জলে ভাসা পদ্ম পর্ব-০২

0
503

#জলে_ভাসা_পদ্ম
#পর্বঃ২
#রেহানা_পুতুল
উনি কে? আপনার কি হয়? জানতে চাইলো পদ্ম।

উনি জোলেখা বানু। আমার নানু। উনার ছেলে মানে আমার মামা পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকে। দুই বছর অন্তর আসে। এবার এখনো আসেনি। আসবে সামনে। নানু অসুস্থ থাকে প্রায়। আবার একা ও থাকতে পারেনা। একজন সঙ্গী থাকা চাই উনার। এতদিন আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ছিলো। তিনি কারণবশত চলে গিয়েছে। আসো নানুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

পদ্ম এখন নিজেকে কিছুটা হালকাবোধ মনে করছে। সে রুমের ভিতরে গিয়ে একটি বেতের চেয়ারে বসলো। নওশাদ ডেকে তুললো তার নানুকে।

নানু… এই নানু.. দেখো তোমার সই চলে এসেছে। নানু মাথা ঘুরিয়ে চায় পদ্মর দিকে। অপলক চেয়ে থাকে। নওশাদ বলে পছন্দ হয়েছে নানু?

নানু আলগোছে হেসে জানায়। ফুলের মতো একটা কচি মেয়ে। কোথায় পেলিরে?

কুড়িয়ে পেয়েছি ওকে । কুড়িয়ে পাওয়া পদ্ম। পদ্ম’কে চোখের ইশারায় মানা করে,যেন তাকে কিভাবে এনেছে এটা না বলে। পদ্ম ও চোখের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় ঠিকাছে বলবনা।

পড়াশোনা করেছো কিছু?
এবার ক্লাস নাইনে উঠেছি। এখনতো আর পড়া হবেনা।

নানু কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করে,
তুমি পড়তে চাও?

পদ্ম নিরুত্তর।
পদ্ম তুমি স্কুলে ভর্তি হতে চাও? এবার জানতে চাইলো নওশাদ।

চাইলেই কি হবে?

বুঝছি বলে নানু নওশাদকে আদেশ দেয় পদ্মকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য।

পদ্ম যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। লুকিয়ে নিজের হাতে নিজেই চিমটি কেটে বুঝে নেয়,না এ স্বপ্ন নয় সত্যি।

এক নিমিষেই পদ্ম’ র মন ভীষণ ভালো হয়ে যায়। মনের আকাশে একঝাঁক পাখি অবাধে উড়াউড়ি করছে ডানা মেলে।

নানু আমার কি কাজ করতে হবে বাসায়? বুঝিয়ে দেন।

তোমার কাজ শুধু আমাকে সময় দেয়া। বাঁধা কাজের মহিলা একজন আছে। আর ছুটা বুয়াও একজন দুপুরে আসে।

নওশাদ বলে, কি পদ্ম কেমন লাগছে নতুন বাসায়? নানুর সাথে থাকতে আপত্তি?

পদ্ম মাথা নেড়ে বলে নানুকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম আমার দাদুর মতো।

পদ্ম তার কাপড়ের ব্যাগ নানুর রুমে নিয়ে আসে। সেখানে মুখোমুখি দুটো খাট। একটাতে পদ্ম থাকবে। পদ্ম ক্লান্ত শরীরে রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরেরদিন নওশাদ পদ্মকে বাসার নিকটবর্তী একটি স্কুলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। স্কুলে পরিচয় দেয় পদ্ম নওশাদের খালাতো বোন । স্কুল ছুটি হলে নওশাদ পদ্মকে আবার গাড়ি করে নিয়ে আসে। গাড়িতে থেকেই পদ্ম নওশাদকে বলে,
ভাইয়া আপনার মোবাইলে ব্যালেন্স আছে?
হুম আছে পদ্ম। কেন?

মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। মাকে ফোন দিব।
এই নাও বলে নিজের হাত থেকে মোবাইল পদ্মর হাতে দেয়। পদ্ম মাকে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই পদ্ম কেঁদে ফেলে হুহু করে। পদ্মর মা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস তুই কই আছিস মা?

আমি ঢাকা আছি মা। ভালো আছি মা। এক বাসায় আমার আশ্রয় হয়েছে। তারা খুব ভালো মা। তারা আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। শুনে পদ্ম’র মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পদ্ম মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়।

এতক্ষন পাশ থেকে নওশাদ সব শুনেছ। পদ্ম’র দিকে চেয়ে জানতে চাইলো, আচ্ছা তুমি গ্রাম থেকে এসেছ পালিয়ে?
হুম।
কিন্তু কারণ?

পরে বলি ভাইয়া? আপনিও আমাকে কিভাবে পেলেন তা বলবেন কিন্তু।
অবশ্যই বলবো। বেলাতো ফুরিয়ে যায়নি পদ্ম।

বিকেলের অবসরে,পদ্মকে নিয়ে বাসার ছাদে গেলো নওশাদ নানুর অনুমতি নিয়েই।

পদ্মকে বলে,শুনো ক্লিয়ার করে দিই তোমাকে পাওয়ার ইতিহাস।

না এখন শুনতে ইচ্ছে করছেনা।
তাহলে তোমার টা বল?

আব্বা গ্রামে আমার বিয়ে ঠিক করে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে । সেই ছেলে সিএনজি চালক। তাই ভোরে যখন সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। তখন বাসস্ট্যান্ডে এসে ঢাকার বাসে উঠে যাই একা একাই। এর আগে ঢাকা কখনো আসিনি। হেলপারকে বলছি সায়েদাবাদ নামবো। সবার কাছে শুনতাম ঢাকায় আসলে প্রথমে সায়েদাবাদ নামতে হয়।

নওশাদ বলে উঠে তুমিতো তাহলে সাহসী মেয়ে।

না আমি সাহসী নই। তবে তখন কিভাবে যেন সাহস এসে গিয়েছে মনে।

হুম। প্রয়োজন মানুষকে সাহসী করে তোলে অনেকসময়।

আপনি কিসে পড়েন ভাইয়া?

আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। নানু একা আর নানুর বাসা থেকে আমার ভার্সিটি কাছে। তাই নানুর বাসায় থাকি। এ বাড়ি নানুর। নানা নানুর নামে লিখে দিয়েছি। আরেকটা বাড়িও আছে উনাদের।

তাহলেতো তারা অনেক ধনীলোক।

শুনে নওশাদ চওড়া হাসি দিলো। বলল তুমিও একদিন ধনীর বউ হবে আমার নানুর মতো।

পাশের ছাদের থেকে একটা পরিচিত ছেলে বলে উঠে নওশাদ ভাইয়া, মানিয়েছে ভালো। আপনাদের বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়ে নাকি?

পদ্ম লজ্জা পেয়ে যায়। নওশাদের পাশ থেকে ছুট দিয়ে বাসায় ঢুকে পড়ে।
____
ছয়মাস অতিবাহিত হলো পদ্ম এ বাসায় আছে। সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলছে। পড়াশোনাও করছে রীতিমতো। কোচিং ও করে। বাসায় নিজ থেকেই টুকটাক কাজ করে। নিজের বাড়িতেও তো কত কাজ করতো৷ এই ভেবে কাজ করতে তার ভালই লাগে। তবে সবসময় বাড়ির জন্য মনটা খাঁ খাঁ করে।

এ বাসায় খাওয়া পরার কোন অভাব নেউ। তবুর বিশাল শূন্যতা পদ্মকে কুরে কুরে খায়। মা বোনদের ছাড়া পদ্ম’র মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। তবুও সে নিরুপায়। দুচোখ ভরা কত স্বপ্ন। পড়াশোনা করে সংসারের অভাব দূর করবে। কিন্তু বাবার জন্যই তাকে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে হলো। এ বাড়িতে যে দুজন মানুষ রয়েছে। এরাও খুব ভালো।
______
কানাড়া থেকে আজ জোলেখা বানুর বড় ছেলে আকরাম স্বপরিবারসহ ঢাকায় এসেছে। আকরামের দুই ছেলে আরিয়ান ও আহিয়ান। আরিয়ান বড়। পড়াশোনা শেষ। আহিয়ান এসএসসি দিবে। একমাত্র মেয়ে নোভা অনার্স এ পড়ে। নওশাদের সমান বয়স প্রায়।
বাসায় তাদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। আজ তাদের পছন্দের মেন্যুগুলোই রান্না করা হয়েছে। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে গল্প গুজব করছে। জোলেখা বানুও আছে সোফায় বসা। পদ্ম সবার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো ড্রয়িংরুমে।

কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পদ্মকে দেখিয়ে নোভা বলল, দাদু নতুন সারভেন্ট কবে থেকে? এই মেয়ে তোমার নাম কি? ভালোইতো কফি বানাতে পারো। আমাকে তুমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা কফি বানিয়ে দিবে। কিচেনে যাও কাজ করো৷

পদ্ম মাথা নামিয়ে ড্রয়িংরুমের বাইরে গিয়ে পা থামায়। জোলেখা বানুকে বলতে শোনে, নোভা তোর পটর পটর স্বভাব এখনো আছে? ও কাজের মেয়ে নয়। আমার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোনের মেয়ের ঘরের নাতনি। আমি একা তাই এনেছি। ও ক্লাস নাইনে পড়ে।

পদ্ম’র কলিজা দিগুণ হয়ে যায় শুনে। মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। ভাবে নানু এত ভালো মানুষ। আমাকে এত ভালোবাসে। নানুকে আজ আমার প্রিয়জন মনে হচ্ছে।

জীবনের পথচলায় চেনাজন হয় অচেনা। আর অচেনাজন হয় চেনা। আপন হয় পর। পর হয় আপন। এইতো বিধির খেলাঘরের খেলা। কেউ প্রিয় থেকে অপ্রিয় হয়। আর কেউ অপ্রিয় থেকে প্রিয় হয়। এই কঠিন মায়ার বাঁধনে স্বর্ণলতার মতো পেঁচিয়ে যাচ্ছে পদ্ম নামের মেয়েটির জীবন।

পদ্ম রান্নাঘরে চলে যায়। বাসায় এখন মানুষ বেশী। তাই কাজের পরিমান ও খুব বেশী। নোভা পদ্মকে এপ্রোচ করে কাজের মেয়ের মতই। পদ্ম তাতে কিছুই মনে করেনা। বিনা খাটুনিতে বিনা পয়সায় আর কত আরামদায়ক হবে জীবন। এইই ঢের।

সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। জোলেখা বানুর রুমের বাকি খাটে নোভা ঘুমায়। তারা যতদিন থাকবে ততদিন পদ্ম’র ঘুমানোর জন্য বরাদ্দ স্থান হলো সুফিয়া খালার সাথে । অর্থাৎ সারভেন্ট রুমে।এতে পদ্মর কোন আপত্তি নেই।

রাতে পদ্ম’র পানির পিপাসা লাগছে। তাই পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়েছে। অন্ধকার রুমে কারো ছায়া নড়তে দেখেই ভূত বলে চিৎকার দিতে যাচ্ছিলো। অমনি তার মুখে চাপা পড়ে একটি পুরুষ হাতের।

চুপ প্লিজ…
পদ্ম তার মুখ থেকে হাত টেনে সরায়। ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে,
কে..এ? কে আপনি? রান্নাঘরে কেন আসছেন এত রাতে?

আমার ও একি প্রশ্ন তুমি কে? কিচেনে কেন আসছ?

চলবে…