ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-০৩

0
149

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#তৃতীয়_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

ফোনের রিংটোনে সাজিদের ভাবনার রেশ কাটল। নাম্বার দেখার পর রিসিভ করতে ইচ্ছে করলো না।যেন একপ্রকার এড়িয়ে গেল।একটু পরে ট্রাফিক সিগন্যাল। সিগন্যাল কাটিয়ে কিছুদূর এগোতে ট্র্যাফিক জ্যাম।আধঘন্টা ধরে বসে আছে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন নেই।গাড়িগুলো নির্বিকার ভাবে আটকে আছে।কেউ কেউ অসহ্য হয়ে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে।আজকাল জ্যামের কারণে রাস্তায় গাড়ি চালানো সবচেয়ে ধৈর্য্যের কাজ। সাজিদের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।গাড়ির কাচ নামিয়ে বাইরে তাকাতেই দূর থেকে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পায়। পরিচিত মুখের ব্যাক্তিটিকে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতেই সাজিদ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিজেকে আড়াল করে সে ব্যক্তিটিকে দেখতে থাকে।ব্যাক্তিটি আর কেউ নয়।চিত্রার স্বামী সাগর। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে তাড়াহুড়া করে একটা দোকানের দিকে যাচ্ছিলো ।সাজিদ গাড়ি থেকে নেমে সাগরে পিছু নিলো। কিঞ্চিত দূরত্ব বজায় রেখে সে সাগরকে অনুসরণ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে সাগর দোকান থেকে বের হয়ে উল্টো দিকে হাটা দিলো।সাজিদ দেরি না করে ওই দোকানে গেল।দোকানে ঢুকতেই একটা মাঝ বয়সী লোক এসে বলে,”কি লাগবো কন?”
হারমোনিয়াম,সেতার,বীণা,তবলা হগ্গল কিছু আছে।ইচ্ছা হইলে রেডিমেড নিতে ফারেন।আবার নিজের পছন্দ অনুযায়ী কিন্না নিতে ফারেন।”

“আমার একটা ইনফরমেশন চাই।আশা করি অ্যান্সার পাবো।”

লোকটা ইংরেজিটা বুঝতে না পেরে একজনকে ডেকে বলল,”এই ফটকা উনি কি কইতাছে দেখ দিখি নি ।আমি তো ওসব ইংজিরি ফিনজিরি বুঝি না।তুই তো তাও কয় কেলাশ পড়লি।”

একটা অল্পবয়সী ছেলে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলল,”মালিক আমার নাম ফটিক। আপনি আমারে ফটকা কইবেন না। আমার একটা পিস্টিজ আছে না।”

“হইছে তুই আমার আর জ্ঞান দিতে আইবি না।কামে মন দে।”

ফটিক এসে বলল,”জি স্যার কন?”

“একটু আগে একটা ছেলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এসেছিল। যাওয়ার সময় তার সাথে কোনো ব্যাগ ছিল না।কেন এসেছিল তুমি জানো?”

“হ জানমু না ক্যান।উনি একডা হারমোনিয়াম বেচতে আইছে।মন মতো ট্যাকা পাইছে বেইচ্চা দিছে।”

“ওই হারমোনিয়ামটা একটু দেখতে পারি।”

“এখনি আনতাছি।”

ফটিক হারমোনিয়ামটা সাজিদের সামনে নিয়ে আসলো। হারমোনিয়ামটা তার খুব চেনা। হারমোনিয়ামর বাম পাশে একটা নাম দেখে সাজিদ হাসির রেখা টেনে বলে,”আমি এটা নিতে চাই।”

“জে নিতে পারেন।মালিক মালিক।”

“কি হইছে ডা কি? ষাঁড়ের মত চেঁচাস ক্যান?”

“স্যার হারমোনিয়াম ডা নিতে চায়।”

দোকানের মালিকের থেকে সাজিদ হারমোনিয়ামটা কিনে নেয়।ফটিক এসে গাড়িতে রেখে দেয়। ফটিককে আরো কিছু টাকা দেয় গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসার জন‌্য। হারমোনিয়ামটা হাত বুলিয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে।প্রায় এক ঘন্টা পর একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামায়।পুরনো ধাঁচের বাড়ি। চারপাশে গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা।দরজা কড়া নাড়তেই একজন বয়স্ক বৃদ্ধা দরজা খুলে দেয়। চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নেয়।”কে তুমি বাবা? তোমায় তো চিনতে পারলাম না।”

“আমায় আপনি চিনবেন না। মিনহাজ সাহেব বাড়ি আছেন?আমি ওনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“খোকা তো বাড়ি নেই। মাত্রই বেরিয়েছে। আসতে দেরি হবে। তুমি অন্য একদিন এসো‌। বিশেষ করে শুক্রবার দিনটায় খোকা বাড়িতেই থাকে।”

“আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। ওনার জন্য অপেক্ষা করতে চাই। উনি আসলে দেখা করে তারপর যাবো‌।”

“ঠিক আছে তবে ভেতরে এসে বসো।”

সাজিদ বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বাইরে থেকে যতটা পুরনো মনে হয় ভেতরে ঠিক তার উল্টো চিত্র। বিশেষ করে বাড়ির সামনের উঠোন জুড়ে নানা ধরনের ফুলের গাছ। বৃদ্ধা মহিলাটি সাজিদকে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।”তুমি বসো বাবা।আমি এক্ষুনি আসছি।”

সাজিদ এক পলকে পুরো রুম দেখে নিলো। খুব রুচিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে এমনভাবে ঘর সাজানো যায় না।দেয়ালে অনেকগুলো ছবি টাঙানো।একটা ছবিতে সাজিদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেছে। বৃদ্ধা মহিলাটি কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন।হাতে একটা চায়ের ট্রে।”নাও বাবা চা টা খাও। অনেক দূর থেকে এসেছে চা টা খেলে ভালো লাগবে।”

সাজিদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলো।মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে।শুনেছে মিনহাজ সাহেব খুব কড়া ধাঁচের মানুষ।কোনো ভুল চুক করা যাবে না।একটা ভুল কথা সব কিছু এলোমেলো করে দিতে পারে।”আচ্ছা তুমি খোকার কাছে কেন এসেছো?”

“একটা বিশেষ কাজে। আপনার নাতনি চিত্রাকে নিয়ে কিছু কথা বলার ছিলো।”

বৃদ্ধা মহিলার চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে এলো।যেন মনে হলো অনেকদিন পরে খুশীর বান এসেছে। আহ্লাদী সুরে বলে উঠলো,”চিত্রা !! আমার চিত্রা!”

“জি!”

“কেমন আছে আমার নাতনি? কতদিন হলো কোনো খোঁজ নেই। বিয়ের পর মেয়েটা কেমন পালটে গেল।ওর বাবা তো ওর মুখ দেখতে চায় না।আমায় ও বারণ করে দিয়েছে।”

“আপনার নাতনি খুব ভালো আছে। আপনি যাবেন ওর সাথে দেখা করতে?”

“না।ওর মতো অসভ্য অবাধ্য মেয়ের মুখোদর্শন করতে চাই না আমরা।”

পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে সাজিদ বুঝতে পারে এটাই চিত্রার বাবা। বৃদ্ধা মহিলাটি ছুটে ছেলের কাছে গেলেন।”মেয়েটা কেমন আছে তুই কি একবারও জানতে চাস না খোকা?”

“না মা।সে বাঁচুক মরুক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।শোনো ছোকড়া তুমি যদি চিত্রার উমেদারি করতে এসে থাকো তবে ভুল জায়গায় এসেছো। মেহমান হয়ে এসেছো খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নিয়ে বাড়ি চলে যাও।অন্য কারোর হয়ে সালিশী করতে আসলে সেটা ভালো হবে না।”

মিনহাজ সাহেবের কথা শুনে মনে হলো অনেক অভিমান জমা হয়েছে। পুরুষ সহজে কাঁদে না। কষ্টগুলো বুকের ভেতর জমিয়ে জমিয়ে নিজেকে পাথরের মতো শক্ত আবরণে ঢেকে ফেলে।”আঙ্কেল আমি শুধু দুই মিনিট চিত্রার সম্পর্কে বলবো। আমার দুই মিনিট কথা শুনে আপনার যদি মনে হয় আমি ভুল তবে আমি সে মূহুর্তে চলে যাবো আর কখনও চিত্রার সম্পর্কে কোনো কথা নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবো না।”

মিনহাজ সাহেব বেশকিছুক্ষন ভাবলেন। সোফায় বসে সাজিদকে কথা বলার জন্য ইশারা করলেন।সাজিদ নিজের মনের মধ্যে থাকা কথাগুলো শেষ বারের মত ঝালিয়ে নিলো।”আঙ্কেল আমরা সবাই জীবনে ছোট বড় অসংখ্য জানা অজানা ভুল করে ফেলি। কিছু ভুল থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে সেগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি।তাতে আপনারা বড়রা আমাদের পাশে থেকে সাহায্য করেন। আমি মানছি চিত্রা নিজের জীবনে সব চেয়ে বড় একটা ভুল করেছে। আপনি বাবা হয়েও সে ভুল করা থেকে আটকাতে পারেন নি বলে আপনার আক্ষেপের শেষ নেই।সব থেকে খারাপ তখন লাগে যখন সব সত্য জেনেও মিথ্যেগুলো চোখের সামনে বিজয়ীবেশে দেখতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মিথ্যের জয় হলেও সত্যগুলো একটা সময় বেরিয়ে আসে। আপনার মেয়ে চিত্রা সে সত্যের সন্ধান পেয়েছে।সে সত্য এতটাই ভয়ানক ছিলো সে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে আত্মহ** চেষ্টা চালায়।”

মেয়ের এমন করুন পরিনতির কথা শুনে মিনহাজ সাহেব অস্থির অস্থির করতে লাগলো। একমাত্র মেয়েকে দেখার তৃষ্ণা যেনো বহুগুণ বেড়ে গেল।”আঙ্কেল আমার যা বলার বলেছি। আমি এবার আসি।”

সাজিদ বসার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।উঠোন পেরিয়ে গেটের কাছাকাছি চলে আসতেই পেছন থেকে………..

***চলবে****