ছায়াবর্ণ পর্ব-১২+১৩

0
262

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১২

দুদিন জ্বরে ভুগে আজ আমি সুস্থ। কলেজও গিয়েছিলাম আবার কোচিংয়েও। বই খাতা খুলে বসে আছি। বর্ণ ভাই একটু পরই পড়াতে আসবেন। দুই দিন এসে এসে ফিরে গিয়েছিলেন। বর্ণ ভাই একটু বাদেই এসে পড়লেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। উনি জবাব দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছু পর্যবেক্ষণ করে কপালে হাতের উল্টো পিঠ ছোঁয়ালেন, শীতল স্পর্শে চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। সেই হাত কপাল থেকে গাল স্পর্শ করলো এবং গাল থেকে গলা। তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। উনি কি আমার জ্বর আছে কিনা সেটা দেখছিলেন? উনি বললেন–

— তোমার হাত দেখি।

আমি বোকার মতো ডান হাত দেখালাম। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন–

— গ’র্দ’ভ! আমি তোমার পোড়া হাত দেখতে চেয়েছি।

আমি বাম হাত দেখালাম। তিনি হাতটা আলতো করে ধরে ভালো করে দেখলেন। এখন আর ব্যথা নেই তেমন, দাগ আছে। তিনি বললেন–

— ঠিক মতো মলম লাগাবে।

— আচ্ছা।

— রিফাত নামের ওই ছেলেটা আবারও দেখলাম তোমার সাথে। বলেছি না এসব ছেলে টেলে থেকে দূরে থাকবে?

আমি চাপা স্বরে বললাম–

— আপনিও তো ছেলে! তাহলে কি আপনার থেকেও দূরে থাকবো?

তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন–

— কি বললে! কথায় কথায় কি তোমাকে পাল্টা কথা বলতেই হবে? রিফাতের সাথে মিশবে না। বুঝেছ?

— জ্বি।

তিনি পড়ানো শুরু করলেন। পড়ানো শেষে উনি চলে যাবার সময় আমি বললাম–

— নীলা আপু আপনাকে পছন্দ করে তাই না?

তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। থমথমে কন্ঠে বললেন —

— তোমাকে এ কথা বলেছে?

— না মানে, কেউ বলেনি। আপনি বড় হওয়া সত্ত্বেও আপু আপনার নাম ধরে ডাকে, আর আপনার দিকে কেমন করে যেন তাকায় তাই..

— তাই তুমি ধরে নিলে যে ওর আর আমার মধ্যে কিছু আছে? ছোট, ছোটর মতো থাকো। এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।

তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই উনিও নীলা আপুকে পছন্দ করেন। নাহলে তো এভাবে বলতেন না। নীলা আপুই ওনার গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো। ওনার গার্লফ্রেন্ড আছে ভেবেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। অনুভূতি টা মোটেও ভালো লাগার নয়, এটা বুক ভারি হওয়া অনুভূতি।

রানি মিটিমিটি হাসছে আর আমি গালে হাত দিয়ে তাকে দেখছি। এখন অফ পিরিয়ড থাকায় আমরা ফাঁকা ক্লাস রুমে বসে আছি। আমি রানির ওপর বিরক্ত, মহা বিরক্ত। হাত বাড়িয়ে রানির মাথায় গাট্টা মারলাম। রানি আর্তনাদ করে মাথায় হাত ঘসতে ঘসতে বলল–

— মারলি কেন?

— তখন থেকেই আনমনে হেসে চলেছিস! কারণ কি?

রানি এমন একটা ভান করলো যেন খুব লজ্জা পাচ্ছে। আমি আবারও ও’র মাথায় গাট্টা মারলাম। বললাম–

— এসব ড্রামা বাদ দিয়ে সোজাসুজি বল ঘটনা কি?

রানি দুই হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল–

— আসলে হয়েছে কি!

— হ্যাঁ কি হয়েছে?

— না মানে।

— কি মানে?

— আ’ম ইন অ্যা রিলেশনশিপ।

— ওহ!

রানি কি বলল পুরোপুরি বুঝে উঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম–

— ওয়াট!

রানি লাজুক ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। আমি হাহাকার করে বললাম–

— কে সেই হতভাগা? কার কপাল পুড়লো রে রানি?

রানি চোখ ছোট ছোট করে বলল–

— কি বললি?

আমি মেকি হেসে বললাম–

— না মানে জিজু কে?

— তোর আফীফ ভাই।

এবার আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চোখ বড় বড় করে বললাম–

— কিহ! আফীফ ভাই! তুই ভোলাভালা আফীফ ভাইকে ফাঁসিয়ে নিজের জালে জড়িয়ে নিলি? তোর বুক কাঁপলো না?

রানি আমার হাত টেনে ধরে বসালো। ব্যঙ্গ করে বলল–

— এ্যাহ! ওনার ভোলাভালা আফীফ ভাই! ব্যাটা নাম্বার ওয়ান বদ’মাইশ। ব্যাটা আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। আমার পিছু পিছু ঘুরে আমার কানের মাথা খেয়েছে। তারপর আমাকে প্রপোজ করেছে।

— আফীফ ভাই তোকে প্রপোজ করেছে? এসব কবে, কখন হলো?

— এই তো ক’দিন হলো।

— আমাকে বলিসনি কেন? আমাকে জেরা করে শুনতে হলো কেন?

রানি আমার হাত ধরে বলল–

— তুই তো অসুস্থ ছিলি। তারপর আমিও ভুলে গিয়েছিলাম রে।

— আচ্ছা বাদ দে। আফীফ ভাইকে তো একদম সহ্য করতেই পারতি না। আর এখন কি হলো?

রানি নুইয়ে মাথা নিচু করে বলল–

— হয়ে গেল।‌ ব্যাটা এতো রোমান্টিক আমি আগে বুঝিনি। আমার কথা এখন বাদ। তুই কি জানিস তোকে নিয়ে কি হয়েছে?

আমি অবাক হয়ে বললাম–

— আমাকে নিয়ে আবার কি হলো?

— রিফাত আছে না? ও নাকি তোকে ভালোবাসে, সেটা সবার সাথে বলে বেড়িয়েছে। আর তুইও নাকি ও’কে লাইক করিস।

— কিহ!

— হ্যাঁ এসবই হয়েছে।

আমি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললাম–

— বাদ দে। কদিন এসব হবে তারপর এমনি এমনিই সব বন্ধ হয়ে যাবে।

বর্ণ ভাই আমাকে আগে থেকেই বলেছেন রিফাতের সাথে না মিশতে। এখন তো আর ও’র দিকে তাকাবো প্রর্যন্ত না। ছেলে মেয়েতে একটু কথা বললেই কলেজে গুজব ছড়িয়ে যাবে! অদ্ভুত।

অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ। বেশ ভালোই পরীক্ষা দিয়েছি, সব হয়েছে বর্ণ ভাইয়ের জন্য। আজ কোচিং বন্ধ। তাই ছাদে আসার সুযোগ পেয়েছি। কত দিন যে ছাদে আসতে পারি না, ঠিক নেই। কোচিং থেকে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায় আর তার কিছুক্ষণ পরেই বর্ণ ভাই পড়াতে আসেন। তাই আর আসা হয় না। ছাদা দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিলাম। চোখ বন্ধ করে শীতল হাওয়া অনুভব করলাম। সুর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পিছু ঘুরে দেখি নীলা আপু দাঁড়িয়ে আছেন। আমি হেসে বললাম–

— আরে আপু! কেমন আছেন?

উত্তর দিলেন না। আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে বললেন–

— বাইরের লোক, বাইরের লোকের মতোই থাকো। ঘরের লোক হওয়ার চেষ্টা কোরো না।

আমি বুঝলাম না, জিজ্ঞেস করলাম–

— মানে?

নীলা আপু আক্রোশে ফেটে চার আঙুলে আমার গাল শক্ত করে চেপে ধরলেন। হিসহিসিয়ে বললেন–

— বর্ণের থেকে দূরে থাকবে। কি ভেবেছ আমি কিছু বুঝি না? বড়লোক ছেলে দেখেছ কি গলায় ঝুলে পড়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ! ছিঃ!

গাল ব্যথায় এবং আপুর কথার তিক্ততায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আমি কোনো রকম বললাম–

— আপনি এসব কি বলছেন আপু?

তিনি এক প্রকার ঝটকা দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন–

— ঠিক বলছি আমি। আমি অন্ধ নই। কীভাবে যে বর্ণের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াও সবটা দেখি আমি। শুনে রাখো, বর্ণের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ফারদার তোমাকে যদি বর্ণের আশে পাশে দেখি তো মামাকে বলে তোমাদের এই বাড়ি থেকে তাড়াতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না। মাইন্ড ইট।

আমি জড়ানো গলায় বললাম–

— আপনি এসব ভুল ভাবছেন আপু। উনি শুধুই আমার টিউশন টিচার এবং আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে ছাড়া আর কিছুই না।

নীলা আপু বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন–

— হাউ ফানি! তুমি বললে আর আমি নাচতে নাচতে বিশ্বাস করে নিলাম। তুমিই তো একমাত্র বুদ্ধিমতী আর আমরা সবাই তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি তাই না?

আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নীলা আপু বিরক্ত হয়ে বললেন–

— তোমার এসব নাটক আমার সামনে বন্ধ করো। যা বললাম তা যেন মনে থাকে। নাহলে তোমার বাবাকে অপমানিত হয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখবে।

নীলা আপু চলে গেলেন। আমি মুখে দুহাত চেপে কেঁদে উঠলাম। কি দোষ আমার? উনি এতো অপমান কেন করে গেলেন?

রাতে বর্ণ ভাই পড়াতে এলেন। আমার ফোলা চোখ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন–

— চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? চোখটাও দেখছি লাল হয়ে আছে! কি হয়েছে?

আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–

— কিছু না।

তিনি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। পড়ানো শেষে আমি বললাম–

— আমি আপনার কাছে আর পড়বো না। আপনি আর আসবেন না।

তিনি থমকে তাকালেন। গমগমে কন্ঠে শুধালেন–

— কেন? আমার পড়ানো ভালো লাগছে না?

— না, ভালো লাগছে না। আমি পড়বো না ব্যস।

তিনি শীতল কন্ঠে বললেন–

— কি হয়েছে? এমন হাইপার হয়ে আছ কেন?

আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। আবারও কান্না আসছে। তিনি আমার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরালেন। নরম কন্ঠে বললেন–

— আমার দিকে তাকাও।

আমি ঢোক গিলে তার দিকে তাকালাম। উনি বললেন–

— কি হয়েছে? বলো আমাকে?

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–

— কিছু না।

— কেউ কিছু বলেছে?

আমি মৃদু চেঁচিয়ে বললাম–

— না। আপনি আর পড়াতে আসবেন না। আসবেন না মানে আসবেন না। কথা বুঝতে পারছেন না আপনি? যদি আসেন তাহলে আমি কিছু করে ফেলবো বলে দিলাম।

বর্ণ ভাই রেগে গেলেন। টেবিলে থাবা বসিয়ে বললেন–

— মশকরা করছ আমার সাথে? হঠাৎ পড়বো পড়বো না করছ কেন? কিছুই বলছ না। আমি কি খারাপ পড়াচ্ছি? নাকি তোমার আমার কাছে পড়তে ভালো লাগছে না?

আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে রাখলাম। বর্ণ ভাই টেবিলে পুনরায় থাবা বসিয়ে রেগে মেগে বের হয়ে গেলেন। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বিড়বিড় করে বললাম–

— আপনি আমার সামনে আর আসবেন না। আমি আমার বাবাকে অপমানিত হতে কখনও দেখতে পারবো না। কিছুতেই না। আপনি নীলা আপুকে নিয়েই সুখে থাকুন।

চলবে..

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৩

সেদিনের পর থেকে বর্ণ ভাই আর পড়াতে আসেন না। মা ফোন দিলেও ধরেন না। মা আমাকে বলেন —

— তুই কি বর্ণের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস ছায়া? ছেলেটা আর আসছে না কেন?

আমি কিছুই বলি না। উদাস মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি।
অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। আমি বেশ ভালো করেছি। মা বর্ণ ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বলে বেড়াতে লাগলেন বর্ণ ভাই ছাড়া আমার এমন ফলাফল করা সম্ভব হতো না। আমি নিজেও মানি এ’কথা। বর্ণ ভাইকে দেখি না অনেক দিন।‌ দেখবোই বা কীভাবে? আমি তো নিজেই দেখতে চাই না তাকে, আর না চাই তার আশে পাশে যেতে। হয়তো খুব শীঘ্রই নীলা আপু এবং তার বিয়ের দাওয়াত পাবো।

আজ কোচিং ফাঁকি দিয়ে পার্কে বসে আছি। ভালো লাগে না কিছু। বর্ণ ভাই পড়ানো বাদ দেওয়ার পর থেকে আগে যেমন ছিলাম তেমনই হয়ে গিয়েছি। পড়ালেখা করি না, খাপছাড়া জীবন। রানি আমার পাশে বসে আছে। ফোন টিপছে, হয়তো কথা বলছে আফীফ ভাইয়ের সাথে। এদের প্রেম আবার জমজমাট হয়ে উঠেছে। একে অপরকে খুব ভালোবাসে তারা, চোখে হারায় এক প্রকার। আমি এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছি। আমার যে কি হয়েছে তা আমি নিজেও জানি না। বর্ণ ভাইকে খুব মিস করছি। তিনি তো আমার জীবনেরই একটা অংশ হয়ে উঠেছিলেন। এখনও কি আছেন? হয়তো আছেন। হঠাৎ আমার সামনে এসে কেউ দাঁড়ালো।‌ আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম রিফাত। বিরক্ত হলাম। রিফাতকে যত ইগনোর করছি তত যেন বেশি আমার পিছু পিছু ঘুরছে। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–

— সমস্যা কি রিফাত? এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কত বার বলেছি আমার পেছনে আসবে না। তবুও কেন আসো?

রিফাত ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। কোনো হেলদোল হলো না। আমি মুখ কুঁচকে উঠে দাঁড়ালাম। রানিকে বললাম–

— এই রানি। চল বাসায় যাবো।

এগোতে নিলেই রিফাত শক্ত করে হাত ধরে ফেললো। আমি চমকে উঠলাম। হাত মুচড়িয়ে বললাম–

— এটা কি ধরনের অসভ্যতামি রিফাত? হাত ছাড়ো আমার।

রিফাত ছাড়ে না। আরও শক্ত করে ধরে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। রিফাত আবেগপ্রবণ হয়ে বলল–

— আমাকে তুমি বোঝো না ছায়া? আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা তুমি বুঝতে পারো না?

— রিফাত! কি বলছ এসব? তুমি আমার ক্লাসমেট। আমরা শুধুই বন্ধু।

— তো? ক্লাসমেট তো কি হয়েছে? আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না? আমি তো তোমাকে বন্ধু ভাবি না।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম–

— রিফাত প্লিজ সিন ক্রিয়েট কোরো না। আমার হাত ছাড়ো।

রানি হতভম্ব হয়ে আমাদের দেখছে। সে বুঝতে পারছে না তার এখন কি করা উচিত। রিফাত আমার অন্য হাতও ধরে ফেললো। এই স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে আসছে, কই বর্ণ ভাইয়ের স্পর্শে তো এমন হয় না? রিফাত কাতর কন্ঠে বলল–

— আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো ছায়া। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।

— কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না রিফাত। প্লিজ ছাড়ো।

রিফাত নাছোড়বান্দা। আমি যতক্ষন না তার ভালোবাসা গ্রহণ করবো ততক্ষন সে আমার হাত ছাড়বে না। এদিকটা ফাঁকা, তেমন লোকজন নেই। মাঝে মধ্যে দুই একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে । আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে রিফাতকে থাপ্পড় মেরে দিলাম। রিফাত আগুন চোখে তাকালো। বলল–

— তুমি আমাকে মারলে! আমাকে! এখন দেখো তোমাকে কীভাবে অসম্মান করি।

বলেই সে আমার গলা থেকে এক টানে ওড়না খুলে ফেলে দিলো। জামার সাথে পিন লাগানো থাকার ফলে কাঁধের কাছে জামা সামান্য ছিঁড়ে কেটে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম–

— রিফাত!

দুহাতে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।রিফাত যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। সে আবারও হাত বাড়াতে নিলেই এক বলিষ্ঠ হাত তার হাত চেপে ধরলো। হাত মুড়িয়ে শক্ত হাতে চড় বসিয়ে দিলো রিফাতের গালে। রানি আমাকে আগলে নিলো। রানিকে জড়িয়ে ধরে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বর্ণ ভাই রিফাত কে মেরে চলেছেন। লোকজন না থাকায় বর্ণ ভাইকে আটকানোর কেউ নেই। আফীফ ভাই কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বর্ণ ভাইকে ঠেকিয়ে বললেন–

— ছেড়ে দে। ম’রে যাবে তো।

তীব্র আক্রোশে বর্ণ ভাই ফুঁসছেন। আমি রানিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছি। বর্ণ ভাই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আমার ওড়না মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন। রানির থেকে আমাকে ছাড়িয়ে ওড়নাটা মুড়িয়ে দিলেন। এরই মধ্যে রিফাত কোনো রকম পালিয়ে গেল। বর্ণ ভাই আমার হাত ধরে বললেন–

— চলো।

হুট করেই নীলা আপুর কথা গুলো মনে পড়লো। আমি ঝটকা মেরে তার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। দুহাতে চোখ মুছে বললাম–

— আমাকে সাহায্য করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। আর আমি বাইরের লোক। বাইরের লোকদের নিয়ে এতো চিন্তা করা আপনার সাজে না। আমি একা যেতে পারবো। আপনার তো সামনে বিয়ে আপনি বরং নীলা আপুকে সময় দিন। আমার পেছনে সময় নষ্ট করলে তিনি আপনাকে ভুল বুঝবেন।

বর্ণ ভাই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আফীফ ভাই হতবাক কন্ঠে বললেন–

— এসব তুমি কি বলছ ছায়া?

— আমি ঠিকই বলছি। আমাকে উনি পড়াতে আসতেন বলেই ওনারা বেশি টাইম স্পেন্ড করতে পারতেন না। তাই তো আমি ওনাকে পড়াতে আসতে বারণ করেছিলাম। তাছাড়া আমি তো ওনার কেউ না, আমাকে নিয়ে এতো কিসের চিন্তা ওনার? আজ আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম উনি কেন এলেন? একটা বাইরের মেয়ের জন্য এতোটা কেন ভাববেন উনি?

বর্ণ ভাই আবারও হাত চেপে ধরলেন। রাগে দুঃখে আমি বলা শুরু করলাম–

— হাত ছাড়ুন আমার। কোন অধিকারে আমার হাত ধরছেন আপনি? কিসের এতো অধিকার বোধ আপনার? আমি আপনাদের বাড়ির একটা সামান্য ভাড়াটিয়া ছাড়া কিছুই না। কেন এভাবে অধিকার ফলান আমার ওপর? আর পর নারীর হাত ধরতে আপনার লজ্জা করলো না? এতোটা নিচ আপনি?

কথা শেষ হতে না হতেই বাম গাল জ্বলে উঠলো। ব্যথায় চোখে পানি এসে গেল। বর্ণ ভাই মেরেছেন আমায়। আফীফ ভাই এবং রানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বর্ণ ভাইয়ের লাল চোখ দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। কিছুই আর বলতে পারলাম না। বর্ণ ভাই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন। আফীফ ভাই এবং রানিও ছুটল আমাদের পিছু পিছু।

জড়সড় হয়ে বসে আছি। কাঁদতেও পারছি না। গুনগুন করে কাঁদার শব্দ হলেই বর্ণ ভাই ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিচ্ছেন।‌ পাশেই অসহায় হয়ে আফীফ ভাই এবং রানি দাঁড়িয়ে আছে। আফীফ ভাই বর্ণ ভাইকে বললেন–

— বর্ণ! মাথাটা একটু ঠান্ডা কর।

বর্ণ ভাই কিছু বললেন না। সেই যে আমার হাত ধরে এনেছেন এখনও ছাড়েননি শক্ত করে ধরেই আছেন। যেন আমি পালিয়ে যাবো। সামনে বসে আছেন বয়স্ক কাজী। তাকে দেখেই ক্ষণে ক্ষণে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। কাজী কিছুটা কেশে বললেন–

— মেয়ের নাম কি?

বর্ণ ভাই দেরি না করে বললেন–

— তাহসীনা ছায়া।

কাজী লিখলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–

— বয়স?

— আঠারো।

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। এখনও আঠারো হয়নি আমার। এখন চলছে আগস্ট আর আমার আঠারো হবে নভেম্বরে। আমি মুখ খুলতে নিলেই বর্ণ ভাই চোখ রাঙিয়ে তাকান। আমি চুপসে যাই। কাজী আমার চোদ্দ গোষ্ঠীর তথ্য নিয়ে তারপর বললেন–

— ছেলের নাম?

— আওসাফ বর্ণ।

— বয়স?

— সাতাশ।

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। সাতাশ! এতো বড় উনি! দেখতে তো কচি খোকা লাগে, কে বলবে এই লোকের বয়স সাতাশ? আমি তীব্র প্রতিবাদ করতে চাইলাম, “বন্ধ করুন এই বিয়ে! আমি এই বুইড়া ব্যাটা কে একদমই বিয়ে করবো না। কিছুতেই না।” বর্ণ ভাইয়ের শক্ত চোয়াল দেখে কথা গলায় আটকে গেল। কিছু বলার সাহস পেলাম না। ছলছল চোখে আফীফ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। যার অর্থ, “আমাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নিন আফীফ ভাই, প্লিজ।” আফীফ ভাইকে যেন আমার থেকেও বেশি অসহায় দেখালো। কাজী বললেন–

— তাহসীনা ছায়া আপনি আওসাফ বর্ণ কে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন কবুল।

আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। বর্ণ ভাই হাতের বাঁধন শক্ত করে নিলেন। চোখ দিয়ে ইশারা করে কবুল বলতে বললেন। আমি তবুও বললাম না। বর্ণ ভাই ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললেন–

— কি হলো? কবুল বলো দ্রুত।

কাজী বললেন–

— মেয়ে কি রাজি নয়?

— আপনি আপনার কাজ করেন। আমরা সবাই রাজি। ও একটু লজ্জা পাচ্ছে।

বর্ণ ভাই আবারও বললেন–

— কবুল বলো। এতো সময় নেই আমার হাতে। তাড়াতাড়ি।

আমি কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বললাম–

— কবুল।

কাজী আরও দুবার কবুল বলালেন। বর্ণ ভাইকে বলতে বললে উনি একটুও দেরি করলেন না। যেন উনি কবুল বলে ট্রেন ধরবেন। ধমকা ধমকি করে আমাকে দিয়ে জোর পূর্বক সইও করালেন। সাক্ষী হিসেবে আফীফ ভাই এবং রানি স্বাক্ষর করলো। বিবাহ সুসম্পন্ন হয়ে আমি মিস থেকে মিসেস হয়ে গেলাম আর একলা থেকে দোকলা হয়ে গেলাম। মা বাবা জানতে পারলে কি যে ঝড় উঠবে তা ভেবেই আমার হাটু কাঁপতে লাগলো। বর্ণ ভাই আমাকে টেনে কাজী অফিস থেকে বের করলেন। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে জলদগম্ভীর কন্ঠে বললেন–

— আফীফ! ও’কে বলে দে বর্ণ কোনো পর নারীর হাত ধরে না। এটাও বলে দে এখন ও’র ওপর আমার কি অধিকার আছে। আমি এখন যা খুশি করতে পারি। তার ওপর সব থেকে বেশি অধিকার আমার।

একটু চুপ থেকে আবার বললেন–

— অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তুই রানিকে বাড়িতে দিয়ে আয়। আর এ’কে রাস্তায় ছেড়ে দে। থাকুক একা একা।

বলেই হাঁটতে লাগলেন। আফীফ ভাই বাধ্য হয়ে রানিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার পেছনে ছুটলাম। কি পাষাণ লোক! একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে কেউ একা ফেলে যায়? নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে ফেলে কেউ কীভাবে যেতে পারে!

চলবে..