কারণে অকারণে ভালোবাসি02 পর্ব-২০+২১

0
631

#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি02
#সুরাইয়া_আয়াত

২০.

আরিশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাম হাতটা দিয়ে আরুশির ডান হাতটাকে আঁকড়ে ধরলো আরিশ। ডান হাত আলতো স্পর্শে বুকের বা পাশে রাখলো। আরুর দৃষ্টি স্হির। অনুভূতি গুলো দূরন্ত ও চঞ্চল। আরুর হৃদস্পন্দন বাড়ছে, শ্বাস প্রশ্বাস গুলো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এক অকল্পনীয় রুদ্ধশ্বাস অনুভুতি। আরিশ সবকিছু ভুলে আরুর মায়াবী চেহারাতে তার সব ধ্যান ঞ্জান আর ভালোবাসা সপে দিয়েছে। আরিশ চোখটা বন্ধ করে জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে এক উত্তেজনার সাথে বলল

— আরুপাখি।

আরু চমকালো-কেঁপে উঠলো যেন। তড়িৎ গতিতে উত্তর ওর ঠোঁটের কোনে চলে এলো। অনুভূতিগুলো বুকের মাঝে মাদল বাজাচ্ছে। চোখে প্রানোচ্ছাস আর বুকে টিমটিমে জমানো অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে নম্র সুরে আর ভ্রু জোঁড়া প্রসারিত করে বলল

— জ্বিইই!

আরিশ আরুর হাতটা যেন এপিঠ ওপিঠ করে নাড়াচাড়া করে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো। আরিশ উষ্ণ বিমোহিত কন্ঠে বলে উঠলো

— তুমি জানো যে তোমার কাছে প্রকাশ করার মতো আর সপে দেওয়ার মতো কোন অবশিষ্টাংশ আর আমার কাছে না। আমি মানুষটা নিজেই নিজেকে সপে দিয়েছি তোমাতে। যদি বলি যে আর বলবার কিছু নেই তবে নিঃসন্দেহে তুমি ধরতে পারো যে আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি। হাজার হাজার শব্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে না হয় আরও কিছু বাড়তি কথা বললাম তোমাকে। জানো তো যখন তোমাকে আগলে আগলে রাখতাম সেই দিনগুলো কেবল চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য আর যখন সেই আরুপাখিকে আমি পেয়ে গেলাম তখন তো আমার চাওয়াটা আরও দ্বিগুণ হলো। আমি না কখনও তোমাকে অন্য কারোর সাথে কল্পনা করতেই পারিনি, হিংসা হতো বড্ড। এখনো হিংসা হয় যখন দেখি চুপচাপ মুখ গুমরে বসে আছো অভিমান করে কিন্তু আমাকে কিছুই বলছো না, একা একা অভিমান করে আছো, তখন আমার হিংসা হয় এটা ভেবে যে ইশ যদি তার অভিমানে আমিও কিছুটা ভাগ বসাতে পারতাম কি ভালোই না হতো।

আরিশের কথাটা শুনে আরুর মুখের হাসিটা প্রশস্ত হলো। চারিদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান।

আরুর হাসিটাকে উপলক্ষ করে আরিশ বললো
— হাসছো! মাঝে মাঝে এই বুকে এতো জ্বালা হয় বলে বোঝাতে পারবো না। জানোতো আমি প্রতিটা রাতে নিজে আগে না খেয়ে তোমাকে আগে খাইয়ে তারপর নিজে খাই না কেন?

আরু কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল
— না।

— আমি জানি তুমি হাউজওয়াইফ না, আর হতে চাইলেও হয়তো আমি কখনো তোমাকে হতে দেবো না।
তুমি সারাদিন এ যে কতো কাজ করো তুমি কি তার হিসাব রাখো? আর সারাদিন এত কাজ করার পর ও তোমার আগে আমি খেয়ে নেবো এটা ভাবলে কি করে?

আরু ভ্রু কুঁচকে চাইলো। আরিশের কথার অর্থ বোঝা বড্ড ঘোলাটে ধরনের।

— তোমার কাজের তালিকা বলতে গেলে হয়তো আজকে রাতটা পুরোটাই কেটে যাবে বলতে বলতে। তার স্পেশাল কিছু কাজের মধ্যে আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেস্ট লাগে সেটা হলো এই যে তুমি সারাদিন আমাকে বিরক্ত করো সেটা। সকালে উঠতে না উঠতে তুমি যে রোজ হাতে গুনে আমাকে চার চারটে কিল মারো তাতে আমার শরীরের ব্যথা কমে, মাঝে মাঝে কানে কামড়ে ধরো সেটাতে মনে হয় যেন আরও বেশি শুনতে পাচ্ছি। যখন চুল গুলো টেনে দাও তখন সারাদিনে কাজের সব প্রেশার নেমে যায় মাথা থেকে রিল্যাক্স লাগে। যখন মাঝে মাঝে হাতে কামড়ে দাও তখন যেন মনে হয় কেও শরীরে এন্টিসেপটিক পুশ করে দিয়েছে, আর আমি তখন আরও বেশি সতর্ক হয়ে যায় আর অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ ই অনুভব করি না। যখন তুমি আমাকে বকা দাও তখন আমি আমার ছোট্টবেলাটাকে খুঁজে পায় আর যখন তুমি কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে এসে হামলে পড়ো তখন আমি আমার জীবনটাকে অনুভব করতে পারি। আমার সাথে অতোপ্রোত ভাবে মিশে থাকা আমার আরুপাখি নামক এক অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারি। একজনকে ভালোবেসে তার চোখের জল টা মুছিয়ে দিয়ে তাকে এক মুঠো সুখ এনে দেওয়ার জন্য একটা ঝুঁকি নিতে পারি। তাকে যেমন আমি অকারনে ধমকাতেও পারি তেমনি তাকে অকারনে কাছে টেনেও নিতে পারি। এতো কাজ করেও তুমি কলান্ত হও না হ্যাঁ!

মি অভদ্রর ডিক্সনারিতে ভালোবাসার জন্য কারনের প্রয়োজন হয় না, শুধু মন চাইলেই ভালোবাসা যায়, অপ্রোজনে আর অকারনে ভালোবাসা। তাই তো বলি কারনে অকারনে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ ফর নো রিজন।

কথাটা বলে আরুর চোখের দিকে তাকালো আরিশ। আরুর চোখে জল টলটল করছে। আরিশ আরুকে ধমকের সুরে বলল
— একদম কাঁদবে না আরুপাখি। তোমাকে না আমি বারন করেছিলাম।

আরু এর ফুঁপিয়ে উঠলো, চোখ থেকে এখনো জল গড়ায়নি তবে জমে আছে গোপনে। আরু ভেজা কন্ঠে বলল
— সব বারন মানা যায় না মি অভদ্র কিছু বারন হয় অকারনেও। তাই আমাকে কাঁদতে দিন। প্লিজ কাঁদতে দিন।

কথাটা বলে আরিশ এর বুকে হামলে পড়লো আরু। আর কাঁদছে আর সেই চোখের জলে ভিজছে আরিশের মন। আরিশের চোখের কোনে জল এলো তবে তা তৎক্ষণাৎ মুছে নিলো। আরুকে জড়িয়ে আছে আরিশ। ওদেরকে ঘিরে থাকা সকলের চোখে জল। কেও কেও চোখ ও মুছছে। আজ বর্ষন হচ্ছে অঝোর ধারাতে। ভালোবাসার বর্ষন।

____

— ফুপিমা ফুপিমা শোনো না আজকে কিন্তু আমাকে ব্রেকফাস্টে ওই ডিম দিবা না। আমরা খেতে একদম ভালো লাগে না। আর আমি যে এই কথাটা তোমাকে বলেছি সেটাও মিঃ অভদ্রকে বলবানা প্লিজ 🙂

আরুর এমন নিষ্পাপ কন্ঠ শুনে অনিকা খান বলে উঠলেন
— আরিশ জানলে কি হবে শুনি?

আরু ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেল এ অনিকা খানের দিকে তাকিয়ে বলল
— এখন কি তুমিও তোমার ছেলের মতো ডেভিল রুপ ধারন করবা?

অনিকা খান হো হো করে হেসে ফেললেন আরুর কথা শুনে। আরুর কপালে ভালোবাসার পরশ একে বললেন
— তোকে গোমরা মুখে মানায় না মা। তোকে এরকম চঞ্চলই ভালো লাগে। আর কখনও মন খারাপ করে থাকবিনা।

আরু হঠাৎই গম্ভীর স্বরে বলল
— আচ্ছা শাশুড়ি আম্মা মুখ গোমরা করে থাকলে কি আমাকে বেড়ালের মতো লাগে? তুমিই বলো!

অনিকা খান ফিক করে হেসে বলল
— এসব তোকে কে বলেছে পাগল।

— মি অভদ্র বলেছেন। কালকে আমি একটু মুখটা গোমরা করেছিলাম তাই উনি আমাকে এরকম বলবে তুমি বলো! কতো সাহস আমাকে বলে বেড়াল।

অনিকা খান ফাজলামো করে বললেন
— আরিশ যখন বলেছে তখন ঠিক বলতেও পারে।

আরু রেগে গিয়ে বলল
— ফুপি তুমি এরকম বলছো তো! তুমিও ওনার দলে হয়ে গেলে! খাবো না আমি ব্রেকফাস্ট। আজকে মধুর বিয়েতে যাবো, ওখান থাকে আমি মীরপুর চলে যাবো। তোমার অভদ্র ছেলে সিঙ্গাপুরে সুখে থাক।

কথাটা বলে আরু উঠে যেতে গেলেই আরিশ নীচে নামতে নামতে বলল
— আম্মু আরু পাখির ব্রেকফাস্ট কই! দাও আমার কাছে।

কথাটা শুনে আরু শুকনো ঢোক গিলে অনিকা খানের দিকে তাকালেন। উনি মুচকি হেসে আরুর প্লেটে খাবার সাজানোর জন্য চলে গেলেন। আরু নিরীহ প্রানীর মতো চুপচাপ বসে রইলো। আরিশ আরুর পাশের চেয়ারে বসে আছে। সানা এখনো নামেনি।

অনিকা খান খাবারটা আরিশের সামনে ধরে আরুর দিকে দেওয়ার ইশারা করে চলে গেলেন।

আরিশ প্লেট টা হাতে নিয়ে প্রথমেই ডিমটা তুলে আরুর দিকে ধরলো। ডিম দেখে আরু অনিকা খান এর দিকে তাকালেন, তিনি মুচকি হাসছেন।
আরু জোরে চিৎকার দিয়ে বললো
— তুমিও নিজেকে তোমার ছেলের মতো জল্লাদ প্রমান করে ছাড়লে তো। হায়রে দুনিয়া। এই পৃথিবীতে আমার মতো নিরীহ প্রানী তুমি একটাই কেন রাখলে আল্লাহ। আমি এই কোন জল্লাদের মাঝে ফেসে গেলাম। আমি এবার কি করে এই বাসায় সারভাইভ করবো এবং কি করে খাবো আর কে আমাকে বাঁচাবে এদের হাত থেকে। কি পাপ আমি করেছিলাম!

আরু মিথ্যা কাঁদোকাদো ভঙ্গিতে এসব আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরিশ ধমক দিয়ে বলল
— এই মেয়ে একদম চুপ। কি শুরু করলে! খেতে গেলে এতসব বাহানা করা লাগে? তাড়াতাড়ি খাও নাহলে আরও অনেক কিছু গেলাবো তখন বুঝবে মজা।

আরু আরিশের কাছ থেকে প্লেটটা কেড়ে নিয়ে বলল
— দিন আমাকে দিন। আপনার সব নাটক মনে হলে আপনাকে খাওয়াতে হবে না। আমি নিজেই পারবো।

আরিশ চোখ রঙিয়ে কিছু বলতে গেলেই আরু বলল
–থাক থাক কিছু বলতে হবে না। এমনিতেও আপনি কয়েকদিনের মেহমান। আপনি তো সিঙ্গাপুর চলে যাবেন তখন তো আমাকে একাই খেতে হবে তাই আমাকে অভ্যাস করতে দিন।

আরুর কথাটা শুনে অরিশ ভ্রু কুঁচকে বলল
— লাস্ট কবূল নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলেন কিছু মনে পড়ে?

আরু ভাবনার সুরে বলল
— সত্যিই তো মনে পড়ছে না। রোজ তো আপনিই।

কথাটা বলে বাকিটা আর বললো না। উল্টে নিজে ধমক দিয়ে বলল

— তোওও তো! খাইনি বলে কি খাবো না? আপনি চলে গেলে তখন কে খাওয়াবে শুনি!

আরিশ আরুর কাছ থেকে প্লেট টা নিয়ে বলল
–যতদিন আছি ততদিন না হয় আমাকে খাওয়াতে দাও। চলে গেলে কিন্তু কেও এভাবে বলবে না তখন আমাকে মিস করবে দেখবেন মিস ড্রামা কুইন।

আরু মুখ ভাঙচি দিয়ে বলল
— বললেই হলো। আমি মোটেও আপনাকে মিস করবো না হু। আমি হবো যাস্ট স্বাধীন, উড়ন্ত পাখির মতো।

আরিশ একবার একরোখা হেসে বলল
— আচ্ছা দেখা যাবে কে কাকে মিস করে।

আরু আরিশের হাত থেকে খাবার খেয়ে নিয়ে বলল

— হমম হমম দেখা যাবে। আর আবার বলছি আমি মোটেই আপনাকে মিস করবো না হু। আমার বয়েই গেছে।

#চলবে,,

#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি০২
#সুরাইয়া_আয়াত

২১.

— অরিও শোনো না, আজ রাতে তুমি আমার সাথে ঘুমাবে কিন্তু। আমার তোমার সাথে অনেক কথা আছে। আমার অনেক ভয় ভয় লাগছে এই পুরো বিয়ে ব্যাপারটা জুঁড়ে। জীবনে প্রথমবার বিয়ে করছি।

একপ্রকার ভয়ার্ত আর লাজুক কন্ঠে বলে উঠলো মধু। আরু ভ্রু কুঁচকে বলল
— ভয় লাগছে সেটা স্বাভাবিক বাট জীবনে প্রথম বিয়ে করছি মানে টা কি? এখনো আরও দুই চারটে বিয়ে করার প্ল্যান আছে নাকি?

পেয়ারায় কামড় দিয়ে কথা বলতে বলতে মধুকে ধমকে উঠলো আরু। মধু বেশ ভড়কে গেল।
— আসলে না আমি সেটা বলতে চাইনি। আরিশ ভাইয়ায় তো ভয় টা বাড়িয়ে দিলো এটা বলে যে সবকিছু নিয়ে আমি ভয় পাচ্ছি কি না আর ভয় পেলে তোমাকে যেন সে সব কথা জিজ্ঞাসা করি।

আরু মাথাটা মধুর দিক খানিকটা ঝুঁকিয়ে চোখ ছোট করে প্রশ্ন করলো
— মি অভদ্র একথা বলেছে?

— হমম, আরিশ ভাইয়াই তো বললেন যেন তোমাকে সব বলি। তুমি নাকি অনেক এক্সপিরিয়েন্সড এই বিয়ে সম্মন্ধে।

আরু কথাটা শুনে মুখ বাকিয়ে বলল
— হাহ! বিয়েটা কি করে হয়, কিভাবে হয় তাই জানলাম না। আর বলে নকল এক্সপইরিয়েন্সড। বাসর রাতটাও কেমন হয় সেটা অবধি জানি না।

কথাটা শেষ হলো না। আরিশ হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে আরুর দিক প্রশ্ন ছুঁড়লো।
— কেন তোমার কি আবার সেই বিয়ে আর বাসর রাত টাইপের ফিল দরকার আরুপাখি।

আরুর চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। মধু ছিলো পাশে সে লজ্জায় সেখান থেকে চলে গেল।
আরু রাগী চোখে আরিশের দিকে তাকিয়ে বলল
— আপনি আবার ও প্রমান করলেন যে আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে অভদ্র পুরুষ। কোথায় কি বলতে হয় তার হিতাহিত জ্ঞান টুকুও কি আপনার আছে না গেছে।

আরিশ অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলল
— গেছে।

আরু ভ্রু কুঁচকে বলল্
— লাইক সিরিয়াসলি!

আরিশ আরুর নাকে আঙুল দিয়ে আলতো স্পর্শ করে বলল
— আমার ডায়ালগ আমাকেই?

আরু মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল
— তা নয় তো কি হ্যাঁ! যা বলেছি ঠিক ই তো বলেছি । মধু বেচারা নিজের অবস্থা সামাল দিতে বেসামাল, আর আপনি ওকে আরও লজ্জা পাইয়ে দিলেন হু।

আরিশ আরুর গা ঘেষে দাড়িয়ে বলল
— তা কি কি টিপস দিলে।

— কিছু বলতে পারলাম আর কই তার আগেই তো আপনি হাজির।

— তার মানে আপনার তো দেখছি বিয়ে আর বাসর সম্মন্ধে অনেক জ্ঞান তা আমাকেও একটু জ্ঞান দিন এসব নিয়ে তাহলে উপকৃত হতাম বড্ডডডড!

আরিশের লম্বা টেনে বলা কথা শুনে আরু মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল
— এই যে আপনি আমার পিঠ বরাবর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন তাতে আমার পিঠটা জ্বলে যাচ্ছে। সরে দাঁড়িয়ে যা বলার তা বলুন।

আরিশ আরুর দিকে ঝুকে বলল
— রিয়েলি আরুপাখি।

আরু হাতে থাকা পেয়ারটা দূরে ফেলে দিয়ে বলল্
— হমম হমম হমম।

আরিশ আরুর দিকে দুষ্টুমি ভঙ্গিমায় চোখ টিপ মেরে বলল
— আমি যখন জ্বালিয়ে দিয়েছি তখন তা বুজিয়ে মলমটা লাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম।

আর ভ্রু কুঁচকে অকস্মাৎ কষ্ঠে বলল
— মানে।

আরিশ ফিচেল হেসে আরুর হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল।

আরু আলতো জোরালো কন্ঠে বলল
— আআআআ, মি অভদ্র ছাড়ুন আমি মিথ্যা বলেছি। থলি থলি থলি।

আরিশ বাসার সবচেয়ে পিছনের ঘরটাতে আরুকে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে বলল
— এই থলি থলি কি, সরি বলো।

আরু আরিশের বুকে আলতো স্পর্শ দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল
— সরি আর আপনাকে! নেভার! তাই তো থলি থলি থলি। আর এটা আপনি কোথায় নিয়ে এলেন আমাকে। এটা কোন ঘর।

আরিশ আরুর হাতটা ধরে আরুকে পুনরায় আগের স্থানে নিয়ে আসলো আর আরুর শাড়ির আঁচল ভেদ করে হাত আরুর কোমরে রাখতেই ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে আরু কেঁপে উঠলো আর আরিশের পাঞ্জাবী টা শক্ত করে চেপে ধরলো।
আরু চোখ বন্ধ করে নিলেই আরিশ আরুর মুখে ফু দলের আরু চোখ খুলে তাকালো। আরিশের দৃষ্টি আরুর দিকে, গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে আরিশ। আরু সেই দৃষ্টির মায়ায় পড়ে গেল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। আরিশ আরুর গলায় হাত রেখে আরুর মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল
— আজকে রাতে বাসর করবো বলে একটা সেফ জায়গা খুঁজছিলাম ফাইনালি পেয়েও গেলাম তোমার পছন্দ হয়নি?

আরু লজ্জা আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল
— ধ্যাত! খালি বাজে কথা বলেন কেন! এই ঘরটাতেই নানাভাইয়ের সব জিনিস রাখা আছে আর তা আপনি জানেন আর নানাভাইয়ের আলমারীতে তার একটা ছবি ছিল তা নিতেই আপনি এসেছিলেন সেটা বললেই তো হয়।

আরিশ আবার ফু দিয়ে বলল
— সবই তো জানো দেখছি।

আরু কিছু বললো না। আরিশ বলল
— আবার নতুন করে বিয়ে করবো অরুপাখি। আবার নতুন করে বিয়ে হবে, হবে বাসর। পূর্ণতা পাবে সকল অনুভূতি।

পূর্ণতা শব্দটা শুনতেই আরু ভারী কন্ঠে বলল
— সব অপূর্ণতা পূর্ণতা পেলেও একটা পূর্ণতা পাবে না আর আপনার জীবনে সেই পূর্ণতা না দিতে পারায় আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না মি অভদ্র।
মুখে হাসি ফুটিয়ে ভারী কন্ঠে আরু এমন কথা বলে উঠলো
আরিশ আরুর দিকে অপলক চেয়ে আছে, তার আরুপাখিটা তার অজান্তেই বড়ো হয়ে গেল না তো!
আরিশ আরুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
— আরুপাখি!

আরুও আরিশকে জড়িয়ে ধরে বলল
— হমম!

— তোমার আর্শিয়ান যদি কখনো আসে তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো? আমার আগের আরুপাখিই থাকবে তো?

কথাটা শুনে আরু উচ্চস্বরে হেসে বলল
— মি অভদ্র আপনিও না।

কথাটা শুনে হাসতে হাসতেই আরু চোখের জল মুছে বললো
— দেখেছেন এমন কথা বললেন যে হাসতে হাসতে চোখে জল ই চলে এলো। এমন কথা কেও বলে?

আরিশ ভারী কন্ঠে বলল
— কেন! বলে কি অন্যায় করে ফেললাম বুঝি?

আরু আরিশের নাকটা টেনে দিয়ে বলল
— আমি আর কল্পনা নিয়ে বাঁচতে চায় না মি অভদ্র। আমার যেটুকু আছে আর যতটুকু আছে ততটুকু নিয়েই বাঁচতে শিখেছি। আর তা কে শিখিয়েছে জানেন?

আরিশ এ এক অন্য আরুকে দেখছে যেন। আরুর কথার উত্তর এ ও পাল্টা জবাব দিলো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে রাইলো।

— কোন এক জাতীয় অভদ্র আমাকে শিখিয়েছে যে নিজের যা আছে তা নিয়েই বাঁচতে শেখো। নিজের যা আছে সেটুকুকেই ভলোবাসো। আর আমি বাঁচার এক পন্থা পেয়েছি জানেন তো। এ এক অন্য রকম বাঁচা। নিজের আপনজন দের সাথে বাঁচা। জীবনের শেষ টুকু সময় অবধি তাদের সাথে হাসি মুখে বাঁচা। অপূর্ণতা কার মধ্যে নেই বলুন তো! তেমনি আমারও না হয় কিছু অপূর্ণতা আছে। আর আমি সত্যিই ভীষন খুশি জানেন তো এটা ভেবে যে আমার এই অপূর্ণতাকে মহাশূন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক অভদ্র আমাকে এক আকাশ ভালোবাসা এনে দিয়েছে যা কখনো শেষ ই হবে না। আমার মৃত্যু অবধি তো আরামসে সেই ভালোবাসা দিয়ে আমি কাটিয়ে দিতে পারবো। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় কি জানেন তো
আমার বেবি হবেনা জেনেও না তার মাঝে কোন পরিবর্তন নেই। যেন সে শুধু আমাকেই চেয়েছিল এমন। তবে হ্যাঁ একটা কথা হলো যে সে নাকি সত্যিই পরের সপ্তাহে সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি তাকে একটুও মিস করবো না। একটুও নাহ। কোন জাতীয় অভদ্রকে কেও মিস করে নাকি!

কথাটা বলে আরু গিয়ে খাটের ওপর বসলো।

আরিশ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আরুর দিকে তাকিয়ে দেখছে। আরু বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে আর চুপচাপ বসে আছে যেন কিছুই হয়নি। আরিশের বুকের ভিতর এক ভারী অপরাধ বোধ জমা হতে লাগলো। সে আরুকে তো বাঁচতে শিখিয়ে দিয়েছে কিন্তু আরুকে পূর্ণতা দিতে গিয়ে সে যদি আরুকে হারিয়ে ফেলে তখন তাকে নতুন করে কে বাঁচতে শেখাবে! হ্যাঁ সত্যিই আরিশ স্বার্থপর। আর আরুকে নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষটুকু তাকে হতে হয় সে হবে।

আরিশ গিয়ে আরুর পাশে বসলো অর বললো
— আরু পাখি!

— হমম বলুন।

— চলো বিয়ে করি।

আরু অরিশের দিকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল
— আজকে আমার করার মুড নাই। অন্য দিন বলিয়েন।

আরিশ এবার হো হো করে হেসে ফেলল। আরু আরিশের হাসির দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। আরিশ হাসছে ভীষন।

— আজব তো হাসছেন কেন?

আরিশ হাসতে হাসতে বলল
— তা হাসবোনা বলছো?

আরু আরিশের মুখের দু পাশটা চেপে বলল
— না হাসবেন না, চুপ করে থাকুন।

আরিশ তবুও হাসছে। আরু এবার মুখটা পুরোপুরি চেপে ধরে আরিশের একপ্রকার কোলে উঠে গেল প্রায়। আরু বলল
— আপনার চুপ থাকার খুবই প্রয়োজন কারন আমি একটা কথা বলবো তা আপনি চুপচাপ শুনবো।

আরিশ সত্যিই এবার চুপ হয়ে গেল। আরু অবাক হলো বটে তবে এই সুযোগে বলল

— মধু অনেক ভয় পাচ্ছে। তাই ও বলেছে ওর সাথে ঘুমাতে। আমি হ্যাঁ করে দিয়েছি। কোনভাবেই না করতে পারবো না। আপনিও মানা করবেন না প্লিজ প্লিজ।

আরিশ চোখের ইশরায় বলল যে মুখটা ছেড়ে দিতে।
আরু হাতটা ছেড়ে দিয়ে সরে এসে বলল
— তোমার সব অন্যায় আবদার আমি মানতে পারলেও এটা পারবো না তাই ভুলে যাও আর মধুর এতোই ভয় লাগলে তার জামাইকে তার সাথে রাখুক না আমার বউকে নিয়ে টানাটানি কেন।

— টানাটানি কই। আমি তো ঠিকই আছে। আর আপনি এমন নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলবেন না। বেচারি ভয় পাচ্ছে।

আরিশ ধমক দিয়ে বলল
— এমনিতেই তিনটা বছর তো আলাদাই থাকবো। আর তো মাত্র এই কদিন। আর কয়েকটা দিন না হয় আমার সাথে কষ্ট করে থেকে যাও! হাহ।

আরু আরিশের চুলগুলো নিয়ে আঁকিবুকি করে বলল
— আপনি একটু আগে কি বললেন মনে আছে?

— কি বলেছি আরুপাখি?

— আপনি আমার সব অন্যায় আবদার মেনে নেবেন।

— হমম শুধু, আমার থেকে দূরে দূরে থাকা আর ইনক্লুডিং ডিভোর্স।

আরু হুঠ করে বলে ফেলল
— তাহলে আপনি সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন কেন! প্লিজ থেকে যান না।

কথাটা হঠাৎ করে আবেগের বশে বলে ফেলল আরু। মনের কথা আগেই বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, তেমনটাই।

অরিশ আরুর হাত ধরে ওর কোলে আরুকে বসিয়ে বলল
— সত্যি বলছো যাবো না?

— আরু আরিশের কোলে বসে আরিশের দাঁড়াতে আকিবুকি করে বলল
— নাহ মিথ্যা বলেছি।

আরিশ মনে মনে বলল
— আরুপাখি তুমি শুধু একবার বলো যে মি অভদ্র যাবেন না।

আরিশের ভাবনার শেষ হলো না, আরু হঠাৎই আরিশের গলা জড়িয়ে আরিশের বুকে মাথা রাখলো। আরিশ ও আরুকে জড়িয়ে ধরলো।
— আপনি না আমার একটা খুব বাজে অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছেন। আচ্ছা আপনি চলে গেলে আমি সকালে কাকে কিল মেরে গুড মর্নিং বলবো। ব্রেকফাস্ট কে খাইয়ে দেবে? কলেজে কে দিয়ে আসবে? কলেজ মিস করলে সব টপিক গুলো কে বুঝিয়ে দেবে? হুঠহাঠ বাইরে যাওয়ার অবদার করলে কে পূরণ করবে? মাঝ রাতে কে হাওয়াই মিঠাই খাওয়াবে? হসপিটাল থেকে ফিরে এসে কে আমার কাছে কফি চাইবে? শ্বশুরবাবা তো শাশুড়ি আম্মুর হাতের কফি খাই অলওয়েজ। আমি কার জন্য বানাবো? নিজের জন্য? না না, নিজের জন্য কষ্ট করে কে বানায়, বরং তিনটে বছর কফি খাবো না।
তারপর হুঠহাঠ কে শপিং এ নিয়ে গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে আমাকে? কে আমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করবে? হুঠহাঠ খিদে পেলে কে রান্না করে খাওয়াবে?কে বলবে আরুপাখি শীতকালে মোজা ছাড়া ঘুরবে না। কে বলবে আরুপাখি লাফিয়ে হাটবে না একদম। কে মাঝ রাতে বাইক নিয়ে আমাকে ঘুরতে যাবে? কে শীতের রাতে অনেকগুলো সোয়েটার পরিয়ে আমাকে নিয়ে হাটতে বেরোবে? কে কে কে? কে বলবে নো মোর ওয়ার্ডস।
যাই হোক কেও না বলুক তাতে আমার কি। আমার কাওকে লাগবেনা হু।

আরিশের গলা ধরে এলো। মুখ দিয়ে কথা বার হচ্ছে না যেন। বহুকষ্টে বলল
— আরুপাখি।

আরু আরিশের শার্টের কলার ধরে চোখ বন্ধ করে বলল
— নাও আই এম স্লিপি। আমি এখন ঘুমাবো।

আরিশ আরুর কপালে চুমু দিলো। আরু চোখ বন্ধ করে বলল
— আমি কিন্তু আপনাকে একদম মিস করবোনা বলে রাখলাম। গুড নাইট।

আরিশ হেসে ফেলল। ওভাবেই ততখন বসে রইল যখন না আরুর ঘুম ভাঙে।

#চলবে,,