কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-৫+৬

0
510

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

০৫.

ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে রইলো হসপিটালের সামনে, লাবণ্য নামছে না। আদর্শ অচেতন তাই তাকে সামলাতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তার। এটা একটা এক্সিডেন্ট কেস, যতখন না পুলিশ আসবে ততখন আদর্শর ট্রিটমেন্ট শুরু হবে না আর তার সাথে হাজরো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে লাবণ্যকে আর লাবণ্য তা চাই না, এমনিতেই এই কয়েক বছরে নিজেকে ঠিক যতোটা সামলে নিয়েছিল তার থেকে ঢের বেশি ভেঙে পড়েছে সে এই কয়েকটা দিনেই। আর না।

এখনকার ছেলেরা আর বুকপকেটে ফোন রাখে না, রাখে প্যান্টের পকেটে। যদিও বা কেন রাখে তা নিয়ে যুক্তি তর্কের শেষ নেই।
কোনরকম কোন সমস্যা ছাড়াই যাতে সব ঝামেলা মিটে যায় তেমনটাই করবে লাবণ্য। আদর্শর কপাল থেকে আর রক্ত গড়াচ্ছে না, বরং আগের রক্ত গুলোই শুকিয়ে ধীরে ধীরে কালচে বর্ণ ধারন করছে। লাবণ্য ইতস্তত বোধ করলো বেশ তবুও আদর্শর প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বার করলো। আদর্শ তার ফোনে কখনোই পাসওয়ার্ড জাতীয় লক রাখে না তাই ফোন খুলতে বিশেষ অসুবিধা হলো না লাবণ্যর। কল লিস্টে ঢুকেই কয়েক মাসে তার পরিবারের কারোর সাথে কলের কোন রেকর্ড নেই, যার অর্থ লাবণ্যর বুঝতে অসুবিধা হলো না। পরিবারের সাথে আদর্শর সম্পর্কটা বিগড়েছে, যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন হয়েছে হয়তো বছর আগেই তবুও যে সে কি করে সেই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে ভেবেই লাবণ্য অবাক হলো।

আদর্শর বাবা শহরের একজন প্রভাবশালী মানুষ হওয়ার দরুন এই পুলিশের ঝামেলাটা হয়তো উনি খুব সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন। লাবণ্য ফোন করলো,

‘ আপনার ছেলে আদর্শর গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি হসপিটালের সামনে ওনাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি যত দ্রুত সম্ভব আসুন। ‘

‘আমি কে তা এই মুহূর্তে জানা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? আপনি আপনার ছেলেকে বাঁচাতে চাইলে জলদি আসুন। ‘

কথা বেশি দূর নিয়ে গেল না লাবণ্য। তার কাজ সে দায়িত্ব সহকারে করেছে। আদর্শকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল না ও, তাছাড়া আদর্শর শরীরের সম্পূর্ণ ভার বহন করা ওর পক্ষে অসম্ভব। লাবণ্য অপেক্ষা করতে লাগলো ওনার আসার।

সময় পার হচ্ছে তার নিজের গতিতেই। অফিসে সে আজ বিনা নোটিশেই লেট, তার চাকরিটার পরিস্থিতি কতদূর গড়াবে তার আশঙ্কা আছে। বেশ কিছুখন পর লাবণ্যর হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই লাবণ্য তড়িৎ গতিতে সম্বিত ফিরে পেল।

‘হ্যাঁ আপনি এসেছেন? ‘

‘হ্যাঁ আমি এসেছি কিন্তু আমার ছেলে কোথায়?’

লাবণ্য ফোনটা কাটলো। আদর্শকে সরিয়ে ওড়নাটা ঘোমটা স্বরুপ কিছুটা টেনে লাবণ্য ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এলো। আদর্শর বাবাকে পিছন থেকে ডেকে বললেন
‘আপনার ছেলে ওই ট্যাক্সিতে। সত্বর ওনার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করুন। ‘

আদর্শর বাবা চমকে উঠলেন, লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি কে? তোমাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। ‘

লাবণ্য সহজে ধরা দেওয়ার মেয়ে নয়।

‘ আঙ্কেল এই মুহূর্তে আপনাকে ছেলের প্রাণ বাঁচানোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি কে তা জানার থেকে। ‘

উনি বেশ বিব্রত বোধ করলেন। ট্যাক্সির দিকে ছুটে গেলেন উনি আর ওনার ড্রাইভার। আদর্শকে ধরে হসপিটালের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। আদর্শ চোখ পিটপিট করে চেয়ে তাকালো, চোখের সামনে সবটা ঘোলাটে। লাবণ্য দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। আদর্শর বাবা আদর্শর চিন্তায় আজানা মেয়েটার কথা ভুলেই গেলেন। স্ট্রেচারে বসানো মাত্রই আদর্শ বিড়বিড় করে উঠলো,
‘লাবণ্য? ‘

উনি অবাক হয়ে বললেন,
‘কোথায়? ‘

আদর্শ বাইরে লাবণ্যর দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করতেই আদর্শ জ্ঞান হারালো। উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অজানা মেয়েটা গায়েব। সেখানে না আছে কোন ট্যাক্সির চিন্হ আর না আছে লাবণ্যর।

.

শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে লাবণ্যর। হসপিটাল চত্বর থেকে দৌড়ে সে একটা অটোতে উঠেছে। গায়ে রক্তে মাখামাখি হওয়ার দরুন তাকে অটো পেতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে। গায়ে রক্ত থাকার দরুন ড্রাইভার তাকে নিয়ে যেতে নারাজ হলেও পরে লাবণ্যর কাকুতি মিনতি আর দ্বিগুণ টাকা লাভের আশায় উনি রাজি হলেন। লাবণ্য হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, সময় বারোটা ছুঁইছুঁই, সে এমনিতেই লেট। লাবণ্য অটোর টাকাটা মিটিয়ে দৌড়ে অফিসের দিকে ছুটলো। দারোয়ানকে দরজার কাছে দেখলো না ও। ভিতর থেকে গোলমেলে আওয়াজ আসছে, বেশ চিৎকার চেঁচামেচি ও হচ্ছে তা লাবণ্য আন্দাজ করতে পারলো। লাবণ্যর বুকের ভিতর টিপটিপ করতে লাগলো, আজ বুঝি তার চাকরিটা হারালো সে।
লাবণ্যর কা্ধে আদর্শ মাথা রেখেছিল তাই বেশিরভাগ রক্ত লাবণ্যর জামার উপরিভাগে। লাবণ্য ওর ওড়নাটা দিয়ে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করলো কিন্তু তাতেও লাভ হলো না, তার ওড়নাতেও রক্তের ছোপ। লাবণ্য ধীর পায়ে গেল। অবাক হলো ভীষনরকম যখন দেখলো যে ওকে আসতে দেখে সব স্টাফগুলো ভিড় কাটিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য ভীষনরকম ইতস্তত বোধ করলো। লাবণ্য চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো তার অফিসের সোমা নামক কলিগের ওপর রিতিমত হামলে পড়েছেন তার অফিসের বস। লাবণ্য শুকনো ঢোক গিলল। লাবণ্যকে একপলক দেখতেই তিনি এবার লাবণ্যর ওপর চেঁচানো শুরু করলেন,

‘তোমাদের দুজনকে ভালো মনে করতাম আমি, আর তার এই পরিনাম দেখালে লাবণ্য?’

লাবণ্যর শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন কয়েক হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক ছেয়ে গেল। এখানে যা হচ্ছে বা হতে চলেছে তা সম্পর্কে লাবণ্য জ্ঞানহীন প্রায়।

লাবণ্য কম্পিত কন্ঠস্বরে বলল,
‘ঠিক বুঝলাম না স্যার। ‘

লাবণ্যর কথাটা শুনে উনি যা বললেন তাতে লাবণ্যর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো প্রায়।

লাবণ্য জোর গলায় বলল,
‘দু লাখ টাকা? কিভাবে? আমি তো কাল অবধি সব হিসাবই মিলিয়ে রেখেছিলাম তাহলে দুই লাখ টাকার হিসাবের গন্ডগোল কেন হবে? তাছাড়া আমি টাকা কেনই বা সরিয়ে দিতে চাইবো আমাকে বলতে পারেন? ‘

লাবণ্যর কথাতে ওর অফিসের বস রেগে গিয়ে বললেন,
‘চুরি করে চোর কি কখনো স্বিকার করেছে যে সে চোর? তোমরা সবাই কেও শুনেছো? ‘

বাকি স্টাফেদের উদ্দেশ্যে করে বললেন উনি। সবাই বিষয়টাতে বেশ মজা পাচ্ছে তা তাদের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। লাবণ্য থমকে গেল একটা সময়ের জন্য। আসলেই কি ওর দ্বারা এতবড়ো একটা ভুল হয়েছে?

‘স্যার আমি কোথায় ভুল করেছি আপনি দেখান। আমি কোন হিসাবে ভুল করিনি। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ‘

লাবণ্যর কথা শুনে ওর বস হেসে উঠলেন। ফাইলের কাগজগুলো একপ্রকার লাবণ্যর মুখে ছুঁড়ে মারলো। কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। সবাই হাসছে।
লাবণ্য সবার দিকে তাকালো, লাবণ্যর শরীরে তেজ বাড়লো, জোরালো কন্ঠে প্রতিবাদের ন্যায় জানালো
‘ স্যার আপনি এমনটা করতে পারেন না। ‘

সোমা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। লাবণ্য তার মুখের দিকে তাকালো। সোমার পঞ্চাশ হাজারের গড়মিল, লাবণ্য জানে সে সোমা এটা করতে পারে কারন সোমা অনেকবারই এমন করেছে কিন্তু ধরা খাইনি। কিন্তু লাবণ্যর? দুই লাখ? নাহ আর ভাবতে পারছে না সে।

ফ্লোর থেকে সব কাগজগুলো কুঁড়িয়ে একত্রিত করতে নিতেই উনি বললেন,
‘ এই অফিসে তোমাদের আর চাকরি নেই। এক সপ্তাহ সময় দিলাম, টাকাটা ভালোই ভালোই দুজনেই ফিরিয়ে দাও নতুবা হাতে হাত কড়া পড়বে। ‘

কথাটা বলে উনি চলে গেলেন। রাগে ঘৃনায় লাবণ্যর শরীর কাঁপছে। সে যা করেনি তার মাশুল সে কেন গুনবে কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করবে কিভাবে? আর কিভাবেই বা জোগাড় করবে এতগুলো টাকা!

কাগজগুলো কুঁড়িয়ে লাবণ্য থমথমে চোখে দেখতে লাগলো। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে সুজয় নামের ছেলেটা যে এতদিন অবধি লাবণ্যকে পছন্দ করতো সে অবধি ঈর্ষান্বিত সুরে বলল,
‘অতি লোভে তাতী নষ্ট। ‘

লাবণ্যর চোখ জোড়া ভিজে এলো। কি বলবে সে? সে যে নিরুপায়।

#চলবে,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

০৬.

ঠোঁটে কলম চেপে ধরে একের পর এক পাতা ওলটাচ্ছে লাবণ্য। তার এ হিসাবের গড়মিল কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। লাবণ্য কাগজ ওলটাতে ওলটাতে মাঝের একটা পাতায় এসে আটকে গেল। কয়েক দিন আগের হিসাবের পাতা সেটা। যেদিন লাবণ্য অর্ধেক অফিস করে বেরিয়ে এসেছিল সেদিনের। লাবণ্য কিছুটা সময়ের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল। সে যতটা কাজ করেছে ততদূর অবধি হিসাব সঠিকই আছে তারপর বাড়তি হিসাব দেখে লাবণ্যর মাথাটা ঘুরে উঠলো। কিভাবে সম্ভব এটা? তবে এ কথাটা যদি লাবণ্য তার অফিসের বসকে বলতে যায় তো তিনি ভ্রুনাক্ষরেও ওর কথা বিশ্বাস করবেন না বরং তাকে হয়তো আবারও চোরের তকমা দেবে।
ফুটপাতের একটা গাছের নীচে বসে ছিল লাবণ্য। এবার উঠে দাঁড়ালো সে। এভাবে অনেকখন সময় পার হয়ে গেছে, তাকে এবার বাড়িতে ফিরতে হবে। আদর্শর কথাটা তার মাথাতে নেই। বাড়িতে গিয়ে কি জবাব দেবে সে? তার চাকরিটা চলে গেছে? সাথে দুই লাখ টাকার লোকসান?

লাবণ্যর মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো। তার বাবা অনেকবার তাকে নিষেধ করেছিল এভাবে কোম্পানির কোন জব না করতে তবে সে শোনেনি ওর বাবার কথা। কথাটা তার বাবাকে কিছুতেই বলা যাবে না, যা করবে ও নিজেই করবে। কিন্তু কিভাবে? লাবণ্য আর ভাবতে পারছে না। বাকিটা পথ হেটে যাওয়া তার পক্ষে দুষ্কর, তাহলে হয়তো আদর্শর মতো সে ও জ্ঞান হারাবে এই মাঝ রাস্তায়। ব্যাগ থেকে জলটা বার করে কাগজগুলো ব্যাগে ভরে নিলো ও। মাথা ভর্তি কেবল একটাই চিন্তা তা হলো টাকার। কোথা থেকে জোগাড় করবে ও এতগুলো টাকা?

…..

‘আচ্ছা আমার ছেলের জ্ঞান ফিরতে কতখন সময় লাগবে বলতে পারবি? ‘

কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলেন আদর্শর বাবা, তার ভীত কন্ঠ শুনে ডক্টর মৃদুল ওনার কাধে হাত রেখে বললেন,
‘চিন্তা নেই। হি ইজ আউট অফ ডেন্জার। আর আমি আছি তো আমি ওর ট্রিটমেন্ট এর দায়িত্ব নিলাম। ‘

ডক্টর মৃদুল আদর্শর বাবার বন্ধু হওয়ায় আদর্শর বাবা বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘হ্যাঁ রে মৃদুল একটা বাড়তি সাহায্য করবি আমাকে?’

‘হ্যাঁ বল! ‘

‘হসপিটালের সামনে সি সি টিভি আছে না? ওটার ফুটেজটা একটু চেক করা যাবে? ‘

উনি প্রশ্ন করলেন,
‘কেন হঠাৎ সিসিটিভি যে! তাছাড়া এভাবে তো সিসিটিভি বললে তো আর চেক করা যায় না। ‘

উনি মিনতির সুরে তার বন্ধুকে বললেন,
‘ আসলে হসপিটাল অবধি আমি আদর্শকে নিয়ে আসিনি। অন্য একটা মেয়ে নিয়ে ওকে এখানে এসেছে, সে আমাকে ফোন করা মাত্রই আমি এলাম। ছেলেটা এতো ছন্নছাড়া হয়ে গেছে যে তাকে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে রাখা যায় না। কে জানতো এরকম একটা এক্সিডেন্ট বাধিয়ে বসবে। কিন্তু তাকে আমি ধন্যবাদ জানতে চাই যে ওকে এখানে এনেছে। খুবই দরকার তার পরিচয় পাওয়া নাহলে আমি নিজের কাছে অনেকটাই নীচে নেমে যাবো। ‘

ডক্টর মৃদুল গলা থেকে স্টেথোস্কোপটা নামিয়ে হাতে নিয়ে ভাবুক সুরে বললেন,
‘আচ্ছা আমার সাথে আয়। কিছু করা যায় কি দেখছি। ‘

আদর্শর বাবা ডক্টর মৃদুলের সাথে গেলেন, ওনার ভাবনাটা আদতেও সত্য কি তা একবার পরখ করে দেখা উচিত। যদি তা সত্য হয় তবে তিনি লাবণ্যর কাছে গিয়ে পুনরায় ক্ষমা চাইবেন আদর্শর হয়ে আর সীমাহীন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসবে লাবণ্যকে যে এত কিছুর পরেও সে আদর্শর পাশে থেকেছে।

….

কয়েকদিন ধরেই আবহাওয়ার করুন অবস্থা। দক্ষিনা বাতাস দূরে থাক, গরমে যেন পুরো শহর উত্তাল হয়ে গেছে। ঝাকে ঝাকে পাখিদের আর আকাশে উড়তে দেখা যায়না। ফ্ল্যাটের সামনের বড়ো বড়ো নারিকেল আর ইউক্যালিপটাস গাছগুলো যেন পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব বাধিয়েছে যে তারা কিছুতেই তাদের মাথা নাড়াবেনা। গরমের সময় বেলা বড়ো হয়, দুপুর বাড়ার সাথে সাথে যেন তেষ্টা বেড়ে যায়। সামনে রমজান মাস তারপর ঈদ। লাবণ্য ফ্লোরে বসে বিছানার সাথে গা এলিয়ে বসে আছে, শুভ অনেকখন আগেই ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে দিয়ে গেছে লাবণ্য তা ছুঁয়েও দেখেনি। বাড়ি ফিরে জানতে পারে যে লাবণ্যর বাবা বিকালেই লাবণ্যর মামার বাসায় গেছেন কারন লাবণ্যর মামা অসুস্থ। লাবণ্যর মা মারা গেলেও সম্পর্ক গুলোর পরিবর্তন হয়নি বিন্দুমাত্র। মামার জন্য চিন্তাবোধ হলেও সারা রাত ধরে লাবণ্য ঠান্ডা মাথায় সবটা ভাবতে পারবে ভেবে মনে হালকা প্রশান্তি ছেয়ে গেল। লাবণ্যর ঘরের দরজা খোলা। শুভ কাধে ব্যাগ নিয়ে লাবণ্যর ঘরের সামনে গিয়ে বলল,
‘ দিদি ফ্লোরে বসে আছো যে? শরীর খারাপ? জলটাও যে খাওনি। ‘

শুভর প্রশ্নের উত্তর কথায় নয় কাজের মাধ্যমে দিতে চাইলো সে তাই বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ অনেকটা জল খেয়ে হাতের ওপর পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এবার তুই পড়তে যা। ‘

শুভ মাথা নাড়ালো। ব্যাগটা কাধে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যেতেই চেনার মধ্যেও অপরিচিত একজনকে দেখে শুভ আর বেরোলো না, ঘরে ঢুকে মেইন দরজাটা দিয়ে দিল। দরজা লক করার শব্দ শুনে লাবণ্য ওর ঘর থেকে চিৎকার দিল,
‘শুভ তুই এখনো যাসনি? কখন যাবি তুই? ‘

শুভ লাবণ্যর ঘরের সামনে এসে বলল,
‘ কে একটা আমাদের ঘরের দিকে আসছে। তুমি বাড়িতে একা আছো তাই তোমাকে একা রেখে আমি যাবো না। ‘

লাবণ্য ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ানো মাত্রই কলিং বেল বেজে উঠলো। লাবণ্য শুভকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
‘তুই আমার বড়ো নাকি আমি তোর বড়ো কোনটা বলতো? ‘

শুভ তার দিদির বিষয়ে নাছোড়বান্দা। সে কোনভাবেই লাবণ্যর বিপদ হতে দেবে না। সে লাবণ্যর কথা উপেক্ষা করে বলল,
‘সে তুমি যা ই বলো আর তার ই বলো। আমি তোমাকে একা রেখে কথাও যাচ্ছি না। আর আমি এতোটাও ছোট নেই। ক্লাস ১২ এর ছেলেরা এতো ছোট হয় না বুঝেছো?’

লাবণ্য শুভর পাগলামোতে হাসবে না বকবে বুঝতে পারছে না। কলিংবেল টা পুনরায় বেজে উঠলো। লাবণ্য সেদিকে যেতে গেলেই শুভ বলল,
‘তুমি দাঁড়াও আমি খুলছি। ‘

লাবণ্য চোখ রাঙালো। শুভ দমে গেল। লাবণ্য গিয়ে দরজাটা খুললো। শুভ অধীর আগ্ৰহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য। কারন মানুষের মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় তার মানসিক অবস্থা। আর লাবণ্যর বিষয়ে শুভ জিনিসটা বেশ অবজার্ভ করে কারন এখনকার লাবণ্য আর তিন বছর আগের লাবণ্যর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত তাই হয়তো শুভর বেশি কৌতুহল জাগে তার দিদিকে নিয়ে।

লাবণ্য দরজাটা খুলেই আদর্শর বাবাকে দেখলো। ওনাকে হয়তো এই মুহূর্তে এখানে আশা করেনি ও। লাবণ্য থমকালো, কি রিয়েক্ট করবে সে বিষয়ে যেন তার মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। লাবণ্য শুভর দিকে একবার তাকালো। লাবণ্যর দৃষ্টিতে শুভর ভাবনা গুলো আরও তালগোল পাকিয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ লাবণ্যকে বলতে শুনলো,
‘আপনি এখানে? ‘

দরজার ওপারের মানুষটা আদর্শর বাবা। তিনি নরম কন্ঠে বলল,
‘ভিতরে আসতে পারি? ‘

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা থেকে সরে দাঁড়লো। উনি ভিতরে আসলেন।
লাবণ্য শুভকে বললেন,
‘শুভ জল নিয়ে আয়। ‘

শুভ কাধ থেকে ব্যাগটা খুলে জল আনতে গেল। উনি সোফাতে বসলেন মাথা নীচু করে। লাবণ্যর বলার মতো কিছু নেই তবে তিনি কি শুধুই কৃতজ্ঞতার খাতিরে এখানে এসেছেন কি না সেটাই জানার।

শুভ জল এনে ওনাকে দিল। উনি কাঁপা হাতে গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুক খেয়ে গলা ভেজালেন। উনি রিতিমত ইতস্তত বোধ করছেন এটা ভেবে যে কিভাবে বলা শুরু করবে। লাবণ্য চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে। লাবণ্য কিছু বলছে না। নিরবতা ভেঙে আদর্শর বাবা বললেন,
‘ দেখো লাবণ্য তোমার প্রতি সত্যিই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কি বলে যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো তা বলার ও ভাষা নেই। ‘

লাবণ্য কঠিন স্বরে বলল,
‘ তার কোন দরকার হবে না অঙ্কেল। আমি সব ভুলে গেছি। ‘

উনি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শুভ বেশ চমকে গেল। লাবণ্য শিউরে উঠলো ওনাকে দেখে। ছেলের অকর্মের জন্য কোন বাবাকে আজ অবধি এতো ভেঙে পড়তে দেখেনি লাবণ্য, নেহাতই তিনি ভালো মানুষ তাই আদর্শকে এখনও নিজের ছেলের পরিচয় দেন।
লাবণ্যর কন্ঠস্বর কাঁপলো। ওনার কাছে গিয়ে ওনার পাশে বসলো। উনি কাঁদছেন এখনো। লাবণ্য সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ। এতোটা অনুতপ্ত বোধহয় আদর্শ নিজেও হয়নি কখনো।
লাবণ্য বেশ কিছুখন থেমে বলল,
‘আপনি এর আগেও আপনার ছেলের হয়ে আমার কাছে বহুবার ক্ষমতা চেয়েছেন। বিষয়টা এবার বড্ড তেঁতো হয়ে যাচ্ছে। আমি সত্যিই আর কিছু মনে রাখিনি, সবটা ভুলে গেছি আমি। ‘

লাবণ্যর কথাতে উনি মুখ তুলে তাকালেন। চোখটা মুছে বললেন,
‘সবকিছু কি আর এত সহজে ভোলা যায় রে মা। যায়না। আমি জানি তুমি এখনো কিছু ভোলোনি। তাছাড়া আদর্শ দেশে ফিরেছে, একই শহরের একই আকাশের নীচে তোমরা দুজন, পুনরায় দেখা যে হবে না সে আশা আমি রাখি না। ‘

লাবণ্য চুপ করে রইলো। কিছু কি বলা উচিত এখন ওর নাকি নিরব হয়ে সবটা শুনে যাওয়া উচিত।
আদর্শর বাবা থামলেন না।
‘আমি জানি তুমি আদর্শকে হসপিটালে দিয়ে এসেছো। আমি প্রথমে চিনেও চিনতে পারিনি পরে সি সি টিভি ফুটেজ দেখে জানলাম। সত্যি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোমার কি দরকার হবে তুমি শুধু আমাকে বলবে, আমি সবসময় তোমার আর তোমার পরিবারের পাশে আছি। ‘

লাবণ্য ওনার কথায় কর্ণপাত করলো না। লাগামহীন ভাবে বলল,
‘আমার কোন প্রয়োজন নেই আঙ্কেল তাছাড়া আমি আবার বিয়ে করছি। আমার একজনকে বেশ পছন্দ। তাই সুবিধা অসুবিধা তে তাকে আমাদের পাশে পাবো এই আশা রাখি। আপনি সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না। ‘

উনি মাথা নীচু করে বসলেন। শুভ হয়তো কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে বিষয়টা কি। আদর্শর বাবা উঠে দাঁড়ালৈন। লাবণ্যর সামনে হাত জোড় করে বললেন,
‘পারলে আমাকে আর আমার ছেলেকে ক্ষমা করিস রে মা। আমি চাই না আমার ছেলে নতুন করে তোমাকে বিরক্ত করুক। দরকার পড়লে আমি আবার ওকে বিদেশ পাঠিয়ে দেব। কিন্তু ওর জন্য তোমাকে আর সমস্যায় পড়তে দেবো না। ‘

লাবণ্য ওনার হাতটা নামিয়ে বললেন,
‘আমি আপনার ছোট আঙ্কেল প্লিজ এভাবে বলবেন না। আর আপনার ছেলে এখনও আমাকে বিরক্ত করেনি। তবে চিন্তা করবেন না। ‘

লাবণ্য সত্যিটা লুকিয়ে গেল কিসের কারনে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না তবে এই মিথ্যা টা বলতে যেন তার বিন্দু মাত্র খারাপ লাগলো না।

উনি বেরিয়ে গেলেন। শুভর দিকে লাবণ্যর চোখ পড়তেই দেখলো শুভ কপাল কুঁচকে গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। লাবণ্য ধমকের সাথে বলল,
‘কি ভাবছিস কি? টিউশন যা। নাকি যাওয়ার ইচ্ছা নেই। ‘

শুভ সোফা থেকে ব্যাগটা নিয়ে লাবণ্যর সাথে আর কোন কথা বাড়ালো না। দরজা অবধি নম্র ভাবে ব্যাগটা কাধে নিয়ে দরজা দেওয়ার পরই দৌড়ে ছুটলো। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই সে লিফটে ঢুকে আদর্শর বাবার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো।
শুভকে হঁপাতে দেখে আদর্শর বাবা প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি ঠিক আছো তো? ‘

শুভ ওনার কথার তোয়াক্কা না করে বলল,
‘দিদি মিথ্যা কথা বলছে। আদর্শ দার সাথে দিদির দেখা হয়েছে আর তা নিয়ে দিদি বেশ চিন্তিত।”

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘তাহলে! ‘

লিফট থেমে গেল। শুভ লিফট থেকে বেরিয়ে বলল,
‘আপনি শুধু আদর্শ দা কে বলবেন যে দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে, দিদি তাকে ইনভইট করেছে।’

কথাটা বলে শুভ দৌড়ে পালালো। আদর্শর বাবা কিছু বুঝলেন না উল্টে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন শুভর যাওয়ার দিকে।

#চলবে,,,