চোখের দেখাই সব নয় পর্ব-০১

0
367

#গল্প_চোখের_দেখাই_সব_নয়_
প্রথম_পর্ব
লেখক মোঃ কামরুল হাসান

আমার স্বামী কয়েক দিন ধরে রোজ সময় পেলেই জানালা খুলে নিচে পাশের বাড়ির উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রথম প্রথম আমি সেটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করে ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিইনি ! কিন্তু সেটা যখন আমার চোখের সামনে ঘনঘন হতে লাগলো, তখন আর নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে পারলাম না। খুব জানার ইচ্ছে হতে লাগলো ঘটনাটা আসলে কি? আমার স্বামী মারুফ নিচে তাকিয়ে পাশের বাড়িতে কি এমন জিনিস অমন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে?

তা জানতে স্বামীর বিরুদ্ধে আমি তলেতলে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলাম। কখন সে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তাই লক্ষ্য করতে থাকলাম ! ইচ্ছে আছে ঠিক তখনই গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করবো, কি দেখো অমন করে?

এরপর থেকে দুদিন ধরে সে অফিসের কাজে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার জন্যই হয়তো জানালার কাছে যাওয়ার সময় পাচ্ছে না সে। আমি যে তাঁকে নজরে রাখছি তা কিন্তু মোটেই বুঝতে দিলাম না। সে-ও এই সমন্ধে কিছু আন্দাজ করতে পারলো না।

এ বাড়িটা তিন তলা আর পাশের বাড়িটি হাফ বিল্ডিং টিনের চৌচালা বিশিষ্ট ঘরবাড়ি। মাঝখানে মোটামুটি ভালোই বড়সড় একটা কাঁচা উঠোন। সেখানে প্রায়ই আমি দেখতে পাই বিভিন্ন ঘরের ভাড়াটিয়ারা কাপড় চোপড় শুকাতে দেন। শীতের দিনে ভাড়াটিয়াদের বৌ ঝিয়েরা ঘরের বাইরে এসে উঠানে রোদ পোহাতে বসে থাকে। তিন তলা থেকে তা ভালো করেই দেখতে পাওয়া যায়।

পাশের বাড়ি হলেও এ বাড়ি ও পাশের বাড়ির মধ্যে রাত আর দিন তফাৎ! ওখানে সব নিম্নবর্গের মানুষ বসবাস করে আর এখানে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ।

যারপরনাই তাদের ও আমাদের সমাজ এক হলেও অঘোষিত ভাবে তা আলাদা। দেখা হলে সাধারণ কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমেই তা শুধু একটুখানি সৌহার্দপূর্ণ। নয়তো এ বাড়ির সবাই পাশের বাড়ির মানুষদের এড়িয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করে।

এ বাড়ির মানুষ ও বাড়িতে যায়না বললেই চলে। কিন্তু ও বাড়ির অনেক ভাড়াটিয়া ঠেকাবেঠেকায় এবাড়িতে কালেভদ্রে আসে। আর পাশের বাড়ির মালিক তিনি থাকেন ঢাকায়। তিনি অবশ্য এ বাড়ির মালিকের অনাত্মীয় হলেও আত্মীয়ের অধিক অধিকার রাখেন।

সপ্তাহ খানেক পরে হঠাৎ করে একদিন আমার সামনে সুযোগ এসে গেল। মারুফ কে দেখলাম জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অবস্থায় তাঁকে দেখে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি গো তুমি নিচের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন কি দেখো?

আমার স্বামী স্বাভাবিক ভাবে বলে কই কিছু না তো! আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। পুরুষ মানুষের চোখ দুটি কিসের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়, তাতো আর আমাকে কারও বলে দিতে হবে না। আমি তা ভালো করেই জানি! তাই স্বামীর সরল কথা আমি এতো সহজে মেনে নিতে পারছি না!

অবশ্য পাশের বাড়িতে অমন কেউ নেই যে আমাকে টেক্কা দিতে পারে! আর ওঁরা তো অনেক দিন ধরেই সেখানে আছে। আগে তো কখনও এমন স্বভাব ছিলো না আমার স্বামীর। তবে হঠাৎ করে কি এমন দেখার জিনিস গজালো সেই বাড়িতে? তা আমাকে জানতেই হবে!

মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই নিচের সেই বাড়িতে দেখার মতো কিছু একটা অবশ্যই আছে। নয়লে প্রতিদিন সে একই রুটিন মেনে চলছে কেন? সেদিন থেকে আমার স্বামী জানালার কাছে কম যায়। আমিও তাই সবসময় একটা চোখ সেদিকেই রাখি।

কিন্তু এখন আর ওকে জানালার কাছে বেশিবযেতে দেখি না। বুঝতে পারলাম বোকামি করে ফেলেছি। জিজ্ঞেস না করে পিছনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেই সব আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেতো। এখন আমার স্বামী নিশ্চয়ই সাবধান হয়ে গেছে!

তাঁকে ধরা এখন কি আর আমার পক্ষে এতো সহজ হবে? জানি সেই রকম কিছু হলে, মোটেই সহজ হবে না। কিন্তু আমিও হাল ছাড়বার পাত্রী নই। বিয়ের পরে মা আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন। শোন মা! পুরুষ মানুষ কে কখনো চোখের আড়াল করতে নেই । তবে দেখবি কই না কই গিয়ে একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে! মায়ের কথাটি কিন্তু আমি কখনো ভুলিনা।

এই পুরুষ মানুষগুলো ছাড়া গরুর মতো। সুযোগ পেলেই অন্যের ক্ষেতে গিয়ে মুখ দিয়ে বসবে। অন্যের ফসল নষ্ট করবে। তারপর গেরস্তের জরিমানা দিয়ে অপমান অপদস্ত হতে হবে। হেয় প্রতিপন্ন হয়েও গরুটাকে ঠিক মায়ার কারণে ঘরে নিয়ে আসতে বাধ্য হতে হবে।

এমন ঘটনা হবার আগেই কিন্তু ভালো গেরস্তের সাবধানে থাকা ভালো। তাই আমিও ভালো গেরস্তের মতো সাবধানে থাকি! স্বামীকে যথাসম্ভব চোখের দৃষ্টিতে বেঁধে রাখার চেষ্টা করি।

একদিন আমার স্বামীকে বললাম টুকিটাকি কিছু জিনিস পত্র কেনার দরকার। চল মার্কেটে যাই! আমার স্বামীর শরীর ভালো নয় বলে আমাকে একাই মার্কেটে যেতে হলো। তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে ঘরে রেখে মার্কেটে গিয়ে এটা সেটা কিনে তারাতাড়ি ফিরে এসে দেখি ঘরের দরজা খোলা।

আমিও আর ডাক না দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম। এদিক সেদিক খুঁজে তাঁকে সন্দেহ করা জায়গায় গিয়ে খুঁজে পেলাম। জানালার শিক ধরে পাশের বাড়ির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে!

আজ আর আগের সেই ভুল করলাম না। চুপিসারে তাঁর পিছনে গিয়ে নিচে উঁকি দিয়ে দেখলাম। দু’জন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরে পাশের বাড়ির উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অনেক সুন্দরী একটা মহিলা! আর আমার স্বামী তার দিকেই অমন ভাবে তাকিয়ে ছিলো। মহিলাটিও নি*র্ল*জ্জ দৃষ্টিতে আমার স্বামীর দেখা তাকিয়ে ছিলো।

দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মারুফের গায়ে পড়ে যাচ্ছিলাম প্রায়। কিন্তু জানালার শিক ধরে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। তাই দেখে মারুফ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে, তুমি কখন কোন সময় এলে? দরজা কে খুলে দিলো?

আমি বললাম তুমি কোন কথা বলবে না আমার সাথে। নিচে তাকিয়ে দেখলাম নিচের উঠানে এখনো নি*র্ল*জ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই সুন্দরী মহিলা। তাঁর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। ওদিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে বললাম ছি!

জানিনা তিনি শুনতে পেলেন কি-না? তবে আমার মুখ ও বলার ভাব দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। সেখানে তাঁর প্রতি ঘৃ*ণা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

আমার স্বামী আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু আমি তার কোন কথা শুনতে রাজি হলাম না। সেদিন থেকে এক সপ্তাহ ধরে দুইজন দুই বিছানায় থাকি!

স্বামীর সব কাজ নিরবে করে যাই। কিন্তু কথা বলতে মন চায় না। ভাবি আমার স্বামীর এমন স্বভাব! আমি কখনো স্বপ্নেও তা ভাবতে পারিনা। আমি আমার স্বামীকে অনেক ভালোবাসি। সে মানুষটা মোটেও খারাপ নয়। হয়তো চোখের নেশায় পড়ে গিয়েছিল। এখন আর কতদিন ধরে জানালার ধারেকাছেও যায় না সে।

হয়তো নিজের ভুল এখন সে বুঝতে পেরেছে। আর আমিই বা নিজের স্বামীকে শুধু শুধু একা দোষী ভাবছি কেন? ঐ মহিলা যদি অমন রুপের থালা হাতে নিয়ে ঘুরেন তবে সেই দিকে কোন পুরুষের দৃষ্টি না পড়বে?

ভাবলাম একদিন গিয়ে কয়েকটি কথা উনাকে ভালো করে শুনিয়ে আসবো। বলবো এভাবে পর পুরুষের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের মানুষটার দিকে নজর দিক। যদি তাতেও তৃপ্তি না হয়, তবে ব্যবসা খুলে বসলেই তো হয়! তখন নিশ্চয়ই তার হুঁশ হবে। তবে যদি তাঁর সম্মান বলে কিছু থেকে থাকে?

আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম স্বামীর সাথে ঝ*গড়া মিটিয়ে ফেলবো। তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। মারুফ বসে বসে টিভি দেখছে। আমি তো তার সাথে কথা বলি না। তাই টিভিতে এটা সেটা দেখেই সে এখন সময় কাটায়। আর সকাল হলে তো অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।

নিজেকে আয়নার সামনে ভালো করে আরও একবার দেখে নিয়ে তারপর ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাবছি চুপিসারে কাছে গিয়ে পিছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে চমকে দেবো।

ড্রয়িং রুমে টিভি চলছে কিন্তু মারুফ সেখানে নেই। সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাঁকে সেখানেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই চলো ঝ*গড়া ঝা*মেলা আর নয়। কিন্তু হঠাৎই মারুফ পকেট থেকে কিছু একটা বের করে জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে দিলো।

আমি তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছুঁড়ে দিলে? চিঠি, মানে প্রেমপত্র! মারুফ আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু না! তবে সায়মা তোমার মাথাটা শীঘ্র নষ্ট হতে চলেছে। বাজে চিন্তা বাদ দাও! আমি তাঁর কথা বিশ্বাস না করে কাছে গিয়ে নিচে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। ভাবলাম আমার চোখের ভুল হবে হয়তো?

মারুফ কে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি ঠিক করেছি আজ থেকে তোমার সাথে আর ঝ*গড়া করবো না। তুমিও আমার মনে কষ্ট লাগে এমন কাজ করোনা প্লিজ! মারুফ হেসে বলে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমি কখনোই এমন কাজ করবো না কখনো, যাতে তুমি কষ্ট পাও!

সেদিন আমরা অনেক সুখেই রাত্রি যাপন করলাম। কিন্তু পরদিন জানালার কাছে একটা পাঁচশ টাকার নোট পড়ে আছে দেখে তুলে নিলাম। বুঝতে পারলাম কালকে মারুফ জানালা দিয়ে তবে টাকা ছুঁড়ে মেরেছে! তারাহুরো করে একটা হয়তো পড়ে গিয়েছিল? টাকাটা তুলে নিয়ে রেখে দিলাম। রাতে বাসায় ফিরে এলে পাঁচশো টাকার নোটটি মারুফের হাতে দিয়ে বললাম, সকালে পেলাম ্ জানালার কাছে পড়ে ছিলো। মারুফ বললো তুমি পেয়েছো তোমার কাছেই রেখে দাও! আমি টাকাটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, আমার এ মাসের হাত খরচের টাকা প্রায় সবই জমা হয়ে আছে। মারুফ আর কিছু না বলে টাকা পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।

মাসখানেক ভালোই কাটলো আমাদের। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু যেনো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। আমি শুধু দেখে কষ্টই পেলাম কিছু করতে পারলাম না!

প্রতিদিনের মতো ঘরের টুকিটাকি জিনিস পত্র গুছাতে গুছাতে হঠাৎ সেই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নিচের দিকে চোখের দৃষ্টিটা না চাইতেও চলে গেল।

এমন দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি আমি! আমার স্বামী সেই মহিলার ঘরে প্রবেশ করছে। কেউ দেখার আগেই আমি জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে নিলাম।

আজকে এই দৃশ্য দেখতে পেয়েও আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো না! কারণ প্রচন্ড ঘৃ*ণার সৃষ্টি হয়েছে আমার হৃদয়ে। এই সংসারে আমি আর থাকতে চাই না! খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিচে নেমে এলাম। তারপর পাশের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে দরজা ধাক্কা দিলাম, দরজাটা খোলাই ছিলো।

দেখতে পেলাম আমার স্বামী কতগুলো টাকা সেই মহিলার হাতে দিয়ে বলছে। আমি তোকে এখন ভালোবাসি রে! কথাটা সে শেষ করার আগেই আমি ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে চিৎকার করে বলে উঠলাম। এই তবে তোমার আসল চেহেরা? ছি! নিজের উপর আজ আমার বড্ড বেশি ঘৃ*ণা হচ্ছে। এই বলে যে, তোমার ঘরের মানুষ আমি! ছি, মারুফ! ছি!

চলবে,,,