কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-৭+৮

0
501

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

০৭.

অনেক রাত হয়েছে কিন্তু শুভ এখনো বাড়িতে ফেরেনি দেখে লাবণ্যর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে এলো। পাইচারি করে গোটা বারান্দাতে পায়ের ছাপ ফেলেছে সে। রাত দশটা বাজতে যায়। অন্যদিন সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসে সে কিন্তু আজ সাড়ে দশটা অবধি গড়ালো। শুভর জোরাজুরিতে মাহিন সাহেব শুভকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলেন তবে তাতে লাবণ্যর আপত্তি ছিলো বেশ। টেস্ট পরিক্ষায় নাম্বার খারাপ আসায় শুভর আর বেশিদিন ফোন চালানোর সুযোগ হয়নি। তবে আজ নিজের কাজকর্মের জন্য বড্ড আফশোষ হচ্ছে লাবণ্যর। শুধু মনে হচ্ছে যদি শুভকে ফোনটা দিত। লাবণ্য ওর বাবাকে এখনও ফোন করে জানায়নি নতুবা উনি চিন্তিত হয়ে পড়বেন আর তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসবেন কিন্তু বেশি দেরি হলেও বিপদ। ভয়ে লাবণ্যর চোখে জল চলে এলো, গলায় বেশ ব্যাথা অনুভব করছে সে। লাবণ্যর দিশেহারা লাগছে নিজেকে? শুভর টিচারকে কল করেছে সে, তিনি বলেছেন শুভ আসেনি আজ পড়তে।

একটা পর্যায়ে লাবণ্য কেঁদে ফেলল। নিস্তব্ধ ঘর জুড়ে কেবল লাবণ্যর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ ভাসছে। মোবাইলের রিঙটোনের শব্দে লাবণ্য কেঁপে উঠলো। হুড়মুড়িয়ে উঠে ফোনটা ধরলো, আদর্শর নাম্বার। লাবণ্য নাম্বারটা দেখে থমকে গেল, এই মুহূর্তে ফোনটা কি ওর ধরা উচিত?
এসব হাজারো ভাবনাচিন্তার মাঝে একটাই কথা মনে কড়া নাড়লো, ‘আদর্শ ঠিক আছেন? ‘

মানবতার খাতিরে কি পুরোনো প্রেমের খাতিরে তা বলতে পারে না তবে কোন একটা কারনে লাবণ্য ফোনটা ধরলো। লাবণ্যর কন্ঠস্বর কাঁপছে। লাবণ্য ফোনটা কানে নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘হ্যালো! ‘

অপর পাশ থেকে কোন উত্তর এলো না, কিন্তু আদর্শর নিশ্বাসের শব্দ লাবণ্য শুনতে পাচ্ছে। লাবণ্য কোন উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,
‘হ্যালো! ‘

আদর্শর বেশ ভালো লাগছে লাবণ্যর এমন ভয়ার্ত কন্ঠস্বর শুনতে তাই সে পুনরায় নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। লাবণ্য এবার ভয়ে কেঁদেই ফেলল, অশ্রুসিক্ত চোখে, গোঙানির সুরে বলল,
‘চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন! আপনারা সবাই কি আমাকে গুমরে চিন্তায় চিন্তায় শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন? ‘

কথাটা বলে লাবণ্য কাঁদতে লাগল, লাবণ্যর হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেল। লাবণ্য কাঁদছে। আদর্শর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। লাবণ্য কাঁদতে লাগলো মেঝেতে বসে। সত্যিই কি তার জীবনে শান্তি নেই?

তৎক্ষনাৎ দরজার বেল বেজে উঠলো। লাবণ্য ছলছল চোখে দরজার দিকে তাকালো। দৌড়ে দরজার কাছে ছুটে গেল। দরজা খুলতেই দেখলো শুভ দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য শুভকে দেখে চোখ মুছে বলল,
‘শুভ তুই ঠিক আছিস? ‘

শুভ লাবণ্যর কথার তোয়াক্কা না করে বলল,
‘আমি ঠিক আছি, কিন্তু আদর্শ দা একদম ঠিক নেই। আদর্শ দা আমাকে বাড়ি অবধি পৌছে দিল। দাদার অবস্থা ভালো নয়। ‘

লাবণ্য দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে ওড়নাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। লাবণ্য শুভকে ভয়ার্ত কন্ঠে জিঞ্জাসা করলো,
‘উনি কোথায়? ‘

শুভ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘দাদা নীচে আছে। লিফটে উঠতে পারেনি। ‘

লাবণ্য ধমকালো,
‘ওনাকে ধরে আনলিনা কেন? একা ছাড়লি কেন? ‘

শুভ বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘আদর্শ দা কে দেখে যদি তুমি রেগে যেতে তাই দাদা আসেনি।’

লাবণ্য ছুটলো। শুভ ও লাবণ্যর পিছনে ছুটলো। লিফটটা নীচের তালায় আসতেই দেখলো সেখানে আদর্শ নেই। শুভ অবাক হয়ে বলল,
‘ এ কি আদর্শ দা তো এখানেই ছিল কোথায় গেল? ‘
লাবণ্য আশেপাশে সব দিক চোখ বুলিয়ে আদর্শ কে কোথাও খুঁজে পেলো না। লাবণ্য শুভর কাছে এসে কঠিন সুরে বলল,
‘ উনি কোথায় শুভ? ‘
শুভ এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলল,
‘দাদা তো এখানেই ছিলো। গাড়িতে গায়ের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি আসতে বললাম এলো না। বললো তুমি রাগ করবে। ‘

কথাটা শুনে লাবণ্যর রাগ হলো সাথে শুভর সাথে আদর্শর দেখা হওয়ার বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন জাগলো ওর মনে।

লাবণ্য শুভর দিকে ঘুরে চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘সত্যি করে বলতো শুভ তুই ওনার সাথে কি করছিলিস? উনি তো হসপিটালে ছিলেন তাহলে তোর সাথে এই অবধি এলো কি করে। ‘

শুভ মৃদু চাপা কন্ঠে বলল,
‘আসলে আদর্শ দার বাবা যখন বাড়িতে আসলেন তখন আমি ওনাকে চিনতে পারিনি পরে তোমাদের কথা শুনে বুঝলাম উনি আদর্শ দার বাবা আর আদর্শ দা এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি। আদর্শ দা কলকাতা এসে সবার আগে আমার সাথেই যোগাযোগ করেছিল তাই এই কদিনে দাদার সাথে আমার সম্পর্কটা আরও ভালো হয়ে গিয়েছিল। দাদার এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে পরে ওনার বাবাকে বললাম যেন তার সাথে আমাকেও নিয়ে যান হসপিটালে আদর্শ দার সাথে দেখা করার জন্য। আমি ওনার সাথে গেলাম। আমাকে দেখে আদর্শ দা খুব খুশি হয়েছিল। দাদা অনেক রিকোয়েস্ট করলো তার বাবাকে যে সে কিছুতেই হসপিটালে থাকবে না। তুমি তো জানো দাদা কতোটা জেদি। পরে আদর্শ দার বাবা একটা গাড়ি পাঠালেন আর সেটা করে দাদা আমাকে বাড়ি অবধি পৌছে দিয়ে গেল, আমি অনেকবার আসার কথা বললেও দাদা আসেনি। কিন্তু দাদার শরীরটা এখনও বেশ খারাপ, গাড়িতে অনেকবার ব্যাথায় ছটফট করেছে। আমি দৌড়ে ছুটে আসলাম তোমার ডাকতে কিন্তু ততখন দাদা চলে গেছে। ‘

কথাটা একনাগাড়ে বলে গেল শুভ, লাবণ্যর মনে হলো শুভ যেন তাকে কোন বিষাদের গল্প শোনাচ্ছে। লাবণ্য ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লাবণ্যকে এভাবে তাকাতে দেখে শুভ মিনমিন করে বলল,
‘সরি দিদি, তোমাকে বলে যাওয়া উচিত ছিল। নেক্সট টাইম আর ভুল হবে না। ‘

লাবণ্য রাগী চোখে শুভর দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘তুই এসব আমাকে আগে বলিস নি কেন শুভ? ওনার সাথে যে তোর যোগাযোগ আছে সেটাও কেন বলিস নি আমাকে? ‘

‘ বললে তুমি আর দাদা কখনো এক হতে পারতে না। ‘

লাবণ্য আলতো করে শুভর গালে চড় মেরে বলল,
‘বেশি বুঝতে শিখেছিস তুই। তোর ব্যাবস্থা করছি আমি। আজকের পর ভেবেছিলাম ফোনটা তোকে ব্যাবহার করতে দেব কিন্তু না। পড়াশোনা না করে তুই লোকের পিয়নগিরি করিস।’

কথাটা বলার পর শুভ কান ধরে বলল,
‘ সরি আর হবে না। কিন্তু তুমি আদর্শ দা কে ভুল ভেবো না। ‘

লাবণ্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘শুভভভভভ। ঘরে চল। আর ওনার সাথে নেক্সট টাইম যোগাযোগ করলে আমি বাবাকে বলে দেবো সব।’

লাবণ্যর গম্ভীরতার মাঝেও শুভ ফিক করে হেসে ফেলল। লাবণ্য রাগী ভাব নিয়ে লিফটে উঠলো। শুভ চেঁচিয়ে বলল,
‘ দিদি বললাম তো এমন আর হবে না। তুমি প্লিজ বাবাকে বলোনা এসব। ‘
লাবণ্য শুনেও না শোনার ভান করে রইলো।

……

‘রাত কটা বাজে তোমার খেয়াল আছে? তুমি অসুস্থ আদর্শ। বারবার বারন করার সত্বেও তুমি হসপিটাল থেকে বাড়িতে চলে আসলে, এতে ক্ষতি টা কার? ‘

আদর্শ রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘লাবণ্যর। ‘

আদর্শর বাবা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘মানে টা কি? ‘

আদর্শ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
‘এই যে আমি মরলে লাবণ্য অকালে বিধবা হবে তাতে ক্ষতি টা কার? ক্ষতিটা তো ওর ই তাইনা? ‘

উনি বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললেন,
‘মেয়েটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। সে তোমাকে হসপিটাল অবধি নিয়ে গেছে সেটাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়? অন্য মেয়ে হলে তোমার দিকে ঘুরেও তাকানো না, নেহাতই ভালো মেয়ে লাবণ্য। ‘

আদর্শ ওনার কথা একেবারেই গায়ে মাখলো না, চুপ করে শুনে গেল। আদর্শর বাবাও চুপ করে আদর্শর ভাবভঙ্গি দেখছে। না পেরে উনি বললেন,
‘হয়েছে তোমার প্রকৃতি বিলাস? এবার চলো। তোমার মা খাবার গরম করেছেন, তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। ”

ওনাকে অবাক করে দিয়ে আদর্শ বলল,
‘ তোমার লাবণ্যকে ভালো লাগে বাবা? ‘

উনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদর্শ কে উনি একদমই বোঝেন না। আদর্শ বলল,
‘ আমারও লাবণ্যকে ভালোলাগে তাই তো দূরে সরে যেতে পারি না। কি করবো বলো! ‘

উনি কিছু না বলেই চলে গেলেন, আর আদর্শর মাকে বললেন,
‘আদর্শর মা তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে, তাকে ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাও। ‘

আদর্শ মুচকি হাসলো ওর বাবার কথা শুনে। এবার পায়ের যন্ত্রনাটা বাড়ছে, আদর্শ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, বসে পড়লো চেয়ারে।
আকাশের তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। আদর্শ কান্ত হাতটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে তারা গোনার চেষ্টা করলো। নিমেষেই সবটা এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো, হিসেবের গড়মিল হলো আর একরাশ ঘুম ভর করে এলো আদর্শর চোখে। লাবণ্যর মুখটা আবছা মনে পড়তে লাগলো তারপর বাস্তব থেকে আদর্শ এক কল্পনার জগতে প্রবেশ করলো যেখানে তার লাবণ্য তার নিজের মতোই। আদর্শ কল্পনাতেই সুখী, বাস্তব সুখী হতে ভাগ্য লাগে আর যা তাদের নেই।

#চলবে,,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

০৮.

‘দিদি তুমি আর আমার সাথে কথা বলছো না কেন? কালকের জন্য কি তুমি এখনও রাগ করে আছো? ‘

লাবণ্য সোফাতে বসে বসে জুতো পরছে সেই মুহূর্তে শুভর কথাগুলো শুনেও উত্তর দিল না ও। পরমুহুর্তেই শুভ বলে উঠলো,
‘দেখো বাবা বাড়ি চলে আসবে একটু পরেই আর এসে যদি দেখে তুমি আমার সাথে কথা বলছো না তখন বাবা আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে। ‘

লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
‘কোন কিছুর তোয়াক্কা করিস তুই? ‘

শুভ এবার লাবণ্যর পায়ের কাছে বসে লাবণ্যর দু হাত ধরে বলল,
‘এ বারের মতো ক্ষমা করে দাও, নেক্সট টাইম আর কখনো এমন ভুল হবে না প্রমিস। ‘

লাবণ্য একটু নরম সুরে বলল,
‘সত্যি তো? ‘

‘তিন সত্যি।’

লাবণ্য শুভর হাতটা ছাড়িয়ে নিজের মথায় শুভর হাতটা রেখে বলল,
‘ আমার মাথায় হাত রেখে বল তাহলে যে কখনো আর আদর্শর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না। ‘

শুভ কাচুমাচু মুখ করে বলল,
‘ তোমার মাথায় হাত দিয়ে মিথ্যা বললে অকালে মরবে তুমি। আমি তা চাইনা। ‘

লাবণ্য শুভর কান ধরে বলল,
‘ আজ বাবা আসুক, বলে দেবো যে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাস।’

শুভ লাবণ্যর হাতটা ধরে মিনতির সুরে বলল,
‘ এই না না, তুমি বাবাকে বলবে না প্লিজ আর তাছাড়া আমি আগে এক দুই বার খেয়েছি কিন্তু তুমি বারন করার পর আর কখনো খাইনি। ‘

লাবণ্য শুভর হাতটা ছাড়িয়ে বলল,
‘ শুভ ওঠ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘

‘তুমি বাবাকে বলবে না তো? ‘

লাবণ্য ব্যাগটা চেক করতে করতে বলল,
‘ভেবে দেখবো। ‘

শুভর মুখে কালো মেঘের ছায়া পড়লো যেন। লাবণ্য ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শুভ প্রশ্ন করলো,
‘ তুমি আজকে অফিসে যাচ্ছো না? ‘

শুভর প্রশ্নে লাবণ্য থমকালো। কঠিন স্বরে জবাব দিলো,
‘না। ‘

পরক্ষনেই একটু সময় নিয়ে বলল,
‘ আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। ‘

শুভ লাবণ্যর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ কেন? ‘

‘ ভালো লাগছিলোনা তাই। আর কিছু জিঞ্জাস্য? ‘

শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ভালোই হয়েছে তোমার ওই চাকরিটা গেছে, ওরা তোমাকে কি পরিমান খাটাতো। ভালোই হলো এবার থেকে তুমি বাড়িতে থাকবে আর কোন ম্যাথ প্রবলেম হলে সময় করে বুঝিয়ে দিতে পারবে। ‘

লাবণ্য দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে বলল,
‘ চাকরি খুঁজতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হলেও হতে পারে। বাবাকে বলে দিস। ‘

শুভ বেকুব হয়ে গেল।
‘ এই না তুমি বললে তোমার চাকরি করতে ভালো লাগছে না তাই ছেড়ে দিয়েছো তাহলে আবার কি? ‘

ততখনে লাবণ্য চলে গেছে। শুভর মাথায় এলো যে কথাটা আদর্শকে জানানো উচিত। শুভ বাড়ির টেলিফোন থেকে আদর্শকে কল করলো,
‘আদর্শ দা তুমি এখন কেমন আছো? জানো তো দিদি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ‘

…..

‘সত্যি করে বলুন সুজয় এ বিষয়ে আপনি কি কিছু জানেন? ‘

অফিসের সুজয় নামের ছেলেটার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল লাবণ্য। তার ধারনা যদি খুব ভুল না হয় তো সেদিনের সেই হিসাবের গড়মিল সুজয়ের কারসাজি। লাবণ্য কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে তা। আর সে যদি আরও ভুল না হয় তো সুজয় কাজটা করেছে লাবণ্যর প্রতি রাগে কারন সে সুজয়কে প্রত্যাখ্যান করেছে বহুবার।

সুজয়ের মুখের হাবভাব অস্বাভাবিক। সে হয়তো এতো সহজে আন্দাজ করতে পারেনি যে লাবণ্য বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি ধরে ফেলবে।

সে ঘাবড়ে গেল তবুও নত স্বীকার করলো না।

‘তুমি কি বলছো তোমার মাথার ঠিক আছে লাবণ্য? আমি এই বিষয়ে কি করে জানবো? তোমার হিসাব তুমি রখো আর তার গড়মিল কোথায় আর কিভাবে হলো তা আমি কি করে জানবো? এতো টাকার গড়মিল করে এখন এর সব দোষ আমাকে দিতে চইছো? ‘

লাবণ্য ভ্রু কুঁচকালো। সে কঠিন স্বরে বলল,
‘দেখুন সুজয় সত্যিটা কখনো চাপা থাকে না, তা একদিন না একদিন জানাজানি হবেই। তাছাড়া আমি সেদিন হাফ ডে অফিস করে চলে গিয়েছিলাম তারপরের সি সি টিভি ফুটেজ ও গায়েব। আর সিসসি টিভি আপনি নিজেও মাঝে মাঝে অপারেট করেন তাই আপনার ওপর সন্দেহের আঙুল তুলতে আমি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করছি না তা আপনি আমার কথাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারছেন আশা করি। ‘

সুজয় এবার নিজেকে বাঁচাতে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলল। টেবিলের ওপর হাত দিয়ে সপাটে একটা বাড়ি মারলো যার আওয়াজ হলো বেশ এবং মানুষজন ঘটনার উৎস বুঝতে ওদের দিকে তাকালো। লাবণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আপনি এমন করছেন কেন? শান্ত পরিবেশে এমন বিশৃঙ্খলা করছেন কেন? ‘

সুজয় নিজের ঘাড়ের দোষ নামাতে একপ্রকার জোরালো গলায় বলল,
‘দেখো লাবণ্য তোমাকে পছন্দ করতাম বলে এটা ভেবো না যে তুমি যা বলবে তাই মুখ বুজে মেনে নেবো। যেই দেখছো এতো টাকার গড়মিল অমনি আমার ওপর দোষ চাপাতে চলে এলে! তুমি কি ভাবলে আমি বোকা কিছু বুঝি না? শোনো আর একবার ও এমন কিছু করার চেষ্টা করলে আমি থানায় গিয়ে তোমার নামে কমপ্লেইন করে আসবো বলে রাখলাম। ‘

কথাটা বলে সুজয় বেরিয়ে গেল লাবণ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। আশেপাশের মানুষ লাবণ্য কে অপরাধীর চোখে দেখছে। কিন্তু কেও জানলোই না যে সুজয় আসল দোষী। সে উল্টে লাবণ্যর ঘাড়ে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে বুক ফলিয়ে বেরিয়ে গেল।

লাবণ্য নিস্তব্ধ হয়ে রইলো কিছুখন। তার সমগ্ৰ শরীর কাঁপছে, ঠোঁট জোড়াও কাঁপছে ভয়ে আর রাগে। লাবণ্যর চোখের কোনে নোনাজলের ভীড় জমে আসতে লাগল। কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস গুলোকে কেবল তার সাথেই হতে হয়?

লাবণ্য উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে যেতেই নিলেই ওয়েটার বললেন,
‘ম্যাম এনি প্রবলেম? ‘

লাবণ্য মাথা নীচু করে মাথা নাড়ালো।

রেস্টুরেন্ট এর বাইরে এসে চোখটা মুছে নিল লাবণ্য। বাইরে তাপমাত্রা ৪৩ডিগ্ৰি প্রায়। লাবণ্য ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখতে গিয়ে হাতে যেন একপ্রকার ছ্যাকা খেল, ফোনটা তাপে গমগম করছে যেন। চটজলদি সময় দেখে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাটা শুরু করলো। তার ছাতাটা সে আদর্শ কে দিয়ে দিয়েছিল তার পর আর ছাতা কেনা হয়নি। লাবণ্য দিশেহারা। বুঝে উঠতে পারছে না যে এখন তার কি করা উচিত, মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। রিকশা নেবে নাকি হেটে যাবে? শরীর আর বইছে না। সকালে যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল এখন সেই আত্মবিশ্বাস মাথা নুইয়েছে।

ফোনটা ভাইব্রেট হতেই লাবণ্য ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করলো অজানা একটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। লাবণ্য ফোন ধরার সাথে সাথেই অপর পাশ থেকে এক অপরিচিত কন্ঠস্বর থেকে আওয়াজ ভেসে এল,
‘ আপনি কি লাবণ্য আহমেদ? ‘

লাবণ্য প্রথমে খানিকটা অবাক হলো তারপর বলল,
‘হ্যাঁ? তবে কেন? ‘

‘আপনি যে জবের ইন্টারভিউ এর জন্য দরখাস্ত করেছিলেন আমরা সেটার জন্যই ফোন করেছি আপনাকে। আমাদের কোম্পানিতে নতুন স্টাফ লাগবে। আপনার বায়োডাটা টা স্যার দেখেছেন। আপনি আজকেই চলে আসুন দুপুর ১২ টার পর। ‘

লাবণ্য আকাশ থেকে পড়লো যেন, এ তো মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু সে কবে কোথায় কোন কোম্পানিতে ইন্টারভিউ এর জন্য দরখাস্ত করেছিল তা ওর মনে পড়ছে না, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে ভাবার চেষ্টা করেও কোন কূলকিনারা পেল না ও। বিধায় আর ভাবার চেষ্টা করলো না।
‘আপনাদের অফিসটা কোথায় যদি কাইন্ডলি বলতেন, আসলে আমার ঠিক মাথায় আসছে না কোন কোম্পানিতে জবের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। ‘

উনি লাবণ্য কে এড্রেস বললেন, লাবণ্য থমকালো এড্রেস শুনে, এখানে তো আদর্শদের অফিস। সে কবে আদর্শ দের অফিসে জবের জন্য এপ্লাই করেছিল তার মনে নেই। ‘

লাবণ্য ‘ওকে’ বলে ফোনটা কাটলো। পা দুটো এগোচ্ছে না আবার পেছাচ্ছেও না। বিষয়টা তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই মুহূর্তে তার জবটার ভীষন প্রায়োজন আর এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা ওকে ফেরত দিতে হবে আর এক সপ্তাহের আগে সে কোন জব পাবে কি তার নিশ্চয়তা নেই। লাবণ্য আর কিছু ভাবলো না, পা বাড়ালো আদর্শদের অফিসের দিকে। টাকাটা তার প্রয়োজন।

#চলবে,,,