কি আশায় বাঁধি খেলাঘর পর্ব-০৫

0
297

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর (০৫)

রাতে বিছানায় শুয়ে চন্দ্র এপাশ ওপাশ করছিলো।মাথায় হাজারো ভাবনা।
সন্ধ্যায় প্রভার সাথে কথা বলেছে।প্রভার ভীষণ মন খারাপ। প্রভাকে আশ্বাস দিয়েছে খুব শীঘ্রই একসাথে থাকার ব্যবস্থা করবে।

ছোট খালামনির লোভের ব্যাপারটা চন্দ্র জানতে পেরেছে মাস ছয়েক আগে যখন খালামনির সাথে কথা হয়েছে তখন।
চন্দ্রর ১৮ বছর হতেই চন্দ্র উকিলের থেকে সব জানতে পারে।কিন্তু সব কথা নিজের মধ্যে রাখে চন্দ্র কাউকে জানায় না।
চন্দ্র জানে যারা ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে তারাই ওর টাকাপয়সার লোভে পড়ে ওকে কাছে টেনে নিতে চাইবে তাই কাউকে জানায় নি।
এমনকি সোহান কে ও জানায় নি।

উকিলের সাথে চন্দ্রর ছোট খালুর বন্ধুত্ব থাকায় তার থেকে তিনি জানতে পেরে চন্দ্রর ছোট খালামনিকে জানায়।
ছোট খালামনির থেকে নানার বাড়ির সবাই জানে।

চন্দ্র চেয়েছিলো হোস্টেল থেকে বের হয়ে আসতে কিন্তু অভিভাবক ছাড়া হোস্টেল থেকে ছাড়ে না তাই চন্দ্র ও অমত করে নি খালা যখন বলেছে খালু যাবে চন্দ্রকে নিয়ে আসতে।

ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে চলে গেছে।

বাহিরে উত্তরের হাওয়া,চন্দ্র জানালা খুলে দিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ালো।
ঠান্ডা বাতাস চন্দ্রকে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিলো।চন্দ্রর পরনে একটা দেশি শাল,পায়ে মোজা,গলায় উলের একটা নীল মাফলার।

ফোন হাতে নিয়ে চন্দ্র সোহান কে কল দিলো। হোস্টেল থেকে আসার এই একটা ভালো দিক।সোহানের সাথে কথা বলতে পারবে যেকোনো সময়।
সোহানের নাম্বার বিজি!

চন্দ্র কিছুটা অবাক হলো। এর আগে কখনো সোহানের সাথে কথা হয় নি রাতে।শুক্রবার সকাল ৭টায় শুধু কথা হতো তাই চন্দ্রর ধারণা নেই সোহানের ফোন রাতে সবসময় এরকম বিজি থাকে কি-না।
একরাশ অস্বস্তি নিয়ে চন্দ্র বিছানায় গেলো ঘুমাতে।এবং প্রায় সাথেসাথে ঘুমিয়ে গেলো।

চন্দ্রর ঘুম ভাঙ্গলো শেষ রাতের দিকে।
ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো চন্দ্র বিছানায়।
বুকের ভিতর কেমন ভারী হয়ে আছে।ফোন নিয়ে আবারও কল দিলো সোহান কে।
এবার সুইচ অফ পাচ্ছে।

বাকিটা সময় কাটলো চন্দ্রর অস্থিরতায়।

সকালে চন্দ্র বের হলো ফ্ল্যাট খোঁজার উদ্দেশ্যে। খালামনির বাসায় যে চন্দ্র থাকবে না সে-তো চন্দ্রর আগেই ভেবে রেখেছে।চন্দ্রর বাবার রেখে যাওয়া অনেকগুলো বাড়ি আছে,সেগুলোতেও চন্দ্র এখন উঠতে চায় না।কাউকে জানতে দিতে চায় না চন্দ্র এখনই তার অর্থ সম্পদের কথা।চন্দ্র একটা অসহায় মেয়ে,চন্দ্র চায় সবাই সেটাই জানুক।যারা এটা জেনেও চন্দ্রকে ভালোবেসে কাছে টানবে তারাই তো প্রকৃত ওর শুভাকাঙ্ক্ষী,আপন মানুষ,প্রিয় মানুষ।

এখন বাসা খোঁজার পালা।
ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ের জন্য বাসা খুঁজে পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার।
কিন্তু তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না চন্দ্রর।
ভাগ্যে যখন আছে এই বেহাল দশা,না মেনে উপায় কি!
চন্দ্র ঘুরতে লাগলো ধানমন্ডির আশেপাশে বাসার উদ্দেশ্যে।

জীবন তাকে নিয়ে কোন খেলা খেলতে যাচ্ছে তা নিয়ে চন্দ্রর কোনো ধারণা ও ছিলো না।

.
.

নিষাদ প্রতিদিন নিয়ম করে ৩ বার চন্দ্রর ছবি দেখে।ছবিতে চন্দ্রর মুখটা স্পষ্ট না হলেও নিষাদের কাছে মনে হয় এই মুখটির মতো স্বচ্ছ আর কিছু নেই যেনো।

নাশতা সেরে নিষাদ বের হলো সেলুনের উদ্দেশ্যে চুল কাটার জন্য,২ দিন পরে ওর একটা বন্ধুর বিয়ে।বিয়েতে যেতেই হবে।সব বন্ধুদের একটা মিলনমেলা হবে সেখানে।
যদিও নিষাদের মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না বিয়েতে,কিন্তু অনুরোধে ঢেঁকি গেলা বলে একটা কথা আছে।
তেমনই হচ্ছে বিষয়টা। সবার অনুরোধ রক্ষার্থে যেতে হচ্ছে নিষাদকে।

চুল কেটে নিষাদ বাসায় চলে গেলো আবার।গোসল সেরে বের হলো আবার শপিংয়ে। বন্ধুরা সবাই কালার ম্যাচ করে পাঞ্জাবি পরবে বলে ঠিক করেছে।

গায়ে হলুদে বর পরবে হলুদ পাঞ্জাবি,বাকি সব বন্ধু পরবে আকাশি কালার পাঞ্জাবি।
বিয়েতে বরের মেরুন শেরওয়ানি অন্যদের সাদা পাঞ্জাবি।রিসিপশনের দিন বর পরবে নীল পাঞ্জাবি বাকীরা সবাই পরবে চকলেট কালার পাঞ্জাবি।

সেই মতোই শপিং করতে হবে নিষাদের।

.
.

বাসা খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্রর যখন বেহাল অবস্থা তখনই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো।এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে দেখলো চন্দ্র হাতে করে অনেকগুলো ফুলের তোড়া নিয়ে ফিরছে।পোশাক দেখে সাধারণ পরিবারের কোনো মধ্যবয়স্ক গৃহিণী মনে হলো চন্দ্রর।
রাস্তা পার হবার সময় মহিলা বিপাকে পড়ে গেলো। যতোবারই রাস্তা পার হতে চায় একটা না একটা গাড়ি এসে যায়,আর মহিলা যেতে পারে না।৩-৪ বার এরকম করতে করতে একবার মাঝরাস্তায় গিয়ে মহিলার হাত থেকে সবগুলো ফুলের তোড়া পড়ে গেলো রাস্তায়।
মহিলা কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেলো,ফুল তুলে নিবে না-কি নিজে মাঝরাস্তা থেকে সরে আসবে।

সেই মুহুর্তেই চন্দ্র হ্যাঁচকা টান দিয়ে মহিলাকে সরিয়ে নিয়ে এলো মাঝ রাস্তা থেকে।তারপর মহিলাকে দাঁড় করিয়ে নিজে গিয়ে ৩ টা ফুলের তোড়া তুলে নিলো,বাকি ২ টা গাড়ির চাকার নিচে পড়ে থেতলে গেছে।
একহাতে ফুল নিয়ে অন্য হাতে মহিলা কে ধরে রাস্তা পার হলো চন্দ্র।
টের পেলো মহিলার পুরো শরীর কাঁপছে ভয়ে।

চন্দ্রর ভীষণ মায়া হলো।চন্দ্র হেসে জিজ্ঞেস করলো,”একা বের হলেন কেনো চাচী?
মেয়ে নেই আপনার,মেয়েকে সাথে নিয়ে বের হতেন।”
মহিলা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,”না রে মা,আমার মেয়ে নেই।”

চন্দ্র বললো,”এভাবে কেনো বের হয়েছেন চাচী,এতো ফুল কি করবেন?”

মহিলা জবাব দিলো,”তোমার চাচার এই জারবেরা আর রজনীগন্ধা ফুল অনেক পছন্দের মা।মাঝেমধ্যেই আমি এভাবে ফুল কিনে রুমে রাখি তারে সারপ্রাইজ দিতে।”

মহিলার কথা শুনে চন্দ্র অভিভূত হলো।এই বয়সে এসেও কি মহব্বত তাদের মধ্যে।
চন্দ্রর মনে পড়লো মায়ের কথা।ও কখনো দেখে নি বাবা-মাকে একসাথে বসে কথা বলতে,সবসময়ই দেখেছে দুজনকে দু মেরুর বাসিন্দা।
কেউ কারো সাথে কথা বলতো না।

মহিলা জিজ্ঞেস করলো চন্দ্রকে,”কি নাম তোমার মা?
আমার সাথে বাসায় কিন্তু যেতেই হবে তোমার,এতো বড় উপকার করলে আর বাসায় চা খেয়ে যাবে না তা হবে না মা।”

চন্দ্র হেসে দিলো।কখনো তো আপনজন কেউ এরকম আদর করে চন্দ্রর সাথে কথা বললো না।অথচ এই অচেনা মহিলা কি আদরমাখা কণ্ঠে তাকে মা বলে ডাকলো।

চন্দ্র জবাব দিলো,”আমার নাম চন্দ্র চাচী।”

মহিলা মুগ্ধ হয়ে বললো,”খুব সুন্দর নাম তোমার মা,একেবারে তোমার মতো তোমার নাম।আসলেই তুমি একটা চন্দ্র মা।”

মহিলার বাসার সামনে গিয়ে চন্দ্র ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলো। ধানমন্ডির মতো এরকম একটা জায়গায়,এতো বড় একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো মহিলা,অথচ দেখে মনে হয় যেনো নিতান্তই সাধারণ পরিবারের মানুষ তিনি।

বাসার ভিতরে ঢুকে চন্দ্র অবাক হলো ভীষণ রকমের। এতো বড় বাসা চন্দ্র ভাবতে পারে নি।ড্রয়িং রুমের ইন্টেরিয়র ডিজাইন দেখলে যেকোনো মানুষের চক্ষু কপালে উঠে যাবে।দেয়ালে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা মাস্টারপিস কিছু আর্ট।

চন্দ্রকে বসতে বলে মহিলা কিচেনে গেলো একবার। তারপর নিজেদের রুমে ঢুকে ফুল রেখে আসলো চন্দ্রর কাছে।
বোরকা ছাড়া সুতি শাড়িতে মহিলাকে দেখতে কেমন কোমল,স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে।
চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি যাচ্ছিলে কোথায়?”

“আমি বাসা খুঁজতে বের হয়েছি চাচী।”

“কে কে আছে বাসায় তোমার। ”

চন্দ্র একমুহূর্ত চুপ থেকে বললো,”আমার কেউ নেই চাচী,আমি একাই থাকি।বাবা মা মারা গেছেন।একটা বান্ধবীকে সাথে নিয়ে থাকবো একটা ফ্ল্যাটে।তাই ফ্ল্যাট খুঁজছি।এই শহরে একা মেয়েদের বাসা খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ”

মহিলার মুখ ঝলমল করে উঠলো চন্দ্রর কথা শুনে,হেসে বললেন,”তুমি চাইলে এই বিল্ডিং এ বাসা নিতে পারো মা।এই বিল্ডিং টা আমাদের। ৪ তলায় একটা ফ্ল্যাট খালি আছে।তুমি চাইলে আগামীকাল উঠতে পারো।”

এ যেনো মেঘ না চাইতেও জল।চন্দ্রর এতো আনন্দ হলো যে ওর ইচ্ছে করলো মহিলাকে জড়িয়ে ধরে।
কিন্তু লজ্জায় পারলো না।

নাশতা চলে এলো। নাশতার আইটেম দেখে চন্দ্র চমকে উঠলো। এতো আইটেম কে খাবে?
উনি কি চন্দ্রকে রাক্ষস ভেবেছে না-কি!

মহিলা চন্দ্রর মুখের ভাষা পড়তে পারলো।হেসে বললো,”তোমরা ইয়াং জেনারেশন এরকম কেনো,অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে কিছুই খাও না তোমরা। আমার নিষাদ কে ও দেখি এরকম করে,কতো মেপে মেপে খায়।ডাক্তারি পড়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার ছেলের,সব খাবার ক্যালরি মেপে খায় জানো।
এখন তো খাবার বয়স,ইচ্ছে মতো খাবে তোমরা।

তারপর একটা কার্ড দিয়ে বললো,এটা তোমার আংকেলের কার্ড।কোনো সমস্যা হলে সোজা কল দিবে।আমি বলে রাখবো তোমার কথা।যতো শীঘ্রই পারো বাসায় উঠে যেও।”

চন্দ্র কার্ডটির নামে চোখ বুলালো,”মো: হাসনাত চৌধুরী”

চলবে…..???

লিখা: জাহান আরা