জবা ফুলের রঙ লাল পর্ব-০১

0
601

#জবা_ফুলের_রঙ_লাল

প্রথম পর্ব…

আমার বেয়াল্লিশ পেরুবার দিন খুব অবাকভাবেই খেয়াল করলাম আমার লেমন ফ্লেভারের কেক বেশ পছন্দ। হয়ত তাই আমার কলিগ সাবরিনের আনা লেমন কেকটার প্রায় পুরোটাই গলধঃকরণ করে নিলাম কোন ক্যালরির হিসেব ছাড়াই। অথচ চকলেট ফ্লেভার সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ বলে সবসময় কেক কিনতে বা বানাতে গেলে চকলেট ফ্লেভারটাই বেছে নিয়েছি অন্য কোন অপশন না ভেবেই। তবে কি অন্যের যেমন ভাল লাগবে তেমন কোন আবরণ ছিল আমাকে জড়িয়ে? নিজেকে নিজের মত চিনতে এতগুলো বছর পেরুতে হল? নিজেকে আসলেই অন্য রকম মনে হয় যেন। প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাওয়া আমিকে দেখি আয়নায়।
মায়ের কথা মনে পড়ে আমার। মা তার বেয়াল্লিশে শেষ সলতে জড়ানো মোমের মত পড়ে ছিলেন আমাদের সংসারে। সব ভাইবোনদের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত কম প্রতিষ্ঠিত সেটির দায় বয়ে বেড়াতেন তিনি অনর্থক।
আমরা তিন বোন এক ভাই। আমি তুতুল আর মেঝ নীলম ঢাকা ভার্সিটি থেকে গ্র‍্যাজুয়েট। আমি ইংরেজি আর নীলম কেমেস্ট্রি। ছোট ঝিলমটা জাহাঙ্গীরনগরে ফিজিক্স নিয়ে পড়েছে। ভাইটা কেন পাব্লিকে না পড়ে প্রাইভেটে পড়ল সে নিয়ে বাবা আর আত্মীয় স্বজনদের অদ্ভুত সব অভিযোগ মা কেমন করে শুনে যেতেন। দিনরাত আফসোস করতেন আর ছেলেটার ব্যাপারে কেন আরেকটু মনোযোগী হলেন না সে নিয়ে দিনরাত নিজেকে দোষ দিতেন। সে চিন্তায় তার শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল প্রেস্ক্রিপশনের ফাইলটা। মুখে বলিরেখা গুণে শেষ করা যেত না, কিন্তু এককালের মাথাভর্তি চুল গুণে ফেলা যেত সহসাই। তারপর এতসব অভিযোগ নিয়ে পঞ্চান্নতে মোমের মত নিঃশেষে গলে পড়ল তার একদা সোনাবরণ দেহ। অথচ আমি এই বয়সে নিজের শরীরের মাপটা পারফেক্ট ওয়াইন গ্লাস করার জন্যে ইয়োগা থেকে শুরু করে কার্বোহাইড্রেট বাদ দেয়া সব করে চলেছি। মানুষ আমার ষোল বছরের কন্যার সাথে ছবিতে দেখে যখন বলে, ” তোমার এত বড় মেয়ে আছে বোঝাই যায় না।এখনো কত সুন্দর তুমি!” – ভীষণ ভাল লাগে শুনতে। আমার সন্তানঅন্তঃপ্রাণ মায়ের সাথে তুলনায় নিজেকে যদিও বড় স্বার্থপর লাগে। আমি অবশ্য সবসময় এমন ছিলাম না। ভীষণ চুপচাপ আর নিজেকে নিয়ে একদম অসচেতন একটা মেয়ে ছিলাম ছোটবেলা থেকে। জানতাম না কোন রঙে আমাকে বেশি মানায়, এটাও জানতাম না কোন চুলের কাট আমার জন্যে পারফেক্ট। পড়াশোনা নিয়েই জগতটা ছিল আমার। নিজের পোশাক আশাক সবটা মা দেখে দিত। উল্টোটা ছিল নীলম। ভীষণ সুন্দরী আর চটপটে বোন আমার। এই বয়সে এসে আমি বুঝতে পারছি এই বয়সেও নারীরা শেষ হয় না, এগুলো কেবল মগজে ঢোকানো ধারণা মাত্র। একটু একটু করে আমি আবিষ্কার করছিলাম নিজেকে। আর সেটার দিনক্ষণ যদি হিসেব করি ঠিকঠাক, চোখ বুজলেই একটা সাদা ঘর দেখতে পাই। আর শুনি একটা আর্তচিৎকারে ভেঙে গেছে সেই অনন্ত শুভ্রতা-আমার মেয়ের জন্মের ক্ষণটা আমি দিব্যি দেখতে পাই।
আমি আমার মেয়েটাকে দেখছি। ছুটে ছুটে সংখ্যার হিসেবে বুড়িয়ে যাওয়া মায়ের জন্মদিনের সব যোগাড় করে চলেছে। কোমর ছাড়ানো কোঁকড়াচুলগুলো বারবার খুলে যাচ্ছে তার। লাল টপ্সের সাথে নীল ফুলছাপা স্কার্টটা প্রজাপতির ডানার মত উড়ছে। মেয়েটা অবিকল আমার মত হাসে, এক রকম কথা বলে। গায়ের রঙটা পেয়েছে ওর বাবার-ভীষণ ফর্সা। মুখটা দেখলেই শ্রাবস্তীর কারুকার্য থেকে শুরু করে মোনালিসা আর ভেনাসের উপমাগুলো মনে পড়ে যায়। অথচ এক সময় এই পরীর মত মেয়েটাকেই আমি চাইনি!

*
আমার মেয়ে নৈঋতাই করেছে আজকের সব আয়োজন। রাত বারটায় আমার কলিগদের ডেকে সারপ্রাইজ দেয়ার পুরো প্ল্যানটাও তার। মেয়ে আমার সুইটি সিক্সটিনের সবটা সুইটনেস নিয়ে বড় হচ্ছে। কেমন ফড়িংয়ের মত ব্যস্ততা তার। আমার সাথে ম্যাচিং করে পোশাক পরেছে। আমি পরেছি লাল পাড়ের নীল মসলিন। মেয়ের বাবা বলে আমার মত আদুরে হয়েছে নৈঋতা।
সবাই চলে গেলে আমি নৈঋতাকে জাপটে ধরে আদর করে দিলাম। এভাবে ছাড়া তার ঘুম আসে না। মেয়ে আইসক্রিমের আবদার করেছিল ঘুমোবার আগে কিন্তু এমনিতেই যথেষ্ট ক্যালরি জমিয়ে ফেলেছি আর নিতে পারব না।
” মা এত সুন্দর হয়ে কী করবে বলতো? বাবা তো তোমায় এমনি ভালবাসে,” পাতলা চাদরটা বুক অবধি টেনে শুয়ে পড়ল মেয়ে আমার আর চোখে দুষ্টদের মত হাসি।

” আমার যে একটা পরী আছে। তার মায়ের মত লাগতে হবে তো নাকি?” নৈঋতার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। মেয়ে চুল পেয়েছে বাবার মত। ইচ্ছা হয় খুব করে এলোমেলো করে দেই। শোভনের চুলগুলোও এমন তবে অকারণে এলোমেলো করে দেবার ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছেগুলো অতীতের এক পুরনো এলবামে বন্দী হয়ে আছে অনেকদিন। হয়ত কোনদিন সাদাকালো সেলুলয়েড থেকে মুক্তি পাবে তারা- আর হবে রঙিন।

বাইরে চাঁদ আলো ছাড়া মেঘের উপর ভেসে ভেসে আমাদের মা মেয়ের ভালবাসা দেখছে। আমি নৈঋতার রুমের লাইট অফ করে বেডরুমে ঢুকলাম।

শাড়িটা বদলে রাতের পোশাক পরে নিলাম। আমি নিজেকে ভালবাসি আসলে। নিজেকে নিয়ে ভীষণ মুগ্ধতা আমার। “একদম আগের মত আছিস” – শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার শরীরের সকল প্রকোষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে কঠোর নিয়মের নোটিশ। তারজন্যেই এত সব। রোজ ভোরে উঠে ইয়োগা – চিনি এড়িয়ে গ্রিনটি কিংবা হেলদি খাবারের মেন্যু খুঁজে বের করা সব আমিকেন্দ্রিক। নিজেকে আগের মত দেখতে ভালবাসি আমি। শোভনের অবশ্য সেসবে মাথাব্যথা নেই। শোভন ফেরেনি। বিজনেস ট্রিপে গেছে কক্সবাজার।
আজকের রাতটা জেগে কাটাতে ইচ্ছে করছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসলাম বারান্দায়। শোভন বলে আমাদের বারান্দা। কিন্তু আমি কেন যেন আমাদের বলতে পারি না। আমি শব্দটা আমাদের হতে গেলেই আমার ভেতরে আটকে পড়া মুমূর্ষু এক আমি চিৎকার করে ওঠে। আর মনে পড়ে প্রাচীন পাথরের মত বাড়তে থাকা পুরনো কোন বিকেল…

চলবে…