তখন অপরাজিতা পর্ব-০৪

0
52

তখন অপরাজিতা -৪

অয়নির আজ স্কুল ছুটি। টিচারদের কোন মিটিং আছে মনে হয়।ওর ঘুম ভেঙে গেল খুব সকালে। বাইরে কোচিং নেই আজকে। আজ বৃহস্পতিবার, হাসিব ভাইয়া পড়াতে আসবেন। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে মণিকা বললেন কক্সবাজার যাওয়ার কথাটা। অয়নি কিছু বলল না।
মণিকা আবার জিজ্ঞেস করলেন, অনি তুমি যাবে তো?
ভালো লাগবে গেলে!
অয়নি এবার বলল, না মামনি, আমার প্রিটেস্ট সামনে। এখন আমি কোথাও যেতে চাই না।
মণিকা কিছু বুঝে নিয়ে বললেন, তোমার বাবার সাথে দেখা হয়েছিল গত সপ্তাহে?
-হ্যা, ছোট্ট করে উত্তর দিলো অয়নি।
তারপর বলল, তবে আমি বাবাকে প্রতি সপ্তাহে আসতে না করেছি, ওনার কষ্ট হয়, এসে বেশিক্ষণ থাকতেও পারেন না।
মণিকা মনে মনে ভাবলেন, কী দরকার ছিল সপ্তাহে সপ্তাহে ঢং করে দেখা করার নাটক করার।
কিন্তু অয়নির সামনে কিছু বললেন না, কখনো খারাপ কিছু বলেনও না ওর সামনে। তাহলে ওর তো বাবা, ওর মন খারাপ হতে পারে। মণিকা চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব পরিশীলিতভাবে অয়নিকে বড় করতে। তিনি চাইলেই অয়নিকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে পারতেন , কিন্তু তার মনে হয়েছে, অয়নি একটা বাংলা মাধ্যমে সাধারণ ভাবে পড়াশোনা করুক। ও জীবনকে স্পর্শ করে বড় হোক, ও দেখুক, ওর অনেক কিছু আছে, যেটা আসে পাশে অনেকেরই নেই। তাহলে হয়তো বাবা মা আলাদা থাকার কষ্টটা একটু হলেও কমবে।
মণিকা চান অয়নি নিজের মেধায় প্রতিষ্ঠিত হোক।এর একটা সুফল হয়েছে, অয়নি অহংকারী হয়নি। অয়নি সহজেই ওর কোন সাধারণ পরিবারের বান্ধবীর বাসায় চলে যেতে পারে। কখনো মনে হবে না, ও উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে।
খাওয়া শেষ করে অয়নি উঠল। মণিকা অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন।
অয়নির কিছু ম্যাথ করার ছিল, ও সেগুলো শেষ করে কতক্ষণ গল্পের বই পড়ল। তারপর ঘুমিয়ে নিলো একটু সময়। চারটার দিকে হাসিব ভাইয়া এলেন পড়াতে।
অয়নি আগেই উঠেছিল, ডাবল কলিংবেল বাজতেই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল!
কেন এমন হচ্ছে!
হাসিব ভাইয়া আজ নেভী ব্লু টি শার্ট পরেছেন। সব টি শার্ট গুলোই সুন্দর। ভাইয়াকে সব কিছুতেই মানায়।
পড়ানোর ফাঁকে হাসিব জিজ্ঞেস করল, তোমার বন্ধুদের কী হয়েছিল সেদিন?
অয়নি বলল, সুতপা নামে একজনের এক ছেলে বন্ধু দেখা করতে এসেছিল, তাই দেরী হচ্ছিল নাকি!নায়েরা চলে এসে আমাকে পায়নি, আমি তো চলে এলাম।
হাসিব হেসে বলল, ছেলেমেয়ে গুলো খুব ম্যাচিউরড হয়ে যাচ্ছে আজকাল!আমরা এই বয়সটায় তিন গোয়েন্দা আর ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতাম। আর এখন, বয়ফ্রেন্ড, ফোন, চ্যাটিং, ডেটিং হিউজ পরিবর্তন সময়ের। তা তোমাকে ওরা নিয়ে যায়নি কেন?
অয়নি বলল, আসলে ওরা আমার সামনে কিছু বলে না!
একটু এভয়েড করে।
হাসিব মাথা নাড়ল, তাও ভালো, এসব বিষয় থেকে দূরে থাকাই ভাল!
অয়নি বলল, ভাইয়া ছেলেটা নাকি, শুকনা, টিঙটিঙে লম্বা! রাইফেলস কলেজে পড়ে।
হাসিব আবারও হেসে বলল, ও তো ইচ্ছে করে লম্বা হয়নি, এতে বেচারার কী দোষ বলো তো!
অয়নি কলমের মাথা কামড়ে বলল, হু সেটা তো ঠিক!
আমার না এমন ছেলেদের ভালো লাগে না। একটু ম্যাচিউরড, বড়, কেয়ারিং ধরনের হলে ভালো হয়।
এবার হাসিব হো হো করে হেসে ফেলল।
-ম্যাচিউরড, কেয়ারিং ছেলে হলে কী স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে নিউমার্কেটে যেত?ওখানে যাবে এমন টিঙটিঙে ছেলেরাই!
অয়নিও হাসল, হাসিব ভাইয়া আজ অনেক কথা বলছেন, খুব ভালো লাগছে।এমনিতে ভাইয়া এত কথা বলেন না কখনো। সেদিন নিউমার্কেট এ ইনফর্মালি দেখা হওয়াতে হয়তো ভাইয়া অনেকটা সহজ হয়েছেন।
অয়নি মনে মনে নায়েরা আর সুতপাদের ধন্যবাদ দিলো।
ওদের সাথে না গেলে, ওরা ওকে একা রেখে চলে না গেলে এমন কিছু হয়তো হতোই না। দেড়ঘন্টা পড়িয়ে হাসিব উঠল। আগামীকালও পড়াতে আসবে।

থার্ড পিরিয়ডে ফিরোজা ম্যাডামের ক্লাশে নোটিশ এলো, আজ ছয় পিরিয়ড টানা ক্লাশ হবে, তারপর ছুটি।
অয়নির মা কক্সবাজারে। যদিও তিনি কোন বাঁধা দেন না অয়নিকে তবু অয়নির কেমন মুক্ত মুক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এখন যা ইচ্ছে তাই করা সম্ভব।
অয়নি নায়েরাকে বলল, আমাকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবি?
নায়েরা তো ভীষণ অবাক, অয়নি নিজে থেকে যেতে চাইছে, ও খুশী মনে রাজী হয়ে গেল। ছুটির পর নায়েরা অয়নিকে বাসায় নিয়ে এলো।
নায়েরার মা শিউলি বেগম অয়নিকে দেখে খুশীও হলেন, আবার মনে মনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটা দুপুরে এসেছে, নিশ্চয়ই কিছু খায়নি! এমনিতেই মাসের শেষ। এই শহরে মাসের শেষ দিনগুলো কতটা অংক কষে পার করতে হয় সেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মা বাবা ভালো জানেন। এই দিন গুলো আলু ভর্তা, আলু ভাজা, আলুর ডাল এসব দিয়েই পার করতে হয়। দুয়েক বেলায় ডিম ভাজি।
শিউলি বেগম মিটশেফ খুলে দেখলেন দুটো ডিম আছে।
তায়েবা, তারিফ, নায়েরা আর অয়নি, সাথে শাশুড়ি। একসাথে গুলিয়ে ভেজে দিলে হয়ে যাবে। একটু পেয়াজ কাঁচামরিচ বেশি দিতে হবে। শাশুড়ী তার সাথেই থাকেন।
ছোট ছেলের অবস্থা বেশ ভালো, কাছেই থাকে, কিন্তু তার কাছে থাকবেন না। নাইমুলের কাছে থাকতে হবে। নাইমুল নায়েরার বাবার নাম।
শাশুড়ির বয়স যত বাড়ছে, আচরণ তত শিশু সুলভ হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন তাকে খেতে দিতে হবে নাতি নাতনির সাথে। ওদের যা দেওয়া হবে, তিনিও ঠিক সেটাই খাবেন। কোন কারণে কম বেশি হলে একা একা গজগজ করেন। আজ যদি তাকে ডিম না দেওয়া হয়, তাহলে ডিম ইস্যুতে পুরো একমাস বকবক করবেন। ছেলে এলেই নালিশ, তোর বউ পোলাপানরে ডিম খাওয়ায়, আমারে দেয় পানি ভাত!
ইদানিং কানেও একটু কম শোনে তার শাশুড়ী। সব কথা দুবার করে বলতে হয়। নাইমুল সাহেব জনেন, এটা কখনোই সম্ভব নয়।
তবুও মায়ের সামনে শিউলিকে ডেকে একটু ধমক দেবেন। পরে অবশ্য বুঝিয়ে বলেন, কিন্তু পুরো বিষয়টা শিউলির আর ভালো লাগে না!
শিউলি ডিম ভাজলেন। বেগুন ছিল, বেসন দিয়ে বেগুনি ভাজলেন কয়েকপিস। আলুভর্তা, ডাল আগেই ছিল।
ভাতটা নেমেছে বেশি সময় হয়নি। অয়নি নায়েরার রুমে গল্প করছিল তায়েবা তারিফের সাথে। অয়নির পেনসিল বক্সটা তারিফের খুব পছন্দ হলো, ডোরেমন শেপের।
অয়নি কলম পেন্সিল বের করে সেটা তারিফকে দিয়ে দিলো। তারিফের নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা, এই সুন্দর জিনিসটা এখন তার!
নায়েরা অবশ্য খুব নিষেধ করছিল। অয়নি বলল, আমার ছোট ভাই চাইলেও আমি দিয়ে দিতাম, তারিফ কী আমার ভাই না! তুই ও আমাকে দূরের মনে করিস, নায়েরা!
ওর চোখ ছলছল করে উঠল। নায়েরা আর কিছু বলল না।
শিউলি সবাইকে খেতে ডাকলেন। অয়নি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল, শিউলি স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন, আমিতো তোমার মায়ের মতো তাই না মা! তায়েবা, তারিফ, নায়েরা যেমন তুমিও তেমন, সংকোচ করো না মা।
শিউলি গরম ভাতে ঘি দিয়ে দিলেন অয়নিকে।আলুভর্তা, ডিম ভাজি, বেগুন ভাজি, একটু মরিচ ভর্তা, ডাল।
অয়নির মনে হলো, অনেক দিন এত স্বাদের খাবার খাওয়া হয়নি! ইশ, নায়েরার মা রোজ রোজ এত মজার জিনিস রান্না করেন। অয়নির মায়ের একদম রান্না করতে ইচ্ছে করেনা। মাঝে মাঝে কেক বানান শুধু, রান্না নাজমাই করে।
নায়েরার দাদী নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে খেতে এসে বললেন, তোমার আক্কেল কেমন বউ, আমারে ডাকবা না।
শিউলি বললেন, মা আপনে তো জায়নামাজে ছিলেন!
-তাইলেও, তুমি তো ডাকবা না কি! দেখি কী রানছ!
ঢাকনা সরিয়ে ডিম ডাল দেখে বললেন, ওহ, আইজও এইগুলা, মাছ টাছ নাই?
শিউলি একটু লজ্জা পেয়ে বললেন,আপনার ছেলে বাজার করার সময় পায়নি। এই কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করেন আম্মা।
তারপর নায়েরার দাদী বলতে শুরু করলেন, দেশ গায়ে থাকতে মাছ ছাড়া খাই নাই!
শিউলি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন, তাইলে যান, দেশে গিয়া থাকেন!
অয়নিকে দাদী জিজ্ঞেস করলেন,, এই মাইয়া, তোমার বাপ মা আলাদা থাকে না? বাপে আরেকটা বিয়া করছে না?
অয়নি কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারল না আঞ্চলিক টানের জন্য। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো, জী দাদী?
নায়েরা তাড়াতাড়ি বলল, অয়ন ওঠ ওঠ, সি জাস্ট ইটিং ইওর মাথা! হি হি হি!
দাদী বললেন, মাছের মাথা কই পামু, ভর্তা দিয়া ভাত খাওয়ায় তোর মা।
সবাই হি হি করে হেসে উঠল।
শিউলি বেগমেরও হাসি পেলো। খাওয়া শেষে শিউলি অয়নিকে রান্নাঘরে ডেকে বরই এর আচার খেতে দিলেন। কী সুন্দর শুকনো বরই গুড়ে টুপটুপে হয়ে আছে। অয়নির খুব ভালো লাগল। শিউলি আচারের বয়ামটা অয়নিকে দিয়ে দিলেন। অয়নি পাঁচটা পর্যন্ত নায়েরার বাসায় থেকে তারপরে বাসায় গেল। ওর বাসা সামনের গলিতেই বাসা কিন্তু আসা হয় না তেমন। নায়েরা মাঝে মাঝে অয়নির কাছে যায়।

চলবে

শানজানা আলম