এক টুকরো নূর পর্ব-০১

0
136

গল্প – #এক_টুকরো_নূর
লেখিকা: উম্মে হানি মিম (#Ummey_Hani_Mim)

ফাঁকা ঘরটার দিকে ভেজা চোখ বুলাচ্ছেন আলেয়া বেগম।দেখছেন কোথাও কিছু প্রয়োজনীয় রয়ে গেল কি না।ছলছল চোখে মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরা।আলেয়া বেগমের চোখ পড়লো নূরার চোখে।মেয়ের জিজ্ঞাসুক ভাবমূর্তির কারণ তার অজানা নয়।তবুও প্রশ্ন করলেন, “কিছু বলবে নূরা?”
নূরা কোনো ভনিতা না করেই দ্রুত বললো,”আম্মা আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে সবাই অন্যরকম। আমরা কি করে থাকবো সেখানে?”
আলেয়া মাথা নিচু করে বললেন,”মানিয়ে নিতে হবে মা।”
-“সব মানিয়ে নিলাম কিন্তু মা..”
কথা শেষ করতে না দিয়ে আলেয়া বললেন,”- নূরা আর কথা নয়।তুমি যেটার ভয় পাচ্ছো সেটা আল্লাহতালাই হেফাজত করবেন।তিনিই এই পরীক্ষায় ফেলেছেন তোমাকে এবং আমাদের। তিনিই এই বিপর্যয় থেকে আমাদের উঠে দাঁড়ানোর শক্তি দিবেন।”
আলেয়ার ছোট মেয়ে নোহা বললো,”আম্মা, আব্বা থাকলে এমন হতো না বলো? আব্বা কেন চলে গেলেন?”
আলেয়া বেগম নোহার মাথায় হাত রেখে বললেন,”আল্লাহর ফায়সালার উপর অসন্তুষ্ট হতে নাই মা।”
নূরা আর কোনো কথা বললো না বোরকাটা পড়ে, নেকাব লাগালো।কান্নাভেজা চোখটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার মায়াভর্তি চেহারাটার।
নোহাও হিজাবটা পড়ে নিলো।
দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো।নূরা নোহার চাচা এসেছেন ওনাদের নিতে।অচেনা শহরে,অচেনা গন্তব্যে চলে যাচ্ছে তারা।জানে না সেখানে কি অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য।একদম ভিন্নধর্মী পরিবেশে কি করে নিজেকে রক্ষা করবে তারা।
আলেয়া বেগম আর মামুন সাহেবের দুই মেয়ে নূরা,নোহা।ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক বাবা মাকে দেখে বড় হয়ে উঠেছে দুজন।বড় হয়ে নূরা যেন আরও বেশি ধর্মভীরু হয়ে উঠেছে।যতটা সম্ভব ধর্ম মেনে চলার চেষ্টা করে।ছয়মাস আগে এক্সিডেন্টে চলে যান মামুন সাহেব।যে চাচার বাসায় কখনই যেতে যাইত না নূরা সেখানেই তাকে একেবারের জন্য চলে যেতে হচ্ছে।চাচার সাথে সম্পর্ক ভালোই রাখতো কারণ,হাদিসে আছে রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনও বেহেস্তে যাবে না।তবে চাচার বাসার পরিবেশ কখনই তাদের সাথে মিলতো না।সে জন্য কখনই সেখানে যেতে চাইত না।নূরার চাচা আশরাফ সাহেব মর্ডান ধ্যান ধারণার মানুষ। মামুন সাহেবের থেকে একদম আলাদা।তার স্ত্রী -সন্তানেরাও এমন।ধর্মকর্ম তারা মানে না।নামে মুসলিম এতটুকুই তারা জানে।নামাজ, রোজা সবকিছুতেই তারা উদাসীন।মামুন সাহেব অনেকবার ভাইকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু হিতে এগুলো বিপরীত হয়েছে।তাই তিনি আর তাদের কিছু বলতেন না।কিন্তু হঠাৎ করে মামুন সাহেব চলে যাওয়ায় দুই মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন আলেয়া বেগম।শেষ পর্যন্ত আশরাফ সাহেবের জোরাজোরিতে আর এক প্রকার বাধ্য হয়েই ওনার বাসায় যেতে রাজি হয়েছেন।আশ্রয়হীন হয়ে যাওয়ার থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে চাচার বাসায় যাওয়াই মঙ্গল ভেবেছেন তিনি।নূরা কখনই তার বাবা মায়ের অবাধ্য হয় না তাই মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে মুখ বুঝে।অন্যকোনো রাস্তাও তার চোখের সামনে খোলা নাই।এই ছয়মাসে একা একটা বাড়িতে তিনজন মেয়ে মানুষ কত কষ্টে থেকেছে তারাই শুধু জানে।

নূরা দরজা খুলে চাচা আশরাফ সাহেবকে সালাম দিলো।
তবে তিনি সালামের উত্তর দিলেন কি না বুঝা গেল না।নূরার মনটা খারাপ হয়ে গেল।সালাম দেয়া যে কত উত্তম বা সালামের জবাব দেয়া কতটা সওয়াবের তার নিজের চাচা সেটাই জানেন না।
আশরাফ সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,”ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে এখন বেরোতে হবে।তাড়াতাড়ি বের হও।আর এত গরমে এগুলো কি নাকমুখ ঢেকে রেখেছিস নূরা? গরমে অজ্ঞান হয়ে যাবি তো।”
নূরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”কিছু হবে না চাচ্চু।”

আশরাফ তাড়াতাড়ি করে ভিতরে চলে গেলেন।দরজায় দাড়িয়েই শুনতে পেলো নূরা, আশরাফ বলছেন, “আলেয়া মেয়েদেরও তোমার মতোই বানিয়ে ফেলছো।এখন শহরে যাচ্ছো একটু মর্ডান ধ্যানধারণার হওয়ার চেষ্টা করো।আমার ভাতিজীদের অন্যদের সাথে পরিচিত করাতে আমার যেন লজ্জা না লাগে।”
নূরার ভিতরটা কুকড়ে উঠলো।এ কোথায় যাচ্ছে সে! কি হবে তার জীবনে এরপর।আল্লাহ কি তার ইমান রক্ষা করবেন।কতবড় পরীক্ষা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য!

কলিংবেল বাজাতেই আশরাফ সাহেবের মেয়ে পরশি দরজা খুললো।পরনে টিশার্ট আর টাউজার।চুলগুলো সোনালী কালার করা।নোহা নূরার দিকে আড়চোখে তাকালো।নূরা নোহাকে চোখের ইশারায় সাবধান করলো।পরশির চেহারা দেখে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত। দরজা থেকে সরে গিয়ে বিদ্রুপের মতো করে মাকে ডেকে বললো,”মাম্মি তোমাদের মেহমান হাজির।অন্যরুম থেকে হাসিমুখে বের হয়ে এলেন মিসেস পলি।পরনে কুর্তি আর টাউজার গায়ে ওড়নাটাও নাই।চুলগুলো তারও কালার করা। বেশ মর্ডান তিনিও।এগিয়ে এসে বললেন,”এসো এসো এত দেরী হলো যে তোমাদের? ”
আশরাফ সাহেব বললেন, “ট্রেন মিস করেছিলাম বাসে আসতে হলো।রাস্তায় নোহা বমি টমি করে যা অবস্থা। এর জন্যই গাড়ি নিয়ে যাইনি আমি।ওরা দামী গাড়ি চড়ে তো আর অভ্যস্ত না।বাসেও রক্ষা হলো না।”
পলি বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন,”ভাগ্যেস গাড়িটা নাওনি। নতুন গাড়ি আমাদের।সত্যি কথা বলতে আমার ভয় নাই।ওরা গ্রামে থেকে অভ্যস্ত গাড়ি ঘোড়া বা আধুনিকতায় অস্বস্তি তো হবেই।”
আশরাফ সাহেব হাসলেন,”আধুনিক বানাতেই তো এখানে নিয়ে এলাম।তুমি তোমার মতো গড়ে তুলো এদের।”
আলেয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নূরার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললেন।মেয়েদের চোখের দিকে তাকানোর সাহস যেন তার হচ্ছে না।

জামা কাপড় ছেড়ে একটা রুমে এলো তিনজন।আলেয়া অযু করে এসে মেয়েদের বললেন,নামাজ আদায় করে নাও আম্মারা।
নোহা সাথে নিয়ে আসা ক্লাস নাইনের বইগুলো গোছাতে শুরু করেছিল মায়ের কথায় অযু করতে গেল।নূরা অযু করেই ফেলেছিল নামাজটা আদায় করে নিলো।আলেয়া বললেন -“নূরা এই বাসায় সবকিছুর মধ্যে তোর জন্য একটা ভালো হচ্ছে কোনো ননমাহরাম নেই।তুই অন্তত এটাতে স্বস্তি পেয়েছিস।ভাইজানের ছেলে নাকি দেশের বাইরে চলে গেছে।”
নূরা মুচকি হেসে বললো, “হ্যাঁ আম্মা এটা আল্লাহর রহমত।”
আলেয়া কোরআন শরিফে চুমু খেয়ে বললেন,”নূরা একটু দেখবি গিয়ে তোর চাচিআম্মা কি করছে।কোনো কাজে সাহায্য লাগলে করে দিস।আমি একটু তেলাওয়াত করেই আসছি।”
নূরা মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে গেল।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো মিসেস পলি অন্য একজন মহিলাকে দেখিয়ে দিচ্ছেন কি কাজ করতে হবে।ইনি বোধহয় এই বাসায় কাজে সাহায্য করেন।
নূরা এগিয়ে এসে বললো,চাচি আম্মা কোনো কাজ করা লাগবে?
পলি ভ্রু কুচকে বললেন, “এটা কেমন ডাক চাচি আম্মা? এসব গেঁও ডাকটাক ভুলতে হবে।আমাকে মাম্মাম বলে ডেকো তোমরা।আর ফুলহাতা জামা পড়ে আবার এতবড় ওড়না পড়ে আছো তোমার গরম লাগে না নূরা?”
নূরা মাথা নাড়ালো।
পলি আবার বললেন,-“যাও গিয়ে টেবিলটা গোছাও। ফুলি খাবার দিবে।খেয়ে নিও।”
“আপনারা খাবেন না?”
“আমরা এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খাই না”
নূরা টেবিল গোছাচ্ছিল তখনই পরশি এলো পানি নিতে।নূরাকে দেখতে পেয়ে বললো,”তোমার আর ড্রেস নাই?গরমে এগুলো পড়ে আছো কেন?”
নূরা মুচকি হেসে বললো,”আমি এগুলোই পরি।”
পরশি ভ্রু কুচকে বললো,”গ্রামের লোকজনের গরম নাই মনে হয়।আমি তো বাবা এসি ছাড়া থাকতেই পারি না তাও টিশার্ট পরেও গরম লাগে।”
নূরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বললো,”হায় জাহান্নামের গরম যদি তোমাদের বুঝাতে পারতাম।”

কয়েক দিন এভাবেই কেটে গেল।আশরাফ সাহেব নূরাকে একটা মহিলা কলেজে আর নোহাকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।নূরা নোহা প্রতিদিন রিকশা করেই দুইবোন স্কুল,কলেজে যায়।বাসায় গাড়ি থাকা সত্যেও তাদের ভাগ্যে জুটে না সেই গাড়ি।পরশিও একই টাইমে কলেজে যায় অথচ সে গাড়িতে করেই যায়।এসব নিয়ে অবশ্য আলেয়া বেগম বা নূরার কোনো অভিযোগ নাই।শুধু নোহা মাঝেমধ্যে গাড়িতে চড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে নূরার সামনে।সে নোহাকে ভালো মতোই বুঝিয়ে দেয়।

বিকেলে নূরা রান্নাঘরে কাজ করছিল তখনই কলিংবেল বাজে।আলেয়া আর নোহা ছাদে গেছেন কাপড় আনতে।ফুলিও চলে গেছে।পলি বাথরুম থেকেই চেঁচালেন,” নূরা নোহা কে আছো দরজাটা খুলো।”
নূরা ওড়না টেনে একহাতে মুখটা ঢেকে অন্যহাতে দরজা খুললো।একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে পরনে কালো টিশার্ট।চুলগুলো বেশ স্টাইল করে কাটা।বেশ মর্ডান, নায়কের মতোই দেখতে।
নূরাকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল মনে হয়।নূরা চোখ নামিয়ে আছে।ছেলেটা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললো,”এটা পরশিদের ফ্ল্যাট না?”
নূরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে দরজা থেকে সরে এলো।ছেলেটা ভেতরে ঢুকলো।ততক্ষণে পরশি বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।ছেলেটাকে দেখে উচ্ছাসিত হয়ে বললো,”হেই ব্র তুমি চলে এসেছো?” মাম্মি বলছিল আজকে তুমি বাসায় ফিরবে।আমি ভাবছিলাম যাব তোমাদের ফ্ল্যাটে।”
ছেলেটা মুচকি হেসে বললো,”খালামনি কোথায়? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে কার ফ্ল্যাটে এলাম।তোদের বাসায় মেহমান এসেছে নাকি?”
ওদের কথার মাঝখানেই নূরা নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল।পরশি ওকে থামিয়ে বললো,”নূরা তুমি মুখ ঢেকে আছো কেন? কি হয়েছে মুখে।”
নূরা না সূচক মাথা নাড়িয়ে ভিতরে চলে গেল।
পরশি বেশ অবাক হয়েছে।সাদমানকে ওর ঘরে নিয়ে গেল।তারপর বললো,”আমার চাচাতো বোন।ওরা গ্রামে থাকে, এভাবেই অভ্যস্ত বুঝই তো ভাইয়া।তবে আমার অবাক লাগছে সে তোমাকে দেখেও কোনো রিয়েক্ট করলো না।”
সাদমান কোনো আগ্রহ দেখালো না এ ব্যপারে।বললো, এবারের শুটিংটা খুব এনজয় করলাম দেশের বাইরে।তোর না মডেলিং এর শখ তুই কেন আসছিস না মিডিয়ায়?”
পরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,মাম্মি কি আর রাজি হবে? মাম্মির তো একটাই কথা তার সাথে মিডিয়ায় যেতে হলে আগে ইন্টারমিডিয়েটে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।আমিও সেই অপেক্ষায়।যাই হোক সাদমান ভাইয়া তুমি যে শেষ নাটকটা করেছো ওটা কিন্তু সুপারহিট হয়েছে। আমি তো তোমার লুক দেখেই ফিদা হয়ে গিয়ে ছিলাম।তোমাকে দেখে তো এখন অটোগ্রাফের লাইন লাগে আর নূরা তোমাকে চিনলোই না? এরা গ্রামে টিভিও দেখে না নাকি! ”
সাদমান চুল ঠিক করে বললো,”মেয়েটার নাম বুঝি নূরা?”
“হ্যাঁ ”
“সবাই আমাকে চিনবে তার তো মানে নাই”
“তা বলে তোমাকে চিনবে না।এখন তো তুমিই ছোট পর্দায় হিট নায়ক ”
“মেয়েটাকে দেখে তো মনে হলো সে এই জগৎ এর না।না চেনাটাই স্বাভাবিক ”
পরশি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

বাসায় রোজ কেউ না কেউ ছেলে আসতেই লাগলো।বেশিরভাগই পরশির ছেলেবন্ধুরা।পরশির খালাতো ভাই সাদমানরা এই বিল্ডিংএর এই অন্য ফ্ল্যাটে থাকে তাই সেও মাঝেমধ্যে আসতো।
এদের থেকে নূরা যত পারে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।তবে ফুলি না থাকলে সে নাহয় নোহাকেই নাস্তা নিয়ে যেতে হয় ওদের সামনে।তেমনই একদিন নাস্তা নিয়ে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি…

চলবে..