কারনে অকারনে ভালোবাসি02 পর্ব-০৩

0
810

#কারনে_অকারনে_ভালোবাসি02

৩.

সানার ঘর থেকে ফিরে এসে আলতো করে বিছানাতে বসে আরিশের জন্য অপেক্ষা করছিলো আরু, রাতের গভীরতা বাড়ছে, ঘড়ির কাঁটা সময় হিসাবে জানান দিচ্ছে রাত ১০.১৫,বেশ অনেকখন ধরে সানার সঙ্গে গল্প করে ঘরে ফিরেছে তবে এতোখনে আরিশের ফিরে আসার কথা তবুও ফিরছে না তারপর বাসায় ফিরলে মিঃ আরাভ আহমেদকে নিয়ে কি শোরগোল করে তা ভাবাচ্ছে আরু কে। শীতের রাত, জানালার বড়ো কাঁচটা থেকে শিশির গড়িয়ে পড়ছে, আরু দৌড়ে ছুটে গেল জানালার কাছে, মনের ইচ্ছাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয় সেটা আরিশই আরু কে সবসময় শিখিয়েছে এবং তার দোহাই দিয়ে আরু বারংবার বহু দুষ্টামি করেছে নির্দিধায় তবে এখন যা করবে তাতে কোন দোষ আছে বলে ওর মনে হয় না। জানলার কাঁচে খানিকখন আঙুলের আকিঁবুকিতে নিজের আর তার মিঃ অভদ্রর নামটা লিখলেও বোধহয় আরিশ খুব একটা রাগ করবে বলে আরুর মনে হয় না, বিধায় আর কি যা ভাবা তাই কাজ। ঠান্ডা ফ্লোরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আর গায়ে কোন সোয়েটার বা চাঁদর ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে আরু, ঠকঠক করে কাঁপছে আর জানালায় আরিশ আর আরুর নাম লিখছে। কিছুখন পর আরিশ আর আরুর নামটা মুছে যেতেই আরু কিছুখন অপেক্ষা করতে লাগলো পুনরায় জানালাতে শিশির জমার, তাতেও প্রায় দশ মিনিট মতো সময় লাগে। আরু ততখন অপেক্ষা না করে ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি মারলো আরিশ আসছে কি তা দেখার জন্য, নাহ আরিশ আসছে না, আরু একপ্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরে গেল আর জানালার কাছে দাঁড়ালো, হালকা শিশির জমেছে কাঁচে, আরুর আর তর সইলো না, এবার আর আরিশ আরু না, বাচ্চাদের মতো আরু নিজের একটা দাগ কেটে ছবি আঁকলো আর অনেকটা দূরত্ব নিয়ে আরিশের ছবি আঁকলো। আরু ঠোঁট চেপে হাসছে, ছবিটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পূর্বেই ওদের মাঝে একটা ছোট্ট বাচ্চার ছবি আঁকলো ও ছোট করে নাম লিখলো ‘ আর্শিয়ান ‘ নামটা আরু অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলো তাই ভাবতে বেশি সময় লাগলো না।
আরু ছবির মাঝে একটা স্মাইলি আকঁলো, অনেকখন ধরে ছবি আঁকার দরুন শিশির জমেছে বেশ ঘন তাই তা এবার ঝরে যেতে লাগলো, আর আরুর বানানো স্মাইলি ইমোজিটাও গড়িয়ে কান্নার মতো হয়ে গেল, নিমেষেই সবটা এলোমেলো হয়ে যেতেই আরু দু পা পিছিয়ে এলো। একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে বুকের মাঝে। এখন মনে মনে নিজেকেই বকা দিচ্ছে এই ভেবে যে কি ভেবে ছবিটা একেছিলো।
আর্শিয়ান নামটা আর ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে আরু আর ভাবছে সেই সব দিনের কথা যেদিন ও জানতে পেরেছিলো যে সে কখনো মা হতে পারবে না, আর এসব ভাবতে ভাবতে আরু একটা সময় চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো, সেদিনের দৃশ্য ওর চোখে ভাসছে, পাঁচ বছর বয়সী আরু কে যখন ওর পাড়ার এক ছেলে ক্ষতি করতে চেয়েছিলো আর তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আরিশ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো, আরু থামাতে গেলে আরিশ আরুকে সরাতে ধাক্কা মারে আর আরু রাস্তার ধারে ছিটকে পড়ে আর একটা সাইকেল ওর পেটের ওপর দিয়ে চলে যায় আর তারপর হয় ওর অপারেশন, কেটে ফেলা হয় একটা টিউব।
আরু মেঝেতে বসে কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে বেশ জোরেই কান্না করছে, কানের কাছে বারবার একটাই কথা বাজছে আমি মা হতে পারবো না, আমি মা হতে পারবো না।

হঠাৎ আরিশ দৌড়ে ছুটে এলো, আরু কে মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে ওউ আরুকে জড়িয়ে ধরে বলল

— কি হয়েছে আরু পাখি কাঁদছো কেনো?

আরু আরিশ কে পেয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, কাঁদছে আরু। আরু থামছে না দেখে আরিশ আরু কে তুলে বিছানায় বসালো আর ওর চোখ টা মোছালো, আরু এখনো ফুপিয়ে কাঁদছে, সব ই ঠিক ছিলো তবে হঠাৎ ওর এমন ভাবনাগুলোই ওর কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ালো।
আরিশ আশঙ্কা করেই বলল

— তুমি কি আবার বেবির জন্য?

পুরো কথাটা বলতে না বলতেই আরু মাথা নাড়া দিল, কাঁদতে কাঁদতে বলল

— আমার একটা বেবি চাই মিঃ অভদ্র। না চাইতেও আমার সব ইচ্ছা আপনি পূরন করেছেন, তাহলে আমার এই ইচ্ছাটা পূরন করতে পারেন না কেন বলুন?

আরিশ শান্ত কন্ঠে বলল

— কেও কিছু বলেছে আরু পাখি তোমাকে? কে কি বলেছে বলো আমি তাকে দেখে নেবো।

আরুর গালে হাত রেখে কথাগুলো বললো আরিশ। আরু আরিশের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল

— কথা ঘোরাবেন না আপনি, আমার ইচ্ছা পূরনের দায়িত্ব আপনার। আমি কোন কথা শুনবো না আজ।

একপ্রকার পাগলের মতো আবদার করে উঠলো আরু। আরিশ বিরক্ত হলো না তবুও,, বুঝতে পারছে আরুর কষ্টটা।

আরিশ এবার আরুর হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে আরুর কোলে মাথা রেখে বলল

— তোমার কি আমার কাছে থাকতে ইচ্ছা করে না? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার এতোই তাড়া?

আরু একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো

— আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো কেন আমি? আর আমি তো বেবি চেয়েছি তাতে আপনি এসব বলছেন কেন?

আরিশ চাপা কন্ঠে বলে উঠলো

— হয়তো বেবি এলে অনেক দূরে সরে যাবে তুমি এবং আমি তোমাকে হারাতে চাই না।

আরু বুঝতে পারছে না আরিশ কি বলছে, তাই না পেরে বললো

— চলেন না আমরা একটা বেবি এডপ্ট করি। তাতে তো ক্ষতি নেই।

আরিশের রাগটা এবার আকাশ ছুঁয়ে গেলো, দাঁত কিড়কিড় করে আরুর দু বাহু চেপে ধরে বলল

— কোন বেবি এডপ্ট করবো না, হলে আমাদের বেবি হবে নাহলে না।

আরু হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল আরিশের আচমকা রেগে যাওয়াতে। ভয়ে আর কিছু বলল না।

আরিশ উঠে পকেট থেকে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানাতে। আরু চমকে গেল। আরিশ কিছু না বলে একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল, আরুর কান্নাও পাচ্ছে ভীষন কিন্তু কাঁদবে না, বিছানা থেকে গুটি গুটি পায়ে নেমে রুমের দরজাটা খুলে গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বেরোতেই দেখলো সানা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চোখ মুখ গরম করে। আরুর চোখ মুখ ফোলাফোলা, আরু থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো

–তুই?

সানা আরুর হাত ধরে টানতে টানতে নীচে নিয়ে গেল, আরু বুঝতে পারলো যে সানা এমন কেন করছে। সানা আরু কে নিয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে আরু কে বসিয়ে ওর সামনে আর একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে আরুকে প্রশ্ন করলো

— কি হয়েছে বল! তুই ওভাবে চিৎকার করলি কেন? আর চোখ মুখ ফোলাফোলা কেন? ভাইয়াও রেগে গেছে বোধহয়।

আরু মাথা নীচু করে রইলো,উত্তর দিলো না, সানা বিরক্ত হয়ে বলল

— ঠিক আছে আমাকে বলতে হবে না, তোদের পারসোনাল ব্যাপার। তবে ভাইয়া রেগে আছে, খাবার টা নিয়ে যা কিছু খাইনি হয়তো।

আরু কথা বললো না কোন, খাবার টা নিয়ে গেল ঘরে, রুমে যেতেই দেখলো আরিশ এখনো বার হয়নি রুম থেকে, প্লেটটা পাশে রেখে ভদ্র বাচ্চাদের মতো বসে আছে আরু,আরিশের আসার অপেক্ষা করছে। কিছুখন পর আরিশ আসতেই উঠে দাঁড়ালো আর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল

— আপনার খাবার, আপনি বোধহয় কিছু খাননি।

আরিশ ভ্রু উচিয়ে প্রশ্ন করলো

— বোধহয়? কথার মাঝেও সংশয়?

আরু মাথা নীচু করে নিলো, রাগ এখনো কমেনি আরিশের, কি করলে রাগ কমবে তাও আরুর জানা নেই কারন এতোদিন ও রাগ করেছে আর আরিশ রাগ ভাঙিয়েছে। বিধায় চুপ করে দাঁড়ালো। আরিশ মাথার ভেজা চুলটা আলতো স্পর্শে ঝেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় পা মেলিয়ে বসলো। আরু বুঝলো এ ব্যাটার রাগের জন্য আজ ওর সারারাতের ঘুম কাহিল তাই প্লেটটা নিয়ে আরিশের পাশে বসে এক লোকমা ভাত ওর মুখের সামনে ধরলেও আরিশ গুরুত্ব দিলো না। আরু মিনমিন করে বলল

— খেয়ে নিন না প্লিজ।

আরিশ আরুর কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না, আরু এবার আরিশের কাছে আর একটু সরে গিয়ে আচমকা আরিশের মুখটা চেপে ধরে ভাত দিয়ে দিলো, আরিশ রাগী চোখে তাকালো ঠিকই কিন্তু কিছু বললো না আর। আরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিশকে আর লোকমা দিতে যাবে তখনই দেখলো আরিশ নেই। আরু চিৎকার দিয়ে বলল

— ভূত!

আরুর চিৎকার শুনে আরিশ ধমক দিয়ে বলল

— এই মেয়ে কি হচ্ছে টা কি? চেচাচ্ছো কেন?

আরু আরিশকে দেখে বুকে ফু দিয়ে বলল

— ও আপনি ওইখানে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি ভাবলাম ভূত।

আরিশ বিড়বিড় করে বললো

— তোমার থেকে বড়ো ঘাড়ত্যাড়া ভূত এই ঘরে আছে বলে আমার জানা নেই।

আরু বিড়বিড় করার আওয়াজ শুনে বলল

— আপনি কিছু বললেন?

আরিশ পাল্টা উত্তর দিলো না। আলমারিতে কি একটা রেখে দিচ্ছে ও। আরু বুঝতে পেরে উঁকি মারার চেষ্টা চালালো, হঠাৎ অরিশের চোখাচোখি হতেই ওর দমাদমি বন্ধ হয়ে গেল। আরিশ আবার বিছানায় আসতেই আরু ভাত দিতে গেলেই আরিশ আরুর হাতটা ধরে বলল

— এতো ফরমালিটি কিসের?

আরু মিনমিন করে বলল

— ফরমালিটি কোথায় দেখালাম আমি তো যাস্ট।

— যাস্ট কি? কর্তব্য পালন?

আরু মাথা নাড়িয়ে বলল

— নাহ, আপনার বউ তাই আপনাকে খাইয়ে দিচ্ছি। এটুকু তো করতেই পারি।

আরিশ আর কথা না বাড়িয়ে বলল

— প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসো, আমার ক্ষিদে নেই।

আরু নারাজ, তবে আরিশের বলার ধরন শুনে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে আসতেই দেখলো আরিশ আরামে শুয়ে পড়েছে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে। এতখনের সব কিছু ভুলে গিয়ে আরু আরু ওর ঠান্ডা দুটো হাত সামনে উঁচু করে নিজের মনে মনে বললো

— আপনি তো জানেন মি অভদ্র আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেখলে আমার ভালো লাগে না। আপনার শান্তি ভঙ্গ করতে মে হু না!

কথাটা বলে একটা ডেভিল স্মাইল দিয়ে গুটিশুটি দিয়ে ব্ল্যঙ্কেটের ভিতর ঢুকে ঠান্ডা হাতটা দিয়ে আরিশের শার্টের একটা বোতাম খুলে আরিশের গায়ে ওর ঠান্ডা হাতটা দিলো আর গান ধরলো

— গুমনাম হে কেয়ি।

এটুকু গেয়ে আর গাইতে পারলো না, তার আগেই আরিশ আরু কে ওর নীচে ফেলে আরুর দুই হাতের আঙুল মুঠিবদ্ধ করে নিয়ে আরুর গলায় ঠোঁট বুলিয়ে বলল

— বদনাম হে কোয়ি। কিসকো খবর কন হে এ আনজাম হে কোয়ি।

আরিশ ওর হাত দুটো নিজের আঙুলের মাঝে শক্ত করে চেপে রেখেছে, আর আরিশের শরীরের অর্ধেকাংশের বেশি ভার আরুর ওপর।
আরু মিথ্যা কান্না করে বললো

— মি অভদ্র ছেড়ে দিন আর এমন হবে না, আর এমন কাজ করবো না, আমার ঠান্ডা হাত ও আপনার গায়ে দেবো না, আপনি কি ভারী বাবা সরে যান কষ্ট হচ্ছে আমার।

আরিশ আরুর গলা থেকে সরে এসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল

— খুব শখ তাইনা আমাকে জ্বালোনোর তো নাও ইটস মাই টাইম।

আরু বলল

— আআআ, সরে যান ভুল হয়ে গেছে আর এমন করবো না, আর আপনি কি খান যে আপনার ওজন এতো বেশি, আমরা একই খাবারই তো খাই। সরে যান, ও বাবাগো আমার দম আটকে আসছে।

মিথ্যা করে বললো আরু।

আরুর ফোনে তখন ডঃ মিতার এস এম এস এলো, আরু বলল
— দেখুন মিতা ম্যাম টেক্সট করেছে ওটা দেখতে দিন।

আরিশ বুঝলো যে ওদের এতো সুন্দর মুহূর্তের মাঝে ডক্টর মিতার টেক্সট আরু দেখলে ওর মন খারাপ হয়ে যাবে।
আরু আঙুল গুলো কিছুটা এগিয়ে ফোনটা ধরতে গেলেই আরিশ হাতটা কাছে টেনে বলল

— আগে আমাকে সমলাও তারপর ডক্টর মিতা।

লাইটস অফ, ওই আর কি🥱 ইয়ে মানে শুভরাত্রি আর কি সেটাই বলতে চাইলাম।

Suraiya Aayat Suraiya Aayat Ariya

#চলবে,,,,