জীবন_রঙ্গমঞ্চ পর্ব-০২

0
166

#জীবন_রঙ্গমঞ্চ
#পর্বঃ ২
#লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

আব্বা স’শব্দে আমার গালে পরাপর দু’টো থা’প্প’ড় মে’রে বসলেন। অতঃপর বা’জ’খাঁই গলায় বলে উঠলেন, “আমি তোর বাপ হই জবা। মুখে লাগাম টেনে কথা বল বেয়াদব। আমি বিয়ে করেছি তাতে এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই।
বিয়ে করেছি বেশ করেছি। আরো আগেই করা উচিত ছিলো এটা। তোর মা কি দিয়েছে আমায়? উল্টো বছরের পর বছর অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আমার টাকা-পয়সা সব খেয়েছে। আজ অবধি একটা ছেলে দিতে পারেনি আমায়।”

আকস্মিক মা’রে’র চোট সামলাতে না পেরে আমি ছিঁটকে খানিকটা দূরে থাকা দেয়ালের সাথে পড়ে গেলাম। আবারো নিজে নিজেই উঠে বসলাম। কানে বাজছে আব্বার বলা কথা গুলো। আব্বা শেষ বয়সে এসেও ছেলের জন্য বিয়ে করেছে? সিরিয়াসলি! আমার মা ছেলে দিতে পারেনি বলে বিয়ে করেছে.. এতগুলো মানুষের সামনে কত সুন্দর করে বলে দিলো বাবা। আচ্ছা ছেলে কি মেয়ে/মায়েদের হাতে? ছেলে/মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেএে এখানে তো নারীর ভূমিকা নেই বরং পুরুষের ভুমিকা অপরিহার্য। কিন্তু, এই সমাজ ছেলে সন্তানের জন্য নারীকেই কেবল দোষারোপ করছে।হাহ!

এদিকে আব্বার কাজে উপস্থিত সবাই হতবাক। আবার কেউ বা দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হেসে মজা লু’টছে। আমার দৃষ্টি মায়ের দিকে। তার মুখের অধল বদলে গিয়েছে। প্রিয় মানুষ হারানোর শোকে এতক্ষণের বিষন্ন চেহারায় ঘৃণা, ক্রো’ধ বাসা বেঁধেছে। রাগে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। আমার মা শিক্ষিত নারী। মেয়ের জামাই’সহ এতগুলো মানুষের সামনে বাবার অসামাজিক কার্যকলাপে ভীষণ ক্ষু’ব্ধ উনি।
মা কিছু বলতে গিয়েও তাসনিমের দিকে তাকিয়ে থেমে যান তিনি। ঐ লোকটার হয়তো নিজের মান-সম্মান নেই কিন্তু তার আছে। উনি নিজেকে দমিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
.
.
তাসনিম কিয়াৎক্ষণ ঘোরের মধ্যেই ছিলেন। হুঁশ ফিরতেই দৌড়ে এসে ধরলো আমায়। নিজের বাহুডোরে আগলে নিয়ে ব্যতিব্যাস্ত কণ্ঠে শুধালো, “তুমি ঠিক আছো জবা?”

আমি চুপ করেই রইলাম। মাথায় চো*ট লেগে মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। দেয়ালে লেগে কপাল কে’টে গিয়েছে কিঞ্চিৎ।
কিন্তু আব্বা এরপর ও থেমে নেই তে*ড়ে আসছেন আমার দিকে। এবার আমার বর তাসনিম রেগে গেলেন। উনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, “মামা খবরদার! এদিকে আর এক পা ও এগোবেন । নেক্সট আমার স্ত্রী’র গায়ে একটা আঁচড় পড়লেও খুব খারাপ হবে কিন্তু বলে দিলাম।”

বাবা ও কম না। বিপরীতে উনিও পুনরায় তে*ড়ে আসতে আসতে ক্রো’ধি’ত কণ্ঠে বললেন, “চিৎকার করো না তাসনিম। অহেতুক তুমি এসবের মধ্যে জড়িয়ো না। আমি আমার মেয়ের গায়ে একশো বার হাত তুলবো। কি করবে তুমি শুনি?”

উনি বাবা’র দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে কিঞ্চিৎ হাসলো। পরক্ষণে আমাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে হেয়ালি করে বললেন,

“আসলাম শেখ (বাবার নাম) আপনি জানেন কি? সব পুরুষ কারো বাবা কিংবা স্বামী হবার যোগ্যতা রাখে না। কাপুরুষেরাতো একেবারেই নয় ! জবা’র এখন শুধু একটাই পরিচয়, “মিসেস তাসনিম চৌধুরী”। ওর গায়ে শুধু পুনরায় একটিবার হাত তুলেই দেখুন না। আমিও ভুলে যাবো আপনি আমার মামা হন।”

উনাকে বেশি কিছু বলতে দিলাম না আমি। আমি উনার হাত ধরে শান্ত হতে বললাম। উনি আব্বার দিকে একবার চোখ কটমট করে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। আকস্মিক বাবা এসে তাসনিমকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো, এ্যাই, এ্যাই বেয়াদব ছেলে.. কি করবে তুমি হ্যাঁ?”

তাসনিম রক্তিম চোখে একবার চেয়ে বাবা’র হাত থেকে নিজের শার্ট ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু বাবা আরো ঝাপটে ধরছে তাকে। যদিও তাসনিমে’র শক্তির কাছে বাবা শূন্য।
বাবা’র কাজে রাগে তার ফর্সা মুখখানা রক্তিম হয়ে গিয়েছে। কপালের রগটাও ফুলে উঠেছে। আমার বাবা না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো এতক্ষণে উনি কয়েক ঘা দিয়ে বসতো। উনি যথাসাধ্য নিজেকে কনট্রোল করার ট্রাই করছে।

আমি হতবুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। আগের থেকেও লোকজনের ভীর জমেছে এখানে। কিন্তু, আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসছে না বরং তারা দাঁড়িয়ে বিষয়টা উপভোগ করছে।

ঘটনা বিপরীত দিকে যাওয়ার আগেই তান্মধ্যে দু’জনার মাঝে এসে দাঁড়ালো মা। মা তাসনিম’কে ছাড়িয়ে দিতে দিতে বললো, রিলাক্স তাসনিম! কুকুর কা’ম’ড় দিলে উল্টো কুকুর’কে ও কা’ম’ড় দিতে নেই। মানুষ হয়ে তো আর নোংরা কুকুর’কে কা*মড় দেওয়া যায় না।”

তাসনিম বিনাবাক্যে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। মা কিঞ্চিৎ হাসলো। মায়ের কথার মিনিং বুঝতে পেরে বাবা’র আত্মসম্মানে লেগেছে। আব্বা হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লেন। একরাশ ক্রো’ধ নিয়ে মায়ের দিকে হাত উঠিয়ে ঝংকার তুলে বললেন, “তোর খুব সাহস বেড়েছে তাই না? মা.. তুই আমাকে কুকুর বললি..। ”

মা এই অবধি আব্বা’র দিকে আর তাকায়নি। আব্বা তার মুখোমুখি হতেই সাথে সাথে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো তিনি। অতঃপর কিঞ্চিৎ হেসেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

” ঘরে আজই নতুন বউ এনেছেন তার সামনে ভদ্রতা বজায় রাখুন আসলাম শেখ। তাছাড়া, কুকুরকে কুকুর বলেছি এতে এতো হাইপার হওয়ার তো কিছু নেই।”

“তোর খুব দে’মা’ক বেড়েছে তাই না রে? আজ খুব তেজ বেড়েছে তোর। দাঁড়া তোর তেজ ছুটাচ্ছি আমি।”

আব্বা এই বলেই ততক্ষণাৎ পাশে থাকা বাঁশের ছোট্ট লাঠিটা হাতে তুলে নিলেন। আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, “মা…..!”

মা ততক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ালো। আব্বা আঘাত করার আগেই লাঠিটা ধরে ফেললেন। অতঃপর রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ” কাপুরুষ! ছোটলোক কোথাকার! কি ভাবেন নিজেকে? অনেক হয়েছে, এবার একদম চুপ। নিজের লিমিট ক্রোশ করবেন না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু… ”

“তাহলে কিন্তু কি?” সাথে সাথে বললো আব্বা।

মা তার প্রশ্নে উওর না দিয়ে আমার দিকে চাইলো। আমার সে দিকে খেয়াল নেই।
আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বাবা নামক মানুষটার অপরিচিত রুপটাই দেখছি।
মানুষ কত দ্রুত বদলায় তাই না? যে বাবা একসময় আমার এতটুকু ঠান্ডা লেগে গেলে বাড়ি মাথায় তুলতো। সেই বাবা.. হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই বাবাই আজ আমার গায়ে হাত তুলছেন। আঘাত করেছেন আমার কলিজায়। র’ক্ত ক্ষ’র’ণ হচ্ছে আমার মায়ের বুকে! ছেলে’র জন্য বিয়ে করে সতীন এনেছে আমার মায়ের যত্নে গড়া সংসারে। কতগুলো মানুষের সামনে অসম্মান করেছে আমার বর’কে। এখনো জঘন্য ব্যবহার করছেন আমার মায়ের সাথে।
অথচ এক সময় মায়ের হাসির মাঝেই বাবা শত মুগ্ধতা খুঁজে নিতেন।
.
আমার ভাবনার মাঝে পাশে এসে দাঁড়ালো তাসনিম। উনি আমার কপালে হাত রাখতেই এলোমেলো দৃষ্টিতে তার দিকে একবার তাকালাম আমি। কপালের রক্তটুকু এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে।
তান্মধ্যে মা তাসনিম’কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি জবা’কে নিয়ে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও বাবা। এই ন’র’কে আর এসো না।”

তাসনিম যেন এইটারই অপেক্ষা ছিলো। উনি সাথে সাথে আমার হাত ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “চলো জবা।”

কিন্তু, অমত করলাম আমি। মা’কে এই অবস্থায় রেখে কিছুতেই যাবো না আমি। আমার জে’দ বেশীক্ষণ রইলো না। মা এগিয়ে আসলো। আমার মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো, চলে যা মা। আমার দো’হা’ই লাগে!”

“কিন্তু মা….।”

“কোনো কিন্তু নয়।”

এরিমধ্যে বাবা আমাকে আরো এক ধাপ অবাক করে দিয়ে কড়া গলায় বললেন, “তোরা মা-মেয়ে দু’জনই বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। আর কখনো জানি তোদের এই বাড়ির চার সীমানায় না দেখি।”

এই বলে আব্বা নিজের রুমে চলে গেলেন। উনার পিছনে পিছনে তার নতুন বধূ ও।
আমি এবার ও কিছু বলতে পারলাম না। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। মা খুব গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। টের পেলাম আমি। আমি জানি আমার মা এখন যতই উপরে উপরে নিজেকে শক্তপোক্ত দেখায় না কেন, তার ভিতরটায় জ্ব*লে পু*ড়ে খাঁ*ক হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে তাসনিম মৃদু রাগ দেখিয়ে আমাকে বললো,

“জবা। এতকিছুর পরেও এখানে থাকবে তুমি?”

“আমি তো যা…”

উনি আমাকে থামিয়ে দিয়েই বললেন,

“উঁহু। আমি আর তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না জবা। আর এক মুহূর্তে ও এখানে নয়। আর মা-মণি আপনি ও আমাদের সাথে চলুন।”

মা মলিন হেসে বললো, “তোমরা যাও বাবা। আমাকে আমার সংসার বুঝে নিতে দেও।”

তাসনিম আর কথা বাড়ালো না। আমার হাত ধরে সদরদরজার দিকে পা বাড়ালো।

পিছনে ঘুরে একবার তাকিয়ে দেখতে পেলাম, মা আমার যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই মা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আঁচলে চোখ মুছে পুনরায় সবার উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললেন,

“আপনারা ও চলে যান। দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখানে? অনেক তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখলেন। সার্কাস শেষ এখন চলে যান।”

কিছু মহিলা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিলো। কেউ বা এখনো দাঁড়িয়ে শেষটুকু ও উপভোগ করতে চাইছেন। তান্মধ্যে আব্বা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন,
“উনারা কেউ যাবে না। তুই এখান থেকে চলে যাবি। দাঁড়া এই ব্যাবস্হাই করে দিচ্ছি। আপনারা সবাই দাঁড়ান।”

আব্বার কণ্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি সহ সবাই। আব্বা পুনরায় আবারো বলে উঠলো, “এই যে আপনারা সাক্ষী। আপনাদের সাক্ষী রেখে আমি আমার প্রথম স্ত্রী’কে এই মুহুর্তে তালাক দিচ্ছি।”

উনি পরপর গটগট করে তিনবার “তালাক” শব্দটি উচ্চারণ করলেন।

আব্বার ভয়ংকর কাজে কেঁপে উঠলাম আমি। সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে গেলো। আব্বা এতো নিষ্ঠুরতম শাস্তি দিলো মা’কে। আহ! এই বয়সে এসেও বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ! আমার কলিজা মো*চ*ড় দিয়ে উঠলো। আমি তাসনিম ভাইকে উপেক্ষা করে কাঁপা কাঁপা পায়ে দৌড়ে আসলাম মায়ের কাছে। আমার মা মাথা নিচু করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ধরলাম মা’কে। আরো কয়েকজন মহিলা এগিয়ে আসলো। আমি ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলাম, “মা।”

মা এলোমেলো কণ্ঠে বলে উঠলো, ” পৃথিবীতে আমরা এমন অনেক কিছুই নিজের মনে করি যা কখনোই আমাদের ছিলো না আর থাকতেও না। আসলেই প্রিয় বলতে কেউ হয় না! কেউ শেষ অবধি একান্তই কারো হয়ে থাকে না। পুরুষ বদলায়.. কারণে অকারণে বদলায়। এই শহরে কারণে অকারণেই ভালোবাসার বিচ্ছেদ হয়। বছরের পর বছর পার করা ভালোবাসার ও বিচ্ছেদ হয়। এই শহর থেকে ভালোবাসা শব্দটি ম’রে যা’ক।”

মায়ের হৃদয়ে ভা’ঙা র’ক্ত’ -ক্ষ’র’ণী’য় কথা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি আমি। কেঁদে উঠলাম শব্দ করে। মা নির্জীব হয়ে আছেন। পুনরায় আবারো বললেন, “আমার” বলতে আমার কিছু রইলো না রে। একটা মানুষকে ভালোবেসে ঘর ছেড়ে ছিলাম আমি। ছেড়ে এসেছিলাম বাবা-মা, প্রিয়জন। অথচ ভালোবাসার মানুষটি শেষ বয়সে আমায় ভালোবেসে সতীন উপহার দিয়েছে। ভালোবাসা আরো গাঢ় হলো অতঃপর বিচ্ছেদ উপহার দিলো।”

বাবা নামক মানুষটার দিকে চাইলাম এক পলক। সে বেশ আয়েস করে বসে আছেন। এক আকাশ সমান ঘৃণা জন্ম হলো মানুষটার উপর।
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। মায়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললাম, “এখান থেকে চলো মা।”

কিন্তু মা নড়লো না। কাঠকাঠ কণ্ঠে জবাব দিলো,

চলবে…..