তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-১৬+১৭

0
457

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৬

সকাল সকাল বাবা চলে যাচ্ছে শুনেই আমি তার পেছন পেছন ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করলাম। হঠাৎ করে বাবার একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে, তাই এখনই চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু বাবা বলল আমাকে তাজ ভাইয়ের সাথে যেতে হবে। আমার সব গুছিয়ে নিতে নিতে না-কি তার অনেক দেরি হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ বাবার সাথে ঘ্যানঘ্যান করার পরও যখন বাবা রাজি হলো না তখন বাধ্য হয়ে আমি থেকেই গেলাম। কী আর করা? তাজ ভাইয়ের সাথে আগামীকালই যেতে হবে। যার জন্য বাবার সাথে যেতে চাইলাম তার সাথেই আবার ফিরতে হবে! পরে ভাবলাম আসার সময় আমি আর তাজ ভাই একাই এসেছি। কিন্তু যাওয়ার সময় তো শ্রেয়ান ভাইয়াও যাবে। এটা‌ ভেবে কিছুটা চিন্তামুক্ত হলাম। বাবাকে বিদায় জানিয়ে আমি বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া আমার পেছনেই কথা বলতে বলতে আসছেন। সামনে যে অলি কলার খোসা ফেলে রেখেছে তা আর চোখে পড়ল না। হঠাৎ বেখেয়াল হাঁটতে গিয়ে সেই খোসার ওপর পা পিছলে আমি চিৎপটাং। কানফাটানো এক চিৎকার দিয়ে আমি পা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া একদৌড়ে আমার কাছে চলে এলেন। কিন্তু তাজ ভাইয়ের আগে শ্রেয়ান ভাইয়াই আমাকে ধরে দাঁড় করালেন। পায়ে এত বেশি ব্যথা পেয়েছি যে এখন ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছি না। বাধ্য হয়ে আমি দুহাতে শ্রেয়ান ভাইয়ার হাত চেপে ধরে রাখলাম। আমার চিৎকার শুনে ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলেন। ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করেছে। মেজো কাকি দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এলেন। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার পা-টা উঁচু করে ধরলেন। আমি কিছুটা ইতস্তত করে পা সরিয়ে নিতে চাইতেই শ্রেয়ান ভাইয়া ভ্রুকুটি করে বললেন,“ম্যাডাম, এখন অন্তত পায়ের ব্যথা কমাতে দাও। আপাতত নড়াচড়া বন্ধ রাখো।

আমি চুপ হয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া কাকির হাত থেকে বরফের বাটিটা নিয়ে আমার পায়ে বরফ ঘষে দিলেন। এই মুহূর্তে ‘না’ বললেও যে শুনবেন না তা বুঝতে পেরে চুপ থাকাই সমীচিন মনে করলাম। এমনকি কাকি বরফ লাগিয়ে দিতে চাইলে তাকেও মানা করে দিলেন শ্রেয়ান ভাইয়া। কিন্তু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম বাড়ির সবাই মুখ টিপে হাসছে। ব্যাপারটা দেখে আমি আহাম্মক বনে গেলাম। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছি আর সবাই কি না হাসছে! তাজ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে গম্ভীর মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ের বরফ লাগানো দেখছে। আফরা আপু একটা অয়েন্টমেন্ট এনে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। শ্রেয়ান ভাইয়া আলতো হাতে আমার পায়ে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলেন। মেজো কাকি অলিকে বকাবকি শুরু করে দিলেন। সে কেন কলা খেয়ে যেখানে সেখানে খোসা ফেলে, এটাই তার দোষ। বকা শুনে অলির মুখটা চুপসে গেল। সে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি মেজো কাকিকে বললাম,“কাকি, ও ছোটো মানুষ, এতকিছু ওর মাথায় থাকে? শুধু শুধু ওকে বকছো। থামো, নইলে মেয়েটা ভয় পেয়ে যাবে।”

মেজো কাকি থেমে গেলেন। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার সামনে থেকে উঠে পাশে বসে বললেন,“ইলোমিলো, তোমার ভাগ্য ভালো পা-টা শুধু ফুলে লাল হয়ে গেছে। ভেঙে গেলে কী অবস্থা হত ভাবতে পারছো? দেখেশুনে হাঁটাচলা করতে পারো না একটু?”

আমি মন খারাপ করে বললাম,“খোসাটা একদমই চোখে পড়েনি ভাইয়া।”

মেজো কাকি বললেন,“রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম কর। কয়েকবার মলম লাগালেই ব্যথাটা কমে যাবে। চিন্তা করিস না।”

শ্রেয়ান ভাইয়া আমার হাত ধরে বললেন,“আন্টি ঠিক কথা বলেছে। চলো আমি দিয়ে আসি।”

আমি নিজে থেকে পায়ে ভর দিয়ে উঠতে পারব না তাই শ্রেয়ান ভাইয়া আমার হাতটা শক্ত করে ধরে সোফা থেকে উঠালেন। তারপর আমাকে ধরে ধরে রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। আমি আড়চোখে একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি এখনও গম্ভীর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওনার মুখোভাব দেখে মনোভাব বুঝতে পারলাম না। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। তার পেছন পেছন ছোটো কাকি আর আফরা আপুও এসেছে। ছোটো কাকি আমার পা দুটো বিছানায় তুলে দিলেন। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“আরামসে রেস্ট করো। কিছু দরকার হলে কাউকে ডেকে বলবে। পা-টা বেশি নড়াচড়া কোরো না, ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে অলরেডি।”

আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আর ছোটো কাকি আমাকে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর আফরা আপু বিছানায় উঠে আমার পাশে বসে পড়ল। তারপর আর কী? শুরু হয়ে গেল তার তাজ ভাইয়ার গান। আমি অসহায়ের মতো মুখ করে শুধু শুনে গেলাম। দুপুরে গোসলের সময় ভাগ্যিস আফরা আপু হেল্প করল। নইলে আজ পায়ের জ্বালায় গোসলও করা হত না। দুপুরের খাবারটা মেজো কাকি আমার রুমে দিয়ে গেল। সবাই মিলে আমার বেশ ভালোই যত্ন করতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর পর একজন একজন করে এসে আমার খবর নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি তাজ ভাইয়ের দেখা পেলাম না। খবর নেয়া তো দূর, শয়তানটা একবার উঁকি দিয়েও দেখল না! সন্ধ্যা আটটার দিকে আমি বালিশে হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রলিং করছিলাম। হঠাৎ করে তাজ ভাই আমার রুমে এলেন। আমি ওনাকে একনজর দেখে আবার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলাম। উনি এসে আমার পাশে বসলেন। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারলাম উনি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু সময় পর ওনার দৃষ্টি এসে আমার মুখে আটকাল। তবু আমি চোখ তুলে তাকালাম না। উনি যেহেতু সকাল থেকে একবারও আমার খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি, আমি কেন ওনার সাথে যেচে কথা বলতে যাব? এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট। তারপর হুট করেই উনি আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরলেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি এতটাই চমকে উঠলাম যে ফোনটা আমার হাত ফসকে পড়ে গেল। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সাহসটুকুও ফুস করে উড়ে গেল। কারণ রাক্ষসটার চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“পরপুরুষের ছোঁয়া পাওয়ার খুব শখ তাই না? শ্রেয়ান তোকে কেন ছোঁবে? বাড়িতে আরও মানুষ ছিল না? ধরে উঠিয়ে সোফায় বসানো, আইস লাগানো, অয়েন্টমেন্ট লাগানো, ধরে ধরে রুমে নিয়ে আসা। সব ওকেই কেন করতে হবে? ছেলেদের ছোঁয়া পাওয়ার এত শখ জাগলে আমাকে বলতি। শখ মিটিয়ে দিতাম।”

আমার চোখে পানি এসে গেল। অবাক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এসব কী বলছেন উনি? শ্রেয়ান ভাইয়াকে কি আমি বলেছিলাম ছুঁতে? তাছাড়া উনি তো আমার ভালোর জন্যই ছুঁয়েছিলেন। কিন্তু তাজ ভাই এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা কেন এমন বাজেভাবে নিচ্ছেন? উনি আমার বাহু ধরে ঝাঁকুনী দিয়ে আবার বললেন,“মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না এখন? আজকের পর আর কোনোদিনও যেন এমন কিছু না দেখতে হয়। সাবধানে না চললে পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখব।”

ওনার কথার উত্তর দিতে পারলাম না। বাহুতে ব্যথা পেয়ে আমি মুখ কুঁচকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,“আমার হাতে লাগছে।”

বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি আমার বাহু ছেড়ে দিলেন। আমি ভেজা চোখ জোড়া নামিয়ে নিয়ে এক হাত দিয়ে অপর হাতের বাহু ঘষতে লাগলাম। উনি মিনিট খানেক আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যেভাবে এসেছিলেন আবার সেভাবেই চলে গেলেন। আমি শুধু বিস্ময় নিয়ে ওনার চলে যাওয়া দেখলাম। এইটুকু সময়ের মধ্যে আমার চোখে পানি ঝড়িয়ে চলে গেল লোকটা। কী হলো না হলো সবটা আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। ওনার এমন আচরণ এই প্রথম দেখলাম। সবসময় উনি আমাকে বকেন, ঝগড়া করেন, আবার যত্নও নেন। কিন্তু এতটা রাগ কখনও দেখাননি। আর ওই কথাগুলো! এমন কথা উনি কেন বললেন আমাকে? এক মিনিট। উনি কি কোনোভাবে হিংসা করছেন? প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে হিংসা করছেন শুধু আমাকে ছুঁয়েছে বলে! হুম, রহস্য আছে। পা ভালো হয়ে গেলেই রহস্য উদঘাটন করতে নেমে পড়তে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওনার কথাগুলো মনে করেই আমার খুব খারাপ লাগছে। এমন একটা কথা উনি বলেছেন তা আমার বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে করছে না। সরাসরি আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুললেন! ছিঃ! ওনার সাথে আমি আর কোনোদিন কথাই বলব না। চোখ মুছে মুখ ভার করে বসে রইলাম। জেমি পাশ থেকে আমার কোলে উঠে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর আমার হাসি পেল। সঙ্গে সঙ্গে ও লাফিয়ে উঠল। মনে হলো ও এতক্ষণ আমার মন ভালো করার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। আর তাই আনন্দ পাচ্ছে। এজন্যই ওকে আমি এত ভালোবাসি। তারপর আফরা আপুকে ডেকে তার সাথে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত গল্প করলাম। রাতের খাবারটা আফরা আপু নিজেরটাসহ আমারটা রুমে নিয়ে এল। দুজন একসাথে ডিনার করলাম। খাবার শেষ করে বাবাকে ফোন করলাম। ঢাকায় পৌঁছে বাবা একবার ফোন করেছিল। কিন্তু আমি তখন আমার পায়ের কথাটা বলিনি। বললেই সে দুশ্চিন্তা করবে। এবারও বাবাকে কথাটা বললাম না। এমনিতেই আগামীকাল ঢাকায় চলে যাব। এখন এই কথাটা না বলাই ভালো। ছোটো কাকি ঘুমন্ত অলিকে কোলে করে নিয়ে রুমে ঢুকল। অলিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল,“আফরা ঘুমাতে যা। ইলোর রাত জাগার দরকার নেই।”

আফরা আপু ছোটো কাকির কথায় সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। ছোটো কাকির হাতে অয়েন্টমেন্ট দেখলাম। কাকি সেটা আমার পায়ে যত্ন সহকারে লাগিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে শুইয়ে দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ করেই আমার পায়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম। আমার ঘুম ছুটে গেল ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে আমার ধুমিয়ে জ্বর এসেছে। জ্বরের প্রকোপে মাথাটা ভার ভার লাগছে। একদিকে ব্যথার কারণে পা নাড়াতে পারছি না আরেকদিকে জ্বরের কারণে মাথাটাও তুলতে পারছি না। পাশে অলি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি জ্বরে আর পা ব্যথায় চোখ বন্ধ করে বারবার ককিয়ে উঠলাম। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। পরক্ষণেই কপালে কারো হাতের আলতো স্পর্শ পেয়ে আধো আধো চোখ খুলে তাকালাম। আবছা দৃষ্টিতে চোখের সামনে একটা পুরুষের মুখ ভেসে উঠল। সে আমার কপালে, গালে, গলায় হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই কপালে ঠান্ডা কিছু একটা অনুভব করলাম। পরক্ষণেই হঠাৎ চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল। তারপর যখন চোখ খুললাম তখন সূর্যের তীব্র আলোক রশ্মি এসে সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেছে। আমি চোখ কচলে, আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই পায়ে হালকা ব্যথা অনুভব করলাম। কিন্তু কালকের থেকে কিছুটা কম। পাশে তাকিয়ে অলিকে পেলাম না। হয়তো অনেক আগেই উঠে গেছে। আন্দাজ করলে এখন হয়তো সকাল সাড়ে আটটা কিংবা নয়টা বাজে। অথচ আজ কেউ আমাকে ডাকল না। এমনকি তাজ ভাইও না! পা টেনে কিছুটা ভাঁজ করে হালকা ঝুঁকে পায়ের ব্যথার জায়গাটাতে হাত বুলালাম। ফোলা অনেকটা কমে গেছে। এখন শুধু ব্যথাটুকু কমলেই বাঁচি। সোজা হয়ে বসতেই মাথাটা হালকা চক্কর দিয়ে উঠল। একহাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলাম। পরক্ষণেই আবার ঠিক হয়ে গেল। শরীরটা কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে দুর্বল হয়ে পড়েছি। শিয়রের পাশ থেকে ফোনটা নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। কিন্তু ফোনের সাথে আরেকটা জিনিসও পেলাম। ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ। ফোনের নিচে কাগজ রাখল কে? আমি কিছু একটা ভেবে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে ফেললাম। পরিচিত হাতের লেখা। এই একই হাতের লেখা এর আগেও দেখেছি মনে হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে মনে মনে পড়তে শুরু করলাম।

“জ্বরের ঘোরে একটা মেয়ে এতটা পাগলামি করতে পারে তা তোমাকে না দেখলে জানতে পারতাম না। আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে দিনের চব্বিশ ঘন্টা পার করতে চাই। কিন্তু কখনও তোমার অজান্তে এমন কিছু করতে চাই না যা শুনলে তুমি কষ্ট পাবে। গতরাতে তোমার পাগলামির কারণে ঘটা ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত বনলতা। তোমার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে আমায়। কারণ তোমার মনের কষ্টগুলোর কাছে আমি পরাজিত।”

আমার বুকটা ধক করে উঠল। হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। গলাটা হঠাৎ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তাজ ভাইয়ের চিরকুট। কিন্তু এসব কী লেখা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কাল মাঝরাতে হঠাৎ প্রচন্ড পায়ে ব্যথা আর জ্বর অনুভব করেছিলাম। তারপর কপালে কিছু একটা অনুভব করেছিলাম। কিন্তু তারপর তো কিছুই মনে নেই আমার। তাহলে এমন চিরকুটের মানে কী? কাল রাতে কী এমন হয়েছিল যে উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন? উনি আমার রুমে এলেন কখন? আর আমিই বা কী পাগলামি করেছি? কোন জেদের কাছে উনি হার মেনেছেন? হায় আল্লাহ্! আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। উনি এই চিরকুটের মাধ্যমে আসলে কী বুঝাতে চাইছেন? খারাপ কিছু হয়নি তো?

চলবে………………….🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৭

মেজো কাকি খাবারের জন্য বারকয়েক ডেকেছে শুনেও আমি চিরকুট হাতে নিয়ে আপনমনে ভেবে চলেছি। এবার নিয়ে প্রায় বারো বার পড়লাম চিরকুটটা। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও বুঝতে ব্যর্থ হলাম। চিরকুটে উল্লিখিত গতরাতের ঘটনার ‘ঘ’ ও মনে নেই আমার। মনটা কু গাইছে। কিছু উদ্ভট চিন্তাভাবনা দানা বেঁধেছে মস্তিষ্কে। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে চিরকুটটা নিয়ে গেল। গভীর ভাবনায় ডুবে থাকায় আমি হকচকিয়ে উঠলাম। হন্তদন্ত হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিরকুটটা ওনার মুঠোয় মুড়িয়ে ফেলেছেন। আমি ওনাকে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললাম। চিরকুটের কথা ভেবে ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। কিন্তু এই চিরকুটের আসল সত্য একমাত্র উনিই জানেন। তাই ওনার মুখ থেকেই বের করতে হবে গতরাতে কী করেছিলেন উনি আমার সাথে। তাজ ভাই আমার আড়ষ্টতা লক্ষ্য করে বললেন,“বিলাইর মতো মুখ করে রেখেছিস কেন? কখন থেকে খেতে ডাকছে শুনছিস না? তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে রেডি হ। না-কি ফেরার ইচ্ছা নেই?”

আমার মনেই ছিল না আজ আমরা ঢাকায় ফিরব। আমি কিছুটা নড়েচড়ে বসে আমতা-আমতা করে বললাম,“কাল রাতে কি আমার খুব বেশি জ্বর ছিল?”

উনি সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখোমুখি বসে কপালে হাত রাখলেন। ওনার ছোঁয়া পেয়েই আমি পিছিয়ে গেলাম। উনি চিন্তিত মুখে বললেন,“রাতে অনেক জ্বর ছিল। ভোররাতের দিকে জ্বর ছেড়েছে। এখন আবার উঠছে।”

আমি আঁতকে উঠে বললাম,“আপনি কাল সারারাত এই রুমে ছিলেন?”

“শখে থাকিনি। বাধ্য হয়ে থেকেছি। যা জ্বর উঠেছিল! কিছু একটা হয়ে গেলে তোর বাপ কাউকে ছেড়ে কথা বলতো?”

আমি ওনার কথায় কান দিলাম না। আমার মাথায় শুধু চিরকুটের কথাটাই ঘুরছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,“ঐ চিরকুটে এসব কী লেখা?”

তাজ ভাই আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাতের দিকে তাকালেন। মুঠোয় মুচড়ে যাওয়া কাগজটার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। তারপর বড়ো বড়ো চোখ করে বললেন,“কী সর্বনাশ! তলে তলে এসব চলে? রাত-দুপুরে কার সাথে জেদ ধরিস, হুম?”

আমি বিরক্ত হলাম। জানতাম উনি এভাবেই কথাটা ঘুরাতে চাইবেন। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। আজ আমি জেনেই ছাড়ব উনি কী করেছেন। আমি শক্ত মুখে বললাম,“কথা ঘুরাবেন না। কাল রাতে আপনি ছিলেন এই রুমে। আর এই চিরকুটটাও আপনার লেখা। কিন্তু এসব কী লিখেছেন? কী করেছেন আপনি আমার সাথে?”

শেষের কথাটুকু বলার সময় আমার গলাটা আবার কেঁপে উঠল। উনি বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে পকেট থেকে ফোন বের করলেন। তারপর মিনিট খানেক ফোন স্ক্রল করে ফোনটা আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়েস রেকর্ড শুনতে পেলাম। তাও আবার আমার নিজেরই। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনতে লাগলাম। রেকর্ডিংয়ে শুনতে পাচ্ছি আমি ভাঙা গলায় বাচ্চাদের মতো কন্ঠ করে বলছি,“ও তাজ ভাইয়া থুক্কু ভাই। কপাল থেকে এটা সরান তো। আমার কথা শুনুন না প্লিজ।”

তাজ ভাই বললেন,“চুপ করে শুয়ে থাক। জলপট্টি দিচ্ছি তো বাবা।”

আমি জেদ ধরে বললাম,“না, আগে আমার কথা শুনতে হবে।”

উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,“আচ্ছা বল।”

“আগে আমাকে বসান না। আমি উঠতে পারছি না।”

উনি বললেন,“হাত ধর।”

তার মিনিট খানেক পর আমি বললাম,“আচ্ছা? আপনি এত শয়তান কেন বলুন তো?”

ওনার কোনো উত্তর শোনা গেল না। আমি আবার দুর্বল গলায় বললাম,“না থাক, এসব বাদ। এখন বলুন, আপনি আমাকে আম্মুর মতো কেয়ার করেন কীভাবে? আপনার কেয়ার দেখে মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আপনাকে হয়তো আম্মু বলে দিয়েছে কীভাবে কীভাবে আমার কেয়ার করতে হবে। আচ্ছা? আম্মু সত্যিই আপনার সাথে কথা বলে? তাহলে আমার সাথে বলে না কেন? আমার খুব কষ্ট হয় আম্মুকে ছাড়া, তা কি সে বোঝে না? আমি আম্মুর কাছে যাব। আপনি আমাকে নিয়ে যান না প্লিজ।”

তাজ ভাই শান্ত কন্ঠে বললেন,“এসব বলে না ইলোনি। তোর আব্বু কষ্ট পাবে।”

“কেন?”

“এত কথা বলতে হবে না। তোর শরীর দুর্বল।”

আমি বায়না ধরে বললাম,“আর একটা কথা বলি?”

“আচ্ছা বল।”

“আপনি আম্মুর মতো করে আমাকে এত কেয়ার করেন, কিন্তু তার মতো আদর করেন না কেন?”

তাজ ভাই কিছুটা অবাক কন্ঠে বললেন,“মানে?”

“আমাকে আম্মুর মতো করে এইখানে একটা পাপ্পি দিন না। আম্মু অন্নেকগুলো দিত, আপনি মাত্র একটা দিন।”

তাজ ভাই খানিক ধমকে উঠে বললেন,“জ্বরের ঘোরে মাথাটাও খারাপ হয়ে গেছে? বেয়াদব মেয়ে! চুপচাপ শুয়ে পড়।”

সঙ্গে সঙ্গে আমি বাচ্চাদের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করলাম।‌ তাজ ভাই হন্তদন্ত হয়ে বললেন,“আরে কাঁদছিস কেন? এত রাতে কাঁদে না ইলোনি। বাড়ির সবাই জেগে যাবে।”

আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,“উঠুক। আপনি আমাকে আম্মুর মতো ভালোবাসেন না। আপনি তো আস্ত একটা শয়তান। যান আমার রুম থেকে।”

তাজ ভাই নরম কন্ঠে বললেন,“এমন অবুঝের মতো করিস না। তুই না লক্ষ্মী মেয়ে? লক্ষ্মী মেয়েরা এমন জেদ ধরে না। মামির মতো পাপ্পি দিতে পারব না আমি।”

আমি আরও জোরে কেঁদে উঠে বললাম,“কেন পারবেন না? তাহলে আপনি আমার কেয়ারও করবেন না। যান, সরুন এখান থেকে।”

তাজ ভাই বিরক্তির সুরে বললেন,“কী মুশকিল! তুই কি থামবি না? আমি কিন্তু থাপ্পড় লাগাব।”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,“হ্যাঁ তা তো মারবেনই। আপনি তো আমাকে ভালোই বাসেন না। ঢং করে কেয়ার করেন। আমি আম্মুকে বলে দেবো আপনি আমাকে সারাক্ষণ শুধু বকেন।”

তাজ ভাই আবার নরম কন্ঠে বললেন,“আচ্ছা ঠিক আছে। পাপ্পি চাই তো? দিবো, কিন্তু আগে কান্না থামাতে হবে।”

তবু আমি কান্না না থামিয়ে বললাম,“প্রমিস?”

উনি ছোটো একটা শব্দ করলেন,“হুম।”

সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। তারপর উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম,“এবার দিন তাহলে।”

এই পর্যন্ত শোনার পরেই রেকর্ডিংটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি হতবাক হয়ে থম মেরে বসে আছি। রেকর্ডিং শুনে লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতেও পারছি না। জ্বরের ঘোরে আমি আজেবাজে বকি তা আমার জানা আছে। কিন্তু গতকাল এত বাজে কান্ড ঘটিয়েছি ভাবতেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ছিঃ ছিঃ! তাজ ভাই কী ভেবেছেন? উনি নিশ্চয়ই অনেক হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু সেসব এখন ভাবার সময় নেই। প্রমিজ করার পর উনি সত্যিই আমাকে…..। ছিঃ ছিঃ! আমাকে এটা জানতেই হবে। কিন্তু আমি তো লজ্জায় ওনার দিকে তাকাতেই পারছি না। তাজ ভাই বলে উঠলেন,“কী? এখন চুপ মেরে গেলি কেন? আমি কোনোকিছু লুকিয়ে রাখতে চাইনি তাই বলে দিলাম। এই রেকর্ডিংটা সেজন্যই করা, যাতে আমাকে দোষারোপ না করতে পারিস। আমার কী মনে হয়েছিল জানিস? জ্বরের ঘোরে তুই নেশা করে মাতাল হয়েছিলি।”

কথাটা বলেই তাজ ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি আরও মিইয়ে গেলাম। উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু আমি ভুল করেও মাথা তুললাম না। তারপর উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“ফ্রেশ হয়ে খেতে যা। টেবিলে মেডিসিন রাখা আছে। ব্রেকফাস্ট করে তারপর খেয়ে নিবি।”

কথাটা বলেই উনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। আমি হঠাৎ ফট করে বলে উঠলাম,“ঐ রেকর্ডিংয়ের পর কী হয়েছিল?”

তাজ ভাই থেমে গেলেন। উনি ঘুরে দাঁড়াতেই আমি আবার মাথা নিচু করে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলাম। উনি পুনরায় এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। নিচু স্বরে বললেন,“জানতে ইচ্ছে করছে?”

আমি মাথা নিচু করেই উপর নিচে মৃদু ঝাঁকালাম। উনি বললেন,“বলব না। এবার সারাক্ষণ এসবই ভাবতে থাক ‌এটা তোর পাগলামির আর আমাকে সারারাত সজাগ রাখার শাস্তি।”

আমি কাঁদো কাঁদো মিনমিনে গলায় বললাম,“প্লিজ।”

উনি হঠাৎ আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এলেন। আমি চমকে পিছিয়ে যেতে নিতেই উনি ডান হাত দিয়ে আমার কোমর আলতো করে ধরে কিছুটা কাছে টেনে নিলেন। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ওনার আর আমার মাঝে প্রায় দুই ইঞ্চির দূরত্ব। আমি ওনার থেকে সরে যেতে চাইতেই উনি হুট করে ঝুঁকে এসে আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আমি এবার বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। আমি সরার আগেই উনি উঠে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে চলে গেলেন। ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। আমার চোখের কোণে পানি জমে গেছে। এই মুহূর্তে লজ্জার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে। উনি আমার জেদের কারণে গতরাতে আমাকে কিস করেছেন তা না হয় বুঝলাম। সেটা তো মুখে বললেই হত। এখন এভাবে আবার কিস করার কী দরকার ছিল? সবাই আসলে সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু ওনার ক্ষেত্রে এটা ভাবতেও কেন জানি আমার কষ্ট লাগছে। এখন আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, উনি কেন গতরাতে আমার রুমে এসেছিলেন? উনি তো আর জানতেন না আমার জ্বর উঠেছে। পরক্ষণেই মনে পড়ল ওনার বলা কথাটা। উনি কাল সারারাত আমার জন্য জেগে ছিলেন, আবার জলপট্টিও দিয়েছেন। হয়তো রাত জেগে আমার সেবা করেছেন বলেই জ্বরটা এত দ্রুত অনেকটা কমে গেছে। আসলে এই লোকটাকে বুঝার সাধ্য আমার কোনোকালেই হবে না। মাথাটা হালকা ধরেছে। আমি দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে মৃদু ঝাঁকালাম। তারপর মুখ ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ধীর পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম। এরমধ্যে আবার ছোটো কাকিও ডেকে গেছে। জেমিকে রুমে পেলাম না, হয়তো বাইরে আছে। ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মেজো কাকি আমার মুখ দেখেই বললেন,“কিরে ইলো? চোখ-মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”

আমি দুর্বল গলায় বললাম,“পায়ের ব্যথায় জ্বর এসেছে কাকি।”

কাকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার কপালে হাত ছুঁয়ে চিন্তিত মুখে বললেন,“সে কী রে! জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। কখন থেকে উঠল?”

আমি উত্তর দিলাম,“কাল রাত থেকে।”

“কী! এত সময় ধরে জ্বর এসেছে! রাতে আমাদের ডাকিসনি কেন?”

“অতরাতে তোমাদের বিরক্ত করতে ইচ্ছে করেনি কাকি। তাছাড়া আমার তেমন হুঁশও ছিল না।”

“হায় আল্লাহ্! আজ ঢাকায় ফেরার কথা আর আজই মেয়েটা অসুখ বাঁধাল। ভাইজান কী ভাববে বল তো? আয় আয়, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি তোর কাকাকে বলছি ডাক্তার নিয়ে আসতে।”

কথাগুলো বলে কাকি আমাকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। উনি খাবার সামনে দিতেই আমি বললাম,“শুধু শুধু ডক্টর ডাকতে হবে না কাকি। ঢাকায় ফিরেই ডক্টর দেখাব।”

কাকি বললেন,“এসব কী বলছিস মেয়ে? এই শরীর নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। একটু সুস্থ হয়ে তারপর যাবি।”

আমি কিছু বলার আগেই কোথা থেকে তাজ ভাই এসে বললেন,“কোনো ব্যাপার না মামি। আমি মেডিসিন নিয়ে এসেছি, খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে।”

“আজকের দিনটা অপেক্ষা কর বাবা। কাল না হয় চলে যাস।”

“না মামি। ও তো আর একা যাচ্ছে না। শ্রেয়ান আর আমিও যাচ্ছি। এত চিন্তা কোরো না।”

আমি খাবার মুখে দিয়েই মুখ কুঁচকে ফেললাম। একদম বিস্বাদ লাগছে। মামি রান্নাঘরে ঢুকতেই আমি খাবার রেখে উঠে গেলাম। তাজ ভাই বললেন,“খাবার শেষ না করে কোথায় যাচ্ছিস?”

“খাব না।”

ওনার দিকে না তাকিয়েই কথাটা বলে আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার এক হাত খপ করে ধরে ফেললেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি আমাকে টেনে নিয়ে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। তারপর উনি আমার পাশের চেয়ারে বসে খাবার প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। রুটি ছিঁড়ে আমার মুখের সামনে ধরতেই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি চোখ দুটো সরু করে বললেন,“গাড়িতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তোকে সামলাবে কে? এক রাতেই আমার সাধ মিটে গেছে। তাড়াতাড়ি হা কর।”

আমি মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে বললাম,“আমি খেতে পারব।”

উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বাঁ হাতে আমার মুখটা ঘুরিয়ে মুখে খাবার পুরে দিলেন। আমি খাবার মুখে নিয়েই চুপচাপ বসে রইলাম। উনি ধমকে উঠে বললেন,“খাবি না-কি ঐ রেকর্ডিং সবাইকে শুনাব?”

আমি আঁতকে উঠে খাবার চিবোতে শুরু করলাম। লোকটার এই ব্ল্যাকমেইল থেকে যে কবে রেহাই পাব! তারপর আর কথা বলার সাহস হলো না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওনার হাতে খেতে লাগলাম। খাবার প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখনই আফরা আপুর আগমন ঘটল। আপু আমাদের দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে দেখে নড়েচড়ে বসলাম। আপু যে এখন কী ভাববে কে জানে? আফরা আপু অবাক কন্ঠে বলল,“তাজ ভাইয়া, আপনি হঠাৎ ইলোকে খাইয়ে দিচ্ছেন যে? ও তো সবসময় নিজের হাতেই খায়।”

তাজ ভাই আমার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,“সবসময় ওর জ্বর থাকে না আফরা। আর তোর মতো ওর কাছে ওর মা নেই যে খাবার তুলে খাইয়ে দিবে।”

আফরা আপু এবার কিছুটা নরম গলায় প্রশ্ন করল,“ওর জ্বর এল কখন?”

“রাতে।”

আফরা আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,“ইলো, তোর নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে না করলে তো মাকে বললেই পারতি। শুধু শুধু তাজ ভাইয়াকে বলার কী প্রয়োজন ছিল?”

আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই উত্তর দিলেন,“খাবার সময় এত কথা না বললে খুশি হব আফরা। এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি?”

আফরা আপু খুশি হয়ে বলল,“হ্যাঁ, এখনই আনছি।”

আফরা আপু দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘরে ঢুকল। আমি ভ্রুকুটি করলাম। আমার জানামতে আফরা আপু চা করলে তাজ ভাই বিরক্ত হন। অথচ আজ আফরা আপুকে সরানোর জন্য তার কাছে নিজেই চা চাইলেন। খাবার শেষ করে তাজ ভাই আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। আমি পানি খাওয়ার পর তাজ ভাই নির্দেশের সুরে বললেন,“রুমে গিয়ে মেডিসিন খা। প্যাকেট চেক করব আমি।”

আমি গাল ফুলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। এই ঔষধ নামক জিনিসটা ছোটো বেলা থেকেই আমার বিরক্ত লাগে। মুখে দিলে আর পেটে চালান করতে ইচ্ছে করে না। রুমে ঢুকে টেবিলের ওপর থেকে পানি আর ঔষধ হাতে নিলাম। তারপর মুখ কুঁচকে সেগুলো পেটে চালান করলাম। শয়তানটা হয়তো সকালেই ঔষধ নিয়ে এসেছে। লাগেজ গোছানোর জন্য আলমারি খুলতেই দেখলাম লাগেজ আগে থেকেই গোছানো আছে। এবার আর অবাক হলাম না। কারণ এটা কার কাজ তা এখন আমার বোধগম্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রওনা দেবো তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছি তখনই আফরা আপু আর অলি রুমে এল। আমি হেসে বললাম,“আপু, তুমি সত্যিই এবার যাবে তো আমাদের বাসায়?”

আফরা আপুও হেসে বলল,“হ্যাঁ। দুদিন পর ঢাকা ফিরব। তার প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যেই তোদের বাসায় যাব।”

আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,“আমার তো এখনই খুব এক্সাইটেড লাগছে। উফ্! একা একা আর ভালো লাগে না আমার। তুমি গেলে অনেক মজা হবে।”

অলি গাল ফুলিয়ে বলল,“তোমরা একাই মজা করবে। আমি তো এখানেই থাকব। আম্মু তো আমাকে যেতে দেবে না।”

আমি হেসে অলির নরম গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম,“মন খারাপ করে না অলি বুড়ি। তুমিও আমাদের মতো বড়ো হলে একাই যেতে পারবে। আর আমি কাকাকে বলে যাব, তোমার এক্সাম শেষ হলেই তোমাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে।”

তাতেও অলির মন ভালো হলো না। জেমিকে কোলে তুলে নিয়ে আফরা আপুর সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে আমি লাগেজ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আবার কবে আমার আম্মুর এই রুমে ঢোকা হবে জানা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে এলাম। সেখানে বাড়ির সবাই দাঁড়ানো। শ্রেয়ান ভাইয়া এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে লাগেজ নিয়ে গাড়িতে রাখলেন। বিদায় নেয়ার সময় দাদুমনির কান্না দেখে নিজেকেও সামলাতে পারলাম না। তার কান্না থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তাজ ভাই শেষমেষ তাকে বলল সুযোগ পেলে আবার আসবে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। তাজ ভাই ড্রাইভিং সিটে বসেছেন আর শ্রেয়ান ভাইয়া তার পাশের সিটে। আমি জেমিকে নিয়ে বসেছি পেছনের সিটে। জ্বরের কারণে আজ আম্মুর কবরের পাশেও একবার যেতে পারলাম না। এই ভেবে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললাম। তাজ ভাই গাড়ি স্টার্ট করলেন। আমি সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। কিছু ভালো লাগছে না। হঠাৎ করেই তাজ ভাইয়ের সকালের কান্ডের কথা মনে পড়তেই রাগ উঠে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম ওনাকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেবো না। এতদিন চুপচাপ ছিলাম বলে মাথায় চড়ে বসেছেন। এবার উনি বুঝবেন আমি কেমন মেয়ে! একবার ঢাকায় পৌঁছাই, তারপর আপনাকে বুঝাব মিস্টার আহনাফ তাজওয়ার, আপনার বলা মাথামোটা শব্দটার সম্পূর্ণ বিপরীত আমি।

চলবে…………………🍁