#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি02
#সুরাইয়া_আয়াত
১৮.
— আরুপাখি কি হচ্ছে টা কি! শান্ত হয়ে বসতে বললাম না তোমাকে? এতো নড়াচড়া করলে হয়!
আরু ঠোঁট ফুলিয়ে মলীন কন্ঠে বলল
— আমার পা ব্যাথা করছে খুব আর খুব ক্ষিধে পেয়েছে। এভাবে এতখন বসে থাকা যায়!
আরিশ আরুর হাত মেহেন্দী দেওয়া আপাতত থামিয়ে দিলো, একহাতে বহু কষ্টে মেহেদী পরিয়েছে আরিশ আর অপর হাতে দেওয়ার রিতীমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। ক্ষনিকের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আরিশ বলল
— কি খাবে? আম্মু বাসায় নেই, মধুর হলুদের জন্য শাড়ি কিনতে গেছে, সানাও বাসায় নেই, তাই আমাকেই বানাতে হবে তাই ঝটপট বলে ফেলো।
আরু দুষ্টুমি একটা হেসে বলল
— আইসক্রিম খেলেই আমার পেট ভরে যাবে। খাই না প্লিজ! ফ্রিজেই আছে। বিকালে শ্বশউরবাবা এনে দিয়েছে।
আরিশ রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
— বাবাকে বলবো যেন এই শীতের দিনে তার এইসব অন্যায় আবদার পালন থেকে বিরত থাকে।
কথাটা বলে আরিশ রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলো তখনই আরু গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলল
— মি অভদ্র যাচ্ছেন যখন এই মশাগুলোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান না, এরা আমাকে বিরক্ত করছে খুব।
আরিশ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলল
— তোমার যাতে বোরিং ফিল না হয় সেজন্য ওদেরকে তোমার কাছে রেখে এলাম। নাও সিং আ সঙ!
আরু বিরক্তি সহকারে চেঁচিয়ে বলল
— আপনি একটা জাতীয় অভদ্র কিংবা তার থেকেও বেশি। আহ! মশা কামড়াচ্ছে তাড়াতাড়ি আসুন।
আরিশের নীভু কন্ঠের আওয়াজ এলো
— এতো বেসুরে কেন তুমি, একটু ভালো করে গাও।
আরু আর কিছু বললো না, থেমে গেল, মেহেদি দেওয়া হাত ই এপাশ ওপাশ ছুঁড়ছে আর মশাদের সাথে কারণহীন একপ্রকার যুদ্ধে নেমেছে।
দশ মিনিট পার হতেই আরুর আর ধৈর্যে কুলালো না, আরু এবার হাত পা ছেড়ে শুয়ে পড়লো আর গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলল
— আরিশ ভাইয়া কোথায় আপনি, আই মিস ইউ।
কথাটা বলা সারা আর আরিশ সেই মুহূর্তে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো, আরু একটা সাফল্যর হাসি হেসে বলল
— আপনাকে ভাইয়া বলে ডাকলে এত দ্রুত আপনার রেসপন্স পাওয়া যায় যে কান্ট সে। যাক ভালোই হলো আপনি এসেছেন।
আরিশ পাস্তার বাটিটা বেডের ওপর রেখে দরজা দিতে দিতে বলল
— আরও কি একটা বেশ বলছিলেন যেন। মিস ইউ না কি! আবার বলো!
আরু এবার ফাজলামির সুরে বলল
— আমি বলছিলাম যে আপনি একটা ভালো বউ পাবেন পুরো উইইইমা টুইটুই টাইপের।
কথাটা বলে আরিশের দিকে দুষ্টামি চাহনিতে তাকালেই আরিশ তেজী কন্ঠে বলল
— কোন গালে আগে থাপ্পড় দিব, ডানে নাকি বামে?
আরু খিলখিল করে হেসে উঠলো, এই মানুষটাকে বিরক্ত করায় যেন তার সবচেয়ে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
— হাসলেও থাপ্পড় দিবো। হা করো জলদি। আরেক হাতে যেটুকু বাকি আছে সেটা দিয়ে দিই, আমার কাজ আছে।
আরু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সন্ধ্যা ছয়টা বাজতে পনেরো মিনিট, শীতের দিনের রাত তাই অনেকটা সময়।
— আমার মেহেদী দেওয়ার হয়ে গেলে আপনি কি কাজ করবেন?
আরিশ ভ্রূ কুঁচকে বলল
— কেন?
আরু ভাবলেশহীন ভাবে বলল
— আমি একটু ঘুমাবো। ঘুম পাচ্ছে আমার। কালকে রাতে ঘুম হয়নি।
— আজাইরা চিন্তা করলে এমনই হয়। হা করো।
আরু হা করলো। আরিশ এক চামচ পাস্তা নিয়ে আরু কে দিলো, আরু মুখ নাড়তে নাড়তে অস্পষ্ট সুরে বলল
— একটা প্রশ্ন করি?
— হমম।
— আপনার কলেজ লাইফে আপনার কখনও কাউকে ভালো লাগেনি? মানে ক্রাশ টাইপের কিছু। যাকে দেখলে আপনার হার্টবিট বেড়ে যেত। মনে আনন্দের ঘন্টা বাজতো টুংটুং করে। ওই যে দেখা হে তুঝে ইয়ার, দিল মে বাজি গিটার। ওরকম টাইপের ভাইবস!
আরিশ প্রয়োজন এর থেকেও ভীষন বিরক্তি নিয়ে বলল
— তোমার ঘুম পেলে প্লিজ ঘুমাও তবুও আমাকে আজাইরা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে পাগল করে দিওনা।
আরু আবার হা করলো, আরিশ আরু কে পাস্তাটা দিলো, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পাস্তা শেষ করলো আরু। আরিশ প্লেটটা রেখে এসে আরুর পাশে বসে বলল
— ডান হাতটা দাও, ওটা বাকি আছে অনেকটা।
আরু ওর পা আরিশের কোলের রাখলো। আরিশ অবাক হয়ে বলল
— হাত দিতে বলেছি নট পা।
আরু ঘুমাক্ত কন্ঠে বলল
— পা ব্যাথা করছে তাই একটু পা মেলে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। দুই মিনিট প্লিজ প্লিজ।
আরিশ আর কিছু বললো না, আরিশ দেখলো আরু হাত ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাম হাতের মেহেদির শুকনো ছিল তাই তা বেডশিটে লেগে ঘেটে যাইনি। আরিশ আর আরু কে ডাকলো না, আরুর গায়ে পাতলা চাঁদর দিয়ে দিলো। আরুর পা টা আলতো করে ওর কোলের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে পা টা ঢেকে দিলো। আরুর ডান হাতের মেহেদী টা সম্পূর্ণ করার জন্য হাতটা নিয়ে মেহেদি দিতে শুরু করলো। বেশ অনেকটা সময় লাগলো মেহেদী পরাতে। আরিশ আরুর হাতটা ধরে আছে যাতে কোনরকমে ঘেটে না যায়। এভাবেই কতোটা সময় যে পার হয়ে গেল তার ঠিক নেই।
ঘুম যখন ভাঙলো আরুর তখন দেখলো রুমে আরিশ নেই তবে নীচে সানার আর অনিকা খানের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আরু ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো, আরিশ রুমে নেই। বিছানা থেকে নামতে গেলেই দেখলো হাতে খসখসে জাতীয় জিনিস বাধছে। আরু তাকিয়ে দেখলো যে বিছানা জুড়ে মেহেদীর শুকনো গুড়ো পড়ে আছে। আরু দু হাত বাড়িয়ে দেখলো মেহেদির রঙ গাঢ় লাল টকটকে। মনে পড়ে গেল একবার আরুর মামীর বলা কথাটা। তিনি বলেছিলেন যে স্বামী ভালোবেসে হাতে মেহেদির পরিয়ে দিলে আর সেই মেহেদির রঙ যত গাঢ় হবে তার স্বামীর তার প্রথম ভালোবাসাও তত গাঢ়। আরু এসবে বিশ্বাস করে না, আর এই সব কথা আরিশ কে বললে আরিশ আরু কে বকাঝকা দিবে অনেক। আরু কথাটা ভেবে মুচকি হাসলো, কেন জানি না আজকে ওর মামীর বলা কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে অনেক। আরু মুচকি হাসলো। হাতটা ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো আরিশ বিছানায় বসে সব কাগজপত্র চেক করছে। হঠাৎ আরিশ কে এভাবে দেখে চমকে উঠলো আরু।
বেশ অবাক হয়ে বলল
— আপনি! কখন এলেন!
আরিশ কাজের ফাকে আরুর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কাজে স্বল্প মনোযোগ দিয়ে বলল
— কলেজ গিয়েছিলাম।
আরু হাতটা তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বলল
— হঠাৎ এত রাতে কলেজে কেন? কোন দরকারে?
আরিশ যেন হঠাৎই বেশ চুপ হয়ে গেল। তারপর নরম কন্ঠে বলল
— হমম দরকারে।
আরু ভ্রু কুঁচকে বলল
— আরে কি হয়েছে বলুন না, এত হেয়ালী করছেন কেন!
আরিশ হঠাৎই থমথমে কন্ঠে বলল
— আমাকে এ সিঙ্গাপুর যেতে হবে।
আরু বেশ খুশি হয়ে বলল
— বাহ তা তো ভালো কথা। তা কবে যাচ্ছেন।
আরিশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— নেক্সট উইক, ফ্লাইটের টিকিট রেডি। পাসপোর্ট ভিসা সব।
আরু তোয়ালে টা চেয়ারে রেখে আরিশের হাত ধরে বলল
— চলুন না আমার ভীষন ক্ষুদা পেয়েছে। খাবো।
আরিশ কিছু বলল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল
— আরুপাখি!
— হমম।
— আমি প্রায় তিন বছরের জন্য যাচ্ছি। স্কলারশিপ পেয়েছি আমি, রাশেদ ,জাহিদ সহ আরও অনেকজন।
তিন বছর কথাটা শুনে আরু আরিশের হাতটা ছেড়ে দিল। মুখটাও যেন ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল, কি বলবে বুঝতে পারছে না।
আরু মাথা নীচু করে কেবল বলল
— ওহহ!
আরিশ আচমকাই আরুর হাতটা টেনে আরু কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো, বেশ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল
— আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে আবার বিয়ে করবো নতুন করে, সবাই কে জানাবো আমার আরুপাখি শুধুই আমার।
কিন্তু সুযোগ থাকলেও এখন আর সময় নেই।
আরু চুপ করে আরিশের বুকে মাথা রেখেছে। চোখের কোনে জল টলটল করছে, আরিশ আর কিছু বললেই হয়তো কেঁদে দিবে।
আরিশ মৃদু কন্ঠে বলল
— কি হলো কিছু বলবে না! বলবে না মি অভদ্র যাবেন না।
আরু মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে বলবে না।
আরু এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরিশ কে ছাড়া নিজেকে যেখানে কল্পনা করা দায় সেখানে এতোটা দীর্ঘ সময় আরু কাটাবে কিভাবে!
আরিশ আরুর কপালে চুমু দিয়ে বলল
— অপেক্ষা করবে তো আমার জন্য?
আরু ফুঁপিয়ে কাঁদছে কিছু বলছে না।
#চলবে,,,,
#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি০২
#সুরাইয়া_আয়াত
১৯.
রাতে ডিনারে ডাইনিং টেবিলের আসরে একরাশ থমথমে পরিবেশ আর নিরবতার শোকশভা। কথা বলার মানুষটাই যে চুপ। সানা খাবার মুখে তুলে আরুর মুখের দিকে তাকালো। সবাই কেবল একে অপরের মুখের দিয়ে চাওয়া চাইয়ি করছে আরিশ ও আরু ব্যাতিত।
আরু কখন থেকে চামচ দিয়ে খাবারটা নাড়াচাড়া করেই চলেছে। আরিশের গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। আরু আরিশের পাশেই বসে সবসময় আজও তার ব্যাতিক্রম নয়। আরিশ আড়ালে আরুর এক হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই আরুর ধলা ধরে এল। কষ্টগুলো যেন গলায় এসে আটকে গলায় এক তীব্র পীড়া ঘটাচ্ছে, চোখে জল জমে আসছে আর শরীর জুড়ে একরাশ জড়তা। আরু খাচ্ছে না দেখে অনিকা খান ইশারায় আরিশকে আরুকে ভরসা দেওয়ার কথা বললেন।
আরিশ তিন বছরের জন্য যাবে তার থেকেও সকলের এটা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে যে দুজন একে অপরকে ছাড়া থাকবে কিভাবে যেখানে আরিশ একটা রাতের জন্য হলেও আরু কে পাশের রুমেও থাকতে দেয়না। সানা কিছু বলবে ভেবেও বলছে না। কি বলে শান্তনা দেবে সে? সে তো আর বাচ্চা নয় যে শান্তনা দিয়ে তাকে ভোলানো যাবে। সারাদিন দুজনের মাঝে টম আর জেরির মতো ক্যাটফাইট চলতেই থাকে যা এই খান পরিবারে কোনরকম কোন বিশৃঙ্খলা নয় বরং আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। অনিকা খান ও রিতিমতো প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছেন। আরু কে দেখে প্রানহীন লাগছে।
আরিশ এক লোকমা খাবার নিয়ে আরুর মুখের সামনে ধরলো
— আরুপাখি হা করো।
আরু ভাবলেশহীন। আরিশের কথা যেন তার কানে অবধি পৌছায়নি। আফজাল খান ও নীতু স্বরে বললেন
— আরু মা খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নে।
আরুর অঙ্গভঙ্গির কোন পরিবর্তন নেই। আরিশ এবার আরুর গালে হাত রেখে বলল
— আরুপাখি!
আরুর এবার যেন সম্বিত ফিরলো। খুব ধীরে সুস্থে মুখ তুলে আরিশের দিকে নম্র দৃষ্টিতে তাকালো।
ছোটবেলার একটা কবিতার কথা খুব করে মনে পড়লো আরিশের যখন আরুর চোখের দিকে তাকালো। ওই যে বলে না
— দিঘি ভরা জল করে ঢলঢল।
আরুর চক্ষুযুগল সেই দিঘির ন্যায় ই ঠেকছে আরিশের কাছে। আরুর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। এই চোখের জলের দরুন সে ক্ষমার যোগ্যতা রাখে কি তা ভাবাচ্ছে আরিশকে। নিজের কষ্টটাকে দমিয়ে রেখে আরিশ আরুকে বলে উঠলো
— আরুপাখি হা করো।
আরু আরিশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরিশের চোখের ভাষা আরুর কাছে স্পষ্ট। আরু হা করলো। আরিশ আরু কে এক লোকমা খাইয়ে দিল। অনিকা খান স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন। সানা মাথা নামিয়ে নিলো, আরু কে শেষ এমন ভেঙে পড়তে দেখছিলো যখন শুনেছিলো যে ওর বেবি হবে না সেই সময়।
আরু তার কষ্ট দুঃখ আর মান অভিমান কখনো কাওকে দেখায় না আরিশ ব্যাতিত। কারন সবাই অভিমান বোঝার ক্ষমতা রাখে না আর যে সেই অভিমান বোঝে আর অভিমান ভাঙানোর ক্ষমতা রাখে আরু তার কাছেই সব অভিমান জড়ো করে যে অভিমান ভাঙিয়ে এক আকাল সমান ভালোবাসা এনে দিতে পারে। কারন তার সেই মানুষটা আছে। ওর সব মান অভিমান আর কষ্টের ভাগীদার আরিশ নিজেই। আরুর উনিশ বছরের বয়সে বাহ্যিক ভাবে ম্যাচিওরিটি শব্দটা স্থান দখল করতে না পারলেও আভিমান প্রকাশের জন্য ম্যাচিওরিটি নামক শব্দটা ওকে সঙ্গ দিয়েছে।
খাবারটা মুখের একপাশ থেকে অপর পাশে সরে যাচ্ছে কিন্তু তা কতোটা পাচকযোগ্য তা আরুর ভাবনার মাঝে নেই। অনেকখন আরুর চোখের দিকে চেয়ে রইল আরিশ, প্রেয়শির চোখের আগত জলের জন্য নিজেকে কম অপরাধী মনে হচ্ছে না তার নিজেকে। আরিশ আর এক লোকমা মুখের সামনে ধরে বলল
— আরুপাখি হা করো।
হঠাৎ করে আরিশের এমন ব্যাথাতুর কন্ঠস্বরে আরুর চোখের জল আর বাধ মানলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, নিমেষেই খাবার গলায় আটকে এলো যেন। এক বেসামাল অধৌর্যতা। নিমেষেই বমি বমি ভাব চলে এলো আরুর মাঝে। বেসিনের দিকে ছুটে গেল আরু। সবাই যেন থমকে গেল নিমেষে। আরিশের হাত থেকে খাবরটা পড়ে গেল, আরিশ আরু্র কাছে ছুটে গেল।
আসলেই কি সব বিরহ কাটিয়ে ওঠা এত সহজ?
—
— আরিশ পরের সপ্তাহে চলে যাচ্ছে। আরু কে সামলানো যাচ্ছে না। কি করি বলতো এখন। যে কদিন আরিশ আছে সেই কদিন না হয় ঠিক আছে। কিন্তু ওরা দুজন দুজনকে ছাড়া থাকবে কি করে তা নিয়ে আমার কপালের ভাজ ছাড়ছে না।
টেবিলের ওপর লাউড স্পিকারে দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে অনিকা বেগমের বলা সব কথাগুলো শুনলেন আরমান সাহেব আর আফসানা বেগম। পুরো বিষয়টাই এতোটা বেদনাদায়ক যে ভাবা দায়। আরমান সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন।
— আরিশের যাওয়াটাও যে জরুরি অনিকা। এদিকে চাইলেও আরুকে আরিশের সঙ্গে পাঠানোটা অসম্ভব, আরু নিজের দ্বিতীয় বর্ষের। আরিশ যতদিনে ফিরবে ততদিনে তার ইন্টার্নশিপ চলবে প্রায়। এমতা অবস্থায় পরিস্থিতি প্রতিকূল।
আফসানা বেগম চোখের জল টা শাড়ির এক কোনা দিয়ে মুছে বললেন
— আমরা আছি তো। আর আরিশ কি বছরে একবার কি দুইবার হলেও আসবে না বাসায়?
আরমান সাহেব আপত্তির সুরে বললেন
— না না তা আরও বেশি কষ্টদায়ক হবে আরিশ আর আরুর উভয়ের জন্যই। একবার আসলে তখন ফিরে যেতে তার দ্বিগুণ কষ্ট হবে। তবে আরিশ যা করবে আমরা তো আর তার উপায় অবলম্বনে হস্তক্ষেপ করতে পারি না আর বললেও সে শুনবে না কখনোই।
অনিকা খান চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন
— আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। ছেলে মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা ভাইয়া।
আরমান সাহেব চিন্তিত সুরে বললেন
— কালকে মধুর হলুদ সন্ধাতে তোরা আসছিল তো! তখন কথা হচ্ছে। আমি দেখি আরু মা কে একটু কল করি।
অনিকা খান বারনের ভঙ্গিমায় বললেন
— না না, এখন ফোন করার দরকার নেই। আরু শুয়ে আছে। কিছুখন আগেই বমি করেছে। আরিশ ঔষুধ দিয়েছে। আমি একবার এক পলক দেখে এলাম। ছেলেটা ওর হাত ধরে বসেই আছে, আর এই ওই কতো কিছু বলছে কিন্তু আরুর মুখে কথা নেই।
আফসানা বেগম কাঁদোকাদো হয়ে গেলেন। আরিশ ছাড়া আরু কে সামলানোর মতো কেও নেই। হয় আরু নিজের মতো চলে অথবা আরিশের ভয়ে তার মতো চলে, আরিশ সর্বদা তাকে আগলে রাখে।
—
— আরুপাখি এখন রাত দুটো বাজে, তুমি এখনো ঘুমাও নি।
ঘরের ডিমলাইটটা মৃদু ভঙ্গিতে বেসামাল। আরুর মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা না গেলেও আরিশের পক্ষে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে আরু আদতেও ঘুমিয়েছে কি না।
আরু নিরব। ও কথা বললেই যেন এখনই আরিশ ওকে রেখে সিঙ্গাপুর চলে যাবে এমন ভয়েই হয়তো মূলত আরু ভীত।
আরিশ আরু্র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
— ক্ষুদা লেগেছে?
আরু মাথা নাড়ালো, যার অর্থ তার ক্ষুদা লাগে নাই। আরিশ আরুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আর বিছানা থেকে নেমে গেল। আরুর চোখের কোনা বেয়ে জল গড়ালো। আরিশ আরুর হুডি আর টুপি আর একটা চাদর এনে আরুর কাছে বসলো। আরু অবাক হলো।
আরিশ ইশারা করে বলল
— পরে নাও এগুলো।
আরু আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না, উঠে বসলো, মাথা নীচু করে আছে। আরিশ আরুর চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলল
— এই চোখে যেন আর পানি না আসে। মনে থাকবে। যদি পানি আসে চোখে তাহলে ভাববে আমি তোমার থেকে অনেক দূরে সরে যাবো।
আরুকে থামানোর মতো এর থেকে আর কোন বোকা বোকা কথা হতে পারে বলে আরিশ এর কাছে মনে হয় না কারন মৃত্যু ব্যাতীত আরিশ কখনো আরু কে ছাড়বে না। এটাকেই একটা পারমানেন্ট টোটকা হিসাবে কাজে লাগানো আরিশ।
আরুর বুকের ভিতর যেন ধক করে উঠলো। নিমেষেই আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভয়ার্ত দৃষ্টি আরুর। কাঁপা কন্ঠে বলল
— আমি আর কখনও কাঁদবোনা। কখনো না। কথা দিলাম।
আরিশ আরুকে ওর সামনে টেনে আরুর গলে হাত রেখে বলল
— নামাজের পাটিতে থাকারত অবস্থা ব্যাতিত এই চোখে যেন আমি আর কখনো জল না দেখি। বুঝলে!
আরু মাথা নাড়িয়ে আরিশ কে জড়িয়ে ধরে একটু হাসলো।
আরিশ একটা প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো।
গাড়ি নিয়ে বার হলো আরিশ আর আরু। গন্তব্যস্থল উদ্দেশ্যহীন জায়গা। মাঝ রাতে রাস্তা জনমানবহীন। দুজনেই চুপচাপ আছে। ঢাবির ক্যাম্পাসের মাঠের দিকে সেখানে ক্যাম্পফায়ার টাইপের কিছু একটা হচ্ছে। আরু জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকালো সেদিকে, আরিশ গাড়ি থামালো।
দুজনেই নেমে সেদিকে গেল। ফাকা মাঠের মতো একটা জায়গা, চারিদিকে ল্যাম্পপোষ্টের আলো। আরিশ আরুর হাত ধরে সেদিকে গেল। ওরা যেতেই সেইখানে বসে থাকা একটা মেয়ে বলল
— হেই ভাইয়া-আপু আপনারা এতো রাতে!
আরিশ মুচকি হেসে বলল
— মাঝরাতে বউকে নিয়ে টহলদারি বলতে পারো।
একটা ছেলে বলে উঠলো
— ওয়াহ ভাইয়া আপনি তো বেশ রোমান্টিক। ভাবী আপনি অনেক লাকী হু।
তখন ছেলেটার পাশে বসে থাকা মেয়েটা কনুই দিয়ে ছেলেটাকে একটা গুতো দিয়ে বলল
— তোকে দিয়ে তো কোন রোমান্টিক প্রপোজাল ও হয় না। হুহ!
আরুর মুখে অনেকখন বাদে হাসি ফুটলো। সবাই হেসে উঠলো।
আরিশ আরুর হাসির দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।
আরিশ প্রশ্ন করে উঠলো
— তোমরা ঢাবির স্টুডেন্ট তো। তা কোন বিভাগ?
আর একটা ছেলে উঠলো
— হ্যা ভাইয়া। কেমিষ্ট্রি বিভাগের। কাল থেকে ভার্সিটি বন্ধ থাকবে কোভিড এর জন্য তাই একটু আড্ডা। আপনারাও জয়েন করেন আমাদের সাথে, আমাদের ভালো লাগবে।
আরিশ আর আরু না করলো না। সবমিলিয়ে সেখানে প্রায় দশটা ছেলে মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল আর আরিশ আরু মিলিয়ে বারোজন। একে একে সবার সাথে আলাপ করতে লাগলো।
কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আরু কফিতে এক চুমুক দিলো। কাপটা রাখার আগেই আরিশ হাত থেকে কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো।
সবাই যে আরিশ আর আরুর দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে ওদের খেয়াল নেই। আরিশের এমন কাজে সবাই বলে উঠলো
— ওই হোই। ভাইয়া আপনি জোশ। উফ কি লাভ।
এক দুজন সিটিও দিলো। আরু বেশ লজ্জায় পড়ে গেল।
হঠাৎ আরিশ খেয়াল করলো নাতাশা বলে একটা মেয়ের পাশে একটা গিটার রাখা। আরিশ মেয়েটাকে উদ্দেশ্যে করে বলল
— গিটারটা একটু পাওয়া যাবে?
আরু অবাক চোখে তাকালো।
মেয়েটা বলল
— হমম হমম, ভাইয়া আপুর জন্য একটা গান ধরেন।
আরিশ গিটারটা হাতে নিয়ে আরুর দিকে তাকালো। গিটারের তারের আলতো স্পর্শে শুরু করলো।
— সে কি জানে
আজও তুই কথা বলিস
আমার সাথে মনে মনে
প্রতিদিন বেরঙিন
সে কি তোর কথা ভাবে
আমার মতো করে
তোর চিঠি কিসে পড়ে
এক মনে মাঝ রাতে
একটু মুচকি হেসে
তার কাছে চলে যাওয়া
সে তো যাওয়া নয়
দেখা হবে।
স্মৃতির গভীরে।
সে কি জানে অভিমানে তোকে হাসাতে
সে কি পারে বুকে ধরে তোকে ভোলাতে
তোর প্রিয় গান কে তোকে শোনাবে
বল আমার থেকে কে তোকে ভালো জানে।”
ইশারাতে খুঁজে বেড়ায় তোকে স্বপনে
তোর নাম দেখে হেসে ফেলি আনমনে
কে নিয়ে যাবে রুপকথার দেশে।
বল আমার থেকে কে তোকে ভালো জানে।
আরু মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে আরিশ এর দিকে। সবাই আরিশ এর কন্ঠের মাদকতায় মুগ্ধ। গান শেষ হতেই সবাই জোরে হাততালি দিয়ে উঠতেই আরুর ঘোর ভাঙলো।
সবাই আরিশের গানের প্রশংসা করতে লাগলো। হঠাৎ একটা ছেলে বলে উঠলো
— ভাইয়া আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করি?
— হমম সিওর।
— আপনি তো শুনছি নেক্সট উইক সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। এই সপ্তাহ ভাবীর সাথে কাটাবেন খুব স্পেশাল ভাবে নিশ্চয়। তিনটা বছর অনেকটা সময়। তাই আমাদের সবার তরফ থেকে একটা রিকোয়েস্ট। ভাবীকে এমন কিছু একটা বলেন যেটা আপনি কখনো বলেননি। সেটা সত্য হোক বা মিথ্যা। যা আপনি বলতে চান কিন্তু কখনো বলেননি। হোক সে মনের কথা। দিনটা আমাদের সবার জন্য একটা স্বরনীয় হোক।
আরিশ মুচকি হেসে আরুর হাতটা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
— কেও মিউজিক বাজান একটু।
ব্যাকগ্ৰাউন্ডে গান বাজতে শুরু করলোকরলো, আরু একটু লজ্জা পেলো। আরিশ গানের তালে আরুর সাথে নাচতে শুরু করলো।
গান বাজছে ব্যাকগ্রাউন্ডে
— ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
আরু শিউরে উঠছে আরিশের প্রতিটি স্পর্শে।
গান শেষ হতেই আরিশ হঠাৎই আরুর হাত ধরে হাটুগেড়ে মাটিতে বসলো।
আজ সে বলবে, অনেক কিছু বলবে! তার গোপনে লুকিয়ে রাখা মনের কথা বলবে।
#চলবে,,,, Suraiya Aayat
বানান ভুল ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক দিইনি।