ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০১

0
219

#ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#সূচনা_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

হাসপাতালের বেডে নিজের এক্স হাজবেন্ডকে দেখে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রা। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা পাশে বসে তসবিহ পড়ছেন। পাঁচ বছর আগে দেখা সুদর্শন সেই ছেলেটা আজ অন্তঃসারশূন্য হয়ে বিছানার সাথে লেপ্টে আছে। বিধাতার কি অসীম লীলাখেলা!

বেডের দিকে এগিয়ে যেতে মনে পড়ে গেল পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ।এখনো মনের ভেতরটা দগদগে ঘা হয়ে আছে।

চিত্রা আর সাজিদ একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো।চিত্রা পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ভালো গান করতো। ভার্সিটির কমবেশি সবার কাছে পরিচিত মুখ। অন্যদিকে সাজিদ হাসি আড্ডায় মেতে থাকতো সারাক্ষণ। পড়াশোনা থেকে শত হস্ত দূরে থাকতো। তবে ভার্সিটির সব প্রোগ্ৰামে অংশগ্রহণ করতো। এইজন্য সাজিদ ছিলো ভার্সিটির সবার চোখের মনি। সাজিদ ছিলো চিত্রার এক বছরের সিনিয়র‌। অনুষ্ঠানের সুবাদে দুজন দুজনকে চিনতো। একদিন চিত্রা ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলো।এমন সময় সাজিদ এসে সামনে দাঁড়ায়।চিত্রা হকচকিয়ে গেল‌।”কিছু বলবেন সাজিদ ভাইয়া?”

“সব মেয়েরা আমায় দেখে পাগল হয়ে যায় আর তুমি ভয় পেয়ে যাও। আমার সঙ্গ পেতে সবাই উৎসুক হয়ে থাকে।আর তুমি এড়িয়ে চলো।কেন জানতে পারি?”

চিত্রা সাজিদের কথাগুলো শুনে আরো ঘাবড়ে যায়।মনে মনে ভয় পেলেও মুখের ভঙ্গিতে সেটা লুকানোর চেষ্টা করে বলে,”আপনি আমার সিনিয়র‌।আমরা তো ক্লাসমেট নই যে আপনার সঙ্গ পেতে চাইবো। তাছাড়া আপনি আমার কোনো আত্নার আত্নীয় নন যে আপনাকে দেখে গদগদ হয়ে যাবো‌”

“বাহ !এই প্রথম কোনো মেয়ের মুখে এমন কথা শুনলাম। আমার বন্ধুরা তবে ঠিকই বলেছে। তুমি আসলেই….”

“আপনার বন্ধুরা কি বলেছে আর কি বলবে সেটা জানার কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।দয়া করে আমায় যেতে দিন।”

“যেতে তো দেবোই। শুধু একটা কথা জানার ছিল।”

“কি কথা?”

“কাল তুমি নবীন বরণে গান গাইবে তো!”

“নাম তো দিয়েছি।বাকিটা উপরওয়ালার ইচ্ছে।”

কথাটা বলে চিত্রা চলে গেল। সাজিদের বন্ধুরা এসে সাজিদকে সান্তনা দিতে লাগল‌।পরের দিন নবীন বরণ।চিত্রা ভার্সিটিতে আসতেই রানী বলল,”ওয়াওওওওও চিত্রা তোকে এই নীল শাড়িতে অপূর্ব লাগছে‌।”

“ধ্যাৎ সবসময় তোর ফাইজলামি।”

“রানী ঠিকই বলছে। অনেক সুন্দর লাগছে।”

জয়ীতার কথা শুনে চিত্রার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো।মনে মনে বলল,”শাড়িটা না পড়ে অন্য ড্রেস পরা উচিত ছিল।”

ধীরে ধীরে সবাই ভার্সিটির্তে পৌঁছে গেল‌। যেহেতু নবীন বরণ তাই অনেক মানুষ এসেছে।চিত্রাকে স্টেজে গান করার জন্য ডাকা হচ্ছে‌।চিত্রা এতো মানুষ দেখে একটু ভয় পাচ্ছিলো।যদি গানটা ভালো না হয়।এসব ভাবতে ভাবতে স্টেজে উঠলো‌।গান গাওয়া শুরু করলো।”আমাদের চিত্রা কি ভালো গায় তাই না?”

“হুম রে রানী। সত্যি অসাধারণ গায়।”

চিত্রা গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামতেই সাজিদ সামনে এসে বলল,”নেক্সট টাইম আর কখনও শাড়ি পড়বে না‌।আমি চাই না আমার জিনিস পাবলিক দেখুক।”

সাজিদের কথায় চিত্রা লজ্জা পেলো।দৌড়ে রানী আর জয়িতার কাছে চলে এলো।”কি রে সাজিদ ভাই কি বলছিল তোকে?”

“ক কই তেমন কিছু না।”

চিত্রা তার বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে লাগল।খানিক বাদে একটা ছেলে এসে চিত্রার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো‌।চিত্রা সবার আড়ালে চিরকুটটা পড়লো।”শোন তোরা একটু বস।আমি এক্ষুনি আসছি।”

চিত্রা পুকুর পাড়ে চলে গেল।গিয়ে দেখে খুব একটা কেউ নেই।সাজিদ দূরে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।চিত্রা এসে বলল,”কেন ডেকেছেন?”

“তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে!”

“আপনি সিনিয়র ভাইয়া।আশা করি এমন কিছু বলবেন না যাতে আপনার দিকে তাকালে আমার ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়।”

“মিস চিত্রা আমি তোমার কেউ হই না‌। তাই আশা করা করি বাদ দাও।শোন মেয়ে আমি তোমায় ভালোবাসি‌‌।আর তোমাকেই চাই। আমি কবি সাহিত্যিক নই। তোমায় কবিতা লিখে ইমপ্রেস করার মতো যোগ্যতা নেই‌।আমার তোমাকেই চাই।”

সাজিদের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে চিত্রা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নি।ঠাসস করে একটা চড় মেরে দিলো। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে দেখছে তাদের।”আর কখনও এমন কথা যেন না শুনি।এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

চিত্রা চলে গেল। সাজিদ কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কি যেন বলতে লাগলো। সেদিনের পর আর সাজিদকে ভার্সিটিতে দেখা যায় নি‌।

কেটে গেছে কয়েকমাস। এরই মধ্যে চিত্রার সাগর নামে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব টা একটা সময় গিয়ে প্রণয়ে পরিণত হয়। সবসময় তাদের একসাথে দেখা যেত।সাগর ও টুকটাক গান করতো। হঠাৎ একদিন চিত্রা কাউকে কিছু না জানিয়ে সাগরকে বিয়ে করে ফেলে। চিত্রার মা নেই‌।বিয়েতে তার বাবার খুব আপত্তি ছিলো। তিনি কিছুতেই সাগরকে মেনে নেবেন না।বিয়ের পর চিত্রার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেন।

বিয়ের প্রথম কয়েকমাস খুব ভালোভাবেই কাটে। ধীরে ধীরে সাগরের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে লাগল।সাগর কোনো কাজ কর্ম করতে চাইতো না। চিত্রার কাছে নেশার টাকা চাইতো। গান করে যে কটা টাকা পেত সব সাগর জোর করে নিয়ে যেত।আর টাকা দিতে না পারলে চিত্রাকে মারধর করা শুরু করত। সাগরের অত্যাচাররে মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।চিত্রার সহ্য শক্তি হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে চিত্রা শেষ হয়ে যাবে।মনে মনে ঠিক করলো।”তিলে তিলে শেষ হওয়ার চেয়ে ভালো একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া।”

একদিন রাতে সে ঠিক করলো সাগরের সাথে আর থাকবে না।সে নিজেকে শে** করে দেবে। রাত হওয়ার অপেক্ষা করছিল।সাগর নেশা করে এসে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।কোনো হুঁশ নেই‌।চিত্রা সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর সে একটা নদী দেখতে পায়।সাত পাঁচ না ভেবে নদীতে ঝাঁপ দেবে এমন সময় বাচ্চার কান্না শুনতে পায়। এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। দ্বিতীয়বার ঝাঁপ দিতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটলো। চিত্রার বুকের ভেতরটায় ভয় জমতে শুরু করল‌। নিজেকে সামলে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময় কেউ এসে তাকে বাঁচিয়ে নে। অন্ধকারের একটা আবছায়া অবয়বটা দেখতে পেয়ে চিত্রা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।জ্ঞান ফিরতেই দেখে সে এক রাজকীয় খাটে শুয়ে আসে।পাশে একজন অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে।”ম্যাম আপনি ঠিক আছেন? আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে। অবশ্য সেটা স্যার বলবে।আমি স্য্যারকে ডেকে আনছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”

“স্যার ম্যামের জ্ঞান ফিরেছে।”

“ওকে তুমি এখানে অপেক্ষা করো টিনা।আমি দেখা করে আসছি।”

চিত্রা শুয়ে শুয়ে গতকালের ঘটনার কথা ভাবছে।”কে বাঁচিয়েছে আমায়।আমি বাচ্চাদের কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম কেন!”

এসব ভাবতে ভাবতে চিত্রা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভেঙ্গে দেখে কেউ একজন আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা চিত্রার খুব চেনা। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। নিজেকে ধ্যতস্ত করে বলল, “শুনছেন!”

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিটি ঘাড় ঘুরিয়ে চিত্রার দিকে তাকালো। চিত্রা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল…….

***চলবে****