাপে কিভাবে মেলে? যাই হোক অযথাই আমার জন্য এসব করল। অদ্ভুত একটা মেয়ে!’ ভেবে আনমনেই স্মিত হাসল এবং আইসক্রিমটা হাতে তুলে নিলো রায়েদ।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৯
লেখনী- মাহীরা ফারহীন

সকাল পৌঁনে দশটা বাজে। সকাল হলেও অদ্ভুত ভাবে স্কুলে এই সময় লাঞ্চ ব্রেক চলছে। মিসেস রেয়ের কাউন্টারের সামনে বেজায় ভির। আজ সতেরো তারিখ, সকলের ইভেন্ট প্রজেক্টগুলো জমা দেওয়ার দিন। হৈ-হুল্লোড়ে গমগম করছে ছোট্ট করিডোরটা। মাহীন ওদের তৈরি আর্টিকেলটা নিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। লাইব্রেরি থেকে একটু আগে এটা নিয়ে এসেছে। রায়েদ সেখানে ছিলো না, তবে আর্টিকেলটা সযত্নে টেবিলের ওপর রাখা ছিল। লিম জু আসতে চায়নি, কাজেই ও একাই চলে এসেছে। কাউন্টারের সামনে ছেলে মেয়েদের ভিড়ে তিল ধারণের স্থান নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একসময় বিরক্ত হয়ে মাহীন বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ রোদের নিচে চত্ত্বরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে গরম লাগায় পুনরায় ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন ওর জমা দেওয়ার সুযোগ আসল ততক্ষণে ভিড় বলতে কিছুই নেই। অল্প কয়েকজন মাত্র দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন মাত্র ওর আর্টিকেলটা জমা দিল তখন মনিটর ডেক্সটার কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা খাম। মুখে এক রাশ বিরক্তি এবং ক্লান্তিমাখা ছাপ। মিসেস রে মাহীনের আর্টিকেলটার ওপর সীল মেরে মনিটরের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কি ব্যাপার রাবিতকে খামটা দাওনি কেন?”

“ওকে হাতে পেলে তো দেব। ও স্কুলে আসেইনি।”

মিসেস রে কঠিন স্বরে বললেন, “আশ্চর্য ছেলেটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিই না। আজ ওর মায়ের হাত পর্যন্ত এই খামটা পৌঁছতেই হবে। ওর ভাই কোথায়?”

“ওর ভাইও আসেনি। দুইজনই আজ উধাও।”

মাহীন কাউন্টারে ঠেস দিয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তিতে চোখের মণি ঘুরাল। এই অপেক্ষা বড় বিরক্তিকর জিনিস বটে। মিসেস রে বললেন,

“তাহলে তুমি ওর বাসায় খামটা পৌঁছে দিয়ে এসো।”

মনিটর কপাল কুঁচকে বলল, “ওফ আপনি জানেন তো আমার প্রোজেক্ট নিয়ে এখনো ঝামেলায় আছি। সেটার কাজ শেষ করে তো এক ঘন্টার মধ্যে জমা দিতে হবে।”

মিসেস রে চিন্তিত স্বরে বললেন, “আহা কিন্তু এটা মিসেস রহমানের কাছে দিয়ে আসা প্রয়োজন।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মিসেস রে, আমার আর্টিকেলের সংখ্যা নম্বরটা কি আর দেবেন?”

মিসেস রে ওর দিকে এতক্ষণে দৃষ্টি ফেরালেন। আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা গল্প জুড়ে দিয়েছে। মিসেস রে বললেন,

“ওহ হ্যা তোমার নম্বর। থামো।”

মনিটর হঠাৎ মাহীনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা মাহীন এরপর তোমার কি ক্লাস আছে?”

মাহীন ওর দিকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল,”হিস্টোরি।”

“ওহ তাহলে মিসেস রে, মাহীন কিন্তু খামটা দিয়ে আসতে পারে রাবিতের বাসায়।’ এবার মিসেস রেকে উদ্দেশ্য করে উদ্ভাসিতমুখে বললো ডেক্সটার।

মাহীন চোখ কপালে তুলে বলল, “মানে কি? আমি কেন যাবো! আমি তাকে চিনিও না।”

মনিটর শান্ত ভাবে বলল, “আহা রাবিতের বাড়ি বেশি দূর নয়। এই হেঁটে যেতে ষোলো সতেরো মিনিট লাগবে। এবং সাইকেল নিয়ে গেলে নয় দশ মিনিট লাগবে।”

মাহীন কাটখোট্টা ভাবে বলল, “মশকরা করছ আমার সাথে! আমি যেতে রাজি কখন হলাম যে ওর বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগবে সেটা বলছো? আর বেশি দূর না মানে? সাইকেল নিয়ে যেতেও নয় দশ মিনিট লাগবে!”

মিসেস রে তার কম্পিউটারের মনিটরের দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে বললেন,

” ডেক্সটার ওকে কেন বলছো? ও তো মনিটর না। এটা তোমার দায়িত্ব।”

মাহীন তিক্ত কন্ঠে বলল, “আর বাকি মনিটররা কোই? তাদের পাঠাও! আমার পিছনে লেগে আছো কেন?”

ডেক্সটার নিচু গলায় বলল, “আরে বাবা এটাই তো সমস্যা! এটা আমার কাজ। ওরা অন্য কাজ হলে সামলে নিত এখন একজনের বাসায় যেতে হবে সেটা কেউ করতে চাইবে না। আর এমনিতেও ওরা কেউ আমাকে দেখতে পারে না। আর অন্য সময় হলে আমি ওদের জোর দেখিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু এখন তো আমি অমন আচরণ করা ছেড়ে দিয়েছি।”

শেষের কথাটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল। মাহীন একটু গললো না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গাঢ় কন্ঠে বলল,

“তাতে আমি কী করব? ওরা তোমাকে দেখতে পারে না সেটা তোমার দোষ। এখন নিজের ঝামেলা কিভাবে সামলাবা সেটা শুধুই তোমার মাথা ব্যথা।”

ডেক্সটার অনুনয়ের স্বরে বলল,”দেখো মাহীন হিস্টোরি ক্লাস তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওটা একদিন বাদ দিলেও কিছু হবে না। এবং তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি তোমার কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব।”

মাহীন মুখ বাঁকা করে বলল, “হিস্টোরি ক্লাস গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই না? তাহলে এর ক্লাসও না নিলেই পারত। এবং আমার কি দায় পরেছে আমি তোমাকে সাহায্য করব?”

“কারণ গতবার আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম।

মাহীন বিদ্রুপ করে হাসল। বলল বলল, ” তাই না? তুমি আমাকে নিজে থেকে সাহায্য করলে অবশ্যই আমি এখন তোমাকে সাহায্য করতাম। কিন্তু আহা তোমাকে তো আমার ব্ল্যাকমেইল করা লেগেছিল তাই না? এবং সেই প্রমানাদি কি আমি মুছে ফেলেছি ভেবেছ? অবশ্যই না।”

মনিটর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বলল,”আমি জানি। তবে বিশ্বাস করো মাহীন, আমি সেইসব বাজে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছি। তুমি কি এর মধ্যে একবারও কাউকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুনেছ?”

মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল। ভাবল, এ-তো এত সহজে ভালো হবার পাত্র লাগে না। ভালো ভালো আচরণ করছে কারণ এখনো আমার হাতে ভিডিও টা আছে। ভিডিও টা শুধু না থাকলেই যেই লাউ সেই কোদু। আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি না? নাহলে এত শিক্ষার্থী থাকতে আমাকেই কেন ধরল? আর যাই হোক আমার মন গলাতে পারবে না।’

তখনই মিসেস রে একটা ছোট কাগজ কাউন্টারে রেখে বললেন, “মাহীন তোমার নম্বর।”

মাহীন কাগজটা নিজের পকেটে রেখে মনিটরের উদ্দেশ্যে বলল,
“তো আমি কি করব? আর এই রাবিতকে তোমার এখনই কেন খামটা দেওয়া লাগবে? স্কুল ছুটির পরও তো দিতে পারো।”

“না,না খামটা এখনই ওর বাসায় পৌঁছতে হবে। স্কুল যখন ছুটি হয় সেই সময় ওর মা বাসায় থাকে না। গত তিনদিন ধরে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই বদটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিই না।” শেষের কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “এটা কিসের খাম?”

“অভিযোগের। ওই ফাজিল ছেলেটা সারা স্কু্লের সকলকে জ্বালিয়ে বেড়ায় বলে, ভাইস প্রিন্সিপাল ওর মায়ের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন।”

“ও যদি ফাজিল হয় তাহলে তুমি কি? মিসেস হকিংস কেও তো অভিযোগ করে চিঠি লেখা উচিৎ।”

“ওহ মাহীন, আমি তো আর ওমন নেই। নিজেকে শুধরে ফেলেছি। দয়া করে আমাকে সাহায্য করো। নাহলে আমি আমার প্রোজেক্টই শেষ করতে পারব না।”

মাহীনের কপালে এবার চিন্তার ভাজ পরল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। মনে মনে ভাবল, ভাইয়ের শেখানো চার রুলস ফলো করতে হবে। চারটা নেগেটিভ না কারণ দাঁড় করাতে হবে। এক নম্বর আমি চিনি না জানি না মানুষের বাসায় যাবো না। দ্বিতীয় হলো…দ্বিতীয় কী হবে..উম…ওহ হ্যা ডেক্সটার কে সাহায্য করবো না। আর কী? বাকি দুটো কারণ কী হতে পারে?’ বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরও আর কোনো কারণ পেলো না। যেহেতু চারটা কারণ পুরো হলো না কাজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক আছে আমি যাবো কিন্তু যদি তুমি আমাকে একটা সেরকম কারণ দেখাতে পারো যার জন্য আমার তোমাকে সাহায্য করা উচিৎ তাহলে।”

মনিটরকে বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল। সেও কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলল,
‘স্টিভ জবস বলেছিল, ” যখন তুমি স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাও তখন সবকিছুকে খাপছাড়া লাগে। কিন্তু যখন তুমি সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ঘুরে তাকাও তখন সব বিন্দুগুলো অবিশ্বাস্য ভাবে একে অপরের সাথে মিলে যায়।”

মাহীন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অবাক কন্ঠে বলল, “অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে তোমার মত ধড়িবাজ আবার স্টিভ জবসের বাণীও দিতে পারে।” তারপর একটু থেমে বলল,”যা হোক। ঠিকানা দাও আমাকে।”

“কিসের ঠিকানা?

“যেখানে আমাকে পাঠানোর জন্য এত কাঠখড় পোড়ালা তুমি”।

এবার মনিটর ওর কথা বুঝতে পেরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “ঠিক আছে। লিখে দিচ্ছি।”

বলে পকেট থেকে নোট প্যাড ও কলম বের করে একটা ঠিকানা লিখে মাহীনের হাতে ধরীয়ে দিল। মাহীন মিসেস রেকে ঠিকানাটা দেখিয়ে একবার যাচাই করে নিলো যে আসলেই সঠিক ঠিকানা ও দিয়েছে কিনা। ডেক্সটার কে মোটেও বিশ্বাস নেই।

প্রায় পনেরো মিনিট পর মাহীন কড়া রোদের নিচে স্যান্টা মনিকার রাস্তার ধারের সাইড-ওয়াক ধরে হাঁটছে। কড়া রোদ থেকে নিস্তার নেই। ফুটপাথের ধারে সারি সারি রঙবেরঙের পেতুনিয়া ফুল ঝলমল করছে।
ভাবছে, ‘আমি সত্যিই বেশি দয়া দেখাতে গিয়ে একদিন ডুবে মরবো। কি থেকে কিসে ফেঁসে যাই তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমার কি এখন ক্লাস বাদ দিয়ে এই রাস্তায় থাকার কথা? কোন ছাত্র কি করসে না করসে, চিনি না জানি না তার বাসায় চলেছি অভিযোগ পত্র দিতে। সত্যিই ভাই ঠিক বলে আমার থেকে বড় নমুনা এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা থাকতে পারে না। পরিষ্কার ভাবে সবকিছু জানার পর বুঝার পরও ওই অসভ্য বদ ছেলেটাকে আমি দয়া দেখিয়েছি। সাইলোহ, নায়েল শুনলেও হাসবে।’
ভাবতে ভাবতেই বুক চিরে এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সকলে ব্যস্ত পায়ে একে অপর কে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চলার পথে চোখাচোখি হয়ে গেলে অনেকেই আন্তরিকভাবে হাসছে। মাহীন অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিনাকা অনুযায়ী এটাই সেই ছাত্রের বাড়ি। নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। মোটামুটি বড় দুইতলা সাদা বাড়ি। লাল কনক্রিটের টালি বসানো ডরমার ধাঁচের ছাদ। সামনের লোহার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। সামনে এগিয়ে গিয়ে সাদা কাঠের দরজায় কড়া নাড়ল। অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন একজন গোলাপি ফর্সা চেহারার মহিলা। তবে তার চেহারায় শেতাঙ্গদের মতো রুক্ষ ভাবটা নেই। কেমন মায়া মায়া একটা ভাব। গোল চেহারা, টানা চোখ এবং চোখা নাক। মাহীন সালাম দিল। তিনি ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে সালামের উত্তর দিলেন। তারপর সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পথ করে দিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,

“আসো মা ভেতরে আসো। তুমি নিশ্চয়ই সামোহি থেকে? কতদিন কেউ আসে না ওখান থেকে।”

মাহীন হালকা হাসল তবে ভেতরে প্রবেশ করতে দ্বিধা বোধ করছে। হয়তোবা মহিলা বুঝতে পেরেই বললেন,

“ভেতরে এসো, কোনো সমস্যা নেই।” এবার মাহীন ধীর পায় ভেতরে প্রবেশ করে জুতা খুলে রাখল। মহিলা দরজা লাগিয়ে দিলেন।

মাহীন বলল, “আপনি মিসেস দিলারা রহমান?”

মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন,
“তুমি বোধহয় নতুন মনিটর। রাবিতের ব্যাপারে কিছু?”

মাহীন মাথা উপরে নিচে ঝাকিয়ে খামটা মিসেস রহমানের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মিসেস রহমান খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,

“বুঝেছি, রাবিত আবার কোনো বদমায়েশি করেছে স্কুলে। এই ছেলেটাকে আর শুধরাতে পারলাম না।” তারপর একটু থেমে মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার বললেন, “আচ্ছা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো বসো। এবং তোমার নামটা কি?”

মাহীন বলল,”আমি মাহীন ফারুকী। এবং আসলে আমি বসতে পারব না। স্কুলে ফিরে যেতে হবে।”

মিসেস রহমান হাসি মুখে বললেন,”কিছুটা দেরি হলে সমস্যা কি? তুমি কি প্রতিদিন আসো আমার বাসায়? আজই তো প্রথম এলে।”

মাহীন ইতস্তত করে বলল,”কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে…” ওর কথার মাঝখান দিয়ে মিসেস রহমান বললেন,

“আসো আসো। আমি স্টাফড গ্রেপ লিফস বানাচ্ছি। তোমাকে খেয়ে যেতে হবে।”

মাহীন কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে এগিয়ে গেল ওনার পিছু পিছু। গিয়ে রান্নাঘরের সামনে ডাইনিং টেবিলে বসল। ডাইনিং ও রান্নাঘর আলাদা বলতে কিছু নেই। দুটো একই সাথে। ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠার সিঁড়ি। ঘরের সবকিছু সাদা এবং সোফা,পর্দা ও কার্পেট নেভি ব্লু রঙের। মিসেস রহমান সিঁড়ির পাশ দিয়ে কোনো একটা কামরায় চলে গেলেন। মাহীন একা বসে রইল ডাইনিং টেবিলে। কিছুক্ষণ পর মিসেস রহমান একজন বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। বলতে লাগলেন,

“আম্মা এটা মাহীন, রাবিতের বান্ধবী ও মনিটর। তবে ও ঘুরতে আসেনি। রাবিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র দিয়ে পাঠিয়েছে স্কুল থেকে।”

বৃদ্ধা সামনে এগিয়ে এসে নিরাশ কন্ঠে বললেন,
“আহা এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। এতটা ফাজিল তোর আশকারা পেয়েই হয়েছে।”

মিসেস রহমান নিজের চেয়ারে বসে বললেন,”আর আপনি যেন ওকে খুব শাসন করেন।”

বৃদ্ধা মাহীনের পাশের চেয়ারে বসে বললেন,”তো মা তুমিও কি সোফোমোর?”

মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “জ্বী।”

মিসেস রহমান বললেন, “তো এবার রাবিত কি অকাম করেছে?”

মাহীন ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমি রাবিতের বান্ধবী নই। এমনকি ওকে কখনো দেখিও নি। এবং মনিটরও নই। মনিটর একটা কাজে আটকে যাওয়ায় আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।”

বৃদ্ধা মিসেস রহমানের উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখেছিস তাই তো আমি ভাবছিলাম রাবিত তো ওর কোনো বন্ধু বান্ধবকে বাড়ির ত্রিসীমানায়ও আনে না। সেখানে ও বাড়ি পর্যন্ত চলে এলো কি করে।”

মিসেস রহমান ভাবালু কন্ঠে বললেন, “সেটা অবশ্য আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে।”

মাহীন হঠাৎ করে বলল,”আপনারা দোলমা বানাচ্ছেন। আপনারা কি টার্কিশ?”

মিসেস রহমান মুচকি হেসে বললেন, “না আমার স্বামী টার্কিশ। আমি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূতত।” মাহীন মাথা নাড়ল।

বৃদ্ধা বললেন, “তুই দোলমা খেয়েছিস কখনও?”

মাহীন বলল, “হ্যা, রেস্টুরেন্টে একবার খেয়েছিলাম। তবে ঘরে বানানো কখনো খাইনি।”

বৃদ্ধা ফোকলা দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন,
“তাহলে আজ না খেয়ে যেতে পারবি না।”

মাহীন ইতস্তত হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা আজ রাবিত স্কুলে আসেনি কেন?”

মিসেস রহমান বললেন,”ও স্যাক্রামেন্টোতে গিয়েছে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। গতকাল রাতে ওর বন্ধুর এক্সিডেন্ট হয়েছিল।”

মাহীন কিছু বললো না। মিসেস রহমান আবার বললেন,”আচ্ছা তুমি সম্ভবত অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছো। তোমার জন্মভূমি কোথায়?”

মাহীন বলল,”বাংলাদেশ।”

বৃদ্ধা মিসেস রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”বাহ রে তোর প্রতিবেশী দেশের মেয়ে।”

মিসেস রহমান হাসি মুখে বললেন,”ভালোই তো। আমি অবশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে অতটা জানি না। কারণ আমার জন্ম পাকিস্তানে হলেও কয়েকবছর পরই সেই যে এখানে চলে এসেছি তখন থেকে এখানেই আছি।”

মাহীন মাথা নাড়ল। তারপর বৃদ্ধার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?”

বৃদ্ধা হেসে বললেন,”কি আবার, বাবান্নেম।”

মাহীন উৎসুকভাবে বলল,”টার্কিশ ভাষা?”

মিসেস রহমান বললেন,”হ্যা টার্কিশ ভাষায় এটার অর্থ দাদি।”

মাহীন মুচকি হেসে বলল,”ঠিক আছে বাবান্নেম।” বৃদ্ধা এবং মিসেস রহমান দুজনেই হাসলেন।

তারপর আধাঘন্টা প্রায় সেখানেই বসেছিলো মাহীন। দোলমা না খাইয়ে মিসেস রহমান ছাড়েননি ওকে। পৌঁনে এগারোটার সময় ও বাড়ি থেকে বের হলো ও। সে বের হওয়ার পূর্বে মিসেস রহমান ও বৃদ্ধা এমন ভাবে মাহীনকে বিদায় দিলেন যেন আর দেখা হবে না। সাথে দোলমাও প্যাকেট করে ধরিয়ে দিয়েছেন। মাহীন সেই প্যাকেট হাতে রাস্তার পাশের সাইড-ওয়াক দিয়ে হাঁটছে। মনে হলো যেন চোখের পলকে অনেক কিছু ঘটে গেল। আজ সকালেও এমন কিছু হতে পারে তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি। এমন সময় “উই আর নেভার এভার গেটিং ব্যাক টুগ্যাদার” গানটা বেজে উঠল। মাহীন ওর সেল ফোনটা পকেট থেকে বের করে হাতে নিলো। নায়েল কল দিচ্ছে। ফোনটা ধরে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নায়েল উৎকন্ঠিত গলায় বলল,

“মাহীন তুমি এই মাঝ স্কুলের সময় কোথায় গিয়ে বসে আছো? স্কুলের কোথাও তোমাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

মাহীন বলল,”আমি স্কুলে থাকলে তবে তো আমাকে খুঁজে পাবা। আমি এক ছাত্রের বাড়িতে গিয়েছিলাম।”

নায়েল বিস্মিত স্বরে বলল, “কি একটা ছাত্রের বাড়ি? হঠাৎ কেন?”

মাহীন বলল, “আরেহ সেই ছাত্র দুনিয়ার ফাজিল। কোনো এক অকামের জন্য তার মাকে অভিযোগ পত্র দিতে গিয়েছিলাম।”

“সিরিয়াসলি মাহীন, আর ইউ ইনসেইন? মনিটরের এসব কাজ তুমি কেনো করতে যাবা?”

নায়েল থামতেই ওপাশ থেকে হুটোপুটির খটখট শব্দ হলো তারপর সাইলোর কন্ঠস্বর শোনা গেল। সম্ভবত নায়েলের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে ও।

সাইলোহ উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “মাহীন! হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুইং? তোমার কাছে না সেই ভিডিওটা এখনো আছে? তাহলে কিভাবে মনিটর তার কাজ তোমার ওপর চাপালো?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”ইটস কমপ্লিকেটেড। আমি এখন স্কুলেই ফিরে আসছি। এসে সব বলবো। এবং হ্যা ভিডিওটা এখনো আনার কাছেই আছে। আমি নিজে থেকেই এসেছি।”

সাইলোহ ওপাশ থেকে বলল, “ওফ তোমার এই উদারতা যাকে ইচ্ছা তাকে দেখাও। তাই বলে মনিটর! সেকি উদারতার মানেও বোঝে?”

মাহীন তীব্রভাবে বলল,”ওফ সাইলোহ আমি ছোট বাচ্চা নই। যা করেছি বুঝেশুনেই করেছি। আর আমি বললাম তো এসে সবকিছু খুলে বলবো।”

বলেই লাইন কেটে দিলো। তারপর ওর বুক ফেড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেল ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে আবার ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। এখন ওকে কিছুটা বিষন্নতা ঝেকে ধরল। সেই বিষন্নতা কাটানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। কাজেই মলে ঢুকে একটা মার্শমেলোর প্যাকেট কিনল। হাঁটতে লাগল কোনো ছোট বাচ্চার খোঁজে। কিন্তু রাস্তায় কোনো ছোট বাচ্চাকে একা পাওয়া গেল না। স্কুলের কাছাকাছি আসতেই একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখল স্কেট বোর্ড নিয়ে ধীরে ধীরে ফুটপাথ ধরে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। ছোট মেয়েটা নীল চোখে উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। মাহীন মার্শমেলোর প্যাকেটটা সামনে বাড়িয়ে ধরে বলল,

“আমি তোমাকে এটা গিফট করলে কিছু মনে করবা না তো?”

ছোট মেয়েটা কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। হয়তো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বুঝতে পেরে মাহীন ওর হাতে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিয়ে ঝুঁকে বসল ওর পাশে। তারপর বলল,

“তোমার নাম কী?”

“লিলি।”

“অও! নামটা কি সুন্দর স্নিগ্ধ তোমার মত। আচ্ছা আমার না খুব বিরক্ত লাগছে। মন একদম ভালো নেই। কি করব বলোতো?”

মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মাহীনের দিকে। তারপর ওর গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বলল,

“এখন মন ভালো লাগছে?”

মাহীন হেসে বলল, “অনেক!”

চলবে ইনশাআল্লাহ।