কি আশায় বাঁধি খেলাঘর পর্ব-১০

0
265

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর (১০)

চন্দ্র রশ্মিকে দেখতে গেলো না।যে মানুষটার জন্য একটা সোনার সংসার ভেঙে গেছে সেই মানুষকে শেষ দেখা দেখার কোনো প্রয়োজন অনুভব করে নি চন্দ্র।
বাসায় এসে শুধু কেঁদেছে।
চন্দ্র খাতা নিয়ে আম্মার কাছে একটা চিঠি লিখলো,”আম্মা গো,আম্মা কেনো এরকম করলে গো আম্মা?
কেনো আমার জীবন থেকে আব্বা নামের বটগাছের ছায়া সরিয়ে দিলে?
কেনো আমার মাথার উপর থেকে মায়ের আঁচলের ছায়া সরিয়ে দিলে?
কেনো আমাকে এতিম করে দিলে আম্মা।
আমি যে কোনোদিন আমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকতে পারি নি।
আমি কখনো আব্বার হাত ধরে স্কুলে যেতে পারি নি।
আমার আব্বা যে জীবনে আমার মুখ থেকে আব্বা ডাক শুনে প্রাণ জুড়াতে পারে নি।
আমার আব্বার বুকের ভিতর যে একটা অভিমানের পাহাড় জমে ছিলো তুমি কেনো বুঝলে না গো আম্মা?
আম্মা গো,অন্য মানুষের কথা বিশ্বাস করে কেনো আমার আব্বাকে এতো বড় শাস্তি দিলে তুমি?
আমার আব্বা না হয় একটা অপরাধ করেই ফেলেছে।
তারজন্য নিশ্চয় আব্বা তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে,তোমাকে তো আব্বা ঠকায় নি আম্মা।তুমি ঠকাতে চেয়েছিলে বলেই তো করেছে।
তবুও তো ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে।তুমি তাকে অন্য শাস্তি দিতে কেনো এরকম একটা শাস্তি দিলে আম্মা?
আমার একটা জীবন যাবে আব্বা আম্মাকে ছাড়া।
আমার মাথায় যে কেউ কখনো স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় নি আম্মা।

আমার বুকের ভিতর যে একটা হাহাকার রয়ে গেছে।প্রাণ ভরে আব্বা বলে ডাকার হাহাকার।
আমি যে কখনো আমার আব্বাকে একবার আব্বা বলতে পারি নি।
আম্মা এতো বড় হয়েছি সবার অনাদর আর অবহেলায়। যে ছেলেটা টোকাইয়ের কাজ করে,যে মেয়েটা ফুল বিক্রি করে,তারাও আমার থেকে বেশি সুখে আছে আম্মা।
ঘুম ভাঙলেই তারা দেখতে পায় তাদের আব্বা আম্মাকে।সবাই ঘুম ভাঙতেই চিন্তা করে আজকে কী কী কাজ করবে আর আমি ঘুম ভাঙলেই চিন্তা করি আব্বা আম্মাকে ছাড়া আরেকটা দিনের শুরু হলো।
এই জীবন তো আমি চাই নি আম্মা।

আমার আব্বা এতো শখ করে আমার নাম চন্দ্র রেখেছিলো,কখনো একবার প্রাণ ভরে ডাকতে পারে নি আমায় এই নামে।

আমাকে কেনো বাঁচিয়ে রেখে গেলে তুমি?
সেদিন আমাকে ও মেরে ফেলো নি কেনো আম্মা?
তাহলে তো আর এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।
আমার যে প্রাণ যায় যায় আব্বা আম্মার অভাবে।
আমি কিভাবে এই জ্বালা দূর করবো আম্মা?
তুমি বলে দাও আমায় আমি কি করবো এখন?

ইতি,
তোমার চন্দ্র

চিঠি লিখা শেষ করে চন্দ্র একটা কাগজের প্লেন বানালো চিঠিটা দিয়ে।
তারপর বারান্দায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,”চিঠি তুই উড়ে যা তোর প্রিয় ঠিকানায়। ”
তারপর উড়িয়ে দিলো।

নিষাদ সবেমাত্র বাসায় ফিরেছে।আজকে নিষাদের মুড খুবই ভালো।
সকালে চন্দ্র টেক্সটের রিপ্লে দিয়েছে দু’বার। তাতেই নিষাদের মনে হচ্ছে চন্দ্রকে পেয়ে গেছে।
নিষাদ ঠিক করলো আজকে রাতে কথা বলবে চন্দ্রর সাথে।

গেইট পার হয়ে সবে পা রেখেছে ভিতরে তখনই একটা কাগজ এসে নিষাদের মাথায় এসে লাগলো।
নিষাদ হাতে নিয়ে দেখলো একটা কাগজের প্লেন।

নিষাদের খুবই ইন্টারেস্টিং লাগলো প্লেনটা দেখে।দেখলো কাগজে কি সব যেনো লিখা ও আছে।নিষাদ একটা শিস দিয়ে বললো,”ওহে,আমাকে উড়ো চিঠি পাঠিয়ে পটাতে এসো না।আমি তো অনেক আগেই দিওয়ানা হয়েছি আমার চন্দ্রর প্রেমে।”

চন্দ্র উপর থেকে কিছুই শুনলো না।

নিষাদ বাসায় ঢুকে মা’কে বললো,”দেখো মা,একটা লাভ লেটার পেয়েছি।”

হাসনাত সাহেব এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছেন মনোয়ারা বেগমের রাগ ভাঙাতে।
হাসনাত সাহেবের অপরাধ মালীর সামনে মনোয়ারা বেগম কে মনু বলে ডেকেছেন।
এতে মনোয়ারা বেগমের প্রেস্টিজে লেগেছে।এমনিতেই তিনি কারো সামনে এই নামে ডাকা পছন্দ করেন না,এই নিয়ে প্রায় সময় দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়।
কিন্তু হাসনাত সাহেব মাঝেমাঝে অতি উত্তেজিত হয়ে ভুলে যান এটা।

নিষাদের কথা শুনে হাসনাত সাহেব বললেন,”তোর প্রেমের কথা পরে শুনবো বাপ,আগে আমার বউয়ের রাগ ভাঙাতে সাহায্য কর।”

নিষাদ সোফায় বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,”তোমার প্রব্লেম তুমি সলভ করো বাবা।আমি পারবো না।আমার বউকে তো খুঁজে পেতে তুমি কোনো সাহায্য করো নি।তাহলে আমি কেনো এখন তোমায় সাহায্য করবো বলো?”

হাসনাত সাহেব বললেন,”হাতি খাদে পড়লে চামচিকা ও লাথি মারে। ব্যাপার না।আমার ও সুযোগ আসবে।”

তারপর মনোয়ারা বেগমের হাত ধরে বললেন,”তুমি যদি কথা না বলো মনু,তবে মেপে মেপে ৫ চামচ লবন দিয়ে এই চা খেয়ে আমি নিজেকে তিলে তিলে কষ্ট দিবো।”

নিষাদ মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজের হাসি কন্ট্রোল করলো।

হাসনাত সাহেব দেখলেন কাজ হচ্ছে না। মনোয়ারা বেগমের নাক আরো ফুলে গেছে।
মানে তিনি আরো রেগেছেন।

হাসনাত সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,”তুমি যদি কথা না বলো তবে এই শীতের রাতে আমি ৩ টা কম্বল গায়ে দিয়ে নিজেকে কষ্ট দিবো।”

বিরক্তিতে মনোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
নিষাদ হা হা করে হেসে উঠলো।

হাসনাত সাহেব কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বললেন,”জোকস শুনবে মনু?
শোনো,এক মাতাল রাতে বাড়ি ফিরে ঘরের তালা খোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই চাবি তালার ভেতর ঢোকাতে পারছিল না। পাশের বাসার ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘চাবিটা আমাকে দিন, আমি খুলে দিচ্ছি।’
মাতাল বলল, ‘না না, আমিই পারব। আপনি বাড়িটা শুধু একটু শক্ত করে ধরুন।”

জোকস বলে হাসনাত সাহেব নিজেই হাসতে লাগলেন।
মনোয়ারা বেগম কোনো কথা বললেন না।হাসনাত সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি ভেবেছেন নিষাদ অন্তত হাসবে কিন্তু দেখলো নিষাদ খুব মনোযোগ দিয়ে একটা কাগজ পড়ছে।

হাসনাত সাহেব ছেলের পাশে বসে বললেন,”কি রে,আমি পড়তে পারবো তো তোর লাভ লেটার?”

নিষাদ কোনো কথা বললো না।কেমন যন্ত্রচালিতর মতো কাগজটা বাড়িয়ে দিলো হাসনাত সাহেবের দিকে।
ছেলের এভাবে বিমর্ষ হবার কারণ হাসনাত সাহেব বুঝতে পারলেন না।

তড়িঘড়ি করে তিনিও পড়তে লাগলেন।
চিঠি পড়া শেষ করে তিনি নিজেও থমকে গেলেন।

মনোয়ারা বেগম বাপ ছেলের এই নিরবতা দেখে উঠে এলেন।স্বামীর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়লেন।
পড়তে পড়তে তার ভিতরে মাতৃত্বের সত্ত্বা জেগে উঠলো। দুই চোখ ভিজে গেলো তার।

কেঁদে দিলেন তিনি উঠে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
বারবার তার মনে হলো,আজ যদি তিনি বা হাসনাত সাহেব বেঁচে না থাকতেন তবে তার ছেলের ও তো এরকম কষ্ট হতো।

হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”মেয়েটা কে মনু?”

মনোয়ারা বেগম রাগ করলেন না আর।চোখ মুছে বললেন,”তোমাকে বলেছি না সেদিন একটা মেয়ের কথা,সেই মেয়েটা।”

হাসনাত সাহেব বললেন,”মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আসো।আজ রাতে আমাদের সাথে খাবে না হয়।কে জানে,শেষ কবে মেয়েটা বাবা মায়ের সাথে খাবার খেয়েছে এক টেবিলে বসে।”

চন্দ্র কিছুই বুঝতে পারছে না কেনো তাকে ডাকা হয়েছে। প্রভা আর সে ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে নিচে এলো।
কলিং বেল বাজতেই নিষাদ উঠে গেলো দরজা খোলার জন্য।
দরজা খুলতেই দেখতে পেলো সামনে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে।
নিষাদের মনে হলো তার দৃষ্টিবিভ্রম এটা।তাই দুই হাতে দুই চোখ ভালো করে কচলে নিলো।তারপর আবার তাকালো।
আবারও দেখলো চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে।
নিষাদের হার্টবিট বেড়ে গেলো।কি করবে বা কি বলবে সব এলোমেলো হয়ে গেলো এতো কাছে চন্দ্রকে দেখে।
হতভম্ব হয়ে নিষাদ চন্দ্রকে বললো,”আপনি কি আমার প্রেশারটা মেপে দেখবেন একটু?
আমার মনে হচ্ছে আমার প্রেশার লো হয়ে গেছে।
আচ্ছা আপনি কি আমার প্রেশারের ঔষধ হবেন?”

চন্দ্রর মনে হলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই এলোমেলো চুলের ছেলেটার মাথায় কিছুটা সমস্যা আছে।
চন্দ্র শুনেছে শীত এলে পাগলদের পাগলামি বেড়ে যায়।
মনে মনে চন্দ্র ভীষণ আফসোস করে বললো,”এতো কিউট ও পাগল হয়?”

চলবে…..?

লিখা:জাহান আরা