তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-১৮+১৯

0
473

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৮

বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,“আম্মা, এভাবে হাঁটছো কেন? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? কী হয়েছে?”

আমি মৃদু হেসে বললাম,“রিল্যাক্স বাবা। পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছিলাম।”

“একটু ব্যথা পেয়ে চোখ-মুখের এই অবস্থা?” বলতে বলতে বাবা আমার হাত ধরে সোফায় বসাল। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াও ক্লান্ত শরীরটাকে সোফায় এলিয়ে দিলেন। বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে চমকে উঠে বলল,“আম্মা, তোমার তো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।”

তাজ ভাই বললেন,“তোমার মেয়েকে নতুন করে হাঁটতে শেখাও মামু। গতকাল অলি কলা খেয়ে ফ্লোরে খোসা ফেলে রেখেছিল। মহারানি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। ব্যথার কারণে গতরাতে জ্বর উঠে গেছে।”

বাবা চিন্তিত মুখে আমার পা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাজ ভাইকে প্রশ্ন করল,“ডক্টর দেখিয়েছিস?”

তাজ ভাই বললেন,“পায়ের ব্যথা তখন কম ছিল তাই অয়েন্টমেন্টেই কাজ সেরেছে। রাতে ব্যথাও বেড়েছে আর জ্বরও এসেছে। সকালে আমি আপাতত ঔষধ কিনে খাইয়েছি। তুমি এক কাজ করো। ডক্টর আঙ্কেলকে একটু আসতে বলো।”

বাবা মাথা দুলিয়ে ডক্টর আঙ্কেলকে ফোন করল। হঠাৎ করেই আমার শরীরটা গুলিয়ে উঠল। এমন গরমের মধ্যে অসুস্থ শরীরে জার্নি করায় হয়তো এমন হচ্ছে। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে বললাম,“আমি রুমে যাচ্ছি বাবা। ফ্রেশ হতে হবে।”

বাবা হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“চল আমি দিয়ে আসি।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম,“চিন্তা কোরো না। আমি যেতে পারব।”

বাবা থেমে গেল। আমি লাগেজে হাত দেয়ার আগেই তাজ ভাই লাগেজটা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি লাগেজ নিয়ে আমার রুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“শ্রেয়ান, আজ তোর যাওয়া চলবে না।”

শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“না দোস্ত, আমি এখনই চলে যাব।”

তাজ ভাই আরেকটু উঁচু গলায় বললেন,“কাল যাবি।”

তাজ ভাইয়ের পেছন পেছন আমিও ধীর পায়ে রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। রুমে ঢুকে আমি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে তাজ ভাইয়ের কান্ড দেখতে লাগলাম। উনি আমার লাগেজ থেকে সব জামাকাপড় বের করে কাবার্ডে গুছিয়ে রাখছেন। আমি বললাম,“আপনাকে এসব কে করতে বলেছে? এসবের জন্য মারজিয়া খালা আছে।”

তাজ ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,“এত বড়ো মেয়ে হয়েছিস নিজের কাজটুকু গুছিয়ে করতে পারিস না? সবকিছুতে মারজিয়া খালাকে লাগে? মহিলার বয়স হয়েছে। এত কাজ সামলাতে কষ্ট লাগে না? আলসে মেয়ে!”

“তাই জন্য আপনাকে দরদ দেখাতে হবে না। আমিও করতে পারব।”

“চুপচাপ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”

শরীর খারাপ ভাবটা ক্রমশই বাড়ছে। তাই তাজ ভাইয়ের সাথে আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম তাজ ভাই চলে গেছেন। আমি ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। পা-টা ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। জ্বরটাও বেড়েছে। আর তারমধ্যে আবার পিরিয়ড। পিরিয়ড শব্দটা খুব সহজ হলেও আমার কাছে এটা একটা ভয়ানক শব্দ। এই সময়গুলো আমার জন্য ভয়ঙ্কর হয়। তখন আমি আম্মুকে খুব বেশি মিস করি। আম্মু থাকলে হয়তো আমার এত কষ্ট হত না, দাঁতে দাঁত চিপে ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে বালিশ ভিজাতে হত না, ঘন ঘন মুড সুয়িংয়ের কারণে একাকীত্ব বাড়ত না। ওই মুহূর্তগুলো আমাকে বুঝিয়ে দেয়, একটা মেয়ের জীবনে ‘মা’ নামক মানুষটার মূল্য ঠিক কতটুকু। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়ল। বাবা বাইরে থেকে বলল,“তোমার ডক্টর আঙ্কেল এসেছে আম্মা।”

আমি নড়েচড়ে বসে বললাম,“ভেতরে এসো বাবা।”

বাবা, তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া আর ডক্টর আঙ্কেল রুমে প্রবেশ করলেন। ডক্টর আঙ্কেল আমার বাবার বন্ধু। আমাদের ফ্যামিলি ডক্টরও বলা চলে। আমি ডক্টর আঙ্কেলকে সালাম দিলাম। আঙ্কেল সালামের জবাব দিয়ে হাসিমুখে বললেন,“কী অবস্থা মামনি? গ্রাম থেকে অসুস্থ হয়ে ফিরলে?”

আমি মৃদু হাসলাম। আঙ্কেল এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। কিছুক্ষণ আমাকে পরীক্ষণ করলেন। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,“জ্বরটা একটু বেশি, তবে চিন্তা নেই। আমি প্রেসক্রিপশন দিচ্ছি। সে অনুযায়ী মেডিসিন খাওয়ালেই হবে। ভালোভাবে যত্ন নিবে। আই হোপ, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।”

বাবা মাথা দুলিয়ে বলল,“আচ্ছা।”

ডক্টর আঙ্কেল একটা প্রেসক্রিপশন লিখে বাবার হাতে দিলেন। তাজ ভাই এগিয়ে গিয়ে বললেন,“আমাকে দাও। আমি আর শ্রেয়ান গিয়ে মেডিসিন নিয়ে আসছি।”

বাবা প্রেসক্রিপশনটা তাজ ভাইয়ের হাতে দিলেন। ডক্টর আঙ্কেল উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন,“আসছি মামনি। নিজের যত্ন নিও। হোপ ইউ ফিল বেটার সুন।”

আমি বললাম,“লাঞ্চ করে তারপর যান আঙ্কেল।”

“না না, আমার তাড়া আছে।”

বাবা বলল,“এত তাড়া কিসের? লাঞ্চটা করেই যাও না।”

“অন্য কোনোদিন করব ইকরাম। আজ যেতে হচ্ছে।”

“ঠিক আছে। তবে যাও। ফ্যামিলি নিয়ে একদিন এসো।”

“সময় করে আসব। তুমিও সময় করে যেও বাচ্চাদের নিয়ে।”

ডক্টর আঙ্কেল আর বাবা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে রুম থেকে চলে গেলেন। তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“খালা খাবার দিয়ে যাবে এখন। চুপচাপ খেয়ে নিবি। আমরা ঔষধ নিয়ে আসছি ততক্ষণে।”

আমি কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পরপরই মারজিয়া খালা খাবার নিয়ে হাজির হলেন। আমার সামনে খাবার রেখে বললেন,“তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও মা। তাজ বাবা ঔষধ আনতে গেছে। আসার আগে খাওয়া শেষ করো। জেমিকে খাবার দিয়েছি আমি। আমার কাজ আছে। আমি যাই।”

মারজিয়া খালা চলে গেলেন। আমি খাবারের দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। খাবার দেখেই মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। একটুও খাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। আম্মু থাকলে এখন আমায় নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিত। সকালের কথা মনে পড়ে গেল। সকালে তাজ ভাই আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার এসে যদি দেখেন আমি না খেয়ে বসে আছি, তাহলে কি আবার খাইয়ে দিবেন? দিতে চাইলেও আমি আর কখনও ওনার হাতে খাব না। আস্ত শয়তান একটা! ওনাকে উচিত শিক্ষা না দিতে শান্তি পাব না আমি। প্রায় দশ মিনিট পর তাজ ভাই রুমে এলেন। তাকে দেখেও আমি চুপ মেরে বসে রইলাম। তাজ ভাই খাবারের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,“খাসনি কেন এখনও?”

আমি উত্তর দিলাম না। উনি এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। হাতের ঔষধের প্যাকেটটা বেড সাইড টেবিলে রেখে হাত এগিয়ে আমার কপাল ছুঁতে যেতেই আমি পেছন দিকে পিছিয়ে গেলাম। তাজ ভাই বললেন,“কী সমস্যা?”

আমি গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। ওনার সাথে এখন কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার। তখনই বাবা রুমে ঢুকল। খাবারের দিকে তাকিয়ে সেও তাজ ভাইয়ের মতো বলল,“খাসনি কেন এখনও?”

আমি গোমড়া মুখে বললাম,“খেতে ইচ্ছে করছে না বাবা। মুখ তেতো লাগছে।”

বাবা বলল,“কষ্ট করে একটু খেয়ে নে আম্মা। ঔষধ খেতে হবে তো।”

তারপর আর কী? শুরু হলো বাবার জোরাজুরি। শেষমেষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবার মুখে তুলতে বাধ্য হলাম। কোনমতে কয়েক লোকমা খেয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম। তাজ ভাই ঔষধ বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। চুপচাপ সেগুলো গলাধঃকরণ করলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,“এবার কিছুক্ষণ ঘুমা। শরীরটা ভালো লাগবে।”

বাবা বলতে বলতে আমি গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়লাম। তাজ ভাই আমার মুখের দিকে সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছেন। শয়তানটা নিশ্চয়ই মাইন্ড রিড করে আমার মনের খবর জানার চেষ্টা করছে। ধুর! তাতে আমার কী? আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম বাবা আর তাজ ভাই চলে যাচ্ছে।

বেশ লম্বা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার দিকে আমি বিছানা ছাড়লাম। ফ্রেশ হয়ে আসার পর শরীরটা কিছুটা ভালো লাগল। শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেছেন না থেকে গেছেন জানার ইচ্ছে জাগল। রুম থেকে বেরিয়ে এসে আশেপাশে বাবা, তাজ ভাই বা শ্রেয়ান ভাইয়াকে চোখে পড়ল না। মারজিয়া খালা টেবিল মুছছেন। আমাকে দেখে প্রশ্ন করলেন,“শরীর কেমন লাগছে মা?”

আমি বললাম,“কিছুটা ভালো। বাবা কোথায়?”

“একটু আগে বাইরে গেছে।”

“শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেছে?”

“না। তাজ বাবার রুমে আছে।”

আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেলাম। তারপর কী ভেবে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। দরজা খোলাই ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তার কপালের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হলাম। কারণ তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। অথচ তাজ ভাই তার সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। তারা হয়তো নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। কিন্তু শ্রেয়ান ভাইয়ার কপালে কী হয়েছে? আর তাজ ভাই তা দেখেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন! ভালোভাবে কান পাততেই তাজ ভাইয়ের রাগত কন্ঠ কানে এল। উনি বলছেন,“চোখ কোথায় ছিল তোর? বলেছিলাম না চারদিকে নজর রেখে চলবি?”

শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“আরে আমি বুঝে ওঠার আগেই যে লোকটা অ্যাটাক করে বসবে কে জানত? তারপর তো আমিও লাগিয়েছিলাম কয়েকটা। কিন্তু আমাকে ধাক্কা দেয়ায় গাছের সাথে লেগে কপাল কেটে গেছে। আর সেই সুযোগে লোকটা পালিয়েছে।”

তাজ ভাই বললেন,“শুট করলি না কেন?”

আমি চমকে উঠলাম। শুট! শ্রেয়ান ভাইয়া মাফিয়া না-কি? আর ওনার কাছে কি গান আছে যে শুট করবেন? আমার প্রশ্নের উত্তর মুহূর্তেই পেয়ে গেলাম। দেখলাম তাজ ভাই তেড়ে গিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার শার্ট উঁচু করে কোমর থেকে আস্ত একটা গান বের করলেন। তারপর সেটা শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখের সামনে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,“এটা আছে কী করতে? এটা কি খেলা করতে সাথে রাখিস? না-কি ওসব ছ্যাঁচড়াদের প্রতি দয়ামায়া উতলে পড়ে?”

শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইয়ের হাত থেকে গানটা নিয়ে পুনরায় কোমরে গুঁজে বললেন,“যে পেশায় আছি, ছ্যাঁচড়াদের প্রতি দয়ামায়া থাকলে এতে পা বাড়াতাম না।”

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে বিস্ময় নিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি। নিজের চোখ-কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। শ্রেয়ান ভাইয়া মাফিয়া, কথাটা মাথায় আসতেই আমার মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। আচ্ছা? তাহলে কি তাজ ভাইও মাফিয়া? তার কাছেও এমন গান থাকে? শ্রেয়ান ভাইয়ার কাছে থাকে যেহেতু তার কাছেও হয়তো থাকে। আমি আর ভাবতে পারছি না। মাথা চেপে ধরে টলমলে পায়ে কোনোমতে নিজের রুমে চলে এলাম। বিছানায় উঠে বসে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম। গলাটা আবার শুকিয়ে গেছে। কিন্তু পানি খেতে ইচ্ছে করছে না। ওনাদের আসল উদ্দেশ্য কী? আমার বাবার কোনো ক্ষতি করবে না তো? কথাটা ভেবে নিজেই চমকে উঠলাম। তারপর আবার নিজেকে বুঝালাম, তাজ ভাই আর যাই হোক বাবার কোনো ক্ষতি করবেন না। বাবার প্রতি ওনার সম্মান আর ভালোবাসাটা সত্যি। তাহলে? এসবের মানে কী? তাজ ভাই দেশেই তো ফিরলেন এই বছর। তাহলে মাফিয়াদের দলে যোগ দিলেন কবে? না-কি সুইডেন থেকেই এসব শিখে এসেছেন? মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। হঠাৎ করেই পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম। গরম কোনো পানীয় খাওয়া দরকার। কিন্তু পেটব্যথাটা হুট করেই বেড়ে গেল। এসব পুরোনো না। তাই আমি ঘাবড়ালামও না। দুহাতে পেট চেপে ধরে চোখ-মুখ খিঁচে রইলাম। হাঁটু ভাঁজ করে বসে মুখ গুঁজে শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। মারজিয়া খালাকে ডাকতে পারলে ভালো হত। কিন্তু জোর পাচ্ছি না। আস্তে আস্তে পা দুটোও ব্যথায় ধরে গেল। সেই সাথে আমার চোখের কোণের চিকচিকে পানিটুকুও গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। দরজার বাইরে পদধ্বনি শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চোখের পানি মুছে নড়েচড়ে বসলাম। কষ্ট হচ্ছে তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বাইরে থেকে শ্রেয়ান ভাইয়ার কন্ঠস্বর ভেসে এল। উনি বললেন,“ইলোমিলো শুনছো? ভেতরে আসব?”

আমি গলা ঝেড়ে বললাম,“আসুন ভাইয়া।”

দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া। আমি তাদের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া হাসিমুখে বললেন,“আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো, হ্যাঁ?”

আমি বললাম,“এখনই কেন? থেকে যান দু একটা দিন।”

“না না। মা বারবার ফোন করছে। তাজ যখন আছে তখন আসা হবেই। তোমাকেও একদিন আমার বাড়ি নিয়ে যাব।”

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া তাড়া দেখিয়ে বললেন,“আচ্ছা ভালো থেকো। আমি আসছি। এই তাজ, তুই বাইরে যাবি?”

তাজ ভাই বললেন,“নাহ্। কাল দেখা হবে।”

“ওকে, বাই। বাই ইলোমিলো।”

শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেলেন। অন্য সময় হলে আমি ওনার সাথে কত কথা বলতাম। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ঘটনা আর শরীরের অবস্থার কারণে মুখ খুলতে ইচ্ছে করল না। তাজ ভাই এখনও যাননি। এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ব্যথায় মুখটা কুঁচকে এল আমার। এদিকে উনি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফেললাম। চোখ দুটো আবার ভিজে উঠেছে। মিনিট দুয়েক পর মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। তবু মাথা তুললাম না। কারণ এই রুমে তাজ ভাই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যাক্তি নেই। তাজ ভাই নরম কন্ঠে বললেন,“কষ্ট হচ্ছে খুব? ডক্টর ডাকব?”

আমি মাথা দুলিয়ে না করলাম। তাজ ভাই উঁচু গলায় ডেকে উঠলেন,“খালা, খালা।”

মারজিয়া খালা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,“জি বাবা।”

“আপনি চলে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ।”

“একটু পরে যান প্লিজ। কষ্ট করে একটা হট ব্যাগ নিয়ে আসুন।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম তবু মাথা তুললাম না। উনি হট ব্যাগ কেন আনতে বললেন। উনি বুঝলেন কী করে যে ওটা এখন আমার দরকার? পরক্ষণেই মনে পড়ল আমি ভুল করে প্যাডের প্যাকেটটা বেড সাইড টেবিলে রেখে দিয়েছিলাম। ইশ্! কেন যে সরাতে ভুলে গেলাম। লজ্জায় আমি জড়োসড়ো হয়ে পড়লাম। মারজিয়া খালা হট ব্যাগ নিয়ে আসতেই তাজ ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি খালা। ততক্ষণ আপনি ওর পাশে বসুন।”

তাজ ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনি চলে যেতেই আমি মুখ তুললাম। কিন্তু মারজিয়া খালা এখন কী ভাববেন? খালা এগিয়ে এসে আমার হট ব্যাগটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে ওনার হাত থেকে ওটা নিলাম।

তাজ ভাই বাইরে থেকে ফেরার পর মারজিয়া খালা নিজের বাড়ি চলে গেলেন। তাজ ভাই ট্রেতে করে স্যুপ আর ঔষধ নিয়ে হাজির হলেন। আমি ওনাকে দেখে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উনি এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। দুহাতে আমার মুখটা তুলে ধরলেন। আমি সরতে গিয়েও পারলাম না। কিন্তু ওনার দিকে তাকালামও না। উনি আলতো হাতে যত্ন সহকারে আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,“কাঁদছিস কেন? বোকা মেয়ে! তাকা আমার দিকে। আমি কালই তোর খেয়াল রাখার জন্য দুজন মেয়ে সার্ভেন্ট রাখব। কান্না বন্ধ কর।”

আমি চুপ মেরে রইলাম। তাজ ভাই আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ উঠিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন,“হা কর।”

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ওনার এই কেয়ারগুলো আমার মনের কোণে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়। কিন্তু আজ কেন জানি ওনাকে একদমই সহ্য হচ্ছে না। তাজ ভাই বললেন,“স্যুপটুকু খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে। ত্যাড়ামি করিস না। হা কর।”

আমি ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। উনি শান্ত স্বরেই বললেন,“রেগে আছিস কেন? সকালের জন্য? আচ্ছা আর করব না ওমন। এবার খেয়ে নে।”

শয়তানটা তবু সরি বলবে না। গানের কথাটা মাথায় আসতেই আমি নড়েচড়ে বসে ঢোক গিললাম। তাজ ভাই এবার গম্ভীর গলায় বললেন,“ধমক শুনতে না চাইলে চুপচাপ খেয়ে নে। আর না হয় সারারাত বসে বসে কাঁদ।”

তাই তো। এখন ঔষধ খাওয়াটা খুব দরকার। তাজ ভাই এবার স্যুপ মুখের কাছে ধরতেই আমি হা করলাম। ভাবলাম, স্যুপটা বানিয়েছে কে? উনি না-কি মারজিয়া খালা? এবার খুব বেশি লজ্জায় পড়ে গেলাম। ভুল করেও ওনার চোখের দিকে তাকালাম না। কয়েক চামচ স্যুপ খাওয়ার পর আমি মাথা নেড়ে না করে দিলাম। অর্থাৎ এর চেয়ে বেশি গলাধঃকরণ করা সম্ভব না আমার পক্ষে। তাজ ভাইও জোর করলেন না। উনি আমার হাতে ওনার আনা ঔষধ তুলে দিলেন। তার সাথে আবার দুপুরে আনা ঔষধও দিলেন। আমি চুপচাপ ঔষধ খেলাম। উনি ট্রেটা সরিয়ে রেখে প্রশ্ন করলেন,“পা ব্যথা করছে?”

আমি লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম। উনি হয়তো আমার পা মোচড়ানো দেখেই বুঝে গেছেন। উনি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। আমার পায়ে হাত ছোঁয়াতেই আমি ছিটকে সরে বসলাম। অবাক হয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,“কী করছেন?”

তাজ ভাই বিছানায় উঠে বসে আমার পা দুটো টেনে ধরে পায়ের নিচে একটা বালিশ রাখতে রাখতে বললেন,“সালাম করছি বুড়ি দাদি। আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য আপনার দোআ একান্ত প্রয়োজন। দয়া করে আপনি লাফালাফি থামান।”

আমি চেষ্টা করেও পা দুটো সরাতে পারলাম না। উনি আমার মাথার কাছের বালিশটা ঠিক করে দিয়ে বললেন,“শুয়ে পড়।”

আমি ইতস্তত করে বললাম,“আমার ঘুম আসছে না তো।”

উনি আমাকে জোর করে শুইয়ে দিলেন। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে আমার পা টিপতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি লাফিয়ে উঠে বসে পা দুটো গুটিয়ে নিলাম। উনি বিরক্ত মুখে বললেন,“বলছি না লাফালাফি করবি না? সাধে কি পিচ্চি বলি?”

আমি দ্বিধাভরা কন্ঠে বললাম,“আপনাকে এসব করতে হবে না। আপনি যান।”

উনি কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আবার আমাকে জোর করে শুইয়ে দিলেন। তারপর ধমক দিয়ে বললেন,“উঠলেই থাপ্পড় খাবি। থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপ থাক।”

আমি ঢোক গিললাম। মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা? ওনার কাছে কি এখন গান আছে? থাকতেও পারে। মাফিয়া বলে কথা। বাপরে! আমি জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। উনি আবার আমার পা টিপতে টিপতে বললেন,“ভবিষ্যতের জন্য প্রাকটিস করছি। এসব তো আমাকেই করতে হবে। বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে এমনই জ্বালা।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মুহূর্তে লজ্জা গায়েব হয়ে একরাশ বিস্ময় এসে ভর করল আমার ওপর। এটা কী বললেন উনি? ভবিষ্যতে উনি কেন এসব করতে যাবেন? উনি তো আর আমাকে বিয়ে করবেন না যে আমার এসব কাজ ওনাকে করতে হবে। তাহলে? না-কি ওনার মনে অন্যকিছু? আনহা বলেছিল ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর উনি আমাকে পছন্দ করেন। ওর কথা কি ফলে গেল? নো, নো, নো।‌ এমনটা যদিও হবার নয়। তবু বলছি, এমন দিন দেখিও না আল্লাহ্। আমি গোল গোল চোখে ওনার দিকে তাকালাম। উনি চোখ টিপে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললেন,“আসলে আমার হবু বউ তোর মতো পিচ্চি তো। তার যত্ন নিতে নিশ্চিত আমাকে হিমশিম খেতে হবে। পরে যাতে প্রবলেম না হয় তাই তোকে দিয়ে প্রাকটিস করছি।”

আমি এবার কপাল কুঁচকে ফেললাম। আমি নিশ্চিত উনি আফরা আপুর কথা বলছেন না। কারণ আফরা আপু তো বাচ্চা স্বভাবের না। সে যথেষ্ট ম্যাচিউর। তাছাড়া উনি আফরা আপুকে তেমন পছন্দও করেন না। শয়তানটা কি তাহলে আমাকে মিন করছে? কী জানি! না বাবা। মাফিয়ার বউ হওয়ার অত শখ নেই আমার। তারপর কথায় কথায় মাথায় গান ধরবে। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করলাম,“বিপজ্জনক লোক!”

চলবে………………..🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৯

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আজ ভার্সিটিতে যাব। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা তাতে তো রুম থেকেই বেরোতে পারছি না। জ্বরটা কিছুটা কমেছে। শরীরের অবস্থা ভালো না হলেও গতকালের মতো অত খারাপও না। ঘড়ির কাঁটা নয়টা আটত্রিশের ঘরে। বাবা নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। তাজ ভাই কী করছেন? ওনার কথাটা মাথায় আসতেই গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। লোকটা কাল মাঝরাত পর্যন্ত কত যত্ন করল! পা টিপতেও দ্বিধা বোধ করল না! আমাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ঘুমাতে পেরেছে কি না কে জানে? পরশু রাতেও তো এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি বেচারা। আচ্ছা? আম্মুর মতো এত যত্ন সে শিখেছে কীভাবে? প্রতিবারের মতো এবার আর আমার বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ লাগেনি। আমি খেয়াল করলাম কাল প্রথমবারের মতো অসুস্থ শরীরে আমি আম্মুকে কিছুটা কমই মিস করেছি। মনে হয়েছিল আমার যত্ন নেয়ার জন্য, একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য কেউ একজন আছে। কিন্তু এখন আমার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে ওনার সামনে মুখ দেখাতেও পারব না। ভাবলাম আজ ভুল করেও ওনার সামনে পড়ব না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম তাজ ভাই আমার বিছানায় আয়েশ করে বসে ফোন স্ক্রলিং করছেন। গ্রাম্য একটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে গেল। ‘যার লাইগা দুনিয়া ছাড়া, হেয় আইয়া সামনে খাঁড়া।’ হাস্যকর লাগলেও এটাই এখন আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করে এক পা দু’পা করে রুম থেকে বেরোতে যেতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“ঐ পিচ্চি, কোথায় যাচ্ছিস?”

আমার রাগ উঠলেও জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,“রুমে ভালো লাগছে না।”

“আচ্ছা, ব্রেকফাস্ট করে তারপর বের হ। এদিকে আয়।”

আমি একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্বস্তিতে ওড়নার কোণা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে এদিক-ওদিক চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলাম। তাজ ভাই এবার কিছুটা জোরেই বললেন,“কী হলো? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আসতে বললাম না?”

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়ালাম। উনি চোখের ইশারায় বসতে বললেন। আমি বিছানায় এক পা তুলে আরেক পা নিচে ঝুলিয়ে আড়ষ্টতা নিয়ে বসলাম। উনি আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে হুট করে আমাকে টেনে বিছানায় সম্পূর্ণ উঠিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। উনি আমার কপালে হাত রেখে জ্বর আছে কি না পরীক্ষা করলেন। তারপর বেড সাইড টেবিল থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে উনি নিজের সামনে রাখলেন। উনি খাবারের প্লেটে হাত দিতেই বুঝলাম খাইয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। তাই আগে ভাগেই বলে উঠলাম,“আমি নিজের হাত দিয়ে খাব।”

উনি আমার কথা তোয়াক্কা না করে মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলেন। আমি আবার বললাম,“বলছি তো নিজের হাতে খাব।”

উনি জোর করে আমার মুখে খাবার পুরে দিলেন।আমি বাধ্য হয়ে খাবার চিবোতে লাগলাম। ওনার থেকে প্লেটটা নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনি খপ করে আমার হাতটা মুঠোয় বন্দি করে বাঁকা হেসে বললেন,“মাফিয়ারা কিন্তু মাথায় গান ধরতে পটু।”

আমি হতচকিত হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। গলায় খাবার আটকে কাশি উঠে গেল। তাজ ভাই আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। আমি দুই ঢোক পানি খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলাম। তারপর ঢোক গিলে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালাম। আমার তো মনেই ছিল না যে শয়তানটা মাইন্ড রিড করতে জানে। এখন নিশ্চয়ই মাইন্ড রিড করে এটাও জেনে গেছে যে আমি তাদের গানের খবর পেয়ে গেছি। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,“আ..আপনি সত্যিই মাফিয়া?”

তাজ ভাই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়েই বললেন,“রিল্যাক্স পিচ্চি। এটুকুতেই এত ভয় পেলে চলে? শুধু তো একটা গানই দেখেছিস। এর বেশি কিছু তো আর না।”

আমি ঢোক গিলে বললাম,“আপনি জানলেন কীভাবে?”

“কিছু মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়ার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে আমার। তোর পিচ্চি মাথায় তা ঢুকবে না। এখন হা কর।”

আমি ওনার কথায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি সত্যি সত্যিই মাফিয়া?”

উনি আমার মুখে খাবার পুরে বললেন,“কোনো সন্দেহ আছে?”

“না। কিন্তু আমি তো জানতাম আপনি রাজ ভাইয়ার সাথে বিজনেস সামলান। আর বাংলাদেশেও এসেছেন বেশিদিন হয়নি। তাহলে?”

তাজ ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,“মাফিয়ার সামনে বসে ফটাফট কথা বলছিস। ভয় লাগছে না?”

“লাগছে, তবে বেশি না।”

“কেন?”

“কারণ আমি জানি আপনি বাবার কোনো ক্ষতি করবেন না।”

“যদি তোকে শুট করে দেই?”

আমি চমকে উঠলাম। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে বললাম,“আমি কিন্তু বাবার কাছে বলে দিব আপনি ভালো মানুষের আড়ালে একজন মাফিয়া।”

তাজ ভাই এমনভাবে হাসলেন যেন আমি কোনো জোকস্ শুনিয়েছি। তারপর আবার বললেন,“তার আগেই যদি মেরে দেই?”

আমি এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললাম। উনি হেসে বললেন,“কুল ডাউন পিচ্চি। তুই মুখ বন্ধ রাখলে আমি কিছুই করব না। এতদিন যেরকম ছিলি সেরকমই থাকবি। তুই কিছু দেখিসওনি আর জানিসও না। ওকে?”

আমি ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,“ওকে।”

“আমার ব্যাপারে মাথা ঘামানো চলবে না আর কথার হেরফের করা চলবে না। নইলে মাফিয়াদের দিয়ে কিন্তু বিশ্বাস নেই। মনে থাকবে?”

আমি ঢোক গিলে দ্রুত গতিতে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। তাজ ভাই বাঁকা হেসে বললেন,“গুড গার্ল। এবার হা কর।”

আমি রোবটের মতো চুপচাপ হা করলাম। মুখে বিস্বাদ লাগা সত্ত্বেও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিনা বাক্যে ওনার হাতে খাবার খেতে লাগলাম। মনে মনে আফসোস করলাম, ইশ্! ওনাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য কত কিছুই না ভেবে রেখেছিলাম আমি। সব জলে গেল। এখন তো মনে হচ্ছে উনিই আমাকে পুতুলের মতো নাচাবেন। এতদিন তো শুধু ব্ল্যাকমেইল চলেছে। আর এখন থেকে তার সাথে যোগ হলো গান। বাহ্, দারুণ! আমার এত সাধের জীবনটা বাঁশপাতা হয়ে গেল! খাবার শেষ করে ঔষধ খেয়ে নিলাম। পুরোটা সময় আমি টু শব্দও করলাম না। উনি প্রশ্ন করলেন,“শরীর ভালো লাগছে এখন?”

আমি উপর নিচে মাথা দোলালাম। ওনার পরবর্তী প্রশ্ন,“এক্সামের কতদিন বাকি?”

আমি মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলাম,“দশ দিন।”

“এখন পড়তে বসবি।”

আমি অনীহা নিয়ে বললাম,“ইচ্ছে করছে না।”

উনি চোখ পাকিয়ে বললেন,“আবার বল।”

আমি থতমত খেয়ে বললাম,“এখনই বসব।”

“হুম। আমি এখন বাইরে যাব। এসে যেন বই হাতে দেখি?”

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। যত যাই হোক, উনি গেলে আবার আমার একা একা বসে থাকতে হবে। আমি মনমরা হয়ে ঘাড় কাত করলাম। তাজ ভাই আমার মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন,“তাড়াতাড়ি চলে আসব। ততক্ষণ পর্যন্ত মন দিয়ে পড়।”

আমি ভাবলাম উনি এখনই চলে যাবেন। কিন্তু ওনার কান্ডে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। উনি কিছুটা এগিয়ে এসে আমার বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিলেন। আমার হাতের চুড়ি দুটো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। আমি চুপ মেরে ওনার কান্ড দেখে যাচ্ছি। হুট করেই উনি ঝুঁকে পড়ে চুড়ির ওপরে আলতো করে চুমু খেলেন। কিন্তু চুড়ির সাথে আমার হাতেও ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগে গেল। আমি দ্রুত হাত সরিয়ে ছিটকে দূরে সরে গোল গোল চোখে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। তারপর একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই নিয়ে বসলাম। দশ দিন পর পরীক্ষা, অথচ আমার প্রস্তুতির কথা না বললেই ভালো।

তাজ ভাই ফিরলেন ঠিক দুপুরের সময়। তার সাথে বাবাও ফিরল। তখন আমি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে চুল মুছছিলাম। কলিংবেলের আওয়াজ কানে আসতেই বুঝতে পেরেছি হয় তাজ ভাই আর নয় বাবা এসেছেন। আমি কোনোমতে চুল মুছে বেরিয়ে এলাম। বাবা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে হেসে বলল,“শরীর কেমন আম্মা?”

আমি জবাব দিলাম,“ভালো।”

“গোসল সেরে আসছি।” বলতে বলতে বাবা নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। আমি ভাবলাম ততক্ষণ বসে বসে টিভি দেখি। কিন্তু সামনে তাকাতেই দেখলাম যম আমার দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,“আমি পড়েছি তো। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ পড়েছি। সত্যি বলছি।”

আমার কথা শেষ হতেই তাজ ভাই তেড়ে এসে আমার চুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরলেন। কিন্তু খুব বেশি জোরেও ধরেননি যে আমি ব্যথায় কাতরাব‌। আমি অবাক হয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,“চুল ধরলেন কেন? কী করেছি আমি?”

তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,“গোসল করে চুল মুছিসনি কেন? জ্বর জিইয়ে রাখার এত শখ?”

“মুছলাম তো।”

“তো এত পানি এল কোত্থেকে চুলে? টপটপ করে ফ্লোরেও পড়ছে।”

“আমি তো এভাবেই মুছি।”

তাজ ভাই আমার চুল ছেড়ে দিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করলেন,“কেয়ারলেস।”

শব্দটা উচ্চারণ করেই উনি হনহন করে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সোফায় দুই পা তুলে আরাম করে বসে টিভি অন করলাম। রিমোট নিয়ে একের পর এক চ্যানেল পালটাতে লাগলাম। দেখার মতো কিছুই পাচ্ছি না তাও চ্যানেল পালটে চলেছি। হঠাৎ মাথায় কিছু একটা অনুভব করে তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম স্বয়ং যমরাজ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে পরম যত্নে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিচ্ছেন। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি আমার এক গোছা চুল টেনে ধরে বললেন,“ছিঁড়ে ফেলব।”

আমি গাল ফুলিয়ে আবার সোজা হয়ে বসলাম। এই উজবুকের সাথে এখন তর্ক করার ইচ্ছা নেই। উনি ভালোভাবে চুল মোছা শেষ করে তোয়ালে নিয়ে আবার চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বাবা চলে এল। বাবা খাবার টেবিলে বসে আমাকে ডাকলেন। আমি গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। মারজিয়া খালা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলেন। ততক্ষণে তাজ ভাইও ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে চলে এলেন। আমার বিপরীত পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে উনি বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“মামু, তোমাকে তো বলাই হয়নি, আমি দুজন মেয়ে সার্ভেন্ট ঠিক করেছি।”

বাবা প্রশ্ন করলেন,“দুজন সার্ভেন্ট কেন?”

“তোমার অকর্মা মেয়ের খেয়াল রাখার জন্য। তাছাড়া খালার বয়স হয়েছে। একা মানুষ কত খাটতে পারে? কাল থেকেই ঐ দুজন কাজ শুরু করবে।”

বাবা মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“আচ্ছা।”

মারজিয়া খালা খাবার পরিবেশন করলেন। আমি খাবার মুখে তুলে বুঝলাম মুখের তেতো ভাবটা কমে গেছে। যাক বাবা! ভালোই হয়েছে। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর হঠাৎ বাবা খেতে খেতেই বলে উঠল,“চুড়িগুলো কিন্তু আমিই গড়িয়ে দিয়েছিলাম আলোকে।”

আমি চমকে উঠে খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ঝট করে বাঁ হাতটা টেবিলের ওপর থেকে নামিয়ে নিচে লুকিয়ে ফেললাম। বাবার দৃষ্টি হাতের ওপরেই পড়তে হলো! আল্লাহ্! এখন কী হবে? বাবা কী ভাববে? কী বলবে এখন? শয়তানটার জন্য আমি ফ্যাসাদে পড়ব? তাজ ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম মহারাজ পরম তৃপ্তিতে খাবার গিলে চলেছেন। বাবা এবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমার জিনিস আমার কাছেই ফেরত এল না-কি?”

তাজ ভাই না তাকিয়েই খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলল,“উঁহু। তোমার বোনের জিনিস মেয়ের কাছে এসেছে। এতে তোমার কোনো ভাগ নেই। ওদিকে নজর দিও না।”

বাবা শুধু মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালেন। আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে একবার বাবার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কারোর মধ্যেই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন উত্তেজনা বা ভাবনার লেশ মাত্র নেই। তারা তাদের মতো তৃপ্তি সহকারে খেতে ব্যস্ত। যেন আমার হাতে ফুপির পছন্দের চুড়ি, ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে ভাবাভাবির কিছুই নেই। আশ্চর্য! আমি তো ভেবেছিলাম বাবা অনেক কিছুই ভেবে বসবে বা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না! তবে বাবা এটা নিয়ে মাথা না ঘামানোয় আমি বেশ স্বস্তি পেলাম। এরপর আর আমি টু শব্দটিও করলাম না। চুপচাপ খেয়ে চললাম। বাবা আর তাজ ভাই খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে অনেক কথাই বললেন। আমি যত দ্রুত সম্ভব খাওয়া শেষ করে উঠে চলে এলাম। কিন্তু আমার কপালে কি আর শান্তি শব্দটা শোভা পায়? সে বেচারা তো তাজ নামক যম আসার পর থেকেই চিরবিদায় নিয়েছে। রুমে এসে ফোনটা নিয়ে বসেছি বান্ধবীদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার আশায়। কিন্তু আমার আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে যমরাজ তার ল্যাপটপ নিয়ে আমার বিছানায় গেড়ে বসলেন। শুধু বসেই কি আর শান্তি পেয়েছেন? আমার হাত থেকে ফোনটাও কেড়ে নিয়েছেন। গানের ভয়ে আমি না কিছু বলতে পারছি আর না সহ্য করতে পারছি। গাল ফুলিয়ে বসে মনে মনে তাকে অদ্ভুত সব বকা দিতে লাগলাম। তারপর আমি সাহস নিয়ে বললাম,“ফোন নিলেন কেন? দিন না।”

উনি আমার কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না। ল্যাপটপ খুলে তাতে মুখ গুঁজে বসে রইলেন। আমি ওনার এমন আচরণের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ল্যাপটপ নিয়ে হঠাৎ আমার রুমে আসার মানে কী? ওনার নিজের রুমে কি জায়গার কমতি পড়েছে? তাজ ভাই হঠাৎ আমাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে ল্যাপটপটা সামনে রাখলেন। আমি ভ্যাবলার মতো তার মুখের দিকে তাকালাম। তাজ ভাই আমার মুখটা ধরে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে ঘুরালেন। স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই আমি চোখ বড়ো করে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলাম,“রাজ ভাইয়া!”

ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া হাসিমুখে বললেন,“হাই ইলু। কেমন আছিস?”

আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,“অনেক ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো আছি। তুই না-কি অসুস্থ, তো অনেক ভালো আছিস কীভাবে?”

আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,“তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছি। ভাবি কোথায়? আমি ভাবিকে দেখব।”

“এত বছর পর ভাইকে দেখে তাকে রেখে ভাবির সাথে কথা বলার জন্য ব্যস্ত হচ্ছিস? একটুও মায়া নেই ভাইয়ের জন্য!”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আমি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমার এই শয়তান ভাই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আজ কথা বলতে দিলো। ভাবির ছবিটা পর্যন্ত দেখায়নি। প্লিজ ভাবিকে ডাক না।”

রাজ ভাইয়া হেসে বললেন,“তাজ ঠিকই বলেছে, তুই এখনও সেই পিচ্চি ইলু আছিস।”

আমি কপাল কুঁচকে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে আছেন। আমি বললাম,“ভাইয়া, আগে ভাবিকে ডাক।”

“আমি অফিসে আছি ইলু। তোর ভাবি বাসায় আছে। মন খারাপ করিস না। বাসায় গিয়ে আমি তোর সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিব। ওকে?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,“ওকে।”

“মিস্টার তাজওয়ার কি তোকে খুব জ্বালাচ্ছে?”

আমি আড়চোখে একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি বিদ্রোহী হয়ে বললেন,“হেই ব্রো, এটা কেমন প্রশ্ন? আমাকে এমন মনে হয় তোর? আমি না, বরং এই পিচ্চিই আমার মাথা খায়।”

আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,“কী বললেন? এত বড়ো মিথ্যা কথা!”

“সত্য কথা সবসময়ই মূল্যহীন।”

“আপনি তো সত্যই বলেননি, তার আবার মূল্য আশা করেন কোন আক্কেলে?”

“চুপ মাথামোটা।”

“একদম আজেবাজে নামে ডাকবেন না।”

রাজ ভাইয়া শব্দ করে হেসে বললেন,“তোরা দুটোতে কি সারাজীবনই এমন ঝগড়া করবি? সেই ছোটো বেলার মতো এখনও একজন আরেকজনের পেছনে লেগে আছিস। ফাজিল দুটো!”

আমি আর তাজ ভাই একদম চুপ হয়ে গেলাম। হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ল কিছুক্ষণের জন্য আমি তাজ ভাইয়ের প্রতি সব ভয় ভুলে বসেছিলাম। পরে নিশ্চয়ই এর শোধ তুলবে। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আমি আর ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। হাসিমুখে রাজ ভাইয়ার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

চলবে…………………..🍁