কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-৯+১০

0
487

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

০৯.

‘দেখুন আঙ্কেল আমার যতদূর মনে পড়ে যে আমি আপনাদের অফিসে জবের জন্য কখনো কোন কাগজ পত্র জমা দিইনি। ‘

লাবণ্যর এটুকু কথা শোনামাত্রই উনি বিনীত সুরে বলে উঠলেন,
‘আমি জনি মা যে তুমি কোন কাগজ জমা দাওনি আমার অফিসে জবের জন্য। আমি নিজেই চেয়েছি তুমি এখানে কাজ করো। তুমি আমার ছেলের জন্য এতো কিছু করেছো তার জন্য আমার কৃতঞ্জতার শেষ নেই। তুমি আমার কথাটার না করো না। ‘

আদর্শর কথাটা শুনে লাবণ্য আর সাতে পাঁচে না ভেবে বলল,
‘আপনি আমার গুরুজন তাছাড়া আপনি এতো বার করে বলছেন, আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলে এই মুহূর্তে আমার একটা বেশ বড়ো রকমের টাকার প্রায়োজন। আমি একটা ফাঁদে পড়ে গেছি অযাচিত ভাবেই। আমার কাছে আর কোন উপায় নেই। আমার আগের চাকরিটাও গেছে। আমার আর চারদিনের মধ্যে দুই লক্ষ টাকার প্রায়োজন। আপনি কি আমাকে দিতে পারবেন কদিনের মধ্যেই? আমি আপনার অফিসে কাজ করে সবটাকা শোধ করে দেবো সে বিষয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ‘

আদর্শর বাবা ভ্রু কুঁচকে চান্তিত স্বরে বললেন,
‘তোমার এখনি টাকার প্রায়োজন হলে আমি এখনি দেবো কিন্তু কিভাবে কি হয়েছে সেটা তুমি আমাকে বলবে? তোমার আর এক বাবা হিসাবেই না হয় বললে। ‘

লাবণ্য মাথা নামিয়ে নিল। বেশ কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিয়ে অনর্গল সবকিছূ বলতে শুরু করলেন ওনাকে। বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উনি রাগী কন্ঠে বলল,
‘ ওই ছেলের নামে তুমি এখনো থানায় ডায়েরি করোনি কেন? তার তো জেল হওয়া দরকার। ‘

লাবণ্য বেশ থমথমে মুখ করে বলল,
‘ আমার কাছে উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে আমি কখনো থেমে থাকতাম না, আমি নিরুপায়। নিরুপায় হয়ে আমাকে কাজটা করতে হবে। আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি মন থেকে আমাকে সাহায্য করতে চাইলেও আমি মন থেকে তা নিচ্ছি না। আমার এই মুহূর্তে টাকার সত্যিই ভীষন প্রায়োজন। ‘

আদর্শর বাবা বেশ কিছুখন চুপ করে রইলেন, হয়তো উনি ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে পরছেন না এখনও। উনি চাপা কন্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন,
‘তুমি কোন চিন্তা করো না লাবণ্য, আমি তোমার টাকার ব্যাবস্থা করে দেবো। আর চেকটা কি এখনই দেবো? ‘

লাবণ্য মলীন হাসলো।

‘আপনি বলেছেন এটুকুই আমার জন্য অনেক। আমিও আপনার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। ‘

‘ সেসব কথা না হয় থাক। তুমি বরং নিজেকে সামলে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে অফিস জয়েন করো আর যেদিন টাকার দরকার হবে নির্দিধ্বায় আমাকে বলবে। ‘

লাবণ্য ইতস্তত বোধ করে বলল,
‘ তা কেন হতে যাবে আঙ্কেল। আমি কাজের বিনিময়ে টাকাটা নেব তাহলে আমার কাজ কেন থেমে থাকবে বলতে পারেন? আমি কালকে থেকেই আসবো যদি আপনি অনুমতি দেন। ‘

উনি লাবণ্যর মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘ জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে অনেক বড়ো মানুষ হও। ‘

লাবণ্য নির্বিকরে হাসলো। লাবণ্য. উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আঙ্কেল আজ তাহলে আসি। ‘

উনি মাথা নাড়ালেন।
লাবণ্য দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
‘আঙ্কেল? ‘

‘হ্যাঁ বলো লাবণ্য! ‘

লাবণ্য একটু ইতস্তত বোধ করে বলল,
‘আমি যে এখানে কাজ করতে আসবো সেটা আপনার ছেলে আদর্শকে জানাবেন না। এটা আমার অনুরোধ। ‘

‘ তা নিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ‘

লাবণ্য বেরিয়ে গেল একরাশ শ্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে। মনে মনে সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলল, যা হয় হয়তো ভালোর জন্যই হয়।

অফিস থেকে লাবণ্য বার হওয়া মাত্রই আদর্শর বাবা আদর্শ কে ফোন করলেন,
‘লাবণ্য জবটা করতে রাজি হয়েছে আদর্শ। তবে তুমি তাকে বিরক্ত করবে না কথা দিয়েছো কিন্তু। ‘

ফোনের ওপাশ থেকে আদর্শ রুম কাঁপানো একটা উচ্চস্বরে হাসি দিলো। আদর্শর বাবা ছেলের এমন আচরনে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন আর খানিকটা ঘাবড়েও গেলেন। উনি অপ্রস্তুত সুরে প্রশ্ন করলেন,
‘ কি হলো এভাবে হাসছো যে? ‘

আদর্শ হাসতে হাসতে বলল,
‘ডান। আমি তাকে অফিসে থাকতে বিরক্ত করবো না। কিন্তু অফিসের বাইরে পা রাখলে কি হবে তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না ‘

‘তোমার সমস্যা টা কি আদর্শ? মেয়েটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। সামনেই মেয়েটার বিয়ে। ‘

আদর্শ সিগারেট এ ফুক দিয়ে বলল,
‘আমাকে দাওয়াত দেই নাই তো এখনও? ‘

উনি ধমকে বললেন,
‘এই অবস্থা তেও আমার সাথে মশকরা করছো তুমি? ‘

আদর্শ হো হো করে হেসে বলল,
‘ কই একদম নয় তো। ‘

উনি কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘হাতের ব্যাথা এখন কেমন আছে? ‘

আদর্শর নির্বিকারে উত্তর এলো,
‘হাতের ব্যাথা তার নিজের মতোই আছে, আমি তাকে একটুও জ্বালাইনি। ‘

উনি কপালে হাত দিয়ে বললেন ,
‘এটা কেমন ছেলেমানুষি আদর্শ? ‘

আদর্শ উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে কলটা কেটে দিল। সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে একটা বিষাক্ত ঘ্রাণ নালো সে। আজ তার ভালোবাসা উন্মাদ হয়েছে।

….

রাস্তা দিয়ে হাটছে লাবণ্য, হঠাৎ যেন রোদের তেজটা বেড়ে গেল তবুও যেন বিরক্ত বোধ করলো না লাবণ্য। হাতে ছাতা নেই, রিকশা বা অটো কিছুই নেয়নি তবুও বেশ স্বাভাবিক লাগছে নিজেকে। লাবণ্য ফুটপাত দিয়ে হাটতে লাগলো। কিছুটা হাটতেই একটা বাচ্চা ছেলে ওর ওড়না ধরে টানতে লাগলো। লাবণ্য পিছু ফিরে ঘরে তাকাতেই চমকে গেল বচ্চাটাকে দেখে। চেহারা ধুলোমাখা। গায়ের গেন্জিটাও বেশ নোংরা কিন্তু মুখটা মায়াবি। লাবণ্য বচ্চাটার দিকে ঝুকে বাচ্চাটার নাকে আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
‘ কি চাই? ‘

বাচ্চাটা হঠাৎ করে লাবণ্যর হাতে একটা লাল টকটকে গোলাপফুল দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। লাবণ্য আর হতবিহ্বল হয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারার আগেই সবটা কেমন যেন মিলিয়ে গেল। লাবণ্য বেশ কিছুখন ফুলটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো। তবে সবটা গোলকধাধা।
তবে ফুল জিনিসটই হলো মন ভালো করার মতো। ফুল পেলেই লাবণ্য বরাবর মাথায় গোঁজে। আজকেই বা তার ব্যাতিক্রম হবে কেন? লাবণ্য কিছু ভেবে ফুলটা কানের পাশের খোঁপতে গুঁজলো। গোলাপের এক মিষ্টি ঘ্রান লাবণ্যর নাকে ভেসে আসছে। লাবণ্য পিছনে একবার তাকিয়ে দেখলো দূরে বাচ্চাটা হাতে একটা শপিং এর ব্যাগ নিয়ে ছুটে রাস্তা পার হয়ে গেল আর নিমেষেই মিলিয়ে গেল, বাচ্চাটার মুখের একরাশ হাসি দেখে লাবণ্যর মনটা আপনা আপনিই ভলো হয়ে গেল।

রাত নয়টা বাজে। লাবণ্যর বাবার শরীরটা ক্লান্ত তাই তিনি বিছানায় শুয়ে আরাম করছেন। আজকে ডিনারের দায়িত্বটা লাবণ্য নিয়েছে। লাবণ্যর মামী লাবণ্যদের জন্য পোলাও আর চিকেন রান্না করে পাঠিয়েছেন। লাবণ্য শুধু একটু আলুভাজা, ডিমভাজা, আর মাছ ভাজার দায়িত্বটা নিয়েছে। লাবণ্য রান্নাঘরে গেল। গা থেকে ওড়নাটা খুলে পাশে রেখে দিয়ে চুলটা খোপা করে নিল। গ্যাসটা অন করে কড়ইটা বসাতেই শুভর কন্ঠস্বর শুনতে পেল লাবণ্য।

‘দিদি তোমার ফোন এসেছে।’

রাত নটার পর সচরাচর লাবণ্যকে কেও ফোন করে না। লাবণ্য শুভর কথা শুনে কিচেন থেকে বার হলো। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো তার অফিসের নাম্বার থেকে কল। না ধরা ছাড়া উপায় নেই, বাধ্য হয়ে লাবণ্য ফোনটা ধরতেই অপর পাশ থেকে লাবণ্যর পুরাতন অফিসের বস বলে উঠলেন,
‘ আপনি যে করেই হোক কালকে টাকাটা জোগাড় করে আনবেন। আপনার কোন অভিযোগ শুনবো না।’

ফোন ধরতেই এমন ঝাঝালো কন্ঠস্বর শুনে লাবণ্য চোখ বন্ধ করে নিল। লাবণ্য কথাটা শেষ হতেই চোখ খুললো, খানিকটা স্বাভাবিক হতেই বলল,
‘আপনার টাকা আপনি কালকে সময় মতোই পেয়ে যাবেন। ‘

অপর পাশ থেকে আর উত্তর এলো না, তিনি কলটা কেটে দিয়েছেন। শুভ পড়ার মাঝেও কান পেতে কথাটা শুনেছে। কলটা কাটতেই সে লাবণ্যকে প্রশ্ন করে উঠলো।
‘কিসের টাকা দিদি? ‘

লাবণ্য শুভকে কিছু না বলে শুধু একবার নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে কিচেনে চলে গেল। শুভ একটু বিভ্রান্ত হলো। বিষয়টা বুঝলো না সে। শুভ লাবণ্যর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আদর্শ কে এস এম এস দিলো।

‘দাদা দিদি কোথায় যেন একটা জব পেয়েছে। আমাকে বাড়িতে ফিরে বলল। তোমাকে জনিয়ে রাখলাম। দিদি এখন রেগে আছে। তুমি সুস্থ আছো তো? তোমার একটা কাজিন আছে না, ত্রয়ী, আমার ওকে ভালোলাগে। ওকে কিন্তু বলো না। দিদি তোমাকে মিস করছে। হিহি।’

#চলবে,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

10.

বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়, সকাল থেকেই রোদের নানান বহরে বাইরে পা রাখার জো নেই। পিচের রাস্তাটা রোদে গমগম করে, পা ছোয়ালেই যেন ফোসকা পড়বে। বৈশাখ মাসে কালবৈশাখী হয় কিন্তু এদিকে তো ঝড় বৃষ্টির কোন নাম গন্ধই নেই। যখন বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না তখন এ শহর ভাসে বানভাসী বৃষ্টিতে।

জনালার সাদা পর্দাটা টেনে জানলাটা বন্ধ করে দিল লাবণ্য, সকাল সকাল তার বাবা রোজ জানালাটা খুলে দিয়ে যায় আর লাবণ্য অফিসে যাওয়ার আগে তা বন্ধ করে চলে যায়। পর্দাটা দিয়ে বিছানা থেকে ব্যাগটা নিয়ে লাবণ্য কাধে ঝুলিয়ে নিল।
ঘর থেকে বার হয়ে দেখলো তার বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন একমনে। ওনার মনোযোগ এ ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাবণ্য ওনাকে ডেকে উঠলেন,
‘বাবা তোমাকে কতোবার বলেছি সকাল সকাল গিয়ে জনালাটা খুলে আসবে না, ঘরে তাপ বেড়ে যায়। ‘

উনি খবরের কাগজটা নিঃশব্দে মুখের সামনে থেকে সরালেন আর গরম শ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘এবার মাস শেষ হলে তো পেনশনের টাকাটা পাবো, এবার একটা এসি কিনলে হয় না?’

লাবণ্য কঠিন স্বরে বলল,
‘তোমার ঘরে লাগতে চাইলে কিনতে পারো কিন্তু আমার ঘরে না। আমি জানি তুমি আমার আর শুভর কথা ভেবে বলছো। ‘

উনি নরম কন্ঠে বললেন,
‘বলেছি তো বলেছি। কি হয়েছে। তোদেরকে কষ্টে দেখলে আমার ও তো কষ্ট লাগে নাকি। ‘

লাবণ্য কথা বাড়ালো না, ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই উনি পিছু ডাকলেন,
‘তুই নাকি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিস? ‘

লাবণ্য পিছু ঘরে তাকালো।
‘শুভ বলেছে? ‘

উনি মাথা নাড়ালেন।

লাবণ্য সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ। নতুন একটা চাকরি পেয়েছি। ইন্টারভিউ ও দিয়েছিলাম। তাছাড়া স্যালারিও বেশি। ‘

লাবণ্যর বাবা খুশি হলেন। মূচকি হেসে বললেন,
‘যাক এতোদিনে একটা কাজের কাজ করেছিস। তোর আগের বসটা বড্ড খিটখিটে। আচ্ছা তোর নতুন অফিসে ভালো ছুটিছাটা আছে তো? ‘

লাবণ্য বুঝলো এখন তার বাবা একে একে খুটিনাটি সব কিছু জিজ্ঞাসা করবে তাই এখন কঠিন সুরে কথা বলে ওনাকে থামানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। উপরন্তু লাবণ্য কঠিন স্বরে বলল,

‘ বাবা আমি সবে জয়েন করলাম। এখন এতো কিছু কিভাবে জানবো বলতে পারো? ‘

লাবণ্যর ফিউচার প্রেডিকশন কাজ করে গেল। উনিও চুপ করে গেলেন। নির্বিকার স্বরে বললেন,
‘আচ্ছা তুই যা। সাবধানে যাবি। ‘

লাবণ্য হমম বলে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।

লিফট থেকে নেমে রাস্তার ধারে এসে দঁড়ালো সে, আজ সে তার নতুন অফিসে যাবে অর্থাৎ আদর্শ দের অফিসে। ছেলেটার সাথে যেন ভ্রুনাক্ষরেও ওর দেখা না হয় তার ই প্রার্থনা করতে লাগলো মনে মনে। লাবণ্য রাস্তায় নামতেই দেখলো রাকিব নামের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে যার সাথে লাবণ্যর বিয়ের কথা চলছে। রাকিবকে অকস্মাৎ সেখানে দেখে লাবণ্য চমকে গেল বেশ। সে নিশ্চয়ই লাবণ্যর সাথে দেখা করতে এসেছে নতুবা সে ওখানেই বা দাঁড়িয়ে থাকবে কেন। লাবণ্য ভাবলো সে রাকিবকে ডাকবে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হলো যে আসলেই যদি সে তার সাথে দেখা করতে আসে তাকে একবার ও কল করলো না কেন। লাবণ্য সেখানেই নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। রাকিব নামের ছেলেটাকে ভীষনরকম অস্থির দেখাচ্ছে, যা লাবণ্য তার ভাব ভঙ্গিতে স্পষ্ট লক্ষ করতে পেরেছে, যেমন বারবার রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মোছা, বিরক্ত হয়ে হাত ঝাড়া মারা, কুঁচো পাথরে জুঁতো দিয়ে খসখস আওয়াজ করা। লাবণ্য দূর থেকে রাকিবকে লক্ষ করলো, সম্ভবত সে লাবণ্যকে দেখেনি, দেখলে হয়তো এতখন লাবণ্যর পাশে গিয়ে দাঁড়াতো। হঠাৎ যেন রাকিব কাকে কল করতে লাগলো। লাবণ্য নিজের ফোনের দিকে তাকালো কারন সে নিশ্চিত যে ফোনটা তার ফোনেই আসবে। লাবণ্য খেয়াল করলো তার কলটা ওর ফোনে এলো না উপরন্তু ওদের ফ্ল্যাটের ছয় তলায় থাকা মেয়েটা রাকিবকে পিছন থেকে ডেকে উঠলো। লাবণ্য চমকানো আর অবাক ও হলো বেশ। সে যতোদূর জানে যে সেই মেয়েটার নাম জুঁই, বেশ অহংকারী আর কারোর সঙ্গে বিশেষ খাতির নেই তার। দূরে থাকায় রাকিব আর জুঁইয়ের সম্পূর্ণ কথপোকথন লাবণ্যর কর্ণগোচর হলো না।

লাবণ্যর আকস্মিক ঘোর ভাঙিয়ে একটা অটো এসে সেখানে থামলো। অপর পাশ থেকে উত্তর এলো,
‘দিদি আপনি যাবেন? ‘

লাবণ্য চমকালো অতঃপর আর দেরি না করে অটোতে উঠলো, মাথা জুড়ে চলছে হাজারো প্রশ্নের মেলা যার উত্তর একমাত্র রাকিব দিতে পারবে। লাবণ্য অফিসের দিকে রওনা দিল। আজকে তার একটা বিশেষ দিন, শুভ দিন ও বলা যেতে পারে।

/

এসির ঠান্ডা বাতাসে লাবণ্যর শরীরের সব ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে। লাবণ্য শীতল অনুভব করছে বেশ। লাবণ্যর গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। এতো বড়ো রকমের একটা টাকা আদর্শর বাবা নির্দিধ্বায় আর কতো সহজ সরল ভাবে দিয়ে দিচ্ছেন তবে লাবণ্যর ভয় লাগছে ভীষনরকম। যদি সে কখনো টাকাটা শোধ না করতে পারে? মনের মাঝে জমে রাখা হাজারো রকমের চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রেখে লাবণ্য চেকটা হাতে নিলো। দুই লাখ টাকার একটা হিউজ এমাউন্ট। লাবণ্য চেকটার দিকে তাকিয়ে বেশ থমথমে গলায় বলল,
‘ আপনার এই টাকা আমি খুব শীঘ্রই শোধ করার চেষ্টা করবো। ‘

লাবণ্যর কথা শুনে আদর্শর বাবা হেসে উঠলেন, লাবণ্য চমকে গিয়ে ওনার দিকে তাকালো অবাক চাহনিতে। উনি হাসতে হাসতে ধমকের সুরে বললেন,
‘এটা কি কথা বলোতো লাবণ্য! তুমি কি আমার মেয়ে না বলোতো? ‘

লাবণ্য কিভাবে ওনার কথা উপেক্ষা করবে!

লাবণ্য মাথা নামিয়ে নিল, ভিষনরকম একটা অস্বস্তি লাগছে তার। লাবণ্য বেতাল সুরে বলল,
‘ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আঙ্কেল। আমি জানি না আপনার এই ঋন আমি কি করে শোধ করবো। আমার অসময়ে পাশে থাকার জন্য আমি কৃতঞ্জ। ‘

আদর্শর বাবা চুপ করে রইলেন। উনি যতোটা সহজ ভাবে বিষয়টাকে নিচ্ছেন লাবণ্য হয়তো ততোটা সহজ ভাবে বিষয়গুলো মানতে পারছে, না তা উনি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন।

‘ আচ্ছা মা তুমি তোমার কাজটা আগে মিটিয়ে নাও, ওটা বেশি দরকারী। ‘

লাবণ্য মাথা নাড়ালো।

আদর্শর বাবার অফিস থেকে বেরোলেই শরীরটা যেন হালকা ঝলসানো অনুভূতি হলো গরমে। এবার হাসফাস করার পালা। লাবণ্য অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। রাকিবের চিন্তাটা আপাতত মাথাতে নেই । আজ টাকাটা মিটিয়ে একটা প্রশান্তির ঘুম দেবে ও। চিন্তামুক্ত একট ঘুম।

/

বিকাল ৫.৩৫,,,

কৃষ্নচুড়া গাছের নীচে একা বসে আছে লাবণ্য। কৃষ্নচুড়া গাছটা লাবণ্যদের এলাকার যে ছোট পার্কটা আছে সেখানকার। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিচ্ছে। ওর সমগ্ৰ শরীরে প্রশান্তির বিরাজ। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে কিছুখন সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতির আভাস পেয়ে দ্রুত চোখ খুলে তাকালো ও। আদর্শ বসে আছে তার পাশে, মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে আছে লাবণ্যর দিকে। লাবণ্য হতচকিত হয়ে গেল। খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো আদর্শর দিকে, কতোটা স্বাভাবিক তার চাহনি, তার শ্বাস প্রশ্বাস, তার অঙ্গভঙ্গি। লাবণ্য কথা বাড়লো না। আদর্শর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। আদর্শকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে সে কিছুদিন আগে একটা গুরুতর এক্সিডেন্ট থেকে উঠে এসেছে।

আদর্শ চুপচাপ। লাবণ্যর নিরবতা আদর্শ কে এক অদ্ভুত প্রশান্তি দিচ্ছে কারন আদর্শ লাবণ্যকে দু চোখ ভরে দেখতে পাচ্ছে। লাবণ্য উঠে যেতে নিলেই আদর্শ শক্ত করে লাবণ্যর হাতের কবজিটা ধরে বলল,
‘বিরক্ত হচ্ছো? কিন্তু আমার তো বেশ ভালোই লাগছে। ‘

লাবণ্য নিরবে হাত ছাড়াতে নিলে আদর্শ মাদকতার সুরে বলল,
‘উহুম। অস্থির হয়ো না, হাতে ব্যাথা পাবে।’

লাবণ্যর স্বল্প ছটফটানি বন্ধ হলো। আদর্শ হাতটা ধরে আলতো করে টানতেই লাবণ্য পুনরায় বসে পড়লো। লাবণ্য এখনো চুপচাপ, হয়তো সে পন করেছে আদর্শর কোন প্রশ্নের উত্তর সে দেবে না।

আদর্শ লাবণ্যর হাতটা ছেড়ে দিল। লাবণ্যর দিকে আগের মতো তাকিয়ে বলল,
‘ একা এলে যে! তুমি তো এখানে কখনো একা আসতে না। তোমাকে সবসময় আমি এখানে নিয়ে আসতাম। ‘

লাবণ্য আদর্শর দিকে তাকালো, চাইলেও আজ আদর্শর প্রতি ঘৃনা ভাসছে না ওর চোখে।

লাবণ্য মুখ ফুটে বলেই ফেলল,
‘আমাকে ফলো করছেন? ‘

লাবণ্যর কথাতে আদর্শ ওর হাতের মুঠোয় থাকা কৃষ্নচুড়া ফলটা নিয়ে লাবণ্যর চুলের বেনির একটা ধাপে গুজে দিয়ে বলল,
‘ হমম তা বলতে পারো। ‘

লাবণ্য গভীর নিশ্বাস নিয়ে অন্য দিকে তাকালো। আদর্শ বলতে লাগলো,
‘তুমি যে দু লাখ টাকাটা শোধ করার কথা ভাবছো সেটা শোধ করার দরকার নেই। ‘

আদর্শর মুখ থেকে টাকার কথাটা জানতে পেরে লাবণ্য যেন আকাশ থেকে পড়লো। কথাটা তো তার জানার কথা নয়, তাহলে কি আদর্শর বাবাই তাকে বলেছে?

লাবণ্য ভাবতে লাগলো তখন ওর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে আদর্শ বলল,
‘আজকে অফিসে গিয়েছিলাম আমি, তখন দেখি তুমি ওখানে। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম বেশ। তারপর জানতে পারি তুমি টাকা ধার নিয়েছো, পরিবর্তে কাজ করে তা পরিশোধ করবে বলেছো। ‘

লাবণ্য হঠাৎই অস্থির হয়ে উঠলো কারন সে কখনোই চাইনি যে আদর্শর কান অবধি কথাটা পৌছাক। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। আদর্শর কথার উত্তর দিলো না লাবণ্য, উঠে চলে যেতে নিলেই আদর্শ বলে উঠলো,
‘আমি কিন্তু এখনো তোমার কাছে ঋনী। তোমার ছাতা তোমাকে আমি ফেরত দিতে পারিনি। তার পরিবর্তে না হয় টাকাটা দিয়ে শোধ বোধ। ‘

লাবণ্য পিছন ঘুরে তাকালো, বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘আমার ছাতাটা যে দুই লাখ টাকার সমতুল্য সেটা জানলে বোধহয় কখনো আপনার হাত অবধি পৌছাতে দিতাম না সেটা। আপনি সেটা এতোটা উচ্চমূল্য দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ। আর আমার যা বলার আপনার বাবার সাথে কথা হয়েছে তাই অনুগ্ৰহ করে আপনি এ বিষয়ে কোন কথা বাড়াবেন না। ‘

লাবণ্য চলে যেতে লাগলো। আদর্শ দৌড়ে গিয়ে লাবণ্যর পিছু পিছু হাটতে হাটতে বলল,
‘ এই লাবণ্য, আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? মনে রাখবে যে ক্ষমা করে তার মন কিন্তু অনেক বড়ো হয়।থ ‘

লাবণ্য ভ্রু কুচকে তাকালো। আদর্শ লাবণ্য নাকটা টেনে দিয়ে বলল,
‘ একবার বলো ক্ষমা করেছো। ‘

লাবণ্য উত্তর দিলো না, নির্বিকারে হেটে গেল। আদর্শ কৃষ্নচুড়া ফুলগুলোর পাপড়ি দূর থেকে লাবণ্যর মাথাতে ছুঁড়ে বলল,
‘ আচ্ছা ক্ষমা করতে হবে না, তবে একবার বলো ভালোবসি! ‘

লাবণ্য্ পিছু ফিরে তাকালো একবার, আচমকা হেসে ফেলল। আদর্শ বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল,
‘যদি কখনো বৃষ্টি নামে তবে আমার নামে ভিজো। ‘

#চলবে,,,