কি আশায় বাঁধি খেলাঘর পর্ব-০৪

0
311

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর (০৪)

ভার্সিটি থেকে ফেরা সময় চন্দ্র দেখলো একটা মহিলা ৬-৭ বছর বয়সী একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছে।চন্দ্রর কাছে এসে বললো,”আপা,১০ টা ট্যাকা দিবেন,মাইয়াডার জ্বর,ভাত খাইতে চায় না।একটা রুটি আর চা খাওয়াইতাম।”
চন্দ্র ব্যাগ থেকে বের করে ১০ টাকার একটা নোট দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
মহিলা টাকা নিয়ে পাশের টং দোকানে গেলো।এক কাপ চা আর রুটি নিয়ে দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে মেয়েকে খাওয়াতে লাগলো।
মেয়েটা একটু খেয়ে বললো আর খাবে না।
মহিলা কেমন পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কি সব বলতে লাগলো মেয়েকে,হয়তো কোনো রূপকথার গল্প বললো,অথবা বললো না খেলে এখন বাঘ আসবে

যাই বলুক মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে,তারপর খেয়ে নিলো।

চন্দ্রর বুকের ভিতর চিনচিন করে উঠলো একটা সুক্ষ্ম ব্যথা।
আহারে,আল্লাহ যদি তাকে এরকম একটা গরিব ঘরে পাঠাতো কতোই না ভালো হতো,ভিক্ষা করে হলেও তো মা খাওয়াতো নিজের হাতে।
না খাইয়ে রাখলে ও তো মা’কে কাছে পেতো।

চন্দ্র এগিয়ে গেলো বাচ্চাটার কাছে,বাচ্চার হাতে ১০০০ টাকা দিয়ে বললো,ঠিক মতো খেও কিন্তু,মা’কে কষ্ট দিও না।
তারপর চলে এলো।

খালামনির বাসায় ফিরতে চন্দ্রর বিকেল হলো।বাসায় ঢুকতেই দেখতে পেলো ড্রয়িং রুমে বড় খালা বসে আছে। সাথে নানী ও আছে।
চন্দ্র এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো। তারপর সবাইকে সালাম দিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছেন চন্দ্র।ভাবতে লাগলো নিজের জীবন নিয়ে।
বাবা মায়ের আদর তো ভাগ্যে ছিলোই না,সেই সাথে সাথে কারো আদরই চন্দ্র পায় নি জীবনে।জীবনে আপনজনের আদর স্নেহ,মায়া মমতা কেমন তা চন্দ্র জানে না।

কেউ কখনো দরদ মাখা কণ্ঠে চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে নি,ভাত খাবি না চন্দ্র।
মন খারাপের সময় কেউ বলে নি,কী হয়েছে আমাকে বল।
কেউ জিজ্ঞেস করে নি,তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে?
প্রচন্ড জ্বরের সময় কেউ কপালে হাত দিয়ে দেখে নি জ্বর কতটুকুতে।

সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো কষ্টের সময় চন্দ্র পারে নি কখনো আকুল হয়ে মা’কে ডেকে কাঁদতে অথবা বাবাকে ডেকে কাঁদতে।
কি এক অদ্ভুত জীবন দিলো সৃষ্টিকর্তা।

বারবার মনে পড়ছে সেই ভিখারিনী মায়ের কথা।

আহারে মা!
দরদী মা!

কেনো চন্দ্রর ভাগ্যে জুটলো না এরকম একজন মা।
কেনো আল্লাহ মা বাবার আদর রাখলো না ভাগ্যে,একটা জীবন কি এরকম অনাদর আর অবহেলায় কেটে যাবে?
কান্নায় কখন যে চন্দ্রর জামা ভিজে গেলো টের পেলো না চন্দ্র।

দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে চন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। নিজের চোখ মুছে দরজা খুলে দেখলো নানি আর বড় খালা দাঁড়িয়ে আছে।

চন্দ্র বললো,”ভিতরে আসেন নানি।”

ভিতরে এসে বিছানার উপর বসলো নানি আর খালা।চন্দ্র বসলো চেয়ারে।একটু পরে রশ্মি এলো রুমে।রশ্মির মুখ থমথমে হয়ে আছে।চন্দ্র ভাবলো সকালের সেই রাগ এখনো কমে নি।
অথচ চন্দ্র বুঝতেই পারে নি কি ষড়যন্ত্র চলছে তাকে নিয়ে।

চন্দ্রর বড় খালার নাম রেশমা।রেশমি চন্দ্রর হাত কোলে নিয়ে বললো,”বাহ চন্দ্র,তুই তো খুব সুন্দরী হয়েছিস।”

চন্দ্র কিছু না বলে মুচকি হাসলো।

রেশমা কিছুক্ষণ চন্দ্রর রূপের গুণকীর্তন করলো,চন্দ্রর বাবামায়ের কথা বলে আফসোস করলো।তখনও চন্দ্র বুঝতে পারলো না খালার উদ্দেশ্য। বুঝতে পারলো একটু পরে যখন খালা বললো,”বয়স তো হয়েছে তোর চন্দ্র,বিয়ে করতে হবে তো এবার তোকে।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো,”সময় হলে নিশ্চয় করবো খালা।”

“না না,সময় হলে করবো সেটা কেমন কথা,তোর বাবা মা নেই,আমরাই তো তোর অভিভাবক। আমাদেরই তো ভাবতে হবে তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। ”

চন্দ্র কিছু বললো না।

নানি বললো,”তোর বড় খালার ছেলে জাবেদ এবার চাকরি পেয়েছে,স্কুলে মাস্টারি করে।তোর খালা বললো ছেলেরে বিয়ে করাবে।আমি বললাম,অন্য জায়গা থেকে মেয়ে আনার কি দরকার,মেয়ে তো আমাদের নিজেদের আছে।জাবেদের সাথে তোর বিয়ে হলে ভালো হয়।
ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে।”

এবার চন্দ্রর বেশ জোরেসোরে হাসি পেলো।জোরে হেসে দিয়ে চন্দ্র বললো,”ঘরের মেয়ে কে গো নানি,আমি বুঝি?
না না,তা হবে কেনো নানি,আমি তো পরের মেয়ে,বলতে গেলে পর থেকেও খারাপ আমি।আমি তো অস্পৃশ্য একটা মেয়ে।যার বাবাকে তার মা খুন করে মা ও গলায় দড়ি দিয়েছে।আমাকে তোমাদের ঘরের মেয়ে বলো না গো নানি,ঘরের মেয়ে হলে কি সারা জীবন কাটাতে হতো আমার হোস্টেলে হোস্টেলে?”

চন্দ্রর কথা শুনে সবাই থতমত খেলো।রশ্মির মুখে সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো।

রেশমা বললো,”মা রে এভাবে বলিস না,তোর জন্য আমাদের কী কম ভাবনা ছিলো?
কি করবো বল,কেউ চায় না অন্যের মেয়েকে নিজের সংসারে রেখে বড় করতে,বিশেষ করে বউয়ের দিকের কাউকে এভাবে রাখাটা কোনো স্বামীরাই পছন্দ করে না।”

চন্দ্র বললো,”তো এখন কি খালু পছন্দ করবে বউয়ের দিকের মেয়েকে পুত্রবধূ করা?
না-কি এতোদিনে আমার সম্পদের খবর জানতে পেরেছে খালুও,তাই রাজি হয়েছে আমাকে বউ বানাতে?”

জোঁকের মুখে নুন দেয়ার মতো রেশমার মুখটা হয়ে গেলো।এতটুকু মেয়ে এতো বড় কথা বলে ফেলবে রেশমা ভাবে নি।
রেগে গিয়ে রেশমা বললো,”এসব কি বলছিস তুই?বাবা মা নেই বলে আদর করে ঘরে বউ করতে চেয়েছি,বেশি মায়া দেখাতে চেয়েছি বলে তুই যা ইচ্ছে তা বলছিস।
হোস্টেলে থাকা মেয়েরা অসভ্য হয় জানতাম,আজ প্রমাণ পেলাম।”

চন্দ্র হেসে জবাব দিলো,”তবুও তো সেই অসভ্য মেয়ের সম্পদের লোভ ছাড়তে পারলে না।”

রেশমা চলে গেলো রুম থেকে,রেশমার পিছনে রশ্মি ও গেলো।
বৃদ্ধা নানি বসে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রর দিকে।
চন্দ্র দেখেও কোনো ভ্রক্ষেপ করলো না।

নানি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,”তেজি মায়ের মাইয়া তেজি-ই হয়।তুই একেবারে তোর মায়ের মতোই তেজি হইছস রে চন্দ্র।”

মায়ের কথা শুনতেই চন্দ্রর বুক কেঁপে উঠলো,চোখে জল এসে যেতে নিলো কিন্তু চমদ্র সামলে নিলো নিজেকে।কাউকে সে চোখের পানি দেখাতে চায় না।
আজ পর্যন্ত খুব কমই কেঁদেছে চন্দ্র কারো সামনে।

নানি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,”আমি আগেই বলছিলাম রেশমাকে এতো লোভ ভালো না।এতো বছর যার খবর নেয় নাই কেউ আজ তারে নিয়া টানাটানি,আল্লাহ যেনো তোরে একজন ভালো মানুষ মিলাইয়া দেয় বইন,আমি বুড়া মানুষ আমার কথার দাম নেই কারোর কাছে।”

চন্দ্র নরম স্বরে বললো,”নানি,তুমি তো পারতে আম্মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তোমার কাছে রেখে বড় করতে।কেনো এভাবে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে নানি।”

বৃদ্ধা চোখের পানি মুছে বললেন,”আমি যে মহিলা মানুষরে বইন,তোর নানার কথার উপর কখনো কথা বলে কিছু করতে পারি নি।আমি কতোবার চাইছি তোর সাথে দেখা করতে আমার একটা ছেলে মেয়ে নেয় নাই আমারে।তোর নানা ও নেয় নাই।”

চন্দ্র জিজ্ঞেস করলো,”এতো রাগ কেনো সবার আমার উপর?”

“রাগ তোর উপর না,তোর মায়ের উপর। তোর মা তোর বাপেরে বিয়া করছে প্রেম করে,সেই রাগ তোর নানা মামা খালাদের তোর মা মরার পরেও যায় নাই।তার জন্য কেউ তোকে পছন্দ করে না।তাই কেউই তোকে কাছে রাখতে চায় নি।
কিন্তু এখন যখন সবাই খবর পাইছে তোর নামে সব টাকা পয়সা তোর বাপের,তখন সবাই তোরে হাত করতে চায়।”

চন্দ্র দাঁত কিড়মিড়িয়ে জবাব দিলো,”এতো সোজা না নানি আমারে হাত করা।”

চলবে…..?
লিখা: জাহান আরা
(রিচেক দিই নি,বানান ভুল হলে সরি)