এল এ ডেইস পর্ব-৬+৭

0
168

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৬
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

সবেমাত্র তীব্র শব্দে সেই ঘন্টা বাজল যা জানান দিচ্ছে জিওগ্রাফি ক্লাস সমাপ্ত। প্রতিটা কক্ষে ছেলেমেয়েরা হইচই শুরু করে দিলো। মনে হলো যেন বন্ধ সাউন্ড বক্সে হঠাৎ করেই কেউ হেভি মেটাল রক মিউজিক উচ্চশব্দে চালু করে দিয়েছে। ক্লাস শেষ হতেই মাহীন ও সাইলোহ লকার ওয়ালা করিডরে এসে পৌঁছেছে। আরোও অনেকেই এখানে এসে ভির করছে। মেটালের চকচকে রুপালী লকারের দরজাগুলো খোলা ও বন্ধ করার ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। নায়েল কলিমোরও লকারের কাছে এসে ওদের সাথে যোগ দিল। মাহীন নিজের ব্যাগে বইখাতা গুছিয়ে রাখছে এমন সময় নায়েল নিজের লকারের দরজায় চাবি লাগিয়ে বলল,

“কি খবর জেনেট আজকেও সুস্থ হয়নি?”

সাইলোহ বলল, “ধ্যৎ তোমার স্মৃতি শক্তি বোধহয় পুরোই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভুলে গেছ আজকে লিওর নেভাডা ট্রিপ থেকে ফিরে আসার কথা? তাই জেনেট ওকে না নিতে গিয়ে ক্লাসে আসবে এটা হতেই পারে না।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল,”লিও কে?”

নায়েল বলল,”আমাদের খুব ছোট বেলার বন্ধু।”

“তাহলে তোমরা ওকে নিতে গেলে না যে?”

সাইলোহ বলল, “আমাদের শুধু বন্ধু। বন্ধুকে এত কে এরায়পোর্ট থেকে একদম নিতে চলে যায়? আর জেনেট গেছে কারণ লিও ওর বয়ফ্রেন্ড হয়।”

মাহীন এতক্ষণে বুঝতে পারল মূল ঘটনা। বলল,

“তাহলে সেদিন ও ইভেন্ট সম্পর্কে ওর যে স্মরণীয় কাহিনী আছে বলছিল, সেটাই এই কাহিনী? কিন্তু ম্যাক্সিকান কাহিনী বলেছিলা যে?”

সাইলোহ বলল, “মানে লিও হচ্ছে হাফ ম্যাক্সিকান হাফ আমেরিকান। তাই এমন বলেছিলাম।”

মাহীন উপরে নিচে মাথা নাড়ল। তখনই পকেটে মাহীনের সেল ফোনটা ভাইব্রেট হতে লাগল। বের করে হাতে নিতেই দেখে স্ক্রিনে লেখা আছে, ডিস্টার্বার। নামটা দেখেই বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। নায়েল ওর ফোনে উকি দিয়ে হেসে বলল,

“বাহ কি নাম ডিস্টার্বার কল দিচ্ছে।”

ওরা তিনজন এই কোলাহলের মাঝেই লকারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাইলোহ হেসে বলল,”ডিস্টার্বার নাম কেন দিয়েছ?”

মাহীন বলল, “সর্বদা অসময় ফোন দেয়, অথবা বলতে পারো যখনই কল দিক না কেন আমার ভালো লাগে না ওর সাথে কথা বলতে। আমি খুব ডিস্টার্ব হই, তাই এই নামে সেভ করে রেখেছি।”

তখনই নিঃশব্দে ওদের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সামনে দাঁড়াল রায়েদ। সাইলোহ ও নায়েল তো যেন ওকে দেখে চমকে উঠল। মাহীন খুব একটা অবাক হলো না। কারণ ও আশা করছিল আর্টিকেলের বিষয়বস্তুর কথা জানা মাত্র রায়েদ ওকে হারিকেন দিয়ে খোঁজা শুরু করবে। চারিদিকে উপস্থিত সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে এদিকেই চেয়ে আছে। রায়েদ কঠোর গলায় বলল,

“লাঞ্চ আওয়ারে দেখা করো। কথা আছে।”

বলেই পেছন ঘুরে কিছুটা ধীর পদক্ষেপে পা টিপে টিপে হেঁটে যেতে লাগল। অনেকে বুঝতে পারল না ও কাকে এই কথাটা বললো। কারণ রায়েদ সরাসরি সাইলোহ, নায়েল ও মাহীনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং এটাও বলে যায়নি কোথায় দেখা করতে হবে। তবে সবাই জানে কোথায় দেখা করতে হবে। সাইলোহ মাহীনের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আচ্ছা চলো আমি তোমাদের সব ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলছি।”

তারপর ব্যাগ কাধে নিয়ে ধীর গতিতে হাঁটতে লাগল। প্রথমে মাহীন র‌্যবিটকে ভিজিয়ে দেওয়ার কাহিনী টা শোনাল। ফলে দেখা গেল সাইলোহ ও নায়েলের জন্য হাসতে হাসতে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহীন স্মিত হেসে বলল,

“কিছু হাসি বাঁচিয়ে রাখো। গতকালের ঘটনা এখনো বাকি আছে।” এরপর ও মনিটরের ঘটনাটা খুলে বলল। ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নায়েল ও সাইলোর চোখ ছানাবড়া হয়ে থাকল। ওদের চেহারা দেখে মাহীনের বলতে গিয়ে বারবার হাসি পাচ্ছিল। নায়েল বলল,

“একমিনিট আমি এটা বুঝলাম না, প্রথম দিন এসেই তুমি চিন্তা না জানতেও না এমন একজনের ভিডিও কেন করলা?”

মাহীন শ্রাগ করে বলল, “আমার ওকে দেখেই মনে হয়েছিল ও এক নম্বর ধড়িবাজ। তাই একটা প্রমাণ হাতে রাখলাম কখনো না কখনো কাজে লাগতে পারে ভেবে।”

সাইলোহ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, “ইশ এখন আর মনিটরের অক্ষরে অক্ষরে আদেশ পালন করতে হবে না। বরং আমরা ওকে আমাদের কথা মতো চালাতে পারব।”

নায়েল বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, এবার তাড়াতাড়ি বলো রায়েদ মাদির ঘটনা টা কি? তুমি ওর সাথে কিভাবে জড়িয়ে গেলা?”

মাহীন বলল, “আসলে ও আমার ইভেন্ট পার্টনার।”

ওদের দুজনের মুখেই বিস্ময় স্থান নিল। সাইলোহ বিস্ময়ান্বিত কন্ঠে বলল, “আর তুমি এখনো ইভেন্টে আছ!”
মাহীন ভাবলেশহীন মুখে বললো,”অবশ্যই।” ওর যেন একই কথা শুনতে শুনতে ইতোমধ্যেই অভ্যেস হয়ে গেছে।

সাইলোহ বলল, “একমিনিট তুমি ঠিকঠাক সব খুলে বলো।”
মাহীন ঘটনাটা বিস্তারিত বলার পর নায়েল ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,
“এই তুমি সাথে সাথে মসলা পাতি নিয়ে ঘোরো কেন বলোতো? আর তোমার সাহস কি, রায়েদের কফিতে লবণ ঢেলেছ। অন্য কাউকে বললে এটা তারা বিশ্বাসই করবে না।”

মাহীন মুখ টিপে হাসল। বলল, “মসলা পাতি তো নিরাপত্তার জন্য নিয়ে ঘুরি। আর ও যখন কফিটা অবশেষে খেয়েছে। আমাকে তেমন ভাবে কিছু বলার আগেই আমি কথা ঘুরিয়ে সেখান থেকে কেটে পরি।”

সাইলোহ এখনো হা করেই চেয়ে আছে।কি বলবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না।

মাহীন বলল, “আর মিসেস রে এতটা স্নেহের সঙ্গে রায়েদের সাথে কথা বললেন, যে আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”

সাইলোহ এবার মুখ বাঁকা করে বলল,”ধ্যৎ বাজে একটা মহিলা। স্কুলের সবচাইতে খারাপ ছেলে রায়েদ মাদিহ। আর মহিলার দুনিয়ার সকল ছেলে – মেয়েকে মিচকা শয়তান লাগে এবং একলা রায়েদকে ধোঁয়া তুলসি পাতা লাগে। ওর জন্য কি যে দরদ উতলে পরে আহা দেখলে গা জ্বলে।”

মাহীন হাসি এবং কান্নার মাঝামাঝি একটা মুখভঙ্গি করে রাখল কারণ ও বুঝতেই পারছে না এই কথা শুনে হাসা উচিৎ নাকি কাঁদা উচিৎ।

নায়েল বলল, “এই সবগুলোর এই একটাই সমস্যা। ডেক্সটার মনিটর এত ভাব নিয়ে চলে কারণ ওর মা আমাদের টিচার। এবং রায়েদ মাদিহ এমনি এমনি কাউকে জ্বালায় না ঠিকই। কিন্তু ওর এত দেমাক হওয়ার কারণ বলা যায় মিসেস রেকে।”

ওরা দুই তলার খোলা করিডোরের প্রসস্থ কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসেছে। মাহীন বলল,
“আচ্ছা আগে এটা বলো রায়েদ মাদির সমস্যাটা কেথায়? এমন করে কেন ও?”

সাইলোহ বলল, “কারণ ও এমনই। সমস্যা আবার কি থাকবে।”

মাহীন বলল, “আমি মাত্র একবার কথা বলে যতটুকু বুঝেছি তা হলো, একটা মানুষ মন থেকে খারাপ হলে তার আচরণ অতটাই খারাপ হতো। তবে ও নিজেকে সবার সামনে খারাপ হিসেবেই উপস্থাপন করার জন্য ইচ্ছা করেই এমন আচরণ করে। ” বলে একমুহূর্ত থামল তারপর আবার বলল,”তবে একথা বলতে হবে এই ছেলের অহংকার বড্ড বেশি।”

নায়েল বলল,”তাই বলে টানা বছরের পর বছর ধরে মানুষ শুধু তেমনই অভিনয় করে যাবে যেমনটা সে আসলে নয়? এটা কি সম্ভব? আর প্রতিটা মানুষ চায় ভালো হতে। সকলের সামনে নিজেকে ভালো হিসেবে উপস্থাপন করতে। সেখানে কেন কেউ নিজেকে ইচ্ছে করে খারাপ হিসেবে দেখাতে চাইবে।”

নায়েল থামতেই সাইলোহ বলল, “এবং শুধু মাত্র নিজেকে খারাপ হিসেবে দেখানোর জন্য তো আর কেউ নিজেকেই আঘাত করতে পারে না তাই বলে। তুমি তো নতুন এখানে তাই এখনো দেখোনি। গত বছর এবং তার আগের বছরও ওর বিল এবং ডেনিজের সঙ্গে মারামারি লেগে গিয়েছিল।’ বলে থামল সাইলোহ।

ততক্ষণাৎ নায়েল বলল, “আর অহংকার! সারাদিন বই খাতা নিয়ে বসে থাকে। ফলে সকল টিচারদের চোখের মধ্যমনি। রেজাল্টও ভালো করে। অহংকার থাকবে না।”

ওদের যুক্তি এই মুহূর্তে অকাট্য ঠেকল মাহীনের কাছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,

“তোমরা দুজনই যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছো। এবং আমি এটাও বলিনি যে ও ভালো মানুষ। শুধু এটা বলছিলাম যে ওর এমন হওয়ার পেছনে কি কোনো কারণ আছে?”

সাইলোহ রেলিঙের ওপর থেকে ধপ করে নিচে নেমে বলল, “কারোর খারাপ হতে হলে কারণ লাগে না। বিকৃত মস্তিষ্কই যথেষ্ট।”

তারপর নায়েল বলল,”যাই হোক। একটা কথা না বললেই নয়। মাহীন তোমাকে অনেক কুল লাগসে আমার। স্কুলে আসলা তিন দিনও পুরো হলো না এর মধ্যেই অসভ্য মনিটরটকে হাত করে ফেলসো। অভদ্র রায়েদকে কৌশলের সঙ্গে লবণাক্ত কফি খাইয়েছ। এবং ফাজিল ‌‌র‌্যবিটটাকে শায়েস্তা করেছ।”

সাইলোহ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, “একদম! আমি তো ওকে প্রথম দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম। মাইয়া সেই লেভেলের স্যাভেজ।” মাহীন হেসে উঠল ওদের কথায়।

লাঞ্চ ব্রেক শুরু হয়েছে সবেমাত্র। এবং মাহীন ইতোমধ্যেই লিম জু কে খুঁজে বের করেছে। লিম জু অসহায় কন্ঠে বলছে,
“দেখো আমার সাইকোলজি নিয়ে ধারণাই নেই। এখন মানলাম তোমার কথা যে তুমি গতকাল আমাকে ফোন করেছিলা ব্যপারটা সম্পর্কে মতামত নিতে। কিন্তু তবুও শুধু তুমি হলে একটা কথা ছিলো। রায়েদ মাদির সঙ্গে এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে যেটা নিয়ে আমি কিছুই জানি না। ব্যাপারটা ঠিক গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।”
মাহীন ও লিম জু ক্যাফেটেরিয়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
মাহীন বলল,
“আচ্ছা গতকাল কি তুমি আমার কল রিসিভ করেছিলা?”

লিম জু বলল, “রিসিভ করলে তো তুমি জানতেই পারতে। আমি তখন ফোনের কাছাকাছি ছিলাম না।”

মাহীন বলল, “আচ্ছা চলো আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।”
লিম জু প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো।
মাহীন আবার বলল,
“দেখো আমি তো জানি সাইকোলজি সম্পর্কে এটাই যথেষ্ট। এবং রায়েদ এ সম্পর্কে জানে কি না সে ব্যাপরে আমরা নিশ্চিত নই। তাছাড়া আমরা দুজন এবং ও একা। তাই তো বলছি যে আমি যদি একাই ওর সাথে তাল মিলিয়ে তর্কাতর্কি করতে পারি তাহলে তো তুমি থাকলে আরোও ভালো।”

লিম জু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইল। মাহীন ওকে কথার কৌশলে ফেলে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ওরা চত্বরে রয়েছে। রোদের তেজ কিছুটা কম। বাতাসে আদ্রতাও কম। মাহীন বলল,

“আর ও তোমাকে কিছু বললে সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এবং হ্যা এরপরের কাজের সময়গুলো কিন্তু আমরা আমাদের সুবিধা অনুযায়ী ঠিক করবো।”

লিম জু ম্লান বলল, “না জানি তোমার পাল্লায় পরে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যাবো।”

মাহীন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “এসব নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকো তুমি। আর হ্যা আরেকটা জিনিস, ওর যেন ঘুনাক্ষরেও এটা না মনে হয় যে, আমরা ওর সাথে এই ইভেন্টে কাজ করার জন্য মরে যাচ্ছি। এমন একটা ভাব থাকবে আমাদের মাঝে যে, ইভেন্টে কাজ করতেই হবে এমন কোনো বালাই নেই আমাদের। ও বেশি গুঁইগাই করলে আমরাও কাজ করবো না।”

লিম জু সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। ওরা লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ে পৌঁছে গিয়েছে। তিনতলায় উঠে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। গতকালের মত আজও কোণার সেই টেবিল জুড়ে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে রায়েদ মাদিহ। চোখে কালো ফ্রেমের চিকন চশমা। ওদের আসতে দেখে একবার মুখ তুলে চাইল। ওর স্থির দৃষ্টিতে স্পষ্ট গম্ভীরতা। আবার দৃষ্টি বইয়ের দিকে ফেরাল। মাহীন ওর সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরল। লিম জু প্রথমে দ্বিধান্বিত হয়ে একবার মাহীনের দিকে চাইল, একবার রায়েদের দিকে চাইল এবং একবার কাঠের চেয়ারের দিকে চাইল। তারপর মাহীনের পাশের চেয়ারে বসে পরল। রায়েদ সরাসরি মাহীনের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
“তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে ফোন দেওয়ার!”

মাহীন কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। হঠাৎ এমন ভাবে এই প্রশ্ন করবে তা আশার বাইরে ছিল। তবে ধাতস্থ হয়ে নিরুত্তাপ কন্ঠে বললো,
“আমার কোনো শখ ছিল না তোমাকে ফোন দেওয়ার। সেটা তো মিসেস রে এর কড়া নির্দেশ ছিল বিধায় বাধ্য হয়ে করেছিলাম।”

“এবং ভুল করেও আমার নম্বর যদি কাউকে দিয়েছো তাহলে ভালো হবে না। বলে দিলাম।” তীব্র কন্ঠে বলল রায়েদ।

মাহীন ভারি কন্ঠে বলল, “ফোন তো তুমি রিসিভ করোই নি তাহলে এত রেগে যাওয়ার কি আছে। সে যাই হোক একটা কথা বলি, তোমার নম্বর আমাদের স্কুলের সামনে যদি বিলবোর্ডেও সোভা পায় তবুও ভুল করেও কেউ তোমাকে ফোন দিবে না।” শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।

রায়েদ ভ্রু কুঞ্চিত করল। তারপর বলল, “দ্বিতীয় বার আর আমাকে কখনো ভুলেও ফোন দিবা না। মনে থাকে যেন।”

মাহীন সুর করে বলল, “ধরো আমি কোনো বিপদে পরেছি। এবং একমাত্র তোমার নম্বরটাই আমার মোবাইলে থাকলেও কখনো ফোন দিবো না। কথা দিলাম।”

লিম জু অপ্রতিভ ভাবে বলল, “আমার মনে হয় আমাদের আর্টিকেল নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল।”

রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “ওহ হ্যা সেটা তো আছেই। তুমি কি হিসেবে বিষয়বস্তু সাইকোলজি ও মেন্টাল হেলথ্ ডিসওর্ডার দিয়ে দিলা?”।

মাহীন বিদ্রুপ করে বলল, “সেটাই তো আমাকে জিজ্ঞেস করা তোমার মুখে সোভা পায় না রায়েদ। এক মিনিটেরও কম সময় পূর্বেই তুমি আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়েছ একটা মাত্র ফোন কলের জন্য। এরপর তোমার যেন বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে সে জন্যেই তো কল করেছিলাম।”

রায়েদ বিরক্তি ভরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এবার শান্ত তবে ভারি কন্ঠে বললো,
“এখন তোমার মহামান্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে খুলে বলো।”

“কি খুলে বলবো? সাইকোলজি কিংবা মেন্টাল হেলথ্ নামটা শুনলেই সকলেই বুঝতে পারবে বিষয়টা কি।

” সাইকোলজি কি আমি সেটা জিজ্ঞেস করিনি। এই বিষয়টা নেওয়ার পেছনে যুক্তিটা কি এটাই ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করছি।” তিক্ত কন্ঠে বললো রায়েদ।

মাহীন মনে মনে ভাবলো, ‘আসলেই এখন পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কথা বলছে।’ তারপর ধীরস্থির ভাবে বলতে শুরু করল,
“তো শোনো, কারোর শারীরিক কোনো ক্ষতি হলে বা অসুস্থ থাকলে তো সেটা শুধু সে কেন সকলেরই চোখে পরে। তবে কেউ মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকলে সেটা কারোও চোখে পরে না। এমনকি কোনো মানসিক ডিসওর্ডার হলে তো ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারে না। এবং ইউএসএ তে মানসিক রোগীর হার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মোতাবেক মানসিক সমস্যার দিক থেকে আমেরিকা বিশ্বের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। তার কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশগত সমস্যা, জিনগত সমস্যা বা শারীরিক সমস্যা। এখন আমার যুক্তি হলো, আমাদের আশেপাশে টিনএজ ছেলেমেয়েদের ডিপ্রেশন বা মানসিক সমস্যার মূল কারণ পারিবারিক সমস্যা, পিতা-মাতার বিচ্ছেদ এবং ব্রেকআপ, চিট। যা চারিদিকে অহরহ দেখা যায়। আমি জানি আমাদের মধ্যে অনেকেই এসব নিয়ে সোচ্চার। এসব নিয়ে অনেক সংস্থা রয়েছে, অনেক ম্যাগাজিন রয়েছে। তবুও কি খুব একটা খারাপ বিষয় আর্টিকেলের জন্য?” বলে থামল ও। একটা লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিল।

লিম জু ততক্ষণাৎ উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,”বাহ এসব নিয়ে তো চিন্তা করার কথাও আমার মাথায় আসেনি। এখন আমার ইচ্ছে করছে এই বিষয়টা নিয়েই কাজ করতে।”

রায়েদ কাঠখোট্টা ভাবে বলল, “এত লাফালাফি করার কিছু নেই।”

এতেই লিম জুর মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। রায়েদ শান্ত কন্ঠে বললো,
“ঠিক আছে। তবে আজ আর কাজ করার সময় নেই।”

লিম জু বলল,”আগামীকালও ক্লাস রয়েছে।”

মাহীন বলল,”পরশু তো উইকেন্ড। তাহলে পরশুদিন আমরা কাজ শুরু করতে পারি।”

রায়েদ বলল,”বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত।”

মাহীন বলল,”ঠিক আছে। এবং আমি সাথে করে কয়েকটা সাইকোলজি বই নিয়ে যাব।”
রায়েদ উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে পা টিপে টিপে বাম পাশের সেলফগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,

“তোমার পায়ে কি ব্যথা?”

রায়েদ গম্ভীরস্বরে বলল, “হুম।”

মাহীন আর কিছু বলল না। মোট ছয়টা ভারি ভারি বই হাতে নিয়ে ফিরল রায়েদ। বইগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রেখে কঠোরভাবে বলল,

“এর মধ্যে থেকে যেটা নেওয়ার নাও।”

মাহীন মনে মনে ভাবলো, ‘আশ্চর্য এমন ভাবে বলছে যেন লাইব্রেরিটা ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এখানেই সারাদিন পরে থাকে বলে নিজেকে কি ভাবে আল্লাহই জানে। যেই বই ইচ্ছা সেটাই নিব আমি। ও কে বাঁধা ধরা করে দেওয়ার?’তবে এই মুহূর্তে তার তর্ক করার সময় নেই বিধায় মুখে বললো,

“তো পরশুদিন আমরা বিকেলে কোথায় আলোচনায় বসবো?”

রায়েদ বলল, “কোথায় আবার এখানেই।”

লিম শুকনো কন্ঠে বলল, “ছুটির দিনেও এই স্কুলে আসতে হবে?”

রায়েদ শীতল কন্ঠে বলল,”ক্লাস না হলেও ক্যাম্পাস খোলাই থাকে। প্রতিদিন আসছি তো পরশুদিন আসতে সমস্যা কি?”

মাহীন উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে।”

লিম জু সায় জানিয়ে বলল,”আমারও সমস্যা নেই।”

প্রায় এক ঘন্টা পর। মাহীন ও নায়েল ল্যাটিন ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। এবং সাইলোহ এই ক্ষেত্রে স্প্যনিস ক্লাসে রয়েছে বলে ওদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।
আরোও একটা ক্লাস বাকি। তারপর ছুটি হয়ে যাবে। লম্বা খোলা করিডোর ধরে সাইলোহ ছুঁটতে ছুঁটতে এগিয়ে আসছিল ওদের দিকে। এবং ঠিক মাঝের করিডর দিয়ে ‌র‌্যবিট খোলা করিডোরে প্রবেশ করতেই সাইলোর সঙ্গে ঢাক্কা খেল। দুজনেই কোনোক্রমে তাল সামলে নিল। আরেকটা বাদামি চুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে র‌্যবিটের পেছনে। সাইলোহ ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

“সমস্যা কি তোমার! তোমার জন্য আরেকটু হলে আমি পরে যাচ্ছিলাম।”!

র‌্যবিট তিক্ত কন্ঠে বললো, ” আশ্চর্য ছুটতে ছুটতে আসছিলা তো তুমি। আর এখন দোষ আমার?”

নায়েল বলল, “এক মিনিট। এক্ষেত্রে দোষ কারোরই নয়। কারণ দুজনেই দুজনের আড়ালে ছিল।”

র‌্যবিটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল,”র‌্যবিট তাড়াতাড়ি চলো। ড্রাগ স্টোর পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে।” র‌্যবিট সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

সাইলোহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল, “এখনো একটা ক্লাস বাকি আছে। আর তুমি ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার ফন্দি করছ?”

ওরা পাঁচজন জট পাকিয়ে একসাথে করিডোরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ওদের পাশ কাটিয়ে আসা যাওয়া করছে।

র‌্যবিট বলল, “মরার শিক্ষার্থী সব! কারোও কাছে একটা ফার্স্টএইড কিট নাই। কিন্তু আমার লাগবেই লাগবে। তাই তো ক্লাস যেন ফাঁকি দিতে না হয় বলে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছি।”

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল, “আমার কাছে আছে ফার্স্ট এইড কিট।”

র‌্যবিট মাহীনের দিকে চাইল। বলল, “আরেহ তুমিই তো আজকে আমার ওপর অসময়ে বৃষ্টি ঝড়িয়েছ।”

নায়েল বলল,”র‌্যবিট ও অতি দরদ দেখিয়ে তোমাকে ফার্স্ট এইড কিটটা দিতে চাচ্ছে এটাই কি বেশি নয়?”

র‌্যবিট বিরশ কন্ঠে বলল,” আচ্ছা ঠিক আছে দাও।”

মাহীন নিজের ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরল। সাইলোহ টিটকারির সুরে বলল,

“বাহ আজ এই নিয়ে তৃতীয় বার মাহীনের ফার্স্ট এইড কিটটা ব্যবহার হতে যাচ্ছে। তাও আবার তিন বারই র‌্যবিটের সুবাদে।”

মাহীনের নাম ধরে বললেও কথাটা ও র‌্যবিটকে উদ্দেশ্য করে বলল। মাহীন বক্সটা বের করে র‌্যবিটের হাতে দিতেই ও সেটা নিয়ে প্রায় ছুটে চলে গেল। তার সাথে ওর বন্ধুও ছুটলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৭
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য চারিদিকে প্রবলভাবে উত্তাপ ও আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে গরমে কাহিল দশা মোটামুটি সবারই। কদাচিৎ এক দমকা হাওয়ার ঝাপটা অসংখ্য তাল গাছগুলো কে মৃদু দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছাপালা দুলে উঠছে। তবে এক দন্ড শীতলতার ছোঁয়া রপ্ত করার পূর্বেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে বাতাস। তাই তো গরম থেকে নিস্তার নেই। অনেকে আশঙ্কা করছে, অতিরিক্ত গরমের প্রভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার সবুজ পর্বত সমূহ ও বনাঞ্চলগুলোতে দাবানল শুরু হতে পারে। মাহীন কিছুক্ষণ পূর্বে স্কুলে পৌঁছেছে। সাইকেল পার্কিং-এ রেখে প্রথমে ব্যাগ থেকে অন্যান্য বইখাতা গুলো লকারে রেখে এসেছে।এখন সবেমাত্র সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উপরে উঠছে। দুইতলায় পৌঁছতে হবে ওকে। দুইতলায় উঠে খোলা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতেই দেখল পাশের কনক্রিটের প্রসস্থ রেলিঙের ওপর নায়েল বসে আছে সাথে আরেকটা ছেলে। ছেলেটার সোনালি ঝাঁকড়া চুল, নীল ছোট চোখ। তার শরীরে বোধহয় মেলানিয়াম একটু বেশিই কম, ফলে চোখের পাপড়ি ও ভুরুর রঙ্গ কিছুটা সোনালির পর্যায়ে। ছেলে মেয়েরা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। নায়েল মাহীন কে দেখা মাত্র রেলিঙ থেকে লাফ দিয়ে নামল। সঙ্গের ছেলেটিকেও সাথে করে টেনে এনে মাহীনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,
“এই হচ্ছে আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু লিওনার্দো হায়েস।”

লিও স্মিত হেসে বলল,
“আর তুমি ম্যহীন ফারুকী। নতুন করে চেনার কিছুই নেই। গতকাল থেকে সাইলোহ এবং নায়েল তোমাকে নিয়ে এত ঘটনা শুনিয়েছে যেন তুমি যুগ যুগ ধরে এখানেই পড়ছ।”

মাহীন মুচকি হেসে বলল,”তিন দিনেই অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।”

লিও বলল,”মাত্র সাত দিনের নেভাডা ট্রিপে না গেলেই সব সচক্ষে দেখতে পেতাম।”

নায়েল বলল,”ধ্যৎ আমরাও কিছু দেখিনি। সব ওর মুখেই শুনেছি।”

লিও বলল,”আচ্ছা চলো ক্লাসে গিয়ে বসো। তুমি তো বোধহয় অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছো।”

মাহীন ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,”তা তো হয়েছিই।”

ক্লাসে প্রবেশ করতে করতে লিও নায়েলকে উদ্দেশ্য করে বলল,”বাইশ তারিখ শওন ম্যান্ডেসের এলএ তে কনসার্ট আছে। তবে টিকেটের দাম ২১৫ ডলার। চিন্তা করতে পারো?’

নায়েল বলল,”এটাই তো আমাদের বেরোজগার ছাত্রদের সমস্যা। একটা টিকেট কিনতেই হিমশিম খাই। ভাবছি এখন থেকে কোনো পার্ট টাইম জব করব।’

মাহীন জানালার পাশের নিজের চেয়ারে বসল। বলল,”কেন তোমরা কখনো কারোও কনসার্টে যাওনি?”

নায়েল আফসোস ভরা কন্ঠে বলল,”নাহ আমার সেই ভাগ্য নেই।”

লিও বলল,”আমি একবার গিয়েছিলাম। জেনেট ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল আরকি কারণ ওটা ডেমি লোভাটোর কনসার্ট ছিল।” মুখটা বেজার করে বলল ও।

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “ডেমি লোভাটোকে দেখতে পারো না মনে হচ্ছে।” লিও সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

নায়েল বলল, “তোমার প্রিয় গায়ক কে?”

মাহীন বলল,”টেইলর সুইফট।”

তখনই সাইলোহ ও জেনেট ক্লাসে প্রবেশ করল। ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সোজা মাহীনের পাশের টেবিলের

ওপর উঠে বসল। জেনেট উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো, “ওহ মাহীন তুমি সেই রকম কুল। র‌্যবিটের কাক ভেজা অবস্থাটা আমি শুধু কল্পনা করতে পারি।”

সাইলোহ বলল, “তোমাদের দেখি ইতোমধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে।”

লিও হেসে বলল, ‘অনেকটা সেরকমই।’

জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, “আচ্ছা কেমন হয় যদি আমরা মাহীন কে নিয়ে ভে…”

সাইলোহ মাঝখান দিয়ে বলল, “দয়া করে ভেনিস বিচের কথা বলো না।”

জেনেট বিরশ কন্ঠে বলল,”আমি তো সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম।”

লিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”ওফ জেনেট, বারবার একই জায়গায় যেতে আর ভালো লাগে না। ওখানে এতবার যাওয়া হয়েছে যে একেকটা বালুকণা কেও চিনি আমি।”

নায়েল বলল, “এখানকার বাসিন্দারা তো ভেনিস বিচের বালুতে গড়াগড়ি খেতে খেতে আর সাগরে ভাসতে ভাসতেই বড় হয়ে যায়। সেখানে আবার ঘুরতে যাওয়ার কি আছে?”

জেনেট ভারি বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, “ধ্যৎ আমি জানতাম তোমরা এমনই করবে। কিন্তু এবার কথা হচ্ছে মাহীনকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে। সুতরাং মাহীন বলবে আমরা যাবো কি যাবো না। তাই না মাহীন?”

মাহীন দ্বিধান্বিত হয়ে একে একে চারজনের দিকেই চাইল। ওরা উৎসুক দৃষ্টিতে মাহীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহীন ইতস্তত করে বলল,

“আমাকে যেখানেই নিয়ে যাও না কেন সব জায়গায়ই আমার জন্যে নতুন।”

জেনেট সঙ্গে সঙ্গে তুরি বাজিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“এইতো আমরা তাহলে ভেনিস বিচেই যাচ্ছি।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কবে?”

“কবে আবার আজকে।”

সাইলোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেনেট কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ঠিক আছে কিন্তু মনে রেখো আমরা মাহীনের জন্য যাচ্ছি। তোমার জন্যে নয়।”

লিও বলল, “আচ্ছা চলো আজকের বিকেলেই যাই।”

মাহীন চোখ বড় বড় করে বলল, “এই এক মিনিট। আমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে প্রথমে।”

নায়েল বলল, “কি? কিন্তু কেন? আমাদের সাথে বাইরে গেলে কোনো সমস্যা?”

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল, “না,না বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। আসলে আমার মা আমাদের জন্য খুব বেশিই চিন্তা করেন। এমনকি সাইকেল কেনার আগ পর্যন্ত আমাদের বাসার বাইরে একা বের হতেই দেননি।”

জেনেট বলল, “সত্যিই অবাক করা বিষয়।”

সাইলোহ বলল, “মাহীন তোমার…”

মাহীন মাঝখান দিয়ে বলল, “না, না এবার আর মাকে ফোন দিও না।”

সাইলোহ হেসে বলল,”নাহ এবার আর মোবাইল নয়। এবার তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও।”

মাহীন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মার্কিনীদের সংকোচবোধটা বোধহয় একটু কমই আছে। আজকের প্ল্যান আজই করে। চেনা পরিচিত হলো কী হলো না তার ঠিক নেই কিন্তু বাড়ি গিয়ে হাজির ঠিকই হতে পারবে। মাহীন ইতস্তত করে বলল,

“টুয়েন্টি ফোর নাম্বার স্ট্রিট, হাউজ নাম্বার সেভেন, মন্টানা এভ।”

নায়েল মুচকি হেসে বলল, “বিষয়টা অদ্ভুত যে, তুমি যতসব ডেয়ারিং কাজকারবার করে বেরাও। আর বাইরে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের কথা মনে পরেই কপালে ভাজ পরে।”

মাহীন বিচলিত ভাবে বলল, “তোমরা বুঝবানা ব্যাপারটা।”

বিকেল হওয়ার সাথে সাথেই সূর্যের আলোয় নিস্তেজতা নেমে আসছে। উত্তপ্ত রোদের বদলে সুপ্ত মিষ্টি কিরণ ছড়াচ্ছে সূর্য। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। পাড়ার ছেলে মেয়েরা বাইরে বেরিয়েছে, কেউ সাইকেল নিয়ে, কেউ স্কেট বোর্ড নিয়ে আবার কেউ পায়ে হাঁটছে। পার্কগুলো ছেলেমেয়েদের কলরবমূখর হয়ে উঠেছে। মাহীন নিজের কামরায় আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। ছোট কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলোয় কোনো জট না থাকা সত্ত্বেও বারবার চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে। চুল আঁচড়ানো শেষে বাদামি কুর্তির ওপর একটা কালো রঙ্গের স্রাগ পরে নিয়ে, এক কানে একটা পাথরের টপ পরল। ওর হ্যামস্টার সোনালি খাঁচার ভেতর থেকে কুই কুই করে ডাকল। মাহীন সেদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,

“নাহ তোকে সাথে নিব না। তুই লাফ দিয়ে পানিতে পরে যাস তখন তোকে কে বাঁচাবে?’

“চি চি”

‘আরেহ পানিতে সিহর্স দেখাতো পরের কথা। আগে তোকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে।’
তারপর কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিচে নেমে গেল। মিসেস নাসরিন বেড রুমে নিজের বিছানায় বসে বই পরছেন। নাইম ও মি.মোর্শেদ কেউই বাসায় নেই। মাহীনের বাসায় একা একা ভালো লাগছে না বলে ড্রইংরুমের স্লাইডিং ডোরটা খুলে প্যাটিওতে এসে দাঁড়াল। সামনের বাগানে একটা স্যাকামোর ট্রি রয়েছে। এখানে রয়েছে একটি ক্র্যাবএপোল গাছ। সাদা সাদা ডেইজি,বর্ণিল পেতুনিয়া, হালকা গোলাপি, বেগুনি, কমলা গোলাপ এবং জুঁই ফুলের সুবাস মিলেমিশে একাকার অবস্থা। একপাশে একটা ছোট হাইড্রেন্জিয়ার ঝাড়ও রয়েছে। এবং বাগানের ভেতরেও একটা তাল গাছ না থাকলেই নয়। বিকেলের সোনাবরণ রোদের খানিকটা ছুঁয়েছে মাহীনের চুল ও গাল।

“কিরে তুই বাগানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস যে?”

হঠাৎ মিসেস নাসরিনের কন্ঠে চমকে উঠে মাহীন। পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে মিসেস নাসরিন ড্রইংরুমে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাহীন ভেতরে এসে বলল,

“ভালো লাগছিল না তাই বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।”

তারপর একটু থেমে বলল, “আচ্ছা কেমন হয় যদি আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসি?”

মিসেস নাসরিন বললে, “এইসময় আবার বাইরে একা যাবি? তুই তো রাস্তাঘাট কিছুই চিনিস না। কোথায় যাবি?”

“যদি আমার বন্ধুদের সাথে যাই?”

মিসেস নাসরিন সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন,”ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “দুজন ছেলে, দুজন মেয়ে।”

“এত তাড়াতাড়ি তুই এদের কোথা থেকে জোগাড় করলি?”

“স্কুল থেকে। আমি জানি না কিভাবে যেন আমার বন্ধু হয়ে গেছে ওরা।”

“এখন তুই ওদের ফোন দিবি, তারপর কে কি করছে না করছে সেসব ছেড়ে তোর সাথে ঘুরতে যাবে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।”

তখনই কলিং বেজ বেজে উঠল। মাহীন মুচকি হেসে বলল,

“ওরা এসেছে গেছে।”

বলেই দরজার দিকে ছুটে গেল। দরজা খুলতেই দেখল নাইম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীনকে হাসি মুখে দরজা খুলতে দেখে নাইম অবাক হয়ে বলল,

“কিরে তুই দেখি আমাকে হাসি মুখে বরণ করছিস। কি কুমতলব পাক্কাচ্ছিস তুই?”

মাহীন ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, “তোর রুমে আজ না গেলেই তোর জন্য এবং আমার জন্য দুইজনের জন্যেই ভালো।”

নাইম বাসার ভেতর প্রবেশ করে বলল, “এই তুই আমার রুমের কোনো সর্বনাশ করিস নি তো!”

বলেই জুতা খুলতে ব্যস্ত হলো। এরপর হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মাহীন দরজার বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দেখল, সাইলোহ, জেনেট, নায়েল ও লিও বড় গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। ওদের দেখে ও বাইরে বেরিয়ে গেল। গেটের বাইরে একটা কালো রঙের টেসলা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ওরা সামন-সামনি আসতেই নায়েল হাসি মুখে বললো,

“বাহ তুমি দেখি তৈরি হয়ে দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে আছ।”

মাহীন বলল, “না, তা নয়। আমার ভাই মাত্র বাড়ি ফিরল তাই।”

জেনেট বলল, “তোমার এক কানের টপ বোধহয় পরে গিয়েছে।”

মাহীন বলল, “না, আমি এক কানেই টপ পরেছি। আচ্ছা চলো ভেতরে গিয়ে একবার আমার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”

লিও বলল, “হ্যা। চলো,চলো।”

ওরা পাঁচজন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। মিসেস নাসরিন এখনো সোফায়ই বসে আছেন।

ওরা সকলে সমস্বরে বলল, “হ্যালো আন্টি।”

হঠাৎ এতগুলো ছেলেমেয়ের আগমনে একটু চমকে উঠলেন তিনি। প্রস্তরীভূত হয়ে চেয়ে রইলেন।

সাইলোহ বলল, “আমরা মাহীনকে নিতে এসেছি।”

মিসেস নাসরিন হঠাৎ ওদের কে এখানে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছেন। দ্বিধান্বিত হয়ে চেয়ে আছেন।

নায়েল বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা ওকে দেখে রাখব।”

হঠাৎ করেই মাহীনকে বিরক্তি পেয়ে বসল। কিছুটা রাগও হলো নিজের ওপর। এ পর্যায় মনে হচ্ছে যেন, ও কোনো বাচ্চা মেয়ে। এবং একদল আত্মনির্ভরশীল বড় মানুষ দায়িত্ব নিয়ে ওকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বড়ই বিরক্তিকর লাগল। তাছাড়া ওরাও কি ভাবছে তা নিয়েও ওর মনে প্রশ্ন জাগল। ছিঃ কী অস্বস্তি! কী লজ্জা!

মিসেস নাসরিন ইংলিশে বললেন, “আচ্ছা সমস্যা নেই। কিন্তু তোমরা যাচ্ছ কোথায়?”

লিও বলল, “ভেনিস বিচে। এখান থেকে বেশি দূর নয়।”

মাহীনের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাড়াতাড়ি বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা গেলাম।”

বলেই পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। এবং মিসেস নাসরিনকে বিদায় জানিয়ে বাকিরাও বাইরে বেরিয়ে আসল। মিসেস নাসরিন সেল ফোনটা হাতে নিয়ে গুগলে ভেনিস বিচ লিখে সার্চ দিলেন। এবং একটু ঘাটাঘাটির পর ভাবলেন,

“জায়গাটা তো এখান থেকে বাইশ মিনিটের দূরত্বে। এত দূরে যাচ্ছে এরা। আর সাইলোহ মেয়েটাই তো সেদিন আমাকে ফোন করেছিল। আশা করি ওর ওপর ভরসা করা যায়।’

” মাহীন কোথায় তুই!”
নাইমের কন্ঠে চমকে উঠলেন তিনি। নাইম বলল,

“এই মাহীন গেল কোথায়? আমার রুমে কি করেছে ও?”

মিসেস নাসরিন বললেন, “মাহীন বাসায় নেই। ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে গেছে”

” কী আজব দুই মিনিটের মধ্যে কোথা থেকেই বা আসল ফ্রেন্ড আর কোথাই বা গেল ওরা। মশকরা হচ্ছে নাকি!”

‘কিন্তু কী হয়েছেটা কী?’

“ওফ না জানি আমার কামরার সাথে কি করেছে। রুমে ঢুকতেই ভয় করছে।”
মিসেস নাসরিন মুচকি হাসলেন।
.
.
.
স্যান্টা মনিকার রাস্তা ধরে একটা কালো টেসলা ছুটে চলেছে লস এঞ্জেলসের দিকে। খালি রাস্তাগুলোয় বাতাস কেটে যাচ্ছে শা শা করে। লম্বা তাল গাছগুলো এক পায় দাঁড়িয়ে মৃদু ভাবে মাথা দোলাচ্ছে। রাস্তায় বিকেলের সময় প্রচুর মানুষ হাঁটতে বের হয়। আবার প্রচুর দর্শনার্থীরাও এসে ভির জমায় এসব রাস্তায়। রাস্তার দুপাশে শুধু সারি সারি বিভিন্ন ব্র্যন্ডের সপ। লুই-ভিটন,ডিওর, নাইকি,ভার্সাচি, শেনেল থেকে শুরু করে কি নেই এখানে। রাস্তার দুপাশের সাইডওয়াকে সারি সারি তাল গাছ। গাড়ির ভেতর বাকিদের গল্পে তেমন একটা মন নেই মাহীনের।
গাড়ির রেডিওতে ‘দ্যা ঈগলের’ হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া গানটা চলছে। মাহীন গানের কথায় আবিষ্ট হয়ে ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় হালকা জাম থাকার কারণে মোট পঁচিশ মিনিট পর ওরা ভেনিস বিচ পিয়ারে এসে পৌঁছল। এটা শুধু একটা বিচ নয়, এটা ভেনিস বিচ নেইবারহুড। এলাকার নামই ভেনিস বিচ। মাঝে ওরা স্টার বাকস থেকে অল্প কিছু খাবার কিনে নিয়েছিল। ওরা পাঁচজনই গাড়ি থেকে নামলো। টেসলাটা জেনেটের। সোনালি রোদের পরশে মোরা চারিদিক। তবে এ মিষ্টি রোদ গায়ে মাখলে আরাম লাগে। সামনে সাদা বালু বিছানো প্রান্তর পেরিয়ে দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের গাড়ো নীল জলরাশি চোখে পরে। ছোট ছোট ঢেউ ফেনার মতো ছুটে এসে সাদা বালুগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ছড়িয়ে আছে এক সুমিষ্টঘ্রাণ।
বালুর মধ্যে সারি সারি অসংখ্য রঙবেরঙের ছাতা লাগান। এ এক সাদা বালুর বিস্তৃত সৈকত। পরিষ্কার পেলব সাদা মেঘে ভরতি গাড় নীল আকাশের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের পানি মিশেছে দূর দিগন্তে। মানুষের ভীরে গিজগিজ করছে জায়গাটা। বেশির ভাগ শেতাঙ্গীনিরা বিকিনি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে মাহীনের এক কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

“দেখেছ কি অসম্ভব সুন্দর জায়গাটা। এখানে আসলেই মনটা ভালো হয় যায়। আর এদের এই জায়গাটা পছন্দই না।” শেষের কথাটা মুখ বাঁকা করে বলল।

সাইলোহ বলল, “কে বলেছে পছন্দ না? শুধু বারবার আসতে ভাল্লাগে না।”

ওরা চওড়া প্রসস্থ ব্রডওয়াক ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। রাস্তার একদিকে সারি সারি রঙিন দোকান। বর্ণিল মুরাল দোকানের গায়ে গায়ে। আশেপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ভলিবল ক্লাব, টেনিস কোর্ট, ড্যান্সিং প্লাজা ইত্যাদি। দোকান গুলোবেশির ভাগ সার্ফিং বোর্ড, সুইমিং গগলস,টিউব ও সমুদ্রের ধারে বসে থাকার জন্য যেসব প্রয়োজন সেসবের দোকান। রয়েছে সুস্বাদু খাবারের জমজমাট রেস্টুরেন্ট। লস এঞ্জেলসের একটি বিখ্যাত আকর্ষণ হলো এই ভেনিস বিচ। রাস্তার অপর পাশের বেড়ার মত সারি সারি তাল গাছ। বেশ দূরে সৈকত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ভেনিস বিচ ফিশিং পিয়ার রয়েছে। তাল গাছের সারিগুলোর ওপাশে বিচ। রাস্তা ধরে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ স্কেটিং করছে। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা ওয়ার্ক আউট স্যুট পরে হাঁটছে বা দৌড়ে যাচ্ছে। চলার পথে অনেকেই গুড আফটারনুন বলে আন্তরিক ভাবে গ্রিট করছে। এখানে সাইকেল ভাড়া নেওয়ারও অনেকগুলো দোকান দেখা গেল। একটা আইসক্রিম পার্লার থেকে আইসক্রিম কিনে নিল।

লিও বলল, “আচ্ছা ম্যাহীন তোমার কয় ভাই বোন?”

মাহীন বলল,”আমরা দুই ভাই বোন। আমার বড় ভাই আছে।”

জেনেট বলল, “তোমার ভাই তোমাকে জ্বালায় না?”

মাহীন মুচকি হেসে বলল,”অনেক। তোমরা কয় ভাই বোন?”

জেনেট বলল,”আমরাও এক ভাই এক বোন। আমার ভাইকে নিয়ে আমি খুবই বিরক্ত। সবসময় আমার মেক-আপের জিনিসপত্রগুলোর সর্বনাশ করে।”

নায়েল বলল,”আমরা তিন ভাই বোন। আমার দুজন বড় বোন আছে।”

লিও আফসোস ভরা কন্ঠে বলল,” এবং আমি একা। আমার কেউ নেই।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “আর সাইলোহ তোমার?”

সাইলোহ ম্লান কন্ঠে বললো,”আমার একজন ভাই আছে।”

জেনেট উৎফুল্ল গলায় বলল,”চলো না আমরা পানির কাছে যাই। আমি পা ভিজাবো।”

লিও উচ্চস্বরে বলল,”ওউ! ওউ একদম না।খুব ভালো করে মনে আছে গতবার তুমি আমাদের কিভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলা।”

জেনেট বলল,”ওফ ওটা কি আমার দোষ ছিলো নাকি?”

মাহীন বলল,”এক মিনিট কি হয়েছিল টা কি?”

নায়েল বলল,”আরেহ ওইবার সাইলোহ সাথে ছিল না। শুধু আমরা তিনজন এসেছিলাম। তো আমি আর লিও সার্ফ করতে নেমেছি। এখন জেনেটও জেদ ধরেছে ও সার্ফ করবে। শেষে সার্ফ করতে গিয়ে পানিতে ভেসে গিয়েছিল ও।”

মাহীন ও সাইলোহ হেসে উঠল। সাইলোহ হাসি থামিয়ে বলল,”যতবার শুনি ততবারই হাসি লাগে।”

জেনেট মুখ ফুলিয়ে বলল,”ওফ ওটা তো সার্ফ করতে গিয়েছিলাম। আর আজ তো শুধু পানিতে পা ভেজাতে চাচ্ছি। এবং ওইদিন সমুদ্রে অনেক ঢেউ ছিল।”

নায়েল বলল, “আচ্ছা চলো একবার সমুদ্রের দিক থেকে ঘুরেই আসি।”

বাকিরাও সম্মতি জানালে ওরা রাস্তা থেকে নেমে সাদা বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। বিচের তুলনায় রাস্তায়ই বেশি মানুষের ভিড়। ওরা একদম পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর পর ফেনাময় ঢেউ এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাহীন স্নিকার্স পরে এসেছিল, তাই সেটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের পানি সর্বদাই শীতল। এই গরমের মধ্যে শীতল পানির পরশে কেঁপে উঠছে মাহীন। তিরতির করে এগিয়ে আসা সাদা ফেনার ঢেউ হৃদয় ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশের ক্যানভাসে হঠাৎ বুঝি কোনো শিল্পী এক মুঠো হলুদ ও কমলা রঙের মিশ্রণ ছুঁড়ে দিয়েছে। তিরতির করে গোটা আকাশের রঙ পাল্টে যাচ্ছে। দূর দিগন্তে এখনো চকচকে থালার মতো সোনালি গোলক টা আকাশে ঝুলে রয়েছে। তার সমুদ্রের বুকে ডুবে যেতে এখনো অনেক দেরি। সাইলোহ সতর্ক কন্ঠে বলল,

“এই সাবধানে!”

দেখা গেল রাস্তা থেকে নেমে তিনজন ছেলে সাইকেল নিয়ে বালু মারিয়ে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এবং ওরা পাঁচজন দ্রুত পেছনে পানির দিকে সরে গেল। সেই ছেলেগুলো মাথায় হেলমেট পরে আছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকের পরনেই জ্যাকেট। তারা দ্রুত গতিতে ঠিক লিওর একদম পাশ দিয়ে চলে গেল। বাকিরা আরও পিছনে ছিল। লিও পেছনে সরতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে বালুর মধ্যে পরে গেল। এবং হালকা গুঙ্গিয়ে উঠল। জেনেট ছুটে এসে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। বাকি তিনজনও ওকে ঘিরে দাঁড়াল। নায়েল চিন্তিত স্বরে বলল,

“তোমার কি পায়ে খুব লেগেছে?”

লিও চোখ মুখ কুঁচকে বলল,”বাম পায়ের গোড়ালিতে অনেক ব্যথা হচ্ছে। বোধহয় মচকে গেছে।”

সাইলোহ বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলল,”ওফ জেনেট দেখেছ। যখনই এই বিচে এসেছি, কিছু না কিছু একটা ঝামেলা হয়ই প্রতিবার।”

জেনেট ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,”তো ওরা সাইকেল দিয়ে ওকে ঢাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে গেছে এটা আমার দোষ!”

মাহীন শান্ত কন্ঠে, “আপাতত লিও কে এখান থেকে নিয়ে চলো। ওর পায়ের এই অবস্থা নিয়ে তো এখানে বসে থাকা যাবে না।”

নায়েল বলল, “হ্যা আমি লিও কে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

জেনেট বলল,”আমিও সাহায্য করছি।”

ওদের দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেও, লিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেই কোনো রকম হাঁটতে পারল। গাড়ির কাছে পৌঁছেই প্রথমে লিওকে ভেতরে বসিয়ে দিল। জেনেট ওর পাশের সিটেই উঠে বসল। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাকি তিনজন গাড়িতে প্রবেশ করতে যাবে তখনই দেখল সেই সাইকেলার তিনজন ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন মাথার হেলমেট টা খুলে হাতে ধরে আছে। ওরা এগিয়ে আসল ওদের ধীকে। সবার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে টিটকারির সুরে বলল,

“কি ব্যাপার সামোহিরা লাস্ট ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর তো আর ওদের এদিকে দেখাই যায় না। হঠাৎ তোমরা এদিকে কি করতে এসেছ?”

কেউ কিছু বলার আগে নায়েল কঠিন স্বরে বলল,”আমাদের বন্ধুকে আহত করার জন্য তোমাদের আমরা ছেড়ে দেব ভাবছো! কি হয় দেখোই না।”

ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনা সাকনা ছেলেটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল,

“কি করবা? তোমরা মাত্র কয়েকজন মিলে আমাদের বালটাও ফেলতে পারবা না।”

সাইলোহ কঠিন স্বরে বলল
“ভুলে যেও না তোমরা আমাদের এলাকায় দাঁড়িয়ে আছ। এখানে তোমাদের কোনোও ক্ষমতা নেই সে আমরা কয়েকজনই হই না কেন।”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তিক্ত কন্ঠে বলল,”শুধু এখানে থাকো বলেই জায়গাটাকে নিজের জায়গা বানিয়ে ফেলতে পারো না। সারা দুনিয়া থেকে মানুষ এখানে আসছে তাহলে আমাদের এখানে আসা না আসাতে তোমাদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই।”

মাহীন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নায়েল ও সাইলোহ। ছেলেগুলো কে চেনে না বলেই ও মুখ খুলছে না।

নায়েল বলল, “তো? সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসে ঠিকই কিন্তু তারা কি এখানেই বসবাস করে? নাহ। একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো আমরা এখানে অন্য কোনো স্টেট থেকে আসিনি। আমরা এখানকার স্থানীয়।”

জেনেট জানালা খুলে বাইরে উকি দিল। মাহীন পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল বলে সেটা খেয়াল করে, অপেক্ষা করতে ইশারা করল। সাইলোহ আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“এবং এখানে মারামারি করার কথা তো ভুল করেও ভেবো না। তাহলে আর নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছনোর মত অবস্থা থাকবে না তোমাদের। একবার আশে পাশে চোখ বুলাও। আমাদের অনেক সিনিওর আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবার শুধু আমরা ইশারা দিলেই এক মুহূর্তে সকলে এখানে এসে জড়ো হবে।”

ছেলেটাও ফুঁসে ওঠে বলল,”এরপরের ম্যাচে এর শোধ তুলবো আমরা।”

বলেই ওরা সাইকেল নিয়ে উল্টো পথে এগিয়ে যেতে লাগল। মাহীন, নায়েল ও সাইলোহ গাড়িতে উঠে বসল। জেনেট বলল,
“ওহ আমি তো ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যে বুঝি মারামারি শুরু হয়ে যাবে।”

লিও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে।

মাহীন বলল, “এরা কারা? সমস্যা কি ওদের?”

নায়েল বলল,”ওরা প্যাসাডেনা হাই স্কুলের ছাত্র। ওদের সাথে সাধারণত বাস্কেটবল খেলার সময় দেখা হয়।”

সাইলোহ বলল, “এখানে না আসতে চাওয়ার আরেকটা কারণ, এই বদগুলো সারা সপ্তাহই এই এলাকায় ঘুর ঘুর করে। এবং আমরা বা আমাদের স্কুলের ছেলে মেয়েদেরকে বিরক্ত করে।”

টেসলা চলতে শুরু করেছে ধীর গতিতে কারণ রাস্তায় প্রচুর মানুষ। জেনেট বলল,

“মাহীন তোমার দেরি হলে যেহেতু আন্টি চিন্তা করবেন তাই আগে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আমরা হাসপাতাল যাবো। একবার ওকে ডাক্তার না দেখালেই নয়।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।