ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০২

0
156

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#দ্বিতীয়_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিটি ঘাড় ঘুরিয়ে চিত্রার দিকে তাকালো। চিত্রা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,”সাজিদ ভাইয়া আপনি এখানে?”

“কেন এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”

“না মানে।”

“এতো আমতা আমতা করতে হবে না।মিস টিনা এদিকে আসুন।”

“জি স্যার বলুন।”

“ম্যামকে খাবারটা খাইয়ে দিন।আর শুনুন ওনার যেন কোনো অযত্ন না হয়।”

“স্যার আপনি….”

“আমার একটা দরকারি কাজ আছে।আর হ্যাঁ তোমাকে বলছি মেয়ে এতো দিন নিজে যা খুশি করেছো। এবার নিজের ইচ্ছামতো, খেয়ালখুশি মতো না চলে বাচ্চাটার কথা ভাবতে শেখো।”

থমথমে গলায় কথাগুলো বলে সাজিদ বাইরে চলে গেল।বাচ্চার কথা শুনে চিত্রার একদিকে খুব আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে খুব কান্না পাচ্ছে।এ কেমন নিয়তি তার!টিনা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,”ম্যাম আপনার মন খারাপ কেন?”

“কই না তো।”

“খাবারটা খেয়ে নিন।এখন আপনার সময়মতো খেতে হবে।”

“আপনি রেখে যান আমি পরে খেয়ে নেবো।”

“ঠিক আছে আমি পাশের রুমে আছি। প্রয়োজন হলে এই বেলটা বাজাবেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবো।”

টিনা চলে গেল।চিত্রা সাগরের কথা ভাবছে।”মা হওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতস্বরূপ। ওইজন্য কাল আমি বাচ্চার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম।একটা ছোট্ট প্রাণ আমার ভেতরে তিল তিল করে বেড়ে উঠছে।আচ্ছা বাচ্চার কথা শুনলে কি সাগর আগের মতো ভালো হয়ে যাবে!নাকি পরিবর্তন হবে না!তুই খুব অভাগীরে সোনা। জন্মের আগেই পিতৃহীন হয়ে গেলি। সোনা তুই কোনো চিন্তা করিস না।মাম্মা তোকে সবসময় ভালো রাখবে‌। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেবে না।”

বেশকিছুক্ষন পর টিনা এসে বলল,”ম্যাম এখানে শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ আছে‌। আপনার পছন্দমত একটা পরে নিন। আমাদের বের হতে হবে।”

“টিনা আপু আমরা কোথায় যাবো?”

“স্যার আপনার জন্য ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করছে। উনি গাড়ি পাঠিয়েছেন আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।”

চিত্রা একটা শাড়ি পড়ে নিলো। তারপর গাড়িতে বসে পড়লো। আধঘন্টা পরে একটা হসপিটালের সামনে গাড়ি থামলো‌। টিনা সাবধানে চিত্রাকে নিয়ে গেল ডক্টরের চেম্বারে।অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।চিত্রাকে দেখে সাজিদ অপলক ভাবে তাকিয়ে রইল।যেন তার চোখ দুটো বহু দিনের তৃষ্ণার্ত মিটিয়ে নিচ্ছে।সাজিদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চিত্রার অস্বস্তি হতে লাগলো।”স্যার ম্যামকে নিয়ে এসেছি।”
টিনার কথায় সাজিদের কোনো পরিবর্তন হলো না।

“মিস্টার খান!”

ডক্টরের এমন ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে সাজিদের হুঁশ ফিরে আসলো।এমন একটা সুন্দর মূহুর্তে একটা ককর্শ কন্ঠ অপ্রত্যাশিত। সাজিদের অসহ্য লাগলো।
টিনাকে ইশারা করলো বাইরে অপেক্ষা করার জন্য।ডাক্তার চিত্রাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।”নার্স ওনাকে নিয়ে গিয়ে টেস্টগুলো করিয়ে আধঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট নিয়ে আসো।”

নার্স চিত্রাকে নিয়ে গেল।”ডক্টর চিত্রা ঠিক আছে তো?ওর বাচ্চা কেমন আছে?”

“দেখুন ওনার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ।শরীর অনেকটা দুর্বল। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। ওনার প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার।না হলে বাচ্চাকে কোনো ভাবেই বাঁচানো সম্ভব নয়। ওষুধ শুধু ওনার শারীরিক অবস্থার উন্নতি করতে পারবে কিন্তু মানসিক সুস্থতা আপনাকে করতে হবে।উনি যেনো সবসময় হাসিখুশি থাকে তার খেয়াল রাখতে হবে।আচ্ছা আপনি তো ওনার হাসবেন্ড। আপনাকে আমি যতটুকু চিনি ওনার তো এই অবস্থা হওয়ার কথা নয়‌।”

“আপনি ভুল ভাবছেন ডক্টর।উনি আমার হাসব্যান্ড নন।”

চিত্রার গলার আওয়াজ শুনে সাজিদ নড়েচড়ে বসল। সাজিদের দিকে একবার তাকিয়ে চিত্রা আবার বলা শুরু করলো।”ডক্টর উনি আমার কেউ নন।তাই আমার শরীরের অবস্থা সম্পর্কে ওনাকে বলে শুধু শুধু বিভ্রান্ত করছেন। আপনি যা বলার আমায় বলুন।আমি সবটা মেনে চলার চেষ্টা করবো।”

“উনি তো এতোক্ষণ ধৈর্য্য ধরে কথাগুলো শুনছিলেন।আচ্ছা যাই হোক আপনার অভিভাবক কাউকে ডাকুন।দেখুন আপনি তো পেশেন্ট তাই আপনাকে সব কথা বলতে আমি বাধ্য হলেও এই ব্যাপারগুলো আপনার হাসব্যান্ড বা ফ্যামিলির অন্য কাউকে বলা উচিত।কারণ আপনি আপনার দেখাশোনা ঠিকভাবে করতে পারবেন না।”

“আপনি বলুন। আমার কেউ নেই।আমি একাই।তাই নিজের খেয়াল নিজেকে রাখতে হবে।”

চিত্রার কথাগুলো শুনে সাজিদের প্রচুর রাগ হতে লাগলো।মনে মনে চিত্রাকে খুব বকা দিচ্ছিলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে বলল,”আচ্ছা ডক্টর ওনাকে এখানে আর কোনো প্রয়োজন আছে?”

“না মিস্টার সাজিদ। রিপোর্ট আসলে সে অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হবে।আর প্রত্যেক মাসে একবার করে চেকআপে আসতে হবে।দ্যাটস ইট!”

“ওকে থ্যাংক ইয়ু।থ্যাংক ইয়ু সো মাচ্।মিস টিনা একবার এদিকে আসুন তো।”

টিনা ভেতরে আসতেই সাজিদ বলল,”মিস টিনা ওনাকে নিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করুন।আমি এক্ষুনি আসছি।”

“জি স্যার।ম্যাম আমার সাথে আসুন।”

সাজিদ চলে যেতে বলায় চিত্রার বেশ রাগ হয়। দাঁত কিড়মিড় করে কি যেন বলতে লাগে। সাজিদ চিত্রার দিকে তাকিয়ে দেখে চিত্রা বিরবির করছে।”এমন ভাবে দাঁত কামড়ে ধরলে দাঁত পড়ে যাবে।বয়স তো এখনো কম।এই বয়সে দাদি নানি হওয়ার এতো ইচ্ছে!”

সাজিদের আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া কথাটা চিত্রা বুঝতে পেরে টিনার সাথে চলে গেল।সাজিদ ডক্টরের কাছ থেকে সব জেনে নিলো। ওষুধপত্র নিয়ে আধঘন্টা পরে গাড়িতে ফিরে এলো। গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলল।ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করলো।

ঘুম ভেঙ্গে চিত্রাকে খুঁজতে লাগল সাগর।তার প্রচন্ড নেশার টান উঠেছে। পুরো ঘর তছনছ করে ফেলেছে টাকা খুঁজতে গিয়ে। কিন্তু কোথাও একটা আধুলির ছিটে ফোঁটা পর্যন্ত নেই।তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এক্ষুনি নেশা করতে হবে নইলে সে শেষ হয়ে যাবে।ঘরের একটা কোনায় চিত্রার হারমোনিয়ামটা দেখতে পায়।মাথার মধ্য দুষ্টু বুদ্ধি ঢেউ খেলে যায়।একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,”হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে অনেকখানি টাকা পাওয়া যাবে। মোটামুটি তিন/চার দিনের জন্য নিশ্চিন্ত মনে থাকবো। তারপর আমার চিত্রা বেবির থেকে আবার টাকা নেওয়া শুরু করবো।”একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে এসে হারমোনিয়ামটাকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

“ড্রাইভার সাহেব সামনে একটু ব্রেক করেন।আমি নামবো।মিস টিনা আপনি চিত্রাকে নিয়ে বাড়ি যান। দুইজনে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নিন।আর ওনার একটু খেয়াল রাখবেন।”

“জি স্যার অবশ্যই।”

সাজিদ গাড়ি থেকে নেমে কাকে যেন কল করলো।”হ্যালো। আমি এক্ষুনি আসছি।”
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর একটা গাড়ি এসে সাজিদের সামনে দাঁড়ায়।সাজিদ মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে বলে,”ড্রাইভার সাহেব এই নিন। আপনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান।”

সাজিদ গাড়ি নিয়ে চলে গেল।গাড়ি চালাতে চালাতে কাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ভাবছে।জীবনের চলার পথে কত শত মানুষের সাথে দেখা হয়।কত ঘটনা ঘটে। কিছু ঘটনা মনের মধ্যে দাগ কেটে যায়।চিত্রা তাকে অপমান করার পর আর কখনো সে চিত্রার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু চিত্রার খোঁজ খবর নিতে কখনো কার্পন্য করেনি। গতকাল চিত্রার কথা খুব মনে পড়ছিল তাই কাজ শেষ করে নদীর পাড়ে আসছিল। মন খারাপ থাকলে সবসময় এই জায়গায় এসে বসে থাকে।গাড়ি থেকে নামতেই দেখে দূরে একটা মেয়ে নদীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। মেয়েটার ভাবগতিক সুবিধা লাগছিল না।তাই দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরলো। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। ফোনের ফ্লাশ অন করে দেখে এই তো তার সেই স্বপ্নকুমারী।যাকে এতো সাধ্য সাধনা করেও পায় নি তাকে এই অবস্থা দেখবে ভাবতে পারে নি। তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে তুলে বাসায় নিয়ে গেল।

ফোনের রিংটোনে সাজিদের ভাবনার রেশ কাটল। নাম্বার দেখে আর রিসিভ করলো না। একটু পরে ট্রাফিক জ্যাম পড়লো। আধঘন্টা ধরে বসে আছে। আজকাল জ্যামের কারণে রাস্তায় গাড়ি চালানো অসহ্যকর। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।গাড়ির জানালা নামিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখে…….

***চলবে***