ছায়াবর্ণ পর্ব-১০+১১

0
288

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১০

সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। আজ আন্টির প্রতিবেশীর সেই মেয়ের বিয়ে। আন্টি জেদ ধরে বসেছেন যে আমাকে তার সাথে যেতেই হবে। তিনি মা কেও রাজি করিয়ে ফেলেছেন। আর মা বাবাকে রাজি করিয়েছেন। আন্টি নিচে গিয়েছেন রেডি হতে। আমি বিছানায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মা বললেন–

— বসে আছিস কেন ছায়া? যা রেডি হয়ে নে। ভাবি তো এখনই চলে আসবেন।

আমি হতাশ কন্ঠে বললাম–

— আমি কি পরে যাবো মা?

মা এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি একটা এলিয়েন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন–

— কি সুন্দর একটা সাদা জামা কিনে দিয়েছিলাম। সেটা তো কোথা থেকে রঙে গোসল করে নষ্ট করলি। নষ্ট না হলে আজ দিব্যি ওটা পরে যেতে পারতি। এখন ওই রঙ চঙ মাখা জামা পরে যা।

আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম–

— এই জন্যই আমি যেতে চাইনি। যাব না আমি। আন্টিকে বলে দিও।

মা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে আমার ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার একটা মিষ্টি রঙা শাড়ি বের করে বললেন–

— এসব কিনেছিস কি জন্য? সাজিয়ে রাখবি বলে? আয় তোকে এটা পরিয়ে দিই।

আমি নাকোচ করে বললাম–

— আমি শাড়ি সামলাতে পারব না মা। আমি পরব না।

— আমি সুন্দর করে পরিয়ে দেবো। কোনো সমস্যা হবে না। তাড়াতাড়ি আয়।

অগত্যা আমাকে শাড়ি পরতে হলো। মা সুন্দর করে পিন লাগিয়ে সেট করে দিলেন। শাড়ির সাথে পরলাম কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত হাতা ওয়ালা ব্লাউজ। চুল খোপা করে আর্টিফিসিয়াল গাজরা লাগালাম। হাতে পরলাম কাঁচের চুড়ি। চোখে একটু আইলাইনার আর ঠোঁটে হাকলা গোলাপী লিপস্টিক ছাড়া আর তেমন সাজলাম না। মা আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন–

— দেখ তো, শাড়ি পরলে তোকে কি সুন্দর লাগে! আর তুই শাড়ি পরতেই চাস না। যা এখন তোর আন্টি অপেক্ষা করছে বোধহয়।

আমি মৃদু হেসে হাতে ফোন নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বিনা নিমন্ত্রণে যেতে কেমন একটা লাগছে, আন্টিও না! বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসলেন। আমি আন্টি দের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খোলাই আছে। আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, এমন সময় দেখলাম বর্ণ ভাই ফোন চাপতে চাপতে এগিয়ে আসছেন। পরনে একটা হলুদ রঙের টি শার্ট এবং কালো ট্রাউজার। উনি কি বিয়েতে যাবেন না? হুট করে ফোন থেকে মুখ তুলে উনি কেমন থমকে গেলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টিতে কেমন যেন নুইয়ে পড়লাম। আন্টি এসে বর্ণ ভাইকে বললেন–

— এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর।

বর্ণ ভাই সম্বিত ফিরে পেয়ে সরে গেলেন। আন্টি একটা ফিরোজা রঙের শাড়ি পরেছেন। তিনি আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন–

— ও’মা! ছায়া! তুমি শাড়ি পরেছ! কি সুন্দর লাগছে তোমায়! আমারই তো নজর লেগে যাচ্ছে।

আমি হাসলাম। হঠাৎ বর্ণ ভাই বললেন–

— মা! দুই মিনিট ওয়েট করো।

বলেই তিনি হনহনিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি পরিপাটি হয়ে ড্যা’সিং লুক নিয়ে বের হলেন। কালো রঙের জিন্স আর ইয়াশ রঙের শার্ট পরনে তার। উন্মুক্ত চুল গুলো কপালে পড়ে আছে। আজ না জানি কত মেয়ে কাত হবে! আমার নিজেরই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ, এসব কথা উনি জানতে পারলে কি মনে করবেন! আন্টি অবাক হয়ে বললেন–

— তুই যাবি! তুই যে বলেছিলি যাবি না, তোর কি কাজ আছে। তাহলে?

উনি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন–

— এখন আর কাজ নেই মা। তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে যাই।

— আচ্ছা ঠিক আছে চল। দেরি হয়ে গেল তো। চলো ছায়া।

বাড়ি যেহেতু কাছেই সেহেতু আমরা হেঁটেই গেলাম। জাঁকজমক ভাবে সাজানো বিয়ে বাড়ি। লোক জন গিজগিজ করছে। আমি আন্টির পাশে পাশে হাঁটছি। সবাই অপরিচিত, কাউকেই চিনি না। বর্ণ ভাই আমাদের পিছু পিছু হাঁটছেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আন্টি বললেন–

— ছায়া তুমি এখানে বসো, আমি গিফট দিয়ে আসি।

আন্টি চলে গেলেন। আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। বর্ণ ভাই আমার পাশে বসে বললেন–

— পড়ালেখায় সব সময় ফাঁকি তাই না? পড়ার ভয়ে নাচতে নাচতে বিয়ে বাড়ি চলে এলে? আমি তো তোমাকে পড়াবো বলেই আসতে মানা করেছিলাম।

বিয়ে বাড়িতে আছি মুডটা একটু ভালো ছিল। সেটাও ওনাকে খারাপ করতেই হবে! আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— আমি নাচতে নাচতে চলে আসিনি। আন্টি জোর করে এনেছেন।

তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে বললেন–

— বুঝেছি, যত সব বাহানা।

আমি কিছু বললাম না। ওনাকে কিছু বলাই বৃথা। আমি আশে পাশের লোকজন দেখতে লাগলাম। একেক জন কি সুন্দর করে সেজে এসেছে! আমার দেখতে খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ একটা মহিলা আমার পাশে বসে বললেন–

— তুমি কে গো মা? কার সাথে এসেছ?

— আমি বিথী আন্টির সাথে এসেছি।

উনি পাশের বর্ণ ভাইকে দেখে বললেন–

— বর্ণ! এটা তোমার কোনো বোন বুঝি? ভারি মিষ্টি মেয়ে।

আমি লজ্জা পেলাম এভাবে বলায়। বর্ণ ভাই ফোন থেকে মুখ তুলে বললেন–

— সে আমার কেউ হয় না আন্টি। আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকে মাত্র।

বর্ণ ভাইয়ের এমন কথায় মন খারাপের আভাস পেলাম। মহিলাটি আমার কাছে বিভিন্ন কথা শুনতে লাগলেন। যেমন: তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? তোমার বাবা কি করেন? ইত্যাদি। এক সময় বর্ণ ভাই বললেন–

— আপনার ছেলের সাথে এই মেয়ে হবে না আন্টি। সে কেবল দশম শ্রেণীতে উঠেছে।

মহিলাটির মুখ থমথমে হয়ে গেল। তিনি আফসোসের সাথে বললেন–

— এতো ছোট?

— হ্যাঁ।

মহিলাটি চলে গেলেন। আমি চোখ বড় বড় করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম–

— আপনি মিথ্যে বললেন কেন?

তিনি দাঁত কটমট করে বললেন–

— তো কি বিয়ে করতে চাও? এসব শাড়ি টাড়ি পরে কি ছেলেদের মায়েদের দেখাতে এসেছ? যেন তারা দেখে আর তোমাকে তুলে নিয়ে যায়? বিয়ে করার এতোই শখ?

ওনার ঝাঁঝালো কথায় আমার চোখের কোণে জল জমলো। আমি ঢোক গিলে বললাম–

— আমি বুঝিনি যে উনি এই জন্য আমার থেকে এসব জিজ্ঞেস করছিলেন।

— তা বুঝবে কেন? তুমি তো নার্সারিতে পড়ো।

আমি মুখ ঘুরিয়ে উঠে যেতে নিলেই উনি শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন। শাসিয়ে বললেন–

— খবরদার এখান থেকে এক পাও নড়বে না।

অগত্যা আমাকে বসে থাকতে হলো। লোকে বিয়ে বাড়িতে এসে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আর আমাকে মুর্তি হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

নয়টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল। বিয়েও পড়ানো শেষ। বর বউকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। দু’জনকে মানিয়েছেও বেশ। আন্টি বর্ণ ভাইকে বললেন–

— আমার যেতে দেরি হবে। মেয়ে বিদায় দিয়ে তারপর যাবো। তুই ছায়াকে নিয়ে বাড়িতে যা। ও শাড়ি পরে আর থাকতে পারছে না।

বর্ণ ভাই রাজি হলেন। আমাকে ইশারা করে এগোতে বলে নিজে হাঁটতে লাগলেন। আমি গুটি গুটি পায়ে ওনার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। উনি এতো জোরে জোরে হাঁটছেন যে আমি ওনার সাথে পেরে উঠছি না। আমি হাঁপিয়ে গিয়ে বললাম–

— একটু আস্তে হাঁটুন প্লিজ। আমি আপনার সাথে পারছি না।

উনি দাঁড়িয়ে বললেন–

— হাঁটতেই যখন পারো না তখন শাড়ি পরলে কেন?

— আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম তো। মা আমাকে জোর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। আমি নাচতে নাচতে শাড়ি পরিনি। আপনি সেই তখন থেকে আমাকে এই নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। এতোটা বাজে দেখতে লাগছে আমাকে? ধুর! আর কোনো দিন শাড়ি পরবোই না। আজ আমার আসাই উচিত হয়নি।

আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বর্ণ ভাই এক হাতে আমার দু হাত মুড়িয়ে পেছনে আটকে ফেললেন। এক হাত আলতো করে আমার গাল স্পর্শ করলেন। তিরতির করে কেঁপে উঠলাম। ফাঁকা রাস্তায় কেউ নেই, শুধু আমরা দুজন। ওনার চোখের দিকে তাকালাম, এই চোখের ভাষা আমি পড়তে জানি না। তিনি ফিসফিস করে বললেন–

— তোমার এই নতুন রুপ দেখে যে একজনের মনের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা জানলে তুমি কখনও শাড়ি পরতে না। তোমার এই সাজ দেখে যে একজনের ঠিক কত বার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছে, তা জানলে তুমি এমন সাজতে না। তোমার এই গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট দেখে যে একজন তা ছোঁয়ার জন্য ছটফট করছে, তা জানলে তুমি ঠোঁট রাঙাতে না। তোমার হাতের এই রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে যে একজন মাতাল হয়ে যাচ্ছে, তা জানলে তুমি চুড়ি পরতে না। কখনও না।

আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব শুনে গেলাম। কিছুই বুঝলাম না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ধীর কন্ঠে বললাম–

— কে সেই একজন?

তার হাত ঢিলে হলো। ছেড়ে দিলেন আমায়। হাঁটতে হাঁটতে বললেন–

— দ্রুত এসো। কাজ আছে আমার। লোকদের দেওয়া নেওয়া করার মতো সময় নেই আমার।

আমি মুখ গোমড়া করে হাঁটতে লাগলাম। এতক্ষণ কি সব বকলেন উনি? কার কথা বললেন? কিছুই তো মাথায় ঢুকলো না। আসলেই মূ’র্খ আমি! গণ্ড মূ’র্খ! বাড়িতে পৌঁছে উনি বললেন–

— আগামীকাল পড়াতে যাবো। সব পড়া যেন রেডি থাকে। আর একটু আগে কি না কি বলেছি ভুলে যাও। ফোনে দেখেছিলাম তাই মুখ থেকে বের হয়ে গিয়েছে।

আমি ওপরে চলে এলাম। উনি না বললেও আমি জানি উনি কখনও আমাকে এসব বলতে পারেন না। না জানি ওনার গার্লফ্রেন্ড কে এসব বলেন কিনা?

চলবে..

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১১

এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি। এখন সাড়ে সাতটা বাজে। কি একটা কারণে বর্ণ ভাই আজ পড়াতে আসতে পারবেন না বলেছেন। একদমই পারবেন না এটা বলেননি, বলেছেন আমাদের বাসায় আজ যেতে পারবেন না। শুনে তো আমি খুশিতে আত্মহারা। আজ আর পড়তে হবে ভেবে সে কি আনন্দ আমার আকাশে বাতাসে! কিন্তু হঠাৎ মায়ের একটা কথায় আমি আকাশে বাতাসে উড়তে উড়তে ঠাস করে পড়ে গেলাম।

— বর্ণের কি যেন কাজ আছে তাই আজ আসতে পারবে না। কিন্তু তোর তো কোনো কাজ নেই। শুয়ে বসেই তো থাকিস। যা তুই গিয়ে পড়ে আয়। তাহলে বর্ণের কাজও হবে আর তোর পড়াও। তোকে খুব ভালো বলবে দেখিস, যা।

আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে বললাম–

— আজ না গেলে হয় না মা?

মা চোখ গরম করে তাকালেন। কড়া কন্ঠে আওড়ালেন–

— তুই কি যাবি? নাকি আমি দুই একটা লাগাব?

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— যাচ্ছি যাচ্ছি। এই বেচারা মেয়েটার ওপরই তো তোমরা সবাই মিলে অত্যা’চার করবে। ধুর! ভালো লাগে না।

বই খাতা গুছিয়ে চলে আসলাম। আন্টি দের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম। আন্টি দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে হাসি মুখে বললেন–

— এসো ছায়া। পড়তে এসেছ বুঝি?

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। ভেতরে ড্রয়িং রুমে একটা মেয়েকে বসা দেখলাম। আন্টি বললেন–

— ছায়া! এ হচ্ছে নীলা, আমার ননদের মেয়ে।
নীলা, এই সেই ছায়া যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।

মেয়েটা কেমন যেন করে তাকালো। আমি হাসি মুখে বললাম–

— ভালো আছেন আপু?

— হ্যাঁ।

এক কথায় জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি বুঝলাম না আমার ওপর বিরক্ত হওয়ার কারণ কি? আন্টি বললেন–

— বর্ণ ঘরে আছে। ওই যে ওটা। তুমি যাও।

নীলা আপু খ্যাক করে উঠে বললেন–

— মামি! বর্ণ ভাইয়ের কাজ আছে বলে আমাকে রুমে ঢুকতেই দিলো না। আর তুমি এই মেয়েকে তার রুমে ঢুকে যেতে বলছ? আমি তো নিজেদের লোক তাই আমাকে অ্যালাও করলো না, আর এ তো বাইরের কে না কে!

তিক্ত কথায় বুক ভারি হয়ে উঠলো। নীলা আপু ঠিকই বলেছেন, এতে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। তবুও আমার খারাপ লাগছে। আমি মলিন কন্ঠে আন্টিকে বললাম–

— আমি তাহলে যাই আন্টি।

আন্টি কিছু বললেন না। আমি বের হয়ে যেতে গেলে পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো–

— দাঁড়াও!

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কেন জানি না আমার খুব কান্না পাচ্ছে। বর্ণ ভাই এগিয়ে এসে বললেন–

— সব সময় ফাঁকি দেওয়ার চিন্তা! যাও আমার রুমে যাও। যেয়ে বই বের করো। আমি আসছি।

আমি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি ধমকে উঠে বললেন–

— কি হলো? যাও।

আমি কেঁপে উঠে দ্রুত পায়ে তার রুমে ঢুকে গেলাম। উনি কখনও আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলেন না। হয় ঝাঁঝালো কন্ঠে বলবেন নাহয় ধমকে বলবেন আর নাহয় গম্ভীর কণ্ঠে বলবেন। বর্ণ ভাইয়ের রুমটা খুব পরিপাটি ভাবে সাজানো। রুমের মাঝ বরাবর বড় একটা বিছানা, বিছানার এক পাশে বড় একটা ওয়ারড্রব, ওয়ারড্রবের সোজাসুজি অপর পাশে ওয়াশ রুম, তার পাশে মাঝারি আকারের একটা ড্রেসিং টেবিল, এক কোণে পড়ার টেবিল এবং চেয়ার। জানালায় সাদার ওপর কালো ডিজাইনের পর্দা। বিছানার পাশ ঘেঁষে বেলকনির দরজা। বিছানায় তাকিয়ে দেখি অনেক বই মেলে রাখা। উনি কি পড়ছিলেন? উনি রুমে এসে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–

— হা করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বই বের করো।

আমি মিনমিন করে বললাম–

— কোথায় বসবো?

তিনি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বিছানায় বই মেলে রাখা বই গুলো গুছিয়ে এক পাশে সরিয়ে ফেললেন। ইশারা করা আমাকে সেখানে বসতে বললেন। আমি চুপচাপ বসে বই বের করলাম। উনি নিজে পড়ছেন পাশাপাশি আমাকে পড়াচ্ছেন। আমি বললাম–

— আপনার তো পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে। আমি আজ নাহয় যাই?

তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন–

— আমি তোমাকে বলেছি যে আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে?

আমি মাথা ডানে বায়ে নাড়ালাম। তিনি দ্বিগুণ চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম–

— না।

— তাহলে চুপ চাপ পড়ো।

আমি বিনা বাক্যে পড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দরজায় নক হলো–

— আসবো বর্ণ?

বর্ণ ভাই বিরস কন্ঠে অনুমতি দিলেন–

— আয়।

নীলা আপু রুমে প্রবেশ করেই আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। নীলা আপু হাতে থাকা কফির মগ দেখিয়ে বললেন–

— তুমি বলেছিলে না কফি দিতে? তাই নিয়ে আসলাম বর্ণ।

— রেখে যা। আর তোকে না বলেছি আমাকে নাম ধরে না ডাকতে? আমি না তোর বড়? ভাইয়া বলবি।

নীলা আপু কিছু বললেন না। আমার পাশ কাটিয়ে কফির মগ রাখতে যেয়ে ভুল বশত না ইচ্ছে বশত জানি না, প্রায় আধা কাপ ফুটন্ত কফি পুরোটা আমার বাম হাতে পড়লো। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলাম–

— আহ্!

নীলা আপু তড়িঘড়ি করে বললেন–

— স্যরি স্যরি, আসলে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। ইশ্ তোমার বিছানা টা নষ্ট হয়ে গেল!

বর্ণ ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার হাত ধরে ফেললেন। আমার চোখে পানি টলমল করছে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছি। ইতোমধ্যে হাত লালবর্ণ ধারণ করেছে। বর্ণ ভাই হাতে ফু দিতে লাগলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন–

— ও’র হাত পুড়ে গিয়েছে। আর তুই বিছানা নিয়ে পড়ে আছিস! তোর কাজ শেষ। তুই এবার যেতে পারিস।

— কিন্তু বর্ণ!

— বললাম না যা!

নীলা আপু আমার দিকে একবার রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। আমি জড়ানো গলায় বললাম–

— খুব জ্বলছে।

বর্ণ ভাই দ্রুত পায়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলেন। স্যাভলন বের করতে দেখে আমি আঁতকে উঠে বললাম–

— না, ওটা দিবেন না। ম’রে যাবো আমি।

— কিচ্ছু হবে না।

— না, খুব জ্বলবে।

— হুশ! এই দিকে দেখো। আমার চোখের দিকে তাকাও। তাকাও!

আমি চোখ তুলে ওনার দিকে তাকালাম। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। উনি নরম কন্ঠে বললেন–

— ভরসা আছে আমার ওপর? আমি কি তোমাকে কখনও ব্যথা দিতে পারি? কিচ্ছু হবে না। আমি আস্তে করে মলম লাগিয়ে দেবো। একটুও টের পাবে না। প্রমিস!

আমি ওনার দিকে তাকিয়েই থাকলাম। কি সুন্দর ওনার বিলাই চোখ জোড়া! সাজানো ঘন কালো ভ্রু জোড়া! এত সুন্দর কেন উনি? আমাকে নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছেন কেন উনি? এ মায়া থেকে বের হওয়া যে অসম্ভব। এর মধ্যে উনি নিজের কাজ শেষ করে ফেললেন। পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। আমি এমন এক ঘোরে ছিলাম যে কিছু বুঝতেই পারিনি। উনি দুহাতে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন–

— কি? বুঝতে পেরেছ একটুও?

আমি মাথা দু’পাশে নাড়ালাম। তিনি আমার বই খাতা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন–

— যাও, আজ তোমার ছুটি। আর কাল কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। রাতে আমি পড়াতে যাবো। ঠিক আছে? সাবধানে থাকবে, হাতে যেন চাপ না পড়ে। বুঝেছ? যাও।

আমি ডান হাতে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আন্টি ড্রয়িং রুমেই ছিলেন।‌ আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বললেন–

— তোমার হাতে কি হয়েছে?

— কিছু না আন্টি একটু কফি পড়ে গিয়েছিল।

— সেকি! কীভাবে?

— ও কিছু না আন্টি। আমি যাই।

আন্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি চলে এলাম। বাসায় এসে আরেক জ্বালা! মা ব্যস্ত হয়ে বললেন–

— ভালোই তো গেলি, হাতে ব্যথা পেলি কীভাবে?

আমি রুমে ঢুকে বললাম–

— কিছু না মা। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, খাবো না রাতে। ডাকবে না।

দরজা চাপিয়ে শুয়ে পড়লাম। হাতে চিনচিন করে ব্যথা করছে। ব্যথা সহ্য করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো। গায়ে ধুম জ্বর এসেছে। হাতের ব্যথা থেকেই এই জ্বরের আগমন। মা মাথার কাছে বসে কপালে কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছেন। বাবা মাকে বকাবকি করছেন–

— হাতে এতটা ব্যথা কীভাবে পেল ও? তুমি কোথায় থাকো?

মা বিরক্ত হয়ে বললেন–

— আপনার মেয়ে কি আমাকে বলে কিছু? তখন জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে ব্যথা পেলি, বললো না।

আমি ধীর কন্ঠে ডাকলাম–

— মা।

মা বললেন–

— ঘুম ভেঙেছে তোর! এবার কিছু খেয়ে ওষুধ টা খেয়ে নে ছায়া। নাহলে জ্বর কমবে না।

মা বাবা ধরে আমাকে উঠিয়ে বসালেন। মা গালে তুলে খাইয়ে দিলেন, রুচি চলে যাওয়ার ফলে খেতে পারলাম না। মা আর জোর করলেন না। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তারা চলে গেলেন।

পরদিন কলেজে যেতে পারলাম না। এমনকি বিছানা থেকে উঠলাম প্রর্যন্ত না। মা এসে প্রতি বেলা আমাকে জোর করে গালে তুলে খাওয়ালেন। ঘুমিয়েই কাটলো আমার সারাদিন। রাত সাতটা কি আটটা বাজে, আমি অর্ধ ঘুমে রয়েছি। এমন সময় হাতে শীতল স্পর্শ পেলাম। একটা শীতল হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার পোড়া হাত। আমি চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। ঘুম যেন চোখে এঁটে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। দেখতে পেলাম না কাউকে। যতক্ষণে আমি চোখ মেলে তাকিয়েছি ততক্ষণে রুমে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে।

চলবে..