#কারনে_অকারনে_ভালোবাসি02
#সুরাইয়া_আয়াত
২.
স্ট্র টা চেবাতে চেবাতে একপ্রকার বিষণ্নতা ছেয়ে গেল আরুর মাঝে, স্ট্র টার সাথে সাথে সব জিনিসগুলোও বিষাদময় হয়ে গেছে, মনের ভিতর ভয়, আক্রোশ আর স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গির ছন্দপতন ঘটতে লাগলো, আরু চঞ্চল মনে ভাবতে লাগলো যে ও নিজে যখনই কোন সিক্রেট মিশনে নামে তখনই হঠাৎ ম্যাজিসিয়ানের মতো ওনার( আরিশ) আগমনের কারনটা আরু কখনোই বুঝতে পারে না। শরীরের মাঝের অস্থিরতা তুমূল পর্যায়ে ছড়াচ্ছে। ওদের পুরো টেবিলটা জুড়ে নিরবতা কাজ করছে কিন্তু চারিদিকে কোলাহল। আরু ঘাড়টা ঘুরিয়ে পিছন ফিরে সানাকে একটু দেখার চেষ্টা করতেই হঠাৎ আরিশ তার ঠান্ডা হাতটা আরুর গলায় ছোঁয়াতেই আরুর হাত থেকে কোল্ডড্রিংসের ক্যানটা পড়ে গেল আর সাথে মুখ থেকেও স্ট্র টা পড়ে গেল। আরিশ হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো
–তুমি এখানে কি করছো? তোমার না বাসাতে থাকার কথা ছিলো? আর এই লোকটাই বা কে?
আরু আরাভ নামক স্বল্প চেনা লোকটার দিকে পিটপিট করে পলক ফেলে পুনরায় আরিশের দিকে তাকিয়ে হালকা মিনমিনে কন্ঠে বলল
–আমি ওনাকে চিনি না।
আরিশ আরুর দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। চেয়ার সহ সমস্ত মানবশরীরটা এগিয়ে আসায় টাইলসের ফ্লোর আর চেয়ারের তীব্র ঘর্ষণে উৎপন্ন আওয়াজে আরু বেশ চমকে উঠলো। আরিশ কঠিন সুরে বলল
–চেনো না মানে? না চিনলে তুমি এখানে ওনার সাথে তাও একটা রেস্টুরেন্ট এ দেখা করতে এসেছো কারন কি?
আরু মাথা নীচু রেখেই বলল
— আমি সত্যিই ওনাকে চিনি না বিশ্বাস করুন, সানা ই তো,
কথাটা পুরো বলতে যাবে সেই মুহূর্তে পাশ থেকে কারোর তীব্র গতিতে ধপাস করে পড়ার শব্দে পাশ ফিরলো সবাই। সানা পড়ে পড়ে গেছে আর তাকে দেখে তার এবং তার হাবভাবে দেখে যে কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব যে চোর পুলিশের খেলায় চোর পালানোর্ ব্যার্থ চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
আরু সানা কে পড়ে যেতে দেখে ছুটে গিয়ে ওকে ধরে তোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সানা ওঠার চেষ্টা করছে না, তাকে দেখে মনে হচ্ছে যে তার পা জোড়া কেও যেন ফ্লোরের সাথে আঠা দিয়ে চিপকে রেখেছে। আরু বিড়বিড় করে বলল
— আর এসব করে লাভ নেই, জলদি ওঠ, মি অভদ্র চলে এসেছেন এবার যা যা জিজ্ঞাসা করবে খালি মাথা নাড়াবি এছাড়া আর উপায় নেই।
সানা ভয়ার্ত সুরে বলে উঠলো
–মান সম্মান আর রইলো না, কি করতে এলাম আর হয়ে গেল কি, ভাইয়াটাও যে কি করে সঠিক সময়ে পৌছে যায় বুঝি না।
দূর থেকে আরাভ আহমেদ তার মুখের রসিকতাময় বুলি ছুড়ে বললেন
— কি হলো ভাবিজী ননদিনীর কি হাত পা ভাঙলো নাকি? আমাকে কি ধরে ওঠাতে হবে?
সানা লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে রইলো, এসেছিলো তাকে প্রপোজ করতে আর এসে নিজেই বেকুব হয়ে গেল ভেবেই মাথা কাটা যাচ্ছে লজ্জায়।
সানা উঠে দাঁড়ালো আর ওনার দিকে ফিরে বলল
— না না ভাইয়া কোন সমস্যা না আমি ঠিক আছি।
কথাটা বলে বৃথা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করতেই নিজেকেই যেন ভীষনরকমের বোকা মনে হতে লাগলো সানার।
আরিশ উঠে দাঁড়িয়ে আরাভের দিকে একবার তাকিয়ে আরুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল কটমট কন্ঠে বলল
— বাকি কথা বাসায় ফিরে হবে বাট ইউ হ্যাভ ওনলি টু মিনিটস, আমি গাড়িতে বসে কাউন্টডাইন শুরু করবো, এক মিনিট ও দেরি হলে খবর আছে।
কথাটা বলে আরিশ বেরিয়ে যেতেই সানা ফিসফিসিয়ে আরু কে বলল
— আমি জানি না যে ভাইয়া কি করে এখানে পৌছালো তবে যে উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছি সেটা হয়তো আর পূরন হবে না, না জানি উনি আমাকে কি ভাববেন।
সানাকে আরুর সাথে একান্তে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে দেখে আরাভ বলে উঠলো
— এই যে মিস ভাবিজীর ননদিনী, দেখে চলাফেরা করতে পারো না নাকি চোখে কম দেখো কোনটা?
আরাভের কথাটা শুনে আরুর বেশ রাগ হলো তবে এতোগুলো লোক এর সামনে এমন একটা ঘটনা আর এমন মন্তব্য শুনে সানার কান্নার একটা ভাব চলে এলো, যা ভেবে এসছিল তার কিছুই হলো না।
আরাভের কথার প্রতিউত্তরে কোন জবাব না দিয়ে সানা বিষন্ন মুখ নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল। আরাভ এসে আরুর পাশে এসে দাঁড়ালো, হঠাৎ ওনার পাশে এসে দাঁড়ানোতে আরু খানিকটা চমকে উঠলো আর ওনার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পেলো না। আরু অপরাধ বোধ কন্ঠে বলতে শুরু করলো
— আমি সত্যিই দুঃখিত যা যা হলো, তবে আপনাকে এখানে ডেকে আনার উদ্দেশ্যটা ছিলো একশো শতাংশ সত্য। আসলে উনি আমার হাসবেন্ড ডঃ আবরার আরিশ খান, ওনাকে না জানিয়েই আমরা বাসা থেকে বেরিয়েছি তাই উনি এমনটা রেগে গেলেন তাছাড়া আপনি ওনার অপরিচিত। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে আসল কথাটা কিভাবে শুরু করবো তবে শুধু এটুকু বলার যে, মাই ননদিনী সানা ইজ ইন লাভ, মানে সে আপনার প্রেমে পড়েছে আর সরাসরি আপনাকে বলার সাহস গড়ে তুলতে পারেনি তাই আমাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছিলো। আর আজকে যা ঘটলো তাতে করে আমার মনে হয় না যে সে আর কখনো আপনার মুখোমুখি হবে তাই তাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। ভালোবাসা হলো একটা পবিত্র অনুভূতি আর তা যখন মনের মাঝে এক অদ্ভুত আর সবচেয়ে ভিন্ন ধরনের বার্তা বয়ে আনে তখন মানুষ কোন কিছুই গুছিয়ে ভাবতে পারে না। তবে আপনি তাকে ভুল না বুঝলেই শ্রেয়। আসি ভাইয়া।
কথাটা বলে আরু কয়েক কদম হেটে গেলেই আরাভ বলে উঠলেন
— তা এই যে ভাবিজী আপনি কিন্তু কথা বেশ গুছিয়েই বলেন, আই লাইক ইট। আর আপনার ননদিনীকে বলবেন যে এই বাচ্চা বয়সে যেন প্রেম না করতে আসে। ওই যে একটা প্রবাদ আছে না- পিরীতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পারে ছাড়ে না।
কথাটা বলে আরাভের কোনরকম চাপা হাসি না, বেশ উচ্চস্তরে হেসে উঠলো।
একজন নেতা যেমনটা করে বক্তৃতা দেয় কিছুখন আগেও আরু ওর এতো দিনের লাভ লজিক নিয়ে থাকা সমস্ত জ্ঞান দিয়ে একটা লম্বা ভাসন আরাভকে শোনলো আর তার পর ও ওনার থেকে এমন কথা শুনবে আশা করেননি তাই আরু রাগী চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।
আরু চলে যেতেই আরাভ হো হো করে হেসে ফোন করলো, কারন তখনই ফোনে কল এলো আরাভের থেকে। ফোন ধরা মাত্রই আরাভ বলে উঠলো
— ভাবী কিন্তু জোশ জোশ কথা বলে, ভালোবাসা নিয়ে কি জ্ঞান!
অপর পাশ থেকে আরিশ মুচকি হেসে বলল
— সে আমি জানি, বাট আমার কখনো তার এই ভালোবাসা নিয়ে বলা বানী শোনা হয়নি তবে শুনবো হয়তো কখনো। কিন্তু আমার বোনের চয়েজ যে এতো খারাপ হবে ভাবিনি।
আরাভ খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে চোখ মুখ ফুলিয়ে বলল
— খারাপ চয়েজের লিস্টে আরাভ আহমেদ থাকতে পারে না। যাই হোক ভাবী আর আমার ফিউচার ওয়াইফকে যেন এখনই বলিস না যে উই নো ইচ আদার।এই চোর পুলিশের খেলাটা আরেকটু চলুক, বেশ মজাই তো লাগছে।
আরিশ স্মিত হেসে বলল
— ওকে। এখন রাখি তোর ভাবী আর সানা আসছে এদিকে।
কথাটা বলে আরিশ পুনরায় রাগান্বিত কন্ঠ ধারন করলো আর চোখে মুখে হালকা গম্ভীরতা ভাব আনলো যা আরুকে ভড়কে দিতেই যথেষ্ট।
সানা আর আরু বেশ ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠলো তবে আরিশ কিছু বললো না। সারাটা রাস্তা দুজনের কাটলো ভয় আর নীরবতাতেই।
—-
বাসার সামনে ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো আরিশ, তখন ছিলো সন্ধ্যা 6.30,শীতের দিন তাই ঘড়ির কাটা 5টার ঘর অতিক্রম করতে না করতেই সন্ধ্যার বহর নেমে আসে, কখনো বা পড়ে হাড় হিম করা ঠান্ডা আর এখন বাজে প্রায় ৮ টা, আরিশ এখনো বাসায় ফেরেনি। হিম শব্দটা মনে পড়তেই হিম শব্দটা সহজেই আরুর মস্তিষ্কে ছেয়ে গেল আর মনে পড়ে গেল আগের দিনে কলেজে পড়ানো টপিকটার কথা, হিম কম্পাউন্ড যা সারা শরীরে অক্সিজেন পৌছে দেয়, আর অক্সিজেন এর ঘাটতির দরুন অনেক সময় শ্বাসকষ্ট ও হয়, কথাটা ভাবতেই আরু একটু কেঁপে উঠলো। আজ কয়েক মাস পর আবার ওর নানা ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল, উনি শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন বহুবছর। চোখ জোড়া ভিজে এলো আরুর। দ্রুত বিছানা থেকে নামলো আরু, একা থাকলেই মন খারাপ লাগে আজকাল বড্ড বেশি তাছাড়া অনিকা খান অর্থাৎ আরুর শাশুড়ি তিনি দুই দিন যাবৎ বাসায় নেই, আফজাল খান অর্থাৎ আরুর কথায় ওর শ্বশুর বাবার সাথে ঘুরতে গেছেন, যদিও যেতে চাইনি ওরা সবাই জোর করেই পাঠিয়েছে। আরু সানার রুমের দিকে অগ্ৰসর হওয়ার জন্য পা বাড়াতে গেলেই হঠাৎ মাথাটা ঈষৎ ঝিমঝিম করায় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো, স্বাভাবিক হতে পারছে না, আবার হঠাৎ এমন হওয়ার কারন ও বুঝছে না। কিছুটা দরজা ধরে দাঁড়ানোর পর অনুভব করলো যে হয়তো প্রেশারটা লো তাই ঔষধ খাওয়ার জন্য টেবিলের ডেস্কটা খুলতেই দেখলো যে প্রেসক্রিপশন , হাতে নিয়ে দেখতেই দেখলো ওর ই কয়েকটা ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট। রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে আরু ভাবতে লাগলো যে সকালে তো এটা দেখেনি কিন্তু এখন দেখছে যার অর্থ এটা হয়তো আরিশ বিকালে বাসায় এসে রেখেছে। রিপোর্ট গুলো পড়তে শুরু করলো আরু কিছু বুজছে না দেখে রিপোর্ট গুলোর কয়েকটা ছবি তুলে ডঃ মিতা কে পাঠালেন আর নীচে ছোট করে লিখে দিলো
— What is the result of this report mam?
আগের মতোই রিপোর্ট টা যথা স্থানে রেখে আরু রুম থেকে বেরিয়ে গেল, ওর চিকিৎসা আর স্বাস্থবিধির ওপর আরিশ সবসময় নজর রাখে তাই আরুর নিজের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সবার ক্ষেত্রে এমন হয় যে স্ত্রী রা তাদের স্বামীদের সব দায়িত্ব নেয়, রান্না, সংসার , নিজের কাজ, সকলের খেয়াল রাখার মতো অনেক কাজ করে কিন্তু আরুর ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ঘটনাটা সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম। আর পাঁচটা স্ত্রীর মতো আরু হয়ে উঠতে পারবে না কখনোই, কখনোই মা হতে পারবে না, আরিশ এর হ্যাপিনেসের কারন হতে পারবে না তা ভেবে আরু আরিশ এর জন্য গুমরে মরে রোজ তবে আরিশ ওর ভালোবাসা তে আরু কে আগলে রাখে, কখনো আরুর অপূর্ণতাকে বুঝতে দেয়নি আজ অবধি, সন্তান হবে না জেনেও আরু কে বিয়ে করে একটা সুন্দর জীবন দিয়েছে, এমন ভাগ্যবতী কতোজন হয়?
ঔষুধ টা খেয়ে বিছানায় বসলো আর অপেক্ষা করতে লাগলো ডক্টর মাতার কল অর ম্যাসেজ এর কিন্তু অনেকটা হয়ে গেল কোন কল বা ম্যাসেজ এলোনা দেখে আরু সানার ঘরের দিকে রওনা দিলো। সানার ঘরে গিয়ে দেখলো সানা মুচকি হাসছে, কারন টা না বুঝতে পারলেও কোন একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটেছে তা নিশ্চিত কিন্তু সানার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও আরু জানে না যে তার ভাগ্যে কি আছে।
#চলবে,,, Suraiya Aayat Suraiya Aayat Ariya
অনেকে বুঝতে পারছেন না হয়তো, না বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক, আজকেও পর্ব পড়ে আশা করি অনেকটা বুঝবেন যে আরিশ হলো আরুর স্বামী আর আরু কখনো মা হতে পারবে না তা আরু সহ সবাই জানে আর আরিশ সবকিছু জেনেই আরু কে বিয়ে করেছে। সিজন 1 এর লিংক আমি দিয়ে দেবো, পড়ে নেবেন তাহলে আর অসুবিধা হবে না বুঝতে।